যুদ্ধু যুদ্ধু খেলার শেষে আবার মনে পড়ে যায় সত্যিকারের কিছু জ্বলন্ত জীবনযুদ্ধসংক্রান্ত সমস্যার কথা।
আমার বাড়ির নীচের রাস্তায় হাতে টানা চাকা লাগানো ছোট ঠেলাগাড়ি থেকে পাতলা চপ্পল পরা যে শ্রমিক গরম আলকাতরা ঢেলে চাঁদের গায়ের ক্ষতের মতো গর্তগুলো বোজায় সে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। মিউনিসিপালিটি ঠিকাদার নিয়োগ করে , ঠিকাদার আবার এদের। যে মেয়েরা সৌন্দর্যায়নের বাঁশের বেড়া রঙ করে তারাও তাই। বিশাল মেশিনের পেছনে সাকিং পাইপ ধরা সাফাইকর্মী, ইটভাটার শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ির মেয়েরা, স্কুল, কলেজের মাস্টারমশাই, সেকটর ফাইভের ঝাঁ চকচকে কর্মী, কর্পোরেটের গোলাম, প্রত্যেকের হাতে চুক্তি ধরিয়ে দিয়েছে নিও লিবেরালিজিম। চুক্তি ছাড়াও এদের অনেকের চূড়ান্ত শোষণ এখন জায়েজ। যেমন ইটভাটার খাটিয়েরা। যেমন সাফাইকর্মীরা। ওদিকে পা ধোয়ানো চলছে, অন্যদিকে চুক্তিভিত্তিক চাকরি ছাড়া কর্মসংস্থানের সুযোগ কি রাজ্যে, কি সারা দেশে, একেবারেই সীমিত হয়ে পড়ছে। স্থায়ী চাকরি আকাশকুসুম, অন্যান্য সুযোগসুবিধে ডুমুরফুল, পেনশন নিয়ে ফাটকা খেলায় শাসকের মহানন্দ।লাভের কড়ি গুণছে শুধু শাসকের মাস্তুতো ভাইয়েরা।
এগুলো আরও বাড়বে, কারণ বিশ্বপুঁজিতেও ক্রমাগত মন্দার ছোঁয়া, আর লাভের হার একপয়সা কমলে প্রভুরা হিংস্র হয়ে ওঠেন, অবধারিত ছাঁটাই তখন তাদের হাতের অন্যতম অস্ত্র।
যেমন হচ্ছে এখন। বিশ্বে এখন বেকারের সংখ্যা ২০০ মিলিয়নেরও বেশি। সেই সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি ঘটেছে 'নিরাপত্তাহীন কর্মসংস্থানের'। ঐ যাদের ফোট বলেই ফুটিয়ে দেওয়া যায়।
ভারতের ক্ষেত্রে এই রোগ একেবারে মহামারীর রূপ নিয়েছে। ২০১০ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অনুসারে কৃষিক্ষেত্রের বাইরে থাকা কাজেকম্মে এইরকম নিরাপত্তাহীন কর্মসংস্থানের হার ৯৪%।
বেকারত্বের সর্বকালীন রমরমা এবং নিরাপত্তাওয়ালা রুজির অভাবে যে সংকট দেখা দিয়েছে তার মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা অতি প্রকট। শ্রমিকদরদী শাসক ভারত কোনদিনই পায়নি। কিন্তু মেহনতী মানুষের ন্যায্য পাওনা না দেবার জন্য এতো মাত্রাছাড়া নির্লজ্জ ছলচাতুরীও দেশ কখনো দেখেনি। মুদ্রাস্ফীতির কারণে সংশোধিত মজুরী দেওয়া দূরে থাক, সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ পাবার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে মজুরি ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা অতি কম সেখানে কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে, শ্রম আইন, সুরক্ষা ইত্যাদিকে কাঁচকলা দেখাতে দক্ষ এই সরকার এ ব্যাপারে বরাবর যেন এক নম্বরে থাকার পণ করেই মাঠে নেমেছে। নোটবন্দী, জিএসটি, শ্রম আইন পরিবর্তন, পরিবেশ আইন সংশোধন - একসে বড়কর এক ভানুমতীর খেলায় সে যেন তুলনারহিত।
এই আর্থিক নীতিগুলো আমাদের দেশকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে বিদেশী পুঁজির কাছে। বিদেশি পুঁজির প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ সুগম করতে একের পর এক ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন, অটোমোবাইল, প্রতিরক্ষা, রেল, নির্মাণ, খুচরো ব্যবসা, ওষুধ, পেট্রোলিয়াম, কৃষি, খনি, শিক্ষা, মিডিয়া, ইত্যাদি। ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সেই কালো দিন যখন বিদেশী পুঁজির মুনাফা তার নিজদেশে ফেরাবার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এর জন্য নতুন নতুন ধারণা আমদানি করা হচ্ছে, যেমন লিমিটেড লায়াবিলিটি পার্টনারশিপ যেখানে বিদেশী মুনাফাকারী তার মুনাফার সবটাই স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ২০০৮ এ শুরু হওয়া এই প্রবণতাকে ফুলেপল্লবে বিকশিত করেছে বর্তমান শাসক। এল আই সি র মতো দেশীয় সংস্থা যারা নাগরিকের কাছ থেকে নেওয়া পুঁজির লভ্যাংশ দেশের পরিকাঠামোর উন্নতিতেই বিনিয়োগ করে, তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর্থিক ক্ষতিতে গলা অব্দি ডুবে থাকা ব্যাংকের ভার মকুবের গুরু দায়িত্ব। এই ব্যাংকগুলি আবার এতটা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে যাদের জন্য সেই পুঁজিপতিদের বিদেশে পালাবার পথ সুগম করেছে কে তা ইতোমধ্যে সবারই জানা হয়ে গেছে। এ যেন এক ভয়ংকর হানিচক্র, ঘুরেফিরে যেখান থেকে শুরু সেখানেই অবধারিত ফিরে আসা।
পূর্ণ শোষণের অধিকার পেতে আমাদের দামোদর শেঠ সরকার আরো অনেক কান্ড করেছে। শ্রমিক সুরক্ষার বারোটা বাজানোর জন্য শ্রম আইনের আমূল সংস্কারে ব্রতী হয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই এদের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ঝোঁক দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। দুটো চটজলদি উদাহরণ দেওয়াই যায়। আগে নিয়ম ছিল যে কারখানায় ১০০র বেশি শ্রমিক সেখানে ছাঁটাই বা ক্লোজারের আগে নোটিশ দিতে হবে। এই সরকার তা পালটে করল ৩০০র বেশি শ্রমিক। ছোট কারখানায় শ্রমিকজবাই ভালো হবে এতে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর সব কারখানাতে এই শ্রমিকবিরোধী আইন নির্বিঘ্নে চালুও হয়ে গেল। কখনও এতো খুল্লামখুল্লা পরিবর্তন না এনে অত্যন্ত চালাকির সঙগে কাজটা করা হচ্ছে। যেমন, ফ্যাক্টরি আইন পালটানো হল নারী সমানাধিকারের নামে রাতের শিফটে মেয়েদের কাজ করা চালু করে দিয়ে। জরুরী পরিষেবা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে রাতের শিফট উঠিয়ে দিয়ে দু পয়সা মুনাফা কমিয়েও তো এই মহান মানবিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যেত।
গত ত্রিশ বছরে ভারতীয় শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি বাড়েনি, যদিও তার প্রত্যেক বছর তার গড় উৎপাদনশীলতা বেড়েছে সাত শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে দেশের সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত ছিল তাদের জন্য একটি ভদ্রস্থ মজুরির ব্যবস্থা করা। তা না করে সরকারি মদতে পুঁজিপতিদের অক্লান্ত চেষ্টা চলছে কি করে স্থায়ী কাজের সুযোগ কমিয়ে সেই কাজগুলোকে ইনফর্মাল বা অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে ঠেলে দেওয়া যায়। আরো প্রকটভাবে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে স্থায়ী অস্থায়ী, ঠিকা ও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের মধ্যে। যদিও এইরকম বেতনবৈষম্য দেশের আইন অনুযায়ী একেবারেই বেআইনী।
একটা শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পারতো রাশ টেনে ধরতে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অনেক চেষ্টা করে ট্রেড ইউনিয়নগুলির শক্তি হরণ করা হয়েছে। নিও লিবেরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সেগুলোর গঙ্গাপ্রাপ্তিই অবধারিত। অথচ দেশজুড়ে শ্রমিক মরণপণ লড়াই দেবার জন্য প্রস্তুত, মারুতি কারখানা, মুন্নারের চা শ্রমিক বা মুম্বাইয়ের সাফাই শ্রমিকরা সেকথা প্রমাণ করে দিয়েছে। কতো প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে তা হয়েছে ! নিও লিবেরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক পুঁজি চলাচল করে দ্রুত। ভারতে সুবিধে না হলে চীনে বা অন্য কোথাও। ফলে বেশি মিলিট্যান্ট আন্দোলন গড়ে তোলার ঝুঁকি অনেক। আবার একজায়গায় কাজ না করলে সংঘবদ্ধ করাও মুশকিল। গৃহকর্মীরা কাজ করেন ছড়িয়েছিটিয়ে। তাদের সংঘবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তোলা খুব কঠিন। এদেরকে তোয়াজ করে চলে যে সরকার সে যে শ্রম আইনের লঘুকরণ করবে তাতে আশ্চর্য কি !
এই কারণেই সঠিক
মজুরী নির্ধারণের স্বপক্ষে , ঠিকা শ্রমিক প্রথা ও শ্রমিকবিরোধী শ্রম আইন সংস্কারের বিপক্ষে ছোট ছোট ট্রেড ইউনিয়নগুলির একজোট হয়ে কাজ করা সময়ের দাবী। নাহলে জাতীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি মিশন ( NEEM) এর প্রকল্পে ন্যুনতম মজুরির থেকেও কম মজুরিতে এবং কোন আইনি সুযোগসুবিধা ছাড়াই ট্রেনি শ্রমিক নিয়োগ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। এর একটি উদাহরণ হলো আমাদের রাজ্যের সিভিক পুলিশ। এখন আবার সিভিক শিক্ষকের বরাত দেবার তোড়জোড় চলছে। গোটা দেশ খুঁজলে উদাহরণের স্তূপ তৈরি হয়ে যাবে।
তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতোই ভারতে ন্যুনতম মজুরির হার লজ্জাজনকভাবে কম। ন্যুনতম মজুরির তুলনায় ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতিকে বিবেচনায় রেখে ভারতের বামদলগুলির দাবী ১৮,০০০ টাকা। এর যাথার্থ্য প্রমাণে বলা হয়েছে যে সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ঐ পরিমাণ টাকাই নুন্যতম মজুরির জন্য বিবেচিত হওয়া দরকার।কিছু বামদল ২৫০০০ টাকার দাবী জানিয়েছে। এটা এরকম নয় যে স্বপ্নে পোলাও খাব, তো যতো ইচ্ছে ঘি ঢালব। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব দৃঢ় যুক্তিমালা রয়েছে।
সেভেন্থ পে কমিশন এই টাকা ধার্য করেছে পঞ্চদশ ভারতীয় লেবার কনফারেন্স ও সুপ্রিম কোর্টের ( Raptakos nd Brett case) নির্দেশিকা অনুযায়ী। হিসেবটা আরো একটু বিশদে বললে এইরকম হবে -- ২৭০০ক্যালরি মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণ × ২প্রাপ্তবয়স্ক ও ২ অপ্রাপ্তবয়স্ক।
এদের জন্য মাথাপিছু পোশাক বছরে ১৮ গজ। এর সঙ্গে যোগ হবে বাসস্থান, ফুয়েল, ইলেট্রিসিটি, আরো নানা ব্যয়। এর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট জুড়েছে শিক্ষাখরচ, চিকিৎসা, আমোদপ্রমোদ, বিবাহ এবং বার্ধক্যের ব্যয়। এর সঙ্গে যদি ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কথা ধরি তাহলে ২৫০০০টাকাতেও কিছুই হবে না। আর এর মধ্যে কোন খাতে টাকা খরচ না করে আমার আপনার জীবন চলে ?
কিন্তু স্থায়ী কর্মীদেরই বঞ্চনার শেষ নেই যখন, তখন অস্থায়ী ও অসুরক্ষিত শ্রমিকদের কি অবস্থা তা বোঝাই যায়। এদের চাকরির নিরাপত্তা,সামাজিক নিরাপত্তা, এমনকি ঐক্যবদ্ধভাবে দাবীদাওয়া জানাবার অধিকারও নেই। এমনকি কেউ কেউ শ্রমিক অভিধা থেকেও বঞ্চিত। যেমন গৃহকর্মীরা, যাদের বেশির ভাগই আবার মহিলা। এই অসুরক্ষিত শ্রমিকদের নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে না তুললে ভারতীয় শ্রমিক কখনোই তার বঞ্চনার যোগ্য জবাব দিতে পারবে না। একই ধরণের কাজে বেতনের ফারাক করা চলবে না। স্থায়ী প্রকৃতি যে কাজের, সেই কাজে নিযুক্ত সমস্ত শ্রমিককে স্থায়ী ঘোষণা করতে হবে। এই রকম কাজে চুক্তিপ্রথাও বাতিল করা দরকার। যদি ইতোমধ্যে চুক্তি শ্রমিক নিয়োগ করা হয়ে থাকে তাহলে তাকে স্থায়ী শ্রমিকের সমান বেতন দেওয়া হোক। সামাজিক সুরক্ষা আইনের ছাতার তলায় আনা হোক এদেরকেও। স্থায়ী অস্থায়ী শ্রমিক হাতে হাত মেলালে, কাঁধে কাঁধ জুড়লে তবেই শাসক ও পুঁজিপতিদের এই অশুভ জোটের বিরুদ্ধে এ দেশে জোরদার আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। নাহলে শ্রমিকের কপাললিখন বলে দেগে দেওয়া শোষণ ও বঞ্চনার গল্প কখনও পাল্টাবে না