আজকাল নিত্য নূতন বিষয় এসে ফেসবুক কাঁপায়। এ সময় এমনই। নূতন যৌবনের নূতন চাওয়া স্বাধীনতার ছটফটানি চিরকাল এমনই হয়। এই যেমন টি শার্টে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ ছাপ ক্রমে একটি আন্দোলনের সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব দেখে নিজের জীবন মনে পড়ে। কেবল এই উপমহাদেশ নয় সারা পৃথিবীতেই মেয়েদের সারা জীবনই নিজের শরীর আগলাতে আগলাতেই চলে যায়। এটা হল বাস্তব সত্য। এমন নয় যে আমার আগে কেউ ভাবে নি। বড় হবার সময়, স্কুল কলেজে, বাসে ট্রামে, বিবাহের আগে বা পরে কী কী হয় তা সব্বাই জানে। কিন্তু তীর্থস্থানে? যতদূর মনে পড়ে আমার অসংখ্য মি টু-র অভিজ্ঞতার প্রথমটির অভিজ্ঞতা একেবারে শিশুকালে একটি তীর্থস্থানেই। সেদিনও একটি লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম এবং গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়েছিল অজস্র পুণ্যকামী। এ তো অবভিয়াস ব্যাপার যে পুণ্যের সঙ্গে মেয়েমানুষের স্বাধীকার ভঙ্গের কোনো বিরোধ নেই। দেখুন পাপ পুণ্যের ধারণা যা বইতে মেলে তার সঙ্গে বাস্তবের আচরণ পালনের কোন মিল অধিকাংশ সময়ই দেখতে পাওয়া যায় না। এমন নয় এ কলিযুগ তাই সবাই অধঃপাতে গেছে। সব যুগেই মেয়েরা আগে শরীর তারপর মন ও ব্যক্তিত্ব। এখন কথা হল শরীর তো ছেলেদেরও আছে তাহলে তাদের এ সমস্যা হয় না কেন? আরে ধুর হয় না কে বলল! তাদেরও হয় শরীর নিয়ে এইসব অন্যায় ঝামেলার অভিজ্ঞতা। কিন্তু আনুপাতিক হার প্রায় ঋণাত্মক। কেননা সমস্যার গোড়া জন্ম থেকেই শুরু হয়ে যায়। মেয়ে জন্ম নিলেই বাড়িতে মায়ের সতর্ক দৃষ্টি থাকে তার শরীর সাবধানে রাখার। শরীর তোমার দামী বিষয়টা যত না স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক তার চেয়ে ঢের বেশি যৌনাঙ্গকেন্দ্রিক। তোমার যোনি অক্ষত থাকা জরুরী, কারণ একদিন তোমায় একজন নির্দিষ্ট ছেলের মালিকানায় থাকতে হবে। কাজেই তোমার তুমি নয় তোমার যৌনাঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি ছেলে জন্মালে তার ট্রেনিং হয় মন নিয়ে। সে কতদূর পুরুষ হবে তার প্রমাণ রাখতে হয় সে কোন ইমোশনাল সেট ব্যাকে যাতে তার আবেগ চাপতে পারে। অর্থাৎ ছেলে আগে মন তারপর শরীর, যা কিনা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন একটি সত্ত্বা। তো এরকম ভিন্ন ফোকাস নিয়ে ছোট্টটি থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বড় হতে থাকে। এমন নয় যে এতে পরস্পরের প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে যায়। কারণ আপনি মানুন বা না মানুন ঐ “প্রেম” জিনিষটা যৌনবোধের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের। কিন্তু প্রেম ছাড়াও যৌনতা থাকে, আফটার অল সবই তো ঐ হরমোনের খেলা। ছেলেটি ক্রমাগত ইমোশন বা মন বিষয়কে মূল্যহীন ভাবতে ভাবতে ক্রমে একটি শরীর হয়ে দাঁড়ায় মূলতঃ। বাসে ট্রামে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে চাওয়া এর খুব স্বাভাবিক পরিণতি। কিছুদিন আগে তো একটি ঘটনায় মিডিয়া উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কোন বাসে একটি মেয়ে তার সহযাত্রী কোন হস্ত মৈথুনরত পুরুষের ভিডিও তুলে ভাইরাল করে দেয়। আমি মনে করি এই সমাজে ছেলেরা “সমাজ” স্ট্রাকচারটিকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে ক্রমশ নিজেরা খেলার পুতুল হয়ে যাচ্ছে। শিশুকাল থেকে দু রকমের পেষণে তাদের ‘বড়’ হতে হয়। একদিকে মন বা মানবিক অনুভূতিগুলিকে মেরে ফেলার জন্য নিয়মিত চাপ দেওয়া হয়। এবং এ কাজে তাদের মায়েরা যথেষ্ট সাহায্য করে বাবাদের সঙ্গে। “ এ মা ব্যাথা পেয়েছে তো কাঁদছিস কেন?” কিংবা “তুই কী মেয়ে? এভাবে কাঁদছিস?” “ তুই তো চুড়ি পরিস না তাহলে এত দুর্বলতা তোকে মানায় না” ইত্যাদি । তারাই নিশ্চিন্তে ইঞ্জেক্ট করতে করতে পুরুষ বানানোর ছলে শরীর বানিয়ে তোলে। আর অন্য দিকে বাইরের দুনিয়ায় অর্থ উপার্জনের মূল দায় ছেলেদের ওপরেই চাপানো থাকে বলে তারা যৌবনে পা দিতে দিতেই তাদের দারুণ রুক্ষ লড়াই করতেই হয়। সুতরাং তাদের ওপর সমাজ চাপিয়েই রাখে এমন কঠিন ভার। এখন অবশ্য মেয়েরা একশ বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি অনুপাতে বাড়ির বাইরে বের হয়, কাজ করে। অনাদিকালের চাপ, পেষণ ছেড়ে সদ্য লব্ধ স্বাধীনতার স্বাদে তারা আবার অনেকেই তীব্র মতাবলম্বী হয়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে সন্দেহ, অবিশ্বাস করতে থাকে পাশের পুরুষটিকে। ঠিক এভাবেই সমাজ ভারসাম্য হারাতে থাকে একটু একটু করে। সব পুরুষই কী গা ঘেঁষে দাঁড়াতে চায়? না মোটেই তা নয়। অথচ সুস্থ স্বাভাবিক যে ছেলেটি পাশে দাঁড়িয়ে ভিড় সামলাতে নাকাল হয়ে কোন রকমে হাতল ধরে দাঁড়িয়েছে তাকেও মেয়ে তীব্র কটুকাটব্যে ডুবিয়ে দিতে থাকে। অর্থাৎ এক অন্যায়ের প্রতিবাদে আরেক অন্যায় হতে থাকে। এই গভীরতাহীন বিদ্রোহ অবশ্যই কোন পরিণতি পাবে না বলেই মনে হয়। কারণ সভ্যতার আদি থেকে যতগুলি অন্যায় হয়েছে তার হিসাব মিটিয়ে দিতে চাইলে ব্যাপারটা ‘আঁখ কা বদলা আঁখ’ পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াবে। আপনি চাইলেই তো আর শূন্যে ফিরে যেতে পারেন না! তাই প্রতিবাদ নির্দিষ্ট ঘটনা ভিত্তিক হওয়াই কাম্য। মানুষের তো সাধারণীকরণ করা যায় না। মানুষ তো অনন্ত সম্ভাবনাময়। ছেলেরা সেই মানুষ স্পিসিসটির একটি শাখা মাত্র। এভাবে মারমুখী ভঙ্গী বা ঘৃণার লেখা দেওয়া টি শার্টের প্রতিবাদ আসলে পারস্পরিক ঘৃণা অবিশ্বাসের শ্বাসরোধী পরিবেশ গড়ে তুলবে। সবাইকে বুঝতে হবে একুশ শতকের দুনিয়ায় মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারী এত বেড়ে গেছে, পরিবেশ হত্যা এত মারাত্মক জায়গায় পৌঁছে গেছে যে ঠিক নিয়েন্ডারথ্যাল যুগে যেমনটি নারী পুরুষ হাতে হাত মিলিয়ে সভ্যতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, এখন আর একবার হাতে হাত মিলিয়ে এইসব বিপদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তার জন্য প্রতিবাদের সামান্যীকরণের বদলে নির্দিষ্ট প্রতিবাদ ও স্বাভাবিক মেলামেশা বজায় রাখা জরুরী। ছেলে মেয়ে যদি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে এভাবে তাহলে দুপক্ষেরই পরিণতি ঐ ডায়নোসরদের মত হবে। তখন আর এ লেখা পড়বে কে শুনি!