উৎসবের দিনেও এদের মুখে ঘনিয়ে থাকে অন্ধকার। তাদের প্রিয়জনেরা যখন তখন একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অপুষ্টি আর অনাহারের শিকার হয়ে। তারা অসহায়ের মত চুপ করে দেখে যাচ্ছে এই মৃত্যুমিছিল। কিছু সামাজিক কল্যাণ সমিতির সাহায্য আর তাদের নিজেদের হাহাকার আর অক্ষম রাগের শেষেও এই পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয় না, বরং গত সপ্তাহে আরও দুই শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে।
জলপাইগুড়ির ঢেকলাপাড়া চা বাগানে চলছে এই মৃত্যুর খেলা। অন্তঃসত্ত্বা ও রক্তাল্পতায় ভোগা মেয়েটির নাম ফুলমনি বেদিয়া। রাজ্য সাধারণ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ডাক্তারদের নিষেধ সত্ত্বেও গত রবিবার কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। সোমবার ভোরেই বাড়িতে জন্ম দিলেন সন্তানের। আর তারপর সন্তান সহ মারা গেলেন।
চল্লিশ বছর বয়স্ক গোপাল দুমহার মারা গেছেন, চারদিন জ্বরে ভুগবার পর। আরেক শ্রমিক, বিধু তাঁতি, তার আগের সপ্তাহে মারা গেছেন। মৃত্যুর পরিসংখ্যান সম্ভবত শ্রমিকদের বসতির জনসংখ্যার প্রায় ৩০% ছুঁতে পারে, কারণ বাগানের মধ্যে চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসার জন্য এদের যেতে হয় বীরপাড়া হাসপাতালে। এখানে অনেকে এক "রহস্যময় জ্বরে" ভোগেন। বসিন্দারের কথায়, এই জ্বর এখানে এক মহামারীর আকার ধারণ করেছে, কারণ বেশির ভাগ শ্রমিকদের পরিবারেই যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার জোটে না, বাগান বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে। বাগানের মালিক শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। খাবার জোগাতে শ্রমিকদের একে একে বিক্রি করতে হয়েছে নিজেদের সমস্ত জিনিসপত্র। সেসবও যখন ফুরিয়ে গেছে, তাঁরা বেঁচে থেকেছেন গাছের মূল কন্দ ইত্যাদি খেয়ে। ফলে, তাঁদের শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। ঢেকলাপাড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১১ সালে, বীরপাড়ার বান্দাপানি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫০০ একর জমির ওপরে। ২০০২ সালে এই চা বাগানবন্ধ হয়ে যায়, সেই থেকে আজ পর্যন্ত ৮৮ জন শ্রমিক পরিবারের সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর মূল কারণ অপুষ্টি, জলাভাব আর খিদে।
এই লাগাতার মৃত্যুর কারণ দর্শাতে গিয়ে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক বলেছেন, "-কেউ যদি চিকিৎসা না করিয়েই ফিরে আসেন, সেই দায়টা কি প্রশাসনের? আমি খুব ভালো করে জানি, আবার অনাহারে মৃত্যুর জিগির তুলে রাজ্য জুড়ে হইচই শুরু হবে। কিন্তু আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, গত ছ' মাসে ঢেকলাপাড়ায় যে শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে, তার একটির পিছনেও অনাহার দায়ী নয়।"
শ্রমিকদের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০০০ সালেও এই চা বাগান লাভে চলছিল। তখন সুব্রত ঘোষ নামে এক হোটেল ম্যানেজার আসেন শিলিগুড়ি থেকে, তিনি এই বাগানটা কিনে নেন। এক বছরের মধ্যেই বাগানের মালিক "বিপুল ক্ষতি" দাবি করে বাগানের সমস্ত মেশিন এবং শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় এক কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। সেই থেকে এই বাগান বন্ধ, আর ধীরে ধীরে এটা একটা ভূতুড়ে জায়গায় পরিণত হচ্ছে। সিপিএম নেতারা ২০০৫ সালে গোপীনাথ দাস নামে একজন ব্রোকারকে নিয়ে এসেছিল, যিনি ঢেকলাপাড়া সমেত ডুয়ার্সের ছটি চা-বাগান কিনে নেন এবং তাদের পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ১২ কোটি টাকা লোনও নেন। কিন্তু তিন মাস পরেই তিনি উধাও হয়ে যান। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, কিন্তু গোপীনাথ গ্রেফতার হয় না, বরং সে বহাল তবিয়তে এখন এলাকাতেই ঘুরে বেড়ায়। শুরুর দিকে এই চা বাগানে ছিল ৬০৪ জন স্থায়ী আর ১০০ জন অস্থায়ী শ্রমিক। এই চা বাগানের দৈনিক আয়ব্যয়ের সাথে পরোক্ষ ভাবে নির্ভরশীল ছিল কমবেশি ৫০০০ জন। কাজের অভাব, জলের অভাব, খাবারের অভাব, বিদ্যুতের অভাব এবং সর্বোপরি চিকিৎসা আর ওষুধের অভাবে সেই বাগানের আজ এই অবস্থা। কমবয়েসীরা প্রায় সকলেই কাজের সন্ধানে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছে, মেয়েরা তাদের পেটের জ্বালা মেটাতে গিয়ে স্থান পেয়েছে পতিতালয়ে। কিছু লোক এখন আশপাশের গ্রামে দিনমজুরি খাটে। সরকার থেকে এদের নামে কিছু সাহায্যের সংস্থান করা হয়, FAWLOI (ফিনান্সিয়াল অ্যাসিসটেন্স টু ওয়ার্কার্স অফ লকড আউট ইনডাস্ট্রিজ), AAY এবং SGRYএর মাধ্যমে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই, তা বাসিন্দারের অন্ধকার জীবনে আলো আনতে পারে না। 'ক্লোজড ইনডাস্ট্রি স্ট্যাটাস' নীতি অনুসারে, বাগানের সাড়ে চারশো স্থায়ী শ্রমিক মাসে ১৫০০ টাকা করে একটি ভাতা পান, আগে পেতেন ৫০০ টাকা করে। কিন্তু অস্থায়ী শ্রমিকদের ভাগ্যে কোনও সুবিধেই জোটে না। কাজের খোঁজে শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারদের পায়ে হেঁটে যেতে হয় ডিমডিমা আর রেতি নদীর পারে, পাথর ভাঙার কাজ পেতে, যেখানে দৈনিক ১০০টা পাথর ভেঙে তাদের খুব বেশি হলে ৪০-৫০ টাকা রোজগার হয়।
বাগান বন্ধ হবার পর থেকে তারা নিজেদের মধ্যে একটা সমিতি বানিয়েছে, অপারেটিং ম্যানেজমেন্ট কমিটি নামে, যেখানে পুরনো চা গাছের পাতা কুড়িয়ে তাদের দৈনিক ৩৫ টাকা করে মেলে।
কেন্দ্রীয় সরকারের অন্নপূর্ণা খাদ্য যোজনার মাধ্যমে ৬০-৭০টি পরিবার এখন মাসে ১০ কেজি চাল পায়, অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার মাধ্যমে আরও কিছু পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে ২ কেজি করে চাল, ১ কেজি আটা আর ২০০ গ্রাম রান্নার তেল দেওয়া যায়। আর উৎসবের দিনে ২০০ গ্রাম চিনি বাড়তি।
গত বছর, বিশ্ব খাদ্য দিবসে রাজু ওরাওঁ নামে এক শ্রমিক অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যান। ঠিক তার পরের দিন একই কারণে মারা যান আরও এক শ্রমিক, জয়করণ সুরি। তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে, স্রেফ খেতে না পেয়ে, অনাহারে মারা যান ধীরেন লোহার নামে আরেক শ্রমিক। এই সব ঘটনায় বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়, যার ফলে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আর উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এই বাগান পরিদর্শনে আসেন। তাঁদের বাগান এলাকায় ঢুকতে বাধা দেন শ্রমিকরা, এবং বাগান খোলার ব্যাপারে লিখিত প্রতিশ্রুতির দাবিতে ধর্না সমাবেশে বসেন।
এর পরে রাজ্য সরকার তাদের নিয়মিত বরাদ্দ খাবারের পরিমাণ বাড়ায়, যদিও তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয় নি কিছুই। মুকেশ সোনার নামে এক শ্রমিক জানান, সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোটের কারণে NREGA স্কিমের অন্তর্গত ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প থেমে যাওয়ায় তাঁদের হাতে আর টাকা নেই। চিকিৎসা হচ্ছে না। অনাহার আবার জেঁকে বসেছে বাগানের বাসিন্দাদের ওপরে, তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, সামান্য ইনফ্লুয়েঞ্জাতেও এখন সেখানে লোকের প্রাণ যাচ্ছে।
প্রশ্নের উত্তরে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মার্কি মহাপাত্র জানান যে জেলা আধিকারিক স্বাস্থ্য দফতরকে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ জানিয়েছে। একটি মেডিকাল টিম পাঠানো হবে বাগানে, এই "রহস্যময় জ্বরের" কারণ অনুসন্ধানের জন্য। এখনও পর্যন্ত সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন, সরকারি আধিকারিক, এবং প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, এই বাগান খোলার ব্যাপারে কেউই কোনও উদ্যোগ নেয় নি। জ্বরের প্রকোপ ধীরে ধীরে সমস্ত বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।
১৩ বছর চা বাগান বন্ধ। সরকার থেকে আসা সমস্ত রকমের ভাতা এপ্রিল থেকে বন্ধ। এবং এত কিছু বন্ধের মধ্যে অনাহারে গন্ধ না শুঁকে, লোকদেখানো চিল্লিমিল্লি না করে নীরবে সরকারি হাসপাতাল থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে (নাকি উপেক্ষা করে!) চিকিৎসাহীন মারা যাচ্ছেন শ্রমিকরা। হয়তো দয়ার বা ভিক্ষার দান আর নেবেন না মনস্থির করেছেন। বাগান শ্রমিক স্বপন মজুমদার জানিয়েছেন, ‘– কেন আমাদের সব সময় সবকিছু চেয়ে নিতে হবে। এসব কি দয়ার দান নাকি ? –’
অধিকার সচেতন শ্রমিকদের মৃত্যু কেড়ে নিচ্ছে প্রশাসনের রাতের ঘুম।