
ভূমিকাঃ
হানি সিং বলে কেউ র্যাপ গায়ক আছেন বলে আমার জানা ছিল না। কত কিছুই না জেনেও তো দিব্যি আছি। সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওনার নাম শুনে ও কিছু লিরিক পড়ে হাড়পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল। কেস খেলেন, হোটেলের কন্ট্রাক্ট হারালেন,-- খুশি হলাম।
কিন্তু কেউ কেউ টিভিতে শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা তোলায় হাসি পেল। তবু বর্তমান প্রজন্মের একজনের সঙ্গে এই নিয়ে তক্কাতক্কি করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
আমিঃ সত্যি সত্যি হানি বলে কেউ র্যাপ গায় , তার এই রকম লিরিক , বিক্কিরিও হয়, পাব্লিক ফাংশনে লোকে শোনে?
মহিলাঃ হ্যাঁ, আশ্চর্য্যের কী আছে!
আমিঃ হরি হে, তুমিই সত্য। কালকে শুনবো ফুটপাথে বিক্রি হওয়া 'সচিত্র কোকশাস্ত্র' ও সাহিত্য পদবাচ্য হয়েছে। কোন হরিদাস পাল সেটা নিয়ে তার সামাজিক সন্দর্ভ খুঁজে ডক্টরেট করেছে।
মহিলাঃ হতেই পারে, আশচর্য্যের কি আছে!
আমিঃ আর য়ু সিরিয়াস?
মহিলাঃ ইয়েস, অফকোর্স! আপনারা কোলকাতার বাঙালীরা বড্ড ন্যাকা ও হিপোক্রিট। কেন , আপনাদের গৌতম ভদ্র ইদানীং বটতলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক-সামাজিক সন্দর্ভ নিয়ে ঢাউস বই লেখায় চারদিকে ধন্যি ধন্যি রব ওঠেনি? বটতলা থেকে কোকশাস্ত্র কতদূর? আপনিই চেষ্টা করে দেখুন না? বাৎসায়নের কামশাস্ত্র ও কোকা পন্ডিতের কোকশাস্ত্রে স্ত্রীলিঙ্গ-নির্মাণের সামাজিক সন্দর্ভ নিয়ে থিসিস, বুড়ো বয়সে পি এইচ ডি পেতেও পারেন। নিদেনপক্ষে বাংলা অ্যাকাডেমি।
আমিঃ ফালতু কথা বলবেন না। আমি সিরিয়াস শিল্প নিয়ে কথা বলতে চাই। এইসব অশ্লীল রাস্তার গালি গানের লিরিক হবে?
মহিলাঃ অ ! ষাটের দশকে যখন আপনারা সত্যজিৎ-ঋত্বিক দেখে হায়-হায় করে দাদ দিতেন তখন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে একসময় মেইনস্ট্রিম বাংলা ছবিতে একটি থ্রিলার ফিল্মে প্রসেনজিৎ-- পরমব্রতরা একেবারে রাস্তার স্থুল, অশ্লীল গালি দেবেন, তাও আপনাদের সময়ের সিনেমার পর্দার আদর্শ বঙ্গনারী ম্যাডাম সেনের নাতনিকে? সেন্সর তো কাঁচি চালায় নি। আর বইটা তো হিট!
আমি থতমত খাই।
আমিঃ দেখুন, কথাটা শুধু গালি নিয়ে নয়। কেমন ভাবে বলা হয়েছে তাই দিয়ে। নিছক খিস্তি করার জন্যে, না অন্য কোন লেভেলে পাঠক/দর্শকের সঙ্গে রিলেট/কম্যুনিকেট করার জন্যে। কিন্তু হানি সিং--
মহিলাঃ পথে আসুন কাকু! এতক্ষণ তো অন্য পিচে খেলছিলেন। বলছিলাম না, আপনারা বড্ড ন্যাকা! একসময়ে আপনারা বিবর নিয়ে , বুদ্ধদেব বসুর রাত ভোর বৃষ্টি নিয়ে, হাংরি দের কবিতা নিয়ে তুলকালাম করেছিলেন। আর আজ মলয়বাবুর লেখা গুরুতে বেরোচ্ছে।
দেশ বা অন্যান্য পত্রিকায় সংগীতা/ স্বপ্নময়রা যা লিখছেন সেগুলোর তুলনায় সমরেশএর বিবর-প্রজাপতির কাকার-আদর-মামার-আদরের গল্প তো বিধবার হবিষ্যি।
আমিঃ কিন্তু হানি সিং--
মহিলাঃ দাঁড়ান কাকু, হানি সিং এ আসছি। সেইজন্যেই পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করছি। এখন আপনার আর অশ্লীল শব্দ নিয়ে আপত্তি নেই। আপত্তি কী ভাবে বলা হল, সেটা নান্দনিক হল কি না? তাইতো?
আমি ফ্লিপারটা দেখতে পাইনি। সোৎসাহে বলি-- এইবার আপনি আমার কথা ঠিক বুঝেছেন। আমরা বামপন্থীরা শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। প্রতিষ্ঠান বিরোধী শিল্পকে সাহায্য করি।
আমাকে হাত নেড়ে থামায় মহিলাটি।
-- ধ্যেৎ, কেন মিথ্যে কথা বলছেন? নিজেকে ঠকাচ্ছেন? আপনাদের আসল আপত্তি ওই শব্দ নিয়েই।আপনারা সবচেয়ে বড় ভন্ড। আর এস এস কে বোঝা যায়। ওরা সোজাসুজি মৌলবাদী। আর আপনাদের হল ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। আপনাদের ব্রেখটের নাটকে গালাগাল থাকবে, বিপ্লবী চরিত্রের মুখে যৌন আলাপ থাকবে, প্রশ্ন করা যাবে না।কিন্তু বাঙালী কমরেডের লেখায়? ওরে বাবা! মুস্তাফা সিরাজকে নন্দনের লেখক থেকে দেশের লেখক আপনারাই বানিয়েছেন। -- ভেবে দেখুন, কাকু! আপনারা কী না করেছেন? তখন আপনারা সব ব্যাপারেই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের ভূত দেখতেন। বিটলসদের আপনারা সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির অসুস্থ বিকৃতির নিদর্শন হিসেবে দেখতেন। লেননের 'স্ট্রীট ফাইটিং ইয়ার্স" এর খোঁজ রাখতেন না। প্রতিবাদের সাহিত্য-শিল্প সব আপনাদের তৈরি শৈলীতে না হলেই গেল গেল? অগ্নীশ্বর কথিত পদিপিসীরা অন্তর থেকে না-না করে ওঠে। সুনীল গাঙ্গুলীকে অমনি করে বরাবর খিস্তি করে গেলেন আর যেই উনি ঈশ্বর হয়েছেন আপনারা--।
আমিঃ আপনার ফালতু লেকচার আর ব্যক্তিগত আক্রমণ শুনতে আসিনি। প্লীজ, হানি সিং নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন, তা নিয়ে কথা বলবেন তো বলুন। নইলে কাটি।
মহিলাঃ রেগে যাচ্ছেন কেন? শুনুন, আমি হানি সিং শুনি নি, ইচ্ছেও নেই। আমি হার্ডকোর আমেরিক্যান র্যাপ শুনি। আগে বলুন, আপনি হানির কোন গান শুনেছেন? বা আসল র্যাপ?
আমিঃ না, কোনটাই শুনিনি, ইচ্ছেও নেই।
মহিলাঃ তার মানে শুধু লিরিক পড়ে বা শুনেই গাল দিচ্ছেন। তাহলে সেই কথাগুলোই আসল সমস্যা? শুনুন, আমি হানিকে ডিফেন্ড করছি না। খালি বলছি যে মূল অ্যামেরিকান র্যাপে অনেক বেশি গালমন্দ থাকে।
আমিঃ এটা কোন যুক্তি হল? অ্যামেরিকায় র্যাপে খুব রাস্তার খিস্তি থাকে তাই হানি সিং এর সাতখুন মাপ?আপনাদের প্রজন্মের স্বপ্ন হল আমেরিকায় গিয়ে ঘর বাঁধা। আমেরিকা যা বলবে সেটাই আদর্শ!
মহিলাঃ যেমন আপনাদের সময় রুশ বা চীন। আপনারা একসময় পরিবার-নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করতেন কারণ যুদ্ধোত্তর রুশে বেশি সন্তানের জন্ম দিলে সোভিয়েতের বীর নারী না কি যেন রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়া যেত! আর মাও সে-তুং জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধী ছিলেন। যেই চীন সরকার ছোট পরিবার না করলে সরকারি কর্মচারিদের প্রমোশন/ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করার ফরমান জারি করল অমনি আপনারা চুপ করলেন।
আমিঃ চললাম, ফালতু সময় নষ্ট--।
মহিলাঃ আর একটু বসে যান, গুটিয়ে এনেছি। অ্যামেরিকান র্যাপ উঠে এসেছে হার্লেম-ঘেট্টোর বঞ্চনা আর শোষণের অন্ধকার জীবনের জ্বালা থেকে। তাই ওদের গানে একেবারে দৈনন্দিন জীবনের ভাষা। সলিল চৌধুরির ভাষা নয়। যৌন গালি ওদের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী প্রতিবাদের ভাষা। আপনার ভাল না লগতেই পারে। তাতে কী এসে যায়? ওদের জীবনকে না বুঝলে ওদের শব্দ প্রয়োগ বুঝবেন না।
আমিঃ অ! এতে বিকৃতি নেই?
মহিলাঃ কেন থাকবে না? বিকৃতি সাতমহলা প্রাসাদের মত কুলি-কামিনের জীবনেও আছে। মজদুর শ্রেণী খুব মহান জীবনযাপন করে --এসব বামপন্থীদের তৈরি আর একটা মিথ। আসলে আপনারা সব সময় দুটো একস্ট্রিম মডেল নিয়ে কথা বলেন। বাজার না রাষ্ট্র, বুর্জোয়া না কমিউনিস্ট, গণসংগীত না র্যাপ, বিয়ে না ধর্ষণ। জীবনের ধূসর রং আপনারা দেখতে পান না। তাই বিনয় মজুমদার/ তুষার রায়ের কবিতা আপনাদের কাছে অপাংক্তেয়। মানিক বাবুকে নিয়ে আপনারা বরাবর অস্বস্তি বোধ করতেন, ওকে খোঁচাতেন। আপনাদের মডেল লেখক গোপাল হালদার।
আমি উঠে পড়ি, ঘাট হয়েছে!
-চা এসে গেছে কাকু, না খেয়ে যাবেন না। এনেনেম এর নাম শুনেছেন?
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে ক্যাজুয়াল ভাবে বলি-- সেটা কী জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?
--উনি আমার প্রিয় মার্কিন র্যাপ গায়ক।
-- আগেই বলেছি না, র্যাপ শুনিনি, শুনব না।
মহিলাঃ এখনো সেই মানছি না, মানব না? বামপন্থী হয়েও আপনার স্ট্রীট কালচারের ওপর রাগ? খেয়াল করছেন না এখন ইতিহাসে সমাজতত্ত্বে সাব-অল্টার্ন নিয়ে কথা বলা ইন-থিং? স্ট্র্রীট কালচারটাই মেইন স্ট্রীম হয়ে যাচ্ছে? নতুন নন্দনতত্ত্ব তৈরি করছে মানুষ। মহারাষ্ট্রের দলিত সাহিত্য পড়েছেন। ওরা 'নীরস -তরুবর -পুরতভাগে" না লিখে " শুষ্কং-কাষ্ঠং-তিষ্ঠতি-অগ্রে"টাই লিখছে। ফুলন দেবীকে নিয়ে শেখর কাপুরের ফিলিমটা দেখেছেন? যেখানে ফুলনকে ধর্ষক বাবু লোহারের খপ্পর থেকে বের করে আনা প্রেমিক ডাকাতটি ওকে গুলি চালাতে শেখাচ্ছে? মায়ের গালিটি কেমন আদর মাখানো উচ্চারণে বলে ফুলনকে সম্বোধন করছে?
শুনুন, যারা হানি সিং এর গান ব্যান করতে চাইছে আর যারা বিহারীরাই ধর্ষক বলছে তারা একই রাশির লোক, একই নক্ষত্রে জন্মেছে। মূল বিতর্কের ট্র্যাক বদলে দিচ্ছে। এরা আসলে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আড়াল করতে চায়, বদলাতে চায় না। হানির গানে যদি তাৎকালিক চটকের বেশি কোন নান্দনিক আবেদন না থাকে তো কদিন বাদে বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। আজ ক'জন বাবা সায়গল শোনে? ওসব ছেড়ে শীলা দীক্ষিতের বাড়ির দিকে ধর্ণায় যাবেন তো বলুন। আমি যাচ্ছি।
anirban | unkwn.***.*** | ০৭ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:৪২77442
anirban | unkwn.***.*** | ০৭ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:৪৪77443
আলোচনা | unkwn.***.*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৩:২৫77444
রূপঙ্কর সরকার | unkwn.***.*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৫:০১77446
ranjan roy | unkwn.***.*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৭:২০77447
anirban | unkwn.***.*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:১২77448
rfanjan roy | unkwn.***.*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:৩৫77445