টিস। টাটা ইন্সিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস। এদেশে উচ্চশিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলা চলে। সেই টিসে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে চলছে লাগাতার ধর্মঘট এবং একইসাথে টিসের চারটি ক্যাম্পাস মুম্বই, হায়দ্রাবাদ, গুয়াহাটি ও তুলজাপুর থেকে চলেছে সেই ধর্মঘট। টিস কর্তৃপক্ষ পোস্ট- ম্যাট্রিক গবেষকদের স্কলারশিপ না বৃত্তি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই তার বিরোধিতা করে এই ধর্মঘট শুরু হলেও তার দাবিতে জুড়ে গেছিল সাধারণভাবে সবরকম ফি বৃদ্ধি প্রত্যাহারের ইস্যু। কিছুদিনের মধ্যেই এই ধর্মঘট নজর কেড়ে নেয় আর সমর্থন আসতে থাকে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন, টিসের প্রাক্তনী, এমনকি সারা দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। টিসের প্রতিবাদে টিসের পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপ ( পিএমএস) বন্ধের সমস্যার কথা আলাদাভাবে উঠে এলেও, এর সাথে সাথেই সামনে এসেছে আরো অনেক সমস্যা, যা শুধু একা টিসেরই নয়।
এই লেখায় আমি বৃত্তির রাজনীতি নিয়ে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করব।বৃত্তি, যা বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর কাছে, বিশেষ করে সমাজের একটি শ্রেণীর বহু মানুষের কাছে উচ্চশিক্ষা চালানোর জন্য একান্ত আবশ্যিক, সেই বৃত্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে। শুরুতে আলোচনার কেন্দ্রে টিসের পোস্ট মেট্রিক বৃত্তি থাকলেও পরে এই বৃত্তির সাথে মুদ্রাস্ফীতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাও আসবে, আসবে, কারণ সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
টিস কিন্তু সেই বিরলতম প্রতিষ্ঠানের অন্যতম যেখানে রাষ্ট্র বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল । কিন্তু সাম্প্রতিককালে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সেখানে একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছে, আসছে। এই যেমন, ভর্তির জন্যে অনলাইন পরীক্ষা চালু হওয়া , যা ছাত্র ও ছাত্র উইনিয়নের মুখে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। কারণ এই প্রবেশিকা পরীক্ষার বিন্যাসে যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছিল, তা দিনের শেষে দুঃস্থ ও নিপীড়িত সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যই এই যেমন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার উপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, মাল্টিপল চয়েজ বা বহুচয়ন মূলক প্রশ্ন । টিসে প্রশাসন আজ প্রোগ্রাম পিছু প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১০০০ টাকা ফি ধার্য করেছে। এই অতিরিক্ত প্রবেশিকা পরীক্ষার ফর্মের মূল্যবৃদ্ধি ছাত্রকূলের প্রতি লুঠতরাজের উদাহরণ বিশেষ । অনেক ছাত্রছাত্রীই এখন দু’বার ভাবছে, ভর্তির জন্য আবেদন করার আগে।
টিস কর্তৃপক্ষ তপসিলি জাতি/উপজাতি/অন্য অনগ্রসর জাতির সংখ্যালঘুদের নুতন নামকরণ করল ‘সামাজিক সুরক্ষা দপ্তর’ এবং যেসব সুবিধে আগে প্রান্তিক ছাত্রদের জন্যে সংরক্ষিত ছিল, শুরু হল তা বন্ধ হওয়া। টিস কর্তৃপক্ষ বাতিল করে দিল ভর্তির আগের ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রাম, যোগ্য ওবিসি পিএমএস ছাত্রছাত্রীদের প্রার্থীদের থেকে সম্পূর্ণ ফি চাওয়া শুরু হল এবং তারপরে দেখা গেল আর্থিক অনুদান প্রক্রিয়াটিই বন্ধ হয়ে গেল। এই সব নানা পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হল মাইনে। শেষমেশ এখন তারা দাবি করছে ভর্তির সময়ে পুরো ফি এর টাকা দিয়ে দিতে।
নীচের টেবিল দুটো দেখলেই বোঝা যাবে, ফি কী দ্রুতগতিতে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। অথচ এই বিশাল বৃদ্ধির কোন ব্যাখ্যাই কর্তৃপক্ষ দেয়নি।
টিসের ভিতর থেকে এই প্রতিবাদ কিন্তু হঠাৎ আকাশ থেকে পড়া ও স্বতঃস্ফূর্ত কোন ঘটনা নয়। টিসের ক্রমান্বয়ে পরিকল্পিত পরিবর্তনের ফল।
হস্টেল ফিস প্রতি সেমেস্টার
Year |
Hostel fees |
2014-15 |
6000 |
2015-16 |
10000 |
2016-17 |
15000 |
ডাইনিং খরচ প্রতি সেমেস্টার
Year |
Dh charges |
2014-15 |
12000 |
2015-16 |
14000 |
2016-17 |
16000 |
(তথ্য ITI ও প্রতিবাদী ছাত্রগোষ্ঠী দ্বারা সংগ্রহীত)
২০১৪ সালে কর্তৃপক্ষ ওবিসি পিএমেস ছাত্রদের সব সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে যার ফলস্বরূপ ওবিসি ছাত্র নিয়োগ হ্রাস পায়।
Year |
% of enrolment of OBCs |
2014-15 |
22 |
2015-16 |
20 |
2016-17 |
18 |
((তথ্য ITI ও প্রতিবাদী ছাত্রগোষ্ঠী দ্বারা সংগৃহীত )
উপরের টেবিলে ভর্তির সময়ে ওবিসি ছাত্র নিয়োগ হ্রাসের একটা হিসেব দেওয়া হল। এটা স্পষ্ট, কোর্সের মাঝে অনেক ছাত্র বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এই আর্থিক ভার বহন করতে না পেরে। ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীদের আরো দাবি, আর্থিক অনুদানের মত নানা সহায়তা প্রকল্প আবার ফিরে আসুক। প্রত্যাহৃত হোক ফি বৃদ্ধি।
এর আগে ২০১৪ সালে টিস ছাত্র গোষ্ঠী কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল একটি রিভ্যু কমিটি গঠন করত। ২০১৪ এর জুলাইয়ে সেই কমিটির জমা দেওয়া রিপোর্টে অনেক অনিয়ম ধরা পরে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে দেয়। এই বিপুল পরিমাণে ফি বৃদ্ধি ও নানা আর্থিক সহায়তা প্রকল্প বাতিল সেইসব আর্থিক অনিয়মেরও ফল বটে। টিসের ছাত্রগোষ্ঠীর বিক্ষোভের কারণ বুঝতে এই প্রেক্ষিতটাও জানা তাই জরুরি।
টিসের বিভিন্ন সমস্যার সাথে সাথে ধর্মঘটরত ছাত্র গোষ্ঠী জনসমক্ষে আরো যে বৃহত্তর সমস্যার খবর আনতে চায় তা হল Post Matric গবেষকদের ভয়াবহ দুরবস্থার কথা। তাই PMS সম্পর্কে জানাটা জরুরি।
এই পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপ (পি এম এস) আসলে কী?
রাষ্ট্রের বয়ান অনুযায়ী PMS হল ‘শিক্ষার ক্ষমতায়নের জন্যে ভারত সরকারের একক বৃহত্তম হস্তক্ষেপ’। ১৯৪৪ সালে ঔপনিবেশিক সরকারের আমলে PMS স্কিম চালু হয়েছিল শুধু তফশিলি জাতির (এস সি) ছাত্রদের জন্যে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল দলিত ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্যে আর্থিক সাহায্য প্রদান। এই সাহায্যের সূচনা হয়েছিল রক্ষণাবেক্ষণের বৃত্তি হিসেবে, যার অঙ্ক ছিল খুবই কম। স্বাধীনতার পরে, ১৯৪৮ সালে এই অনুদান সম্প্রসারিত হয় তফসিলি উপজাতির জন্যে ( এস টি)। ১৯৯৮ সালে অন্যান্য অনগ্রসর জাতিকে ( ওবিসি)ও সংযুক্ত করা হয় এই লিস্টে। তফশিলি জাতিউপজাতিদের জন্য পিএমএস চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া হলেও ওবিসিদের জন্য ক্ষেত্রে এটা উপলব্ধ সীমিতসংখ্যক কিছু স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে। রাজ্যগুলি থেকে পিএমএস সহায়তা খুবই কম এবং অনিয়মিত। রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রকল্পগুলির কোন পর্যালোচনা ও সংস্কার হয়নি। PMS সহায়তা প্রকল্পের শেষ সংস্কার হয় ৭-৮ বছর আগে, ২০১০ এ। পিএমএস এর ক কভারেজ এসসি এসটি দের ক্ষেত্রে ওবিসিদের থেকে আলাদা। কোর্সের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে পিএমএস চার ভাগে বিভক্ত।
পিএমএস এর বর্তমান কভারেজঃ
১।হস্টেলবাসীরা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ৩৮০- ১২০০ টাকা পান ও ডে স্কলারদের জন্যে ২৩০- ৫৫০ জন্যে বরাদ্দ।
২।বাধ্যতামূলক অফেরতযোগ্য ফি রিইনবার্স করা।
৩।শিক্ষা সফর (এককালীন) ১৬০০ টাকা ।
৪।গবেষকদের থিসিস টাইপ ও প্রকাশ করার জন্যে (এককালীন) ১৬০০ টাকা
গত আট বছরে এই রক্ষণাবেক্ষণ বরাদ্দে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০১৪ থেকে ছাত্রদের এই ভাতা দেওয়া চালু হয়েছে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে Direct Benefit Transfer মারফত প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি দেওয়ার পরিবর্তে। এই পদ্ধতি ছাত্রদের বোঝা বাড়িয়েছে দু রকম ভাবে। প্রথমত ছাত্রদের তাদের ভর্তির সময়ে পুরো ফিই একেবারে দিয়ে দিতে হচ্ছে, যে ব্যয়ভার অনেকসময়ই তাদের সাধ্যাতীত। ওবিসি ছাত্রদের অনেকে আমাদের বলেছে ভর্তির টাকা একবারে দিতে তাদের খুব সমস্যা হয়। দ্বিতীয়ত PMO ছাত্রদের এই টাকা জোগাড় করতে বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরের কাছে ছোটাছুটি করতে হয়। একজন ছাত্রদের প্রচুর পরিশ্রম ও সময়ের অপচয় হয় এই জন্যে। DBT এই টাকা লেনদেনের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভাবে শুধু সরকার ও প্রার্থীর মধ্যে ব্যক্তিগত আদানপ্রদান বানিয়ে দিয়েছে, যেখানে প্রতিষ্ঠানের কোন দায়ই নেই। পিএমএসের আবেদন জানানোর, তার পরবর্তী সব পদক্ষেপ ও বৃত্তি পাওয়ার নিয়মকানুনের ঠিকঠাকানা না থাকায় রাজ্যসরকারের নির্দিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করে এই কাজ করাও ছাত্রদের পক্ষে কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উচ্চশিক্ষা অর্জনে পিএমএস এর গুরুত্ব
সামাজিক বিচার মন্ত্রকের বাৎসরিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখলে ও এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগীর সংখ্যা দেখলে এই পিএমেসএর গুরুত্ব বোঝা যাবে। গত বছর ৫৭ লক্ষেরও বেশী তফসিলি জাতির ছাত্র পিএমএস ব্যবস্থার সুবিধে পেয়েছে। সংখ্যাটা বাড়বে যদি এর সঙ্গে তফসিলি উপজাতি ও ওবিসি ছাত্রদের ধরা হয়। আর সাধারণভাবে বলা যায়, পিএমএস ব্যবস্থার দাবি উত্তরোত্তর বাড়ছে।
নীচের টেবিলের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ২০১৩- ২০১৪ থেকে ২০১৫- ২০১৬ PMS এর দাবি বেড়েছে কিন্তু রাজ্য থেকে প্রতি ছাত্রের ব্যয় বহুলাংশে কমেছে। ২০১৬ সালে রাজ্যের PMS এর OBC ছাত্র প্রতি ব্যয় ছিল মাথাপিছু ৪০০০ টাকা। উচ্চশিক্ষায় একজন ছাত্রের জন্যে ৪০০০ টাকা নিতান্তই কম, বলাই বাহুল্য। ওবিসি ছাত্রদের জন্য ছাত্রপিছু রাজ্যের সেই খরচ আবার নেমে আসছে মাত্র ২৫০০ টাকায় !
PMS OBC ছাত্র প্রতি রাজ্যের ব্যয়
Year |
Central assistance release (Rs. In Crore) |
No of beneficiaries (In lakhs) |
Per students expenditure |
2013-14 |
2153.49 |
49.95 |
4311 |
2014-15 |
1963.37 |
53.38 |
3687 |
2015-16 |
2213.88 |
57.69 |
3837 |
(সামাজিক বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের বাৎসরিক প্রতিবেদন ২০১৫- ’১৬ এবং ২০১৬- ’১৭)
PMS তপসিলি ছাত্রের জন্যে রাজ্যের ব্যয়ভার
Year |
Central assistance release (Rs. In Crore) |
No of beneficiaries (In lakhs) |
Per students expenditure |
2013-14 |
748.39 |
20.34 |
3678.51 |
2014-15 |
587.84 |
21.06 |
2791.26 |
2015-16 |
857.14 |
20.33 |
4216.13 |
(উপজাতীয় বিষয়ক মন্ত্রকের বাৎসরিক প্রতিবেদন ২০১৫- ’১৬ এবং ২০১৬- ’১৭)
সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রান্তবাসী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষায় প্রতিনিধিত্ব করতে সুনিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু তা তখনই বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব, যখন, তার জন্য যথাযথ সাহায্যও নিশ্চিতভাবে থাকবে। পিএমএস এর অঙ্ক নিতান্তই কম হলেও এটা একরকমভাবে তফসিলি জাতি উপজাতি ওবিসি দের কাছে উচ্চশিক্ষার প্রতিযোগিতায় নামার সহায়ক। রাষ্ট্র যদি সত্যি চায় যে এই শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা পান, তো তার জন্য সরকারকে উচ্চশিক্ষার বরাদ্দ বাড়াতেই হবে।মূল লেখাঃ http://sanhati-india.org/2018/03/07/post-matric-scholarship-and-tiss-strike/ থেকে অনুমতিক্রমে অনূদিত