সোনাগাছি এলাকায় দুর্বার ও আপনে আপের সৌজন্যে বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ডক্টর স্মরজিত জানা বা টিংকু খান্নার সঙ্গে যৌন কর্মীদের মাতৃত্বসংক্রান্ত সুবিধে অসুবিধে নিয়ে তেমন কথা হয়নি কখনো। তাই ওই এলাকায় যাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা হয়েছে সেইরকম মা ও সন্তানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই এই লেখার ভিত্তি। বিশেষ করে মায়েরা, কারণ মা হবার দীর্ঘ সময়কালে নিজেদের প্রয়োজন ও ঝুঁকির কথা তাদের থেকে বেশি কে আর জানে !
মা হবার পর সোনাগাছির মেয়েরা কিন্তু অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলতে চায় সন্তানের শিক্ষা ও উন্নততর জীবনযাপনের স্বার্থে। আরো কয়েক খেপ কাস্টমারের নেওয়া বা কাকুতিমিনতি করে বাচ্চাকে বারুইপুরের আবাসিক স্কুলে রাখা, কোনটাতেই তাদের খামতি থাকে না। মা হিসেবে সবচেয়ে ত্যাগ স্বীকার, সবচেয়ে কষ্ট করতে হয় বোধহয় একজন যৌনকর্মীকে। তারপরেও প্রতিকূল পরিবেশে কটা বাচ্চাই বা সুন্দর ভবিষ্যতের মুখ দেখে ! দেখলেও কজনই বা মাকে সেই জীবনে প্রবেশাধিকার দেয় !
সিঙ্গল মাদারের কথা আমরা যখন বলি তখন কেবল সন্তানসহ বিবাহবিচ্ছিন্নাদের কথা ভাবি। মনেও করিনা যৌনকর্মী যখন মা হয় তখন তার মতো একা আর কেউ না। ঐ মহল্লায় পিতৃপরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়া বৃত্তির কারণেই মোটামুটি অসম্ভব। যদিও বা আঁচ করা যায়, কাস্টমার পুরুষটির পক্ষে তা চূড়ান্ত লজ্জা ও সম্মানহানির ব্যাপার, কিন্তু মাতৃত্বের দেহলক্ষণগুলি লুকিয়ে রাখা তো অসম্ভব। তাই সন্তানের মা কে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলেও, বাচ্চার বাবার পরিচয়টি অত্যন্ত গোপনীয়, এমনকি মা তারস্বরে বাবাটিকে চেনাতে চাইলেও সমাজ তাকে মিথ্যাবাদী বলতে পারে, শত্রুতার কথা তুলতে পারে বা চরিত্রের কথা তুলে কানে আঙুল দিতে পারে, যদি না স্বামী বা পার্টনার নিজে থেকে পিতৃত্ব স্বীকার করে নেয়। ফলে যৌনকর্মীর সন্তানের জীবনে মা একা এবং অদ্বিতীয়ম। তার কোন বাবা নেই।
এই অভাব পূরণের জন্য সোনাগাছির বেশিরভাগ মেয়ে দেহ, মাসোহারা, এমনকি ভরণপোষণ দিয়েও "বাবু" পোষে। অনেক ক্ষেত্রে বাবুর পুরো পরিবারের আর্থিক খরচও মেয়েটিকে যোগাতে হতে পারে। এই বাবু বিবাহিত হতে পারে, নাও হতে পারে। মেয়েটির মহল্লায় চব্বিশঘন্টা থাকতে পারে বা দিনরাতের নির্দিষ্ট কোন সময়ে, কিন্তু বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির সময় সে নাম ধার দেবে, খদ্দের পাওনার বেশি সময় থাকতে চাইলে সে নাক গলাবে, কোন মেয়ে খদ্দেরের হাতে মারধোর খেতে থাকলে সেইই ছুটে যাবে। সন্তানপালনে তার কোন ভূমিকা নেই, তবু যে মেয়েদের বাবু নেই, তারা মায়ের ভূমিকায় যেন আরো একটু বেশি একা। পারিবারিক কোন সাহায্য তো এই মেয়েদের কারোরই থাকে না।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সোনাগাছির মেয়েদের বেশিরভাগই, মানে নিরানব্বই শতাংশ মেয়ে একাধিক বার মা হতে চায়, হয়ও। বৃত্তিগত সমস্ত অসুবিধে তারা তুচ্ছ করে, যাদের মধ্যে রয়েছে মানসিক চাপ, শোষণ, দৈহিক কষ্ট, থাকবার জায়গার অপ্রতুলতা, আর্থিক কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা এবং সুচিকিৎসার অভাব। তবু কেন এই আকাঙ্খা?
কথা বলে মনে হয়েছে এইটাই এই মেয়েদের কাছে মানসিক মুক্তির একমাত্র পথ। হয়তো কাউকে সম্পূর্ণ নিজের বলে দাবী করবার সহজাত সাধারণ মানবিক আবেগ। যে কারণে মাতৃত্বের মধ্যেই সে খুঁজে পেতে চায় কখনো না পাওয়া সামাজিক সম্মানের ছিটেফোটা, অর্থহীন, যান্ত্রিক বাঁচাকে অতিক্রম করে আমি কারো মা এই পরিচয়ে আর একটুখানি ভালো বাঁচার আস্বাদ। বৃদ্ধবয়সে দেখবে কে সেই চিন্তাও হয়তো তাকে উত্যক্ত করে। যে কারণেই হোক, ঘুরেফিরে মাতৃত্বই হয়ে দাঁড়ায় তার বেঁচে থাকবার নির্যাস। দেখা যাচ্ছে এই পর্যায়ে কুসুমের শুধু শরীর নয়, মনও আছে।
ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ভারতে যৌনকর্মীদের সন্তানের সংখ্যা ৫.৪ মিলিয়ন এবং এরা মায়ের সঙ্গে লালবাতি এলাকায় থাকতে বাধ্য হয় সারা জীবন অথবা জীবনের কোন না কোন সময়ে। মায়ের কাছে সন্তানের গুরুত্ব এতো বেশি, যে কোন কারণে সন্তানের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেলে মায়ের মানসিক সুস্থিতি বজায় রাখা মুশকিল হয়। যাতে তা না হয়, সেজন্য সন্তানকে সব খরচ দিয়ে বাপের বাড়ি বা হস্টেলে রাখার জন্য মা খুবই উদগ্রীব হয় এবং একটা সময় পর্যন্ত নিজের পেশা সন্তানের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে। কে না জানে এ সমাজে বেশ্যাসন্তানও মায়ের মতোই ঘৃণ্য এবং পরিত্যাজ্য !
তবে দুর্বার পরিচালিত আবাস রাহুলে গিয়ে দেখেছি বাচ্চারা সবাই মাতৃপরিচয় জানে এবং তাদের যে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে সেখানেও সবাই তা জানে। সময় গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের চৌহদ্দির বাইরে তাদের হেনস্থাও নাকি অনেক কমে এসেছে।
বিদেশের যৌনকর্মীদের মতো তাদের সন্তানেরা সরকারী হেফাজতে বা হোমে বড় হবে সোনাগাছির মায়েরা তা একেবারেই চায় না। ওইভাবে বড় হলে মায়ের সঙ্গে মানসিক বন্ধন একেবারেই গড়ে উঠবে না এই তাদের বদ্ধমূল ধারণা। রাহুলে যারা থাকে তাদের সঙ্গে মায়েদের খুব নিবিড় যোগাযোগ থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করতে আসা, ফোন করে খোঁজ খবর নেওয়া এগুলো সবই মায়েরা করে আর পাঁচজনের মতোই। নিয়ম করে বাচ্চার খরচ দেওয়া, ছুটিছাটায় তাকে "বাড়িতে" নিয়ে যাওয়া এইসবই নিখুঁতভাবে হতে থাকে। খুব ছোটরা বাড়ি যাবার জন্য অধীর হয়ে থাকলেও বড় ছেলেমেয়েদের একটু বেশি সংযত দেখেছি প্রতিক্রিয়ায়। তারা এই বাড়ির মানে বুঝতে শিখে গেছে।
দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটে আপনে আপ যে স্কুলটি চালায় তার পড়ুয়ারা সকলেই ঐ এলাকার মেয়েদের সন্তান। তারা মায়ের সঙ্গেই ওখানে থাকে। থাকবেও, যদি না মায়েরা তাদের পড়াশুনার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ওখানে রাখার বিপদও অনেক।
সন্তান মেয়ে হলে স্বামী / পার্টনার / বাবু তাকে হয় এই পেশায় নামাতে চাইবে, নয়তো একই উদ্দেশে বিক্রি করে মোটা টাকা কামিয়ে নিতে চাইবে। এইরকম একটি মেয়ের সঙ্গে আপনে আপের পাঠশালায় দেখা হয়েছিল। টিঙ্কু খান্না তার জন্য একটি হিন্দি মিডিয়াম আবাসিক স্কুলের খোঁজ জারি রেখেছেন। আর সন্তান ছেলে হলে দ্রুত নেশাভাঙ, নারীসঙ্গে আসক্ত হয়ে পড়বে। তারপর একসময় হয়তো নারীমাংসের দালালি শুরু করে দেবে।
এছাড়া নানা সংক্রামক অসুখবিসুখ তো আছেই। নোংরা এলাকায়, ততোধিক নোংরা গালিগালাজ আছে। বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি তা রপ্তও করে ফেলে। অনেকেই বড়দের জোরজুলুমের শিকার হয়। মায়ের পক্ষে রোজ গড়ে কুড়িজনের কাছাকাছি খদ্দের সামলে বাচ্চার দেখাশোনা কতটুকুই বা হতে পারে !
তবু এই সন্তান মায়ের ভালো থাকার পাসওয়ার্ড। সন্তানকে জোরজুলুম করে ছিনিয়ে নেওয়া হলে যৌনকর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে তা দারুণ প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। দেখা গেছে সন্তান হারিয়ে সে চূড়ান্ত মাতলামি শুরু করেছে। আরো নানা নেশায় ডুবে গেছে ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে।
সন্তানের জন্য এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে এরকম মেয়েও কম নয়। কিন্তু সন্তান কোলছাড়া হলে তাদের বেশিরভাগই আবার পুরনো পেশায় ফিরে আসে। সন্তানের ভালর জন্য সোনাগাছির মা এতোটাই উদগ্রীব হয়ে থাকে যে প্রাপ্তবয়স্কতা প্রাপ্ত হলেও তাকে এই পঙ্কিল পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে তার মরীয়া ভাব দেখার মতো।
বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত আবাসিক স্কুলই হোক বা সরকারী হোম, বাচ্চাদের থাকবার মেয়াদ আঠার বছর বয়স অব্দি। তারপর তাকে নিয়ে যেতে হবে মাকেই। কিন্তু যৌনকর্মীদের তাতে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। তারা কেউই উঠতিবয়সের সন্তানকে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে চায় না।
উত্তর কলকাতার একটি কলেজের সেমিনারে দুর্বার থেকে বক্তা হয়ে এসেছিলেন গীতা মন্ডল ( নাম পরিবর্তিত)। এই সমস্যা তার কাছে খুবই মর্মন্তুদ বলে জানালেন। আঠারো বছর হয়ে গেলেই কী বাচ্চারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সাধারণ ঘরেও, এই ছিল তার প্রশ্ন। এই আইন যাতে প্রয়োগ না করা হয় সেজন্য তার করজোড় মিনতি আজও তাড়া করে।
চূড়ান্ত ঝুঁকিময় পেশায় মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সন্তান কামনা করে সোনাগাছির মেয়েরা। তাদের শারীরিক সুস্থতাও বহুলাংশে নির্ভর করে থাকে সন্তানের ওপর। যা কিছু শুভ ও মঙ্গলময়, এই পৃথিবীতে তার অল্প একটু আভাসের জন্য এ তল্লাটে মা হওয়া খুব জরুরী।
বেশ্যাদ্বারের মাটি ছাড়া দুর্গাপূজা হয় না, যৌনকর্মী মায়ের বিপুল আত্মোৎসর্গ স্মরণ করা ছাড়া নারীদিবসের উদযাপন হয় কি করে !