এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • দ্রোণ পর্ব

    dd লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ জুলাই ২০১৬ | ২৬২৯ বার পঠিত
  • দ্রোণ পর্ব
    ***************
    ভীষ্ম নিহত হলে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিনের রাত্রে, রণাংগন থেকে রাত্রি হলে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্র থেকে হস্তিনাপুরে পৌঁছালেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে প্রশ্ন করলেন ভীষ্মের মৃত্যু হলে দুই পক্ষে কে কী রকম আচরন করেছিলো?

    সঞ্জয় জানালেন ভীষ্মের নিধনের পরেই পান্ডবেরা প্রচন্ড হতোদ্যম কুরুসেনাকে ছাড়খাড় করে দিচ্ছিলো। কৌরব পক্ষের রথীরাও নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে কেনো ভীষ্মের মৃত্যুবার্ত্তা শুনেই দ্রোণ তখুনি যুদ্ধ বন্ধে ঘোষণা করেছিলেন।
    কৌরবেরা তখন সমবেত ভাবে "কর্ণ, কর্ণ" করে তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন। নিজেদের মধ্যে দুর্য্যোধন আর ধৃতরাষ্ট্রের "অজ্ঞতা" নিয়ে আলোচনা করছিলেন আর বলছিলেন গত দশদিন কর্ণ আর তাঁর দলবলেরা যুদ্ধ করে নি। এখনই তাঁদের ডেকে আনা উচিৎ। ধৃতরাষ্ট্র সায় দিয়ে বললেন অষ্টম দিনের যুদ্ধ শেষে দুর্য্যোধন, শকুনি ইত্যাদিরা যে কর্ণের সাথে পরামর্শ করেছিলেন ,সেটি তাহলে ঠিক সিদ্ধান্তই ছিলো।

    কর্ণও বসেছিলেন না। ভীষ্মের নিধনবার্ত্তা শুনেই তিনি কৌরব সেনাদেরকে "পিতা যেমন পুত্রকে রক্ষা করে, তদ্রুপ তিনি বিপদগ্রস্থ কৌরবসেনাকে পরিত্রাণ করিবেন বলিয়া তাহাদিগের সমীপস্থ হইয়া কহিলেন," এখন শোকের সময়। ভীষ্ম ও অন্যান্য নিহত যোদ্ধাদের কথা স্মরণ করুন"। এরপর কর্ণ আরো অনেক উৎসাহব্যাঞ্জক কথা কথা বললেন। যে সেনারা বিমনা হয়ে কাঁদছিলো তারা ক্রমে হর্ষিত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন।
    কর্ণ শপথ নিলেন "এই মহাসংগ্রামে প্রাণপণে কৌরবসেনাদের রক্ষা করত সকল শত্রুদিগকে নিহত করিয়া দুর্য্যোধনকে রাজ্য প্রদান করিব"।আর কুরু সেনারাও"যেইরূপ দেবগন দেবরাজকে অর্চ্চনা করিয়া থাকেন, সেইরূপ কৌরবগন কর্ণের পূজা করিলেন"।

    এই পর্যন্ত্য ঠিক আছে। কিন্তু ভীষ্মের পর কুরুপক্ষে সেনাপতি হবেন কে? দুর্য্যোধনের এই এক বিরাট সমস্যা। কর্ণই সব থেকে জনপ্রিয় নায়ক হতে পারেন কিন্তু তাঁকে সেনাপতি করলে গুরুকুল অর্থাৎদ্রোণ,কৃপ,অশ্বত্থামা এরা কী সহজেই তা মেনে নেবেন?আর অন্য কাউকে সেনাপতি নির্বাচন করলে কর্ণই বা সেটা হজম করে ফেলবেন?

    দুর্য্যোধন, যেরকম বিচক্ষণ রাজা, তার পরম সুহৃদ কর্ণের কাছেই গেলেন। তিনি কর্ণকেই ভার দিলেন কুরুপক্ষের সেনাপতি নির্বাচনের। বললেন "মহাত্মা ভীষ্ম অতি দুষ্কর কার্য্য সম্পাদন করিয়া সুরলোকে গমন কইয়াছেন। এক্ষণে অনুরূপ সেনাপতি মনোনীত কর"।কর্ণকে পরিষ্কার জানালেন "অতএব মদীয় মহাত্মাগনের মধ্যে কোন ব্যক্তি ভীষ্মের পর সেনাপতি হইতে পারেন, তুমি পরীক্ষা কর। তুমি যাঁহাকে সেনাপতিপদের উপযুক্ত মনে করিবে , আমরা সকলে তাঁহাকেই সেনাপতি করিব"। উদারমনা কর্ণ খুব ঠান্ডা মাথায় বললেন , এই সকল মহাত্মারা সকলেই উপযুক্ত, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সকলেই তো আর একসাথে সেনাপতি হতে পারবেন না। আর এঁরা "সকলেই পরষ্পরকে স্পর্ধা করিয়া থাকেন"। যিনি এঁদের মধ্যে সর্বোত্তম তাঁকেই নির্বাচিত করা উচিৎ কিন্তু তাহলে বাকীরা আবার ক্ষুন্ন হবেন। "হিতৈষী হইয়া যুদ্ধ করিবেন না"। সেই সব ভেবে দ্রোণাচার্য্যকেই সেনাপতি করা উচিৎ। তিনি "সকল যোদ্ধার আচার্য্য ,স্থবির, ধনুর্দ্ধনগনের অগ্রগন্য"। আর সমবেত রাজাদের মধ্যে এমন কেউই নেই যে দ্রোণাচার্য্যের অনুগামী হবেন না।

    দুর্য্যোধন, তখন সকল সেনাদের সামনেই দ্রোণাচার্য্যকে সেনাপতিপদের জন্য অনুরোধ করলেন।দ্রোণের প্রচুর স্তব,প্রসংশা করে, দুর্য্যোধন বললেন আপনাকে অগ্রগামী দেখে "অর্জুন কদাচ প্রহার করিবে না। ফলতঃ আপনি সেনাপতি হইলে, আমি সবান্ধব যুধিষ্ঠিরকে সবংশে পরাজয় করিব সন্দেহ নাই"। উপস্থিত সব রাজারাই সিংহনাদে সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে জয়বাদ দিলেন।

    দ্রোণ তো খুসীই হলেন। বললেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার অবধ্য - তাই তাকে ছাড়া আর সকলকেই আমি পরাজিত করব। আর এও ঠিক পান্ডবরা আমার সাথে যুদ্ধ করতে কুন্ঠিত বোধই করবেন।
    দ্রোণাচার্য্য সকল সেনাদের সামনেই দুর্য্যোধনকে বললেন তুমি আমার কাছে কী চাও, বল? দুর্য্যোধন বললেন আমি আপনার কাছে বর চাই যে আপনি যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দী করে আমার সামনে নিয়ে আসুন।

    দ্রোণ তো অবাক হলেন। বললেন, যুধিষ্ঠির কি এতোই অজাতশত্রু যে তুমি তার মৃত্যু কামনা করছ না ? তুমি কি তোমার কুল রক্ষা করতে চাও না যুদ্ধ জয় করে পান্ডবদের রাজ্য দান করে সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখতে চাও ? বোঝাই যাচ্ছে যে তুমিও যুধিষ্ঠিরের প্রতি স্নেহশীল।

    দুর্য্যোধন তখন পরিষ্কার করেই বললেন, আমাদের হাতে যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু হলে অর্জুনকে সামলানো যাবে না। সে আমাদের সকলকেই বিনাশ করবে। কিন্তু সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করে আনলে আমরা আবার দ্যুতক্রীড়া আয়োজন করে পান্ডবদের আবার লম্বা সময়ের জন্য বনে পাঠিয়ে দেব।এইজন্যই আমি যুধিষ্ঠিরের বধ চাই না।
    দ্রোণ " দুর্য্যোধনের কুটিল অভিপ্রায় অবগত হইয়া চিন্তাপুর্ব্বক তাঁহার প্রার্থিত বর এইরূপ সীমাবদ্ধ করিয়া " বললেন যে অর্জুনকে যদি কোথাও সড়িয়ে দিতে পারো তাহলেই সেটা সম্ভব। কেনো না অর্জুন উপস্থিত থাকলে এই কাজে "আমি সাহসী হইতেছি না"।

    দুর্য্যোধন মনে মনে তো জানতেনই দ্রোণাচার্য্যের পান্ডবদের প্রতি স্নেহ দুর্বলতা আছে। তিনি "দ্রোণাচার্য্যকে পান্ডবগনের পক্ষপাতী বলিয়া জানিতেন, এইজন্য সেই প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করিবার নিমিত্ত অনেক মন্ত্রনা করিয়া " সমবেত কুরু সেনাদের সামনেই দ্রোণের এই প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করে দিলেন।

    একাদশ দিনের যুদ্ধ
    *******************************************************
    তো কুরু সেনাপতি দ্রোণের নেতৃত্বে শুরু হল একাদশতম দিনের যুদ্ধ। তিনি অধিনায়ক ঠিকই কিন্তু মহানায়ক কর্ণই।তিনিই ব্যুহের একেবারে সব থেকে সামনে তাঁর সিংহলাঞ্ছিত পতাকা উড়িয়ে অবস্থান করলেন। "তখন কর্ণকে অবলোকন করিয়া কেহই ভীষ্মের অভাবনিবন্ধন বিপদ গণনা করিলেন না"।
    কুরুপক্ষীয় অনেক যোদ্ধা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলেন ,ভীষ্ম তো এতোদিন "পান্ডবদের রক্ষা করিয়াছেন"। যেনো পুরোটাই গট আপ খেলাছিলো। যা হোক, এইবার ঘোর পান্ডববিদ্বেষী কর্ণ এসেছেন। আর চিন্তা নেই।দ্রোণের পান্ডব বিরোধিতাও সন্দেহের উর্দ্ধে ছিলো না। দুর্য্যোধন,এর পরে দেখবো, বেশ কয়েকবারই খুব কটু ভাবে দ্রোণের বিরুদ্ধে পান্ডব পক্ষের হয়ে সাবোতাজের অভিযোগ এনেছেন।

    দ্রোণ গড়লেন শকট ব্যুহ। সামনের দিক্বে সাড়িবদ্ধ ভাবে অল্প সেনা , পিছনে বৃত্তাকারে বেশী সেনা। কুরুপক্ষে শকট ব্যুহের ডানদিকে রইলেন জয়দ্রথ, কলিংগরাজ শ্রুতায়ু ও দুর্য্যোধনের ধার্মিক ভাই বিকর্ণ। তাদের পাশে মানে বুহের উইংসে রইলেন শকুনি ও তাঁর প্রাসধারী অশ্বারোহী সেনাদের দল। বামদিকে রইলেন কৃপ,কৃতবর্ম্মা, দুঃশাসন প্রমুখেরা। আর তাদের উইংসে রইলেন কাম্বোজ রাজা সুদক্ষিণ তাঁর কাম্বোজ দেশীয় দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে।

    যুধিষ্ঠির নির্মান করলেন ক্রৌঞ্চ ব্যুহ। এই ক্রৌঞ্চ ব্যুহই দুই পক্ষের কাছেই সব থেকে জনপ্রিয় ব্যুহ ছিলো মনে হয়।বুহমুখে রইলেন অর্জুন। "কৌরবগনের অগ্রসর কর্ণ ও পান্ডবগণের অগ্রসর অর্জুন,ইঁহারা পরষ্পর জাতক্রোধ ও বধপ্রার্থী হইয়া পরষ্পর অবলোকন করিতে লাগিলেন"।

    পান্ডবপক্ষও জানতে পেরেছিলেন (আপ্তলোক অর্থাৎ গুপ্তচরের মাধ্যমে) দ্রোণের যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করবার ইচ্ছা। যুধিষ্ঠির তখন অর্জুনকে বললেন, দ্রোণ তো বলেইছেন ,পাশে অর্জুন থাকলে আমি যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করতে সক্ষম হব না। তুনি বাপু আমার পাশে পাশেই থাকো। অর্জুনো আশ্বস্ত করলেন যে তিনি বেঁচে থাকতে দ্রোণ বা অন্য কেউই যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করতে পারবে না।

    যুদ্ধ শুরু হলে কুরু ও পান্ডবেরা ও দ্রোণাচার্য্য ও পাঞ্চালদের মহাযুদ্ধ শুরু হল। যেটা উল্লেখযোগ্য যে বহুবারই পান্ডব ও পাঞ্চালদের আলাদা ভাবে গন্য করা হত। আর দ্রোণের জাতক্রোধ ছিলো বিশেষতঃ পাঞ্চালদের উপরই। কিন্তু কোনোপক্ষই অপরপক্ষের ব্যুহভেদ করতে পারছিলো না। এই খানে সেই পরিস্থিতির বর্ণনা বেশ কাব্যিক - "সুতরাং উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণই নিশাকালীন বিবিধ কুসুমরাজি বিরাজিত বনরাজির ন্যায় নিস্তব্দ ভাবে অবস্থিতি করিতে লাগিল"।
    দুই পক্ষের রথীদের সংকুল লড়াই শুরু হল। এর মধ্যে সামরিক দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য অভিমন্যুর লড়াই। কৃতবর্ম্মার সাথে দ্বৈরথ শুরু হলে শরাঘাতে কৃতবর্ম্মা অভিমন্যুর সারথি ও ঘোড়াদের বিদ্ধ করে অভিমন্যুর শরাসন ছিন্ন করে ফেললেন। অভিমন্যুও ঢাল তরোয়াল নিয়ে ছুটে এসে কৃতবর্ম্মার রথে লাফিয়ে উঠে কৃতবর্ম্মার চুল ধরে হেঁচকা টানে তাকে মাটীতে আছড়ে ফেললেন ও খড়গাঘাতে রথের ধ্বজ ছিন্ন করে লাথি মেরেই সারথিকে নিহত করলেন।

    কৃতবর্ম্মার এহেন দুর্দশা দেখে ছুটে এলেন জয়দ্রথ।তিনিও নিজের রথ থেকে নেমে ঢাল তরোয়াল নিয়েই অভিমন্যুর মুখোমুখী হলেন। দুই রথী মিলে অসিযুদ্ধের ঘটনা সমগ্র মহাভারতে বেশী নেই। চতুর্দশ দিনে ভুরিশ্রবা ও সাত্যকিরও অসিযুদ্ধ এমন কি মল্লযুদ্ধও হবে কেনো না দুইজনেরই তীর ধনুক আর ছিলো না। না হলে অসিযুদ্ধ বেশ বিরল ঘটনা।
    খুবই তুমূল লড়াই হচ্ছিলো কিন্তু জয়দ্রথের অসি অভিমন্যুর ঢালের সোনার পাতে আটকে গেলো। হিঁচড়ে টানতে গিয়ে তরোয়ালটাই ভেঙে গেলে জয়দ্রথ দৌড়ে নিজের রথে উঠে চম্পট দিলেন। জয়দ্রথকে যুদ্ধে হারিয়ে অভিমন্যু সিংহনাদ করে উঠলেন।

    অবস্থা সামাল দিতে এলেন শল্য। তিনি অভিমন্যুকে লক্ষ্য করে এক ভারী বল্লম ছুঁড়লে অভিমন্যু লাফিয়ে উঠে সেই শক্তিকে লুফে নিলেন! তারপর সেটাই আবার ছুঁড়ে শল্যর সারথিকে ঘায়েল করলেন। সমবেত পান্ডব বীরেরা সেই কান্ড দেখে প্রচুর হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। শল্য তখন প্রচন্ড রেগে ভয়ানক গদা হাতেই নামলেন মাটীতে।ভয় পাবার ছেলে তো অভিমন্যু নন। তিনিও গদা হাতে তার মামাদাদুকে যুদ্ধে আহ্বান জানাতে লাগলেন।

    কিন্তু তখন অকূস্থলে হাজির ভীমসেন, তিনি "প্রযত্ন সহকারে অভিমন্যুকে নিবারণ" করে ধেয়ে গেলেন শল্যের দিকে। বিভিন্ন দিনে এই মামা ভাগ্নের একাধিকবার গদা যুদ্ধ হবে এবং প্রায় হুবহু একই বিবরণী থাকবে। ফলাফলে দুজনেই দুজনের আঘাতে সংজ্ঞাহীন হবেন। ভীম আবার চটজলদি উঠে দাঁড়াবেন আর শল্যকে কুরুপক্ষের কেউ তার রথে তুলে নিয়ে উদ্ধার করবেন। আজকেও একই ঘটনা।

    ইতিমধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের বুহভেদ করে কুরুসেনাদের ছত্রভংগ করে দিলেন।দ্রোণ তাঁর পলায়মান সেনাদের ডাক দিলেন,"হে শুরগন, পলায়ন করিবার প্রয়োজন নাই"। তখনই দ্রোণ "আপনার ভগ্ন সৈন্য একত্র করিয়া" প্রতিআক্রমন করলেন। এবারে তাঁর সামনে পড়ে গেলেন যুধিষ্ঠির। তাঁকে বন্দী করবার উদ্দেশ্যে দ্রোণ দ্রুত ধেয়ে এলেন। তাঁকে বাধা দিতে গিয়ে ভল্লের আঘাতে নিহত হলেন ধৃষ্টদ্যুম্নের এক ছেলে - যুগন্ধর। অন্যান্য পাঞ্চালেরা তখন প্রাণপন চেষ্টা করছেন যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করতে । আরও দুই পাঞ্চাল বীর - ব্যাঘ্রদত্ত আর সিংহসেন , তাঁরাও দ্রোণকে রুখতে গিয়ে ভল্লের আঘাতে ছিন্নশির হলেন।

    সমবেত কুরুরা হর্ষনাদ করে উঠলো। তারা বললেন এখুনি দ্রোণ তাহলে যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করে আমাদের শিবিরে নিয়ে আসবেন। পান্ডব সেনারা ভয়ে চিৎকার করতে লাগলেন "রাজা নিহত হইলেন"। আর ঠিক সেই মুহুর্ত্তেই, বলা যায় যেমন লাস্ট মোমেন্টে হলিউডি সিনেমার হীরোর মতন অর্জুনের সহসা প্রকাশ। তিনি "মহাবেগে" ছুটে এসে দ্রোণকে সামলালেন। তার ক্রমাগত বাণ বর্ষণে প্রচুর কুরুসেনাও নিহত হলেন।

    সেই সময় সন্ধ্যাও হয়ে আসছিলো। দ্রোণ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলে অর্জুনও "শত্রুগণকে ভীত ও যুদ্ধপরান্মুখ দেখিয়া স্বসৈন্যগণকে অবহারে"এর মানে যুদ্ধবিরতির আদেশ দিলেন।
    মহাভারতকার লিখলেন "শত্রুগণকে পরাজিত করিয়া অর্জুন হৃষ্টচিত্তে" শিবিরে প্রবেশ করলেন।

    শিবিরে এসে দ্রোণ দুর্য্যোধনকে দেখে লজ্জাই পেলেন। বললেন, আমি তো আগেই বলেছি অর্জুন থাকলে দেবতারাও যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করতে পারবে না। এখন তুমি কোনো বীরকে বল অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করতে। "তিনি অর্জুনকে যুদ্ধার্থ স্থানান্তরিত করিলে যুদ্ধস্থলে অর্জুন তাঁহাকে পরাজিত না করিয়া কখনই প্রতিনিবৃত্ত হইবে না।" তাহলেই আমি ধৃষ্টদ্যুম্নের সামনেই যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করব। যদি আমাকে দেখে যুধিষ্ঠির না পালিয়ে যায় তাহলে তাহলে ধরেই রাখতে পারো আমি তাকে বন্দী করব।

    ত্রিগর্ত্তরাজ সুশর্ম্মা এই কথোপকথন শুনে এগিয়ে এসে নিজের থেকেই জানালেন। তিনি ও তাঁর মরণপন সংশপ্তক সেনারা আগামী কাল অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করে দক্ষিণদিকে নিয়ে যাবে। সেই সুযোগে দ্রোণ যা করবার করবেন।

    সুশর্ম্মার সাথে পান্ডব ও বিরাট রাজা'র (অভিমন্যুর শ্বশুর) শত্রুতা খুবই প্রাচীন। এরই রাজ্য দখল করে বিরাট রাজা হয়েছিলেন - তাঁর সহযোগী ছিলো তাঁর সেনাপতি ও শ্যালক কীচক। সুশর্ম্মা তখন রাজ্যহীন হয়ে কৌরবদের আশ্রিত হন। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময়ে কুরুরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিরাট রাজার মৎস্য দেশ আক্রমণ করেন (জয়পুরের সংলগ্ন অঞ্চল)। উত্তর দিকে যান সব কুরুবীরেরা আর দক্ষিণদিকে সুশর্ম্মা যান মৎস্যদেশের সব গরু লুঠ করতে। অর্জুন তো উত্তরের সাথে গিয়ে কুরুদের হারিয়ে তাদের উত্তরীয় নিয়ে চলে আসেন আর ভীম গিয়ে সুশর্ম্মাকে বন্দী করে নিয়ে আসেন বিরাট রাজার কাছে। মৎস্যদেশের রাজা বিরাট, তাঁর রাজধানীর নামও বিরাট রেখেছিলেন।

    সুশর্ম্মা তাঁর অনুগামীদের নিয়ে শপথ নিলেন। শত্রুনিধন না করে তাঁরা রণক্ষেত্র ত্যাগ করবেন না। হয় জয় নয় মৃত্যু - এইছিলো সংশপ্তকদের প্রতিজ্ঞা।

    দ্বাদশদিনের যূদ্ধ
    ********************************************
    সেই পরিকল্পনা মতন সুশর্ম্মা তাঁর চার ভাইকে নিয়ে অর্জুনকে চ্যালেঞ্জ জানালেন - একটা প্রাইভেট যুদ্ধের। মূল রণাংগন থেকে সেটা হবে একটু দুরে - দক্ষিণদিকে ।

    অর্জুন তখন যুধিষ্ঠিরকে জানালেন যে তিনিও শপথবদ্ধ যে তাকে কেউ যুদ্ধে আহ্বান জানালে সেই "আমি কদাচ নিবৃত্ত হইব না"। যুধিষ্ঠির বললেন কিন্তু তুনি তো জানো দ্রোণ আমাকে বন্দী করবার পরিকল্পনা করেছে।

    অর্জুন তখন বললেন এই পাঞ্চালবীর সত্যজিৎ আপনার ছায়াসংগী থাকবে। আর যুদ্ধে এই সত্যজিৎ যদি নিহত হয় তাহলে আপনি আর "রণস্থলে অবস্থান করিবেন না"।
    দ্বাদশদিনের যুদ্ধ শুরু হলে সংশপ্তকেরা কুরুক্ষেত্রের দক্ষিনদিকে সমতল ভূমিতে রথ দিয়ে অর্দ্ধচন্দ্রাকার ব্যুহ বানালেন। ত্রিগর্ত্ত দেশের সেনা ছাড়াও তাঁদের সংগী হল নারায়ণী সেনা ও মালব, মালবেক ও ললিত্থ সেনারা। সাংঘাতিক লড়াই চললো দুই দলে।

    অর্জুনের মহাবিক্রমে ভয় পেয়ে, আমৃত্যু লড়াইএর শপথ নেওয়া স্বত্তেও কিছু সংশপ্তক সেনা পালাতে শুরু করল। ত্রিগর্ত্তরাজ রেগে আগুন হয়ে তাঁদের বললেন কৌরবদের সামনে তোমরা ভয়ানক শপথ নিয়েছিলে, এখন পালিয়ে গেলে তোমরা তো উপহাসের পাত্র হবে। "অতএব তোমরা একত্র মিলিত হইয়া যথাশক্তি যুদ্ধ কর"।

    কিন্তু অর্জুন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য । তাঁর বাণ ও ভল্লের আঘাতে অজস্র সেনাদের ঘায়েল করতে লাগলেন। "অসি ও নখরবিদ্ধ ছিন্ন বর্ম, ছিন্ন অস্থি সন্ধি, ছিন্ন মর্ম পদাতিগন নিহত হইয়া অতি দীনভাবে শয়ন করিল।তখন কেহ নিহত, কেহ হন্যমান, কেহ নিপতিত, কেহ অবস্থিত, কেহ কেহ বা বিচেষ্টমান হইতে লাগিল। এইরূপে রণস্থল সাতিশয় ভীষণ হইয়া উঠিল।"

    এইবার ফিরে আসি মূল রণাংগনে।

    আরম্ভেই দ্রোণ দুর্য্যোধনকে বললেন "বৎস। আমি তোমারই বশংবদ। আমি অর্জুনের সহিত সংশপ্তকদের উদ্ভাবিত করিয়াছি"। অর্জুন তাঁর রথ ও দলবল নিয়ে পান্ডব ব্যুহ ছেড়ে অন্য রণাংগণের দিকে রওয়ানা হলে দ্রোণ কৌরবপক্ষে গারুঢ় ব্যুহ রচনা করলেন। সেই ব্যুহের মুখেই দ্রোণ স্বয়ং।

    আর প্রতিপক্ষে যুধিষ্ঠির বানালেন মন্ডলার্দ্ধ ব্যুহ। নাম শুনে মনে হয় অর্ধচন্দ্র ব্যুহেরই একটি ভেরিয়েশন। যুধিষ্ঠির সারাক্ষণই ভয়ে ভয়ে থাকতেন। তায় আবার চোখের সামনে অর্জুন নেই। তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন দ্রোণের অভিষন্দী। ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে সাহস দিয়ে বললেন, চিন্তা করবেন না। আমি জীবিত থাকা পর্যন্ত্য দ্রোণ আপনাকে বন্দী করতে পারবে না।

    ধৃষ্টদ্যুম্ন তখনই রথ নিয়ে চললেন দ্রোণের অভিমুখে। দ্রোণ তাকে দেখে খুবই "অপ্রসন্ন" হলেন। দ্রোণকে বিমনা দেখে দুর্য্যোধনের ভাই এলেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে রুখতে। আর দ্রোণ তখন পান্ডবসেনাদের ঘায়েল করায় মন দিলেন। দ্রোণ এই পাঞ্চালদের উপর অতিশয় ক্ষিপ্ত ছিলেন।

    অর্জুন বিহীন মূল রণাংগনে দাপট দেখালেন দ্রোণ। তাঁর বিক্রমে হতাহত হচ্ছিলো অসংখ্য পান্ডব সেনা। সেই সময়ে "সৈন্য ও স্বজনে পরিবেষ্টিত রাজা দুর্য্যোধন শত্রুপক্ষের সৈন্যগণকের তদবস্থি নিরীক্ষণ করিয়া অতি হৃষ্ট চিত্তে হাস্য করিয়া কর্ণকে বলিতে লাগিলেন", হে রাধেয়। দেখো, পান্ডব সেনাদের দুর্দশা দেখো। ভীমসেনও একাকী হয়ে পড়েছেন, তাঁকে পরিত্যাগ করে পালিয়েছে তার সহকারী সেনারা। ঐ দুরাত্মা, ভয়ের চোটে নিশ্চয়ই এখন আর রাজ্যলাভের খোয়াব দেখছে না।

    কর্ণ বললেন, তা নয়। ভীম কখনই যুদ্ধ ছেড়ে যাবেন না। খাবারে বিষ, জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা, দ্যুত ক্রীড়ায় অপমান, বনবাসের ক্লেশ - পান্ডবেরা কখনই ভুলবেনা। আমার তো মনে হচ্ছে দ্রোণের উপর বড় বেশী চাপ দেওয়া হয়েছে। চলো, আমরা ওর কাছেই যাই।

    তখন দুই পক্ষেই তুমূল লড়াই শুরু হল। চারিদিকে ধুলো আর তীরে আকাশ ছেয়ে গেলে দ্রোণকে আর দেখাই যাচ্ছিলো না। সঞ্জয় বললেন, আমরা ভয় পাচ্ছিলাম দ্রোণ বোধহয় নিহতই হয়েছেন।

    দুইপক্ষের যুদ্ধ দেখে ধৃতরাষ্ট্রের দাসীপুত্র যুযুৎসু, যিনি যুদ্ধের শুরুতেই তাঁর পিতৃপক্ষ ছেড়ে, পান্ডবপক্ষে যোগদান করেছিলেন বিভীষণের মতন, তিনি দ্বৈরথ লড়াইতে ধৃতরাষ্ট্রের এক ছেলে সুবাহুকে ক্ষুরপ্র আঘাতে ছিন্নবাহু করলেন। তার মানে এই নিয়ে ইনি ধৃতরাষ্ট্রের তৃতীয় পুত্র যাকে ভীম নিহত করেন নি।যুদ্ধক্ষেত্রে আরো উল্লেখ আছে দুঃশাসন তনয়ের। আগাগোড়াই এই ছেলেটির কোনো নাম উচ্চারিত হয় নি মহাভারতে - শুধু দুঃশাসনের ছেলে বলেই পরিচিত হয়েছেন। এঁর হাতেই এক দ্বৈরথে মৃত্যু হবে অভিমন্যুর আগামীকাল।

    গজসৈন্য নিয়ে দুর্য্যোধন এবার ভীমের মুখোমুখী। হাতী দেখলেই ভীমের উত্তেজনা বেড়ে যায়। ভীম বাণ ছুঁড়ে দুর্য্যোধনকে রক্তাক্ত করে দিলেন। দুর্য্যোধনকে বাঁচাতে অংগ দেশের রাজা এলেন আর এক হাতীর পিঠে চড়ে। ভীমের নারাচের আঘাতে হাতীটি নিহত হল আর সেই পতনোন্মুখ হাতীর থেকে ছিটকে পড়লেন অংগর রাজা এবং মাটীতে পড়বার আগেই ভীম এক ভল্লে তার মাথা কেটে ফেললেন।
    আজকের দিনটা হাতীর, আঠারোদিনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের হাতীদিবস। মানে বারবারই গজসেনার কথা রয়েছে। মহাভারতের সবথেকে নামকরা রণহস্তী ছিলো প্রাগজ্যোতিষপুর মানে এখনকার আসামের রাজা ভগদত্তের।

    সেই হাতী, নাম তার সুপ্রতীক, মহাবেগে ছুটে এসে ভীমের ঘোড়া সমেত রথটিকে শুঁড়ে তুলে আছড়ে ভেঙে ফেললো। ভীম কিন্তু পালালেন না। তিনি অঞ্জলিকাবেধবিদ্যা জানতেন। টীকাকার জানিয়েছেন যে হাতীর পেটের নীচে গিয়ে বা পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে থাকার বিদ্যাকেই এই অঞ্জলিকাবেধবিদ্যা বলে। ভীম ঐ হাতীর পেটের নীচে লুকিয়েই হাত দিয়েই হাতীর তলদেশে আঘাত করলে হাতীটি ব্যাথিত হয়ে কুলালচক্রের মতন মানে কুমোরের চাকার মতন ঘুড়তে লাগলো। তখন ভীম আবার হাতীর পেটের নীচ থেকে বেড়িয়ে আসতেই সেই হাতী ভীমকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে পায়ে পিষে মারবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু ভীম তো ভীমই। সেই শুঁড়ের বাঁধন দুই হাতে ছাড়িয়ে আবার ভীম হাতীর পেটের নীচেই সেঁধিয়ে গেলেন।
    ভীমকে আর দেখা যাচ্ছিলো না। পান্ডবপক্ষে হাহাকার পড়ে গেলো। সেনাদের আর্ত্তনাদ শুনে যুধিষ্ঠির এলেন ছুটে, সংগে রইলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। আরো এলেন দশার্ণ দেশের রাজা তার হাতীর পিঠে। দুই হাতীতে যুদ্ধ শুরু হলে ভগদত্তের হাতী দশার্ণ রাজার হাতীটিকে পাশ দিয়ে আক্রমন করে ধরাশায়ী করে দিলেন আর ভগদত্তও তোমরের আঘাতে দশার্ণরাজের প্রানহরণ করলেন।
    মূল রণাংগনে তখন ভগদত্তের হাতীটাই কেন্দ্রবিন্দুতে। পান্ডব পক্ষের যতেক বীর হাজির কিন্তু কেউই সেই হাতীটাকে সামলাতে পারছে না। ভীমসেন আরেকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ্য হলেন। "তৎকালে পান্ডবসৈন্যগন শ্যেণকত্তৃক আক্রান্ত বায়সগণের ন্যায় চীৎকার করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল"।

    সেই হাতী তখন পান্ডবসেনাদের মাঝে ছুটে ব্যুহ তছনছ করে দিচ্ছে। দুর থেকে সেই আওয়াজ শুনে আর ধুলোর ঝড় দেখেই অভিজ্ঞ অর্জুন বললেন এ নিশ্চয়ই ভগদত্ত আর তার হাতীর কান্ড। অমন রণনিপুন হাতী আর দুটো নেই আর ভগদত্তের মতন গজাযোদ্ধাও আর কেই নেই। আমরাই একমাত্র এদের সামলাতে পারবো। অতএব ওখানেই চল।

    কিন্তু তারা ফিরে আসবার আগেই আরো সংশপ্তক - ত্রিগর্ত্ত দেশের আর নারায়নী সেনা - তারা হাজির। দোটানায় পড়ে অর্জুন আবার ওখানেই থেকে গেলেন ও আরো তাড়াহুড়ো করে সংশপ্তকদের ঘায়েল করতে লাগলেন। এমনই প্রচন্ড বেগে তিনি লড়াই করলেন যে স্বয়ং বাসুদেবও অভিভুত হয়ে বললেন তুমি আজ যা বীরত্ব দেখালে তা ইন্দ্র,যম বা কুবেরের পক্ষেও দুঃসাধ্য। আবার তারা রথ ঘুরিয়ে ছুটে চললেন মহাভারতের মূল রণাংগনে। সঞ্জয় বললেন, কর্ণ ও দুর্য্যোধনের প্ররোচনায় যে দুই দিকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা হয়েছিলো তা বিফল হল।

    অর্জুনকে মূল রণাংগনে ঢুকতে দিতে বাধা দিল সুশর্ম্মা। ত্রিগর্ত্তের রাজা, যার শপথবদ্ধ সংশপ্তক সেনারা এতোক্ষন অর্জুনকে ব্যাস্ত রেখেছিলো। অর্জুন বেশী সময় নিলেন না। তার তাড়া ছিলো। তিনি সুশর্ম্মার ভাইদের নিহত করে আর সুশর্ম্মাকে খুব আহত করে ছুটে চললেন ভগদত্তের দিকে।

    ভগদত্ত আর অর্জুন, গজ ও রথের লড়াই শুরু হল। কৃষ্ণ দ্রুত রথ চালিয়ে হাতীটির পিছনে চলে গেলেন - সে সময়ে অর্জুন সেই হাতীটিকে আর ভগদত্ত্কে বিনাশ করতে পারতেন কিন্তু পিছন থেকে আক্রমন করে যুদ্ধ জয় তার অভিপ্রেত ছিলো না। তিনি আবার মুখোমুখী হয়ে প্রথমেই তীক্ষ্ণ বাণে হাতীটির বর্ম ছিন্ন করলেন আর তারপরে হাতীটির মাথায় নারাচ মানে লোহার ভারী বান নিক্ষেপ করলেন। প্রচন্ড আহত হয়ে হাতী আর চলতে পারলো না। ভগদত্তের কোনো নির্দেশই আর তার পালনের ক্ষমতা ছিলো না। মহাভারতকার লিখলেন " দরিদ্রের ভার্য্যা যেমন স্বামীর বাক্যে কর্ণপাত করে না,তদ্রূপ গজরাজ প্রাগজ্যোতিশ্বরের বাক্য শ্রবন করিল না"। কিছু পরেই হাতিটি আর্ত্তনাদ করে প্রাণত্যাগ করল। অর্জুনও এক অর্ধচন্দ্র বাণে ভগদত্তের হৃদয় বিদ্ধ করে তাকে নিহত করল।

    এরপর যা কিছু সময় রইল বাকী আজকের দিনের যুদ্ধের সেটি বিশেষ ভাবে অর্জুনেরই। উনি ভগদত্তের পরেই শকুনির দুই ভাই অচল আর বৃষকের প্রাণ নিলেন। এই দুই ভাই দু দিক থেকে অর্জুনকে আক্রমন করে আঘাত করছিলো, তখন অর্জুন প্রথমে বৃষকের রথ "তিল তিল করে" চুর্ণ করলেন। বৃষক তখন অচলের রথে উঠেই এক যোগে আক্রমন করলে অর্জুন একটি তীর ছুঁড়েই দুই ভাইকে একই সাথে বিদ্ধ করে নিহত করলেন।

    প্রবল বিক্রমী অর্জুনের আক্রমনে কুরুসেনা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছিলো। একদল দ্রোণের কাছে আর অন্য দল দুর্য্যোধনের সংগে। এতো'ই ধুলায় আচ্ছন্ন ছিলো রণাংগন যে সঞ্জয় বললেন আমরা আর ধনঞ্জয়কে দেখতেই পারছিলাম না। আমি তখন দ্রোণকেই অনুসরন করছিলাম।শুধু তার গান্ডীবের ভয়ানক টংকার ধ্বনি শুনে বোঝা যাচ্ছিলো অর্জুন দক্ষিন দিকেই রয়েছেন। সে মানুষই হোক বা ঘোড়া বা হাতী - কারুর জন্যই অর্জুন দ্বিতীয়বার শর নিক্ষেপ করেন নি।

    যুধিষ্ঠির তখন দ্বিধাবিভক্ত কুরুসেনার বামদিকে যেখানে দ্রোণ ছিলেন সেইখানে ভীম,সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুম্নকে পাঠালেন সসৈন্যে।"পান্ডবগণ কহিতে লাগিল আচার্য্যকে বধ কর আর কৌরবগন কহিতে লাগিল দ্রোণকে যেন বিনাশ করে না।এইরূপে কৌরব ও পান্ডবগণ দ্রোণাচার্য্যকে লইয়া যেন দ্যুতক্রীড়া আরম্ভ করিলেন"। পাঞ্চালদের কোনো রথীকে দ্রোণ টার্গেট করলেই ধৃষ্টদ্যুম্ন ছুটে গিয়ে সেইখানে হাজির হচ্ছিলেন। ততক্ষণে অর্জুনও দক্ষিণ দিক থেকে এসে পৌঁছালেন । দ্রোণকে ঘিরে তখন তান্ডব চলছে। দুই পক্ষের সব রথীরাই একই যায়গায়। কৌরবদের প্রায় সকলেই তখন "ও কর্ণ, ও কর্ণ" বলে চিৎকার করতে লাগলেন।

    কর্ণ তার তিন ভাইকে (অর্থাৎ অধিরথ -রাধার সন্তান) নিয়ে সংগ্রাম শুরু করলে অর্জুন প্রথমে তার অনামা কনিষ্ঠ ভাইকে শরবিদ্ধ করে আর তার পরে আর দুই ভাই, শত্রুঞ্জয় ও বিপাটকে তীর ও ভল্লের আঘাতে হত করলেন।

    তুমুল লড়াইএর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সঞ্জয় বললেন অমিততেজা অর্জুনের প্রভাবে "আমাদিগের সৈন্যসমুদয় ছিন্ন ভিন্ন, দ্রোণের অভিলাষ নিস্ফল ও যুধিষ্ঠির সুরক্ষিত হইলে, যুদ্ধনির্জ্জিত, বর্ম্মশূন্য, ধুলিধুসরিত, সমরজয়ী বিপক্ষগণকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত, সাতিশয় হাস্যাস্পদ কৌরবগণ উদ্বিগ্ন মনে দশদিক অবলোকন করিয়া দ্রোণের অনুমতিক্রমে সমর অবহার করিয়া অর্জ্জুনের অসংখ্য গুনগ্রামের প্রসংশা ও তাঁহার সহিত কৃষ্ণের সখ্যভাগ শ্রবণে চিন্তা ও মৌনভাব অবলম্বন পুর্বক অভিশপ্তের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন"।

    সঞ্জয়ের ভাষ্য পড়লে সন্দেহই থাকেনা কৌরবপক্ষ কতটা ডিমরালাইজড হয়ে গেছিলেন।
    ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধ ঃ অভিমন্যু বধ
    http://www.guruchandali.com/blog/2016/05/22/1463934045692.html?author=sudipgupta7
    চতুর্দশ দিনের যুদ্ধ ঃ জয়দ্রথ বধ
    **********************************************************************************
    http://www.guruchandali.com/blog/2015/12/15/1450199336135.html?author=sudipgupta7

    জয়দ্রথ বধের পরে
    চতুর্দশ দিনের রাতের লড়াই
    *************************************************************************
    পান্ডব শিবিরে যেরকম পারষ্পরিক অভিনন্দন আর আনন্দের পালা, স্বাভাবিক ভাবেই কুরু শিবিরে ত্রাস ও হতাশা। দুর্য্যোধন "ভগ্নদন্ত ভুজংজের ন্যায়" দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। চিন্তা করলেন, অর্জুনের মতন বীর আর কে আছে? যার উপর এতো ভরসা করেছিলাম সেই কর্ণও পরাজিত হল।এই সময়ে দ্রোণের সাথে সাক্ষাত হলে দুর্য্যোধন বললেন, হে আচার্য্য। আমার পক্ষর বীরদের এই বিনাশ দেখুন। আমার জন্যই আমার মিত্ররা আজ নিহত। আপনি আপনার প্রিয় শিষ্য অর্জুনের প্রতি স্নেহ দেখিয়ে আমাদের উপেক্ষা করেছেন। একমাত্র কর্ণ ছারা আর কউকেই আমায় জয়ার্থী মনে হচ্ছে না। এখন আমারও মৃত্যুগমন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

    দ্রোণ খুবই ক্ষুব্দ হলেন। রবার বললেন, তুমি আমাকে কোনো বাক্যবানে বিদ্ধ করছো ? অর্জুনকে যুদ্ধে হারাতে পারে এরকম কেউই নেই। বললেন, আমি না হয় অর্জুনকে ব্যুহ প্রবেশে থামাতে পারি নি কিন্তু সূচীব্যুহের মধ্যে তো জয়দ্রথের পাশেই ছিলে তুমি,কর্ণ,শল্য,অশ্বত্থামা। তোমাদের উপস্থিতেই বা জয়দ্রথ কী ভাবে নিহত হন ? তোমার সমস্ত শুভার্থী গুরুজনেরা তোমায় এই যুদ্ধ শুরু না করবার উপদেশ দিয়েছিলো। "এখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, বসুন্ধরা তোমাকে পরিত্যাগ করিয়াছে "।

    যদিও তখন সুর্য্যাস্ত হয়ে গেছে তাও দ্রোণ যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলেন না। দুর্য্যোধনের বাক্যবাণে পীড়িত হয়ে তিনি আবার রণাংগনের দিকে রওয়ানা হলেন। বললেন জানি না আমি আজই ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে নিহত হব কি না।

    দুর্য্যোধনের রাগ কিন্তু কমে নি। তিনি তখনও ফুঁসছেন। এইবারে কর্ণকে সামনে পেয়ে তাকেও বললেন,তোমাদের সামনেই তো অর্জুন অক্লেশে জয়দ্রথকে নিহত করল। দ্রোণ তাঁর প্রিয়শিষ্য অর্জুনের বিরুদ্ধে মোটেই মন দিয়ে যুদ্ধ করেন নি। "তেজস্বী দ্রোণ যদি অর্জুনকে দ্বার দিবার ইচ্ছা না করিতেন ,কিংবা তিনি যদি দ্বাররক্ষায় যত্নবান থাকিতেন, তবে অর্জুন কি করিয়া দুর্ভেদ্য ব্যুহ ভেদ করিত?"তাঁর অতি প্রিয় অর্জুনের জন্য "আচার্য্য যুদ্ধ না করিয়া তাহাকে পথ প্রদর্শন করিয়াছেন।" জয়দ্রথ তো বাড়ীই চলে যেতে চেয়েছিলো। আমার দুর্ভাগ্য যে তাকে আমিই অভয়দান করে রণাংগনে থাকতে বলেছিলাম। আর ভীমসেনও আজই আমার কতোগুলি ভাইদের প্রাণ নিলেন।

    কর্ণ তো নিজেই বেকায়দায়। জয়দ্রথকে রক্ষা করবার দায়িত্বে তিনি নিজেও ব্যার্থ। তাই তিনি বরং দ্রোণকেই ডিফেন্ড করলেন। বললেন, আহা, উনি বৃদ্ধ হয়েছেন, কতোই বা ছুটবেন। এরপর আর কোনো যুক্তি না দেখিয়ে কর্ণ ,সবই কপাল, সবই দৈব এইসব বলে দুর্য্যোধনকে শান্ত করলেন।

    আবার যুদ্ধ শুরু হলে অতি ক্রুদ্ধ দুর্য্যোধন ভয়ানক সংগ্রাম শুরু করলেন। তাকে ঠেকাতে এসে ভীম,সাত্যকি,নকুল,সহদেব - কেউই তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। এইবার যুধিষ্ঠির - যিনি সচরাচর যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে খুব একটা থাকেন না, বরং কৌরব রথীরাই তাঁকে খুঁজে পেতে তাঁর সাথে লড়াই করেন, সেই যুধিষ্ঠির নিজেই এলেন দুর্য্যোধনের মোকাবিলায়। ক্ষিপ্ত দুর্য্যোধন যুধিষ্ঠিরের রথ ধ্বজা কেটে ফেললেন, ধনুক ছিন্ন করলেন আর তাঁর সারথি ইন্দ্রসেন আর চারটি ঘোড়াকেও বাণবিদ্ধ করলেন।

    যুধিষ্ঠির আরেক ধনুক নিয়ে তীর সাঁটিয়ে "হায়,তুমি নিহত হইলে" বলে বাণ নিক্ষেপ করলে দুর্য্যোধন সেই আঘাতে মুর্চ্ছা গিয়ে রথেই শুয়ে পড়লেন। কৌরব পক্ষে ভয়ানক হাহাকার পড়ে গেলো।

    তখন দুই পক্ষেই সেখানে সমবেত হলে তুমূল লড়াই শুরু হল। কিন্তু একতরফা যুদ্ধ জয় না হলেই দুর্য্যোধন মুষড়ে পড়তেন। এখনো তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। অশ্বত্থামা তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, চিন্তা কিসের? এই যুদ্ধ তুমিই জিতবে। তুমি শুধু সেনানীদের উদ্বুদ্ধ কর।

    শকুনি, যথারীতি প্রাসধারী অশ্বারোহী সেনাদের নিয়ে উপস্থিত ছিলেন রিসার্ভ ফোর্সে। দুর্য্যোধন তাকে দেখতে পেয়ে বললেন অশ্বত্থামা তো কুন্তীপুত্রদের ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছেন। এইবারে আপনি সব কুরুবীরদের নিয়ে গিয়ে মোক্ষোম ঘা টুকু দিয়ে আসুন।

    অপ্রতিরোধ্য অশ্বত্থামাকে ঠেকালেন কিন্তু ঘটোৎকচ। কিন্তু অশ্বত্থামা এরই মধ্যে সব পান্ডব বীরদের বাণবিদ্ধ করে দ্রুপদের আট ছেলেকে নিহত করলেন। এর পর কুন্তীভোজের দশ ছেলেও অশ্বত্থামার হাতে প্রাণ হারালেন। এর পরে নিহত হবেন ঘটোৎকচের ছেলেও।

    অন্য পক্ষে ভীমসেনের হাতে নিহত হলেন বাহ্লীক, দুর্য্যোধনের আরো দশ ভাই আর শকুনির পাঁচ ভাই, কর্ণের এক ভাই বৃষরথ। দিন আর রাতে মিলিয়ে ভীমের হাতে মারা গেলেন ধৃতরাষ্ট্রের একচল্লিশজন ছেলে।

    দুর্য্যোধন আবার ছুটলেন কর্ণের কাছে। পান্ডব সেনারা চতুর্দিক দিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলেছেন। ঐ শোনো তাদের বিজয়নাদ। তুমি যাও, আমাদের সেনাদের বাঁচাও।

    অতি দর্পী কর্ণ বললেন আমি এখনই গিয়ে সবাইকে পরাজিত করে অর্জুনকে বধ করে আসবো। আর অর্জুন নিহতে হলেই বাকী ভাইএরা তোমার বশীভুত হবে। আমরা ওদের আবার বনে পাঠিয়ে দেবো। কৃপাচার্য্যের আর এই হামবড়াই সহ্য হল না, তিনি কর্ণকে বললেন, ভালো,ভালো কর্ণ। শুধু বড় বড় কথা দিয়েই সব কাজে সফল হলে তো তুমি একাই দুর্য্যোধনকে রক্ষা করতে পারবে। এতোদিন যে এতো নিজের প্রসংশা কর, কই তোমার বিক্রমের কোনো ফল তো চোখে পড়ে নি।কৃপ এইবারে মনে করিয়ে দিলেন বনবাসের সময়ে গন্ধর্বদের সাথে যুদ্ধ আর বিরাট রাজার দেশের যুদ্ধে। দুই যায়গাতেই কর্ণ অর্জুনের হাতে হেরে গেছিলেন। বল্লেন দূর থেকে গর্জন করছো তো কর। অর্জুনের সামনে এলেই তোমার আর গর্জন থাকবে না।

    কর্ন রেগে গিয়ে বললেন আমি এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি আমার বিক্রম। কৃপ বললেন তোমার এই প্রলাপকে আমি ধর্ত্তব্যের মধ্যেই নেই না। কর্ণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন আমার এই অবর্থ্য অস্ত্র আছে। এই দিয়েই আমি অর্জুনকে বধ করব আর তুমি পান্ডবদের পক্ষ নিয়ে আমাকে হেয় করছো? "দুর্মতি ব্রাহ্মণ!তুমি যদি আবারও এইরূপ আমার অপ্রিয় বাক্য বল, তবে খড়্গ উত্তোলন করিয়া তোমার জিহ্বা ছেদন করিব"। এই সময়ে অশ্ব্ত্থামা চলে এলেন। মামা কৃপের অপমান তিনি সহ্য করবেন কেন? অতি দুর্বুদ্ধি নরাধম, আয় তোর মুন্ডুটা আমি ছিঁড়ে দেই- এই বলে তিনি কর্ণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুর্য্যোধন কোনোক্রমে তাদের তফাৎ করলে কর্ণ চেঁচিয়ে বললেন,তুমি ছেড়ে দাও তো ওটাকে। আমি এই ব্রাহ্মণের বীরত্বটা মেপে নেই। সেই দুর্য্যোধন, নানান স্তোকবাক্য ব্যবহার করে কোনোক্রমে দুই পক্ষকে শান্ত করলেন।

    এই ঝগড়ার বিবরণী বেশ সবিস্তারেই আছে মহাভারতে। কুরুপক্ষের দুর্বলতাটা পরিষ্কারই বোঝা যায়।

    প্রচন্ড ক্ষিপ্ত কর্ণ এমনই মহাবেগে সংগ্রাম শুরু করলেন যে পান্ডবপক্ষের রথীরা শীতার্ত্ত গরুর মতন কাঁপতে লাগলো। সেই অর্জুনই দ্রুত রথ চালিয়ে ছুটে এলেন কর্ণের দিকে। দুর্য্যোধন প্রমাদ গুনে কৃপাচার্য্যকেই বললেন আপনি এখনই যান। কর্ণকে রক্ষা করুন। বাস্তবিক, অর্জুনের সামনে কর্ণ টিঁকতেই পারলেন না। অর্জুন এক বাণে কর্ণের বাম বাহুবিদ্ধ করে পাঁচ ভল্লে কর্ণের সারথী আর চার ঘোড়াকে যমালয়ে পাঠালেন। অগত্যা কর্ণও লাফ মেরে নিজের রথ থেকে পালিয়ে, হায়! সেই কৃপাচার্য্যের রথেই আশ্রয় নিলেন।

    কর্ণের দুর্দশা দেখে কুরুসেনারা পালাতে থাকলে দুর্য্যোধন তাদের বললেন, পালাবেন না। এই দেখুন আমি কিরকম অর্জুনকে যুদ্ধে হারিয়ে দিচ্ছি। দুর্য্যোধনকে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হতে দেখে কৃপ ছুটলেন অশ্বত্থামার কাছে, বল্লেন ,রাজাকে এখনই থামাও, সে যেন অর্জুনের বাণপথে না পড়ে। তাহলে আর দুর্য্যোধনকে বেঁচে ফিরতে হবে না।

    অশ্বত্থামাও তখনই দৌড়ালেন। দুর্য্যোধনকে গিয়ে বললেন, বললেন "অর্জুনকে জয় করিবার জন্য আপনি ব্যাস্ত হইবেন না। আমিই উহাকে বারণ করিব, আপনি থাকুন"।

    দুর্য্যোধন আবার অনুযোগ শুরু করলেন, আচার্য্য তো পান্ডবদের স্নেহ করেন বলে ওদের সাথে যুদ্ধ করেন না। আপনিও ওদের উপেক্ষাই করেন।"অথবা আমার ভাগ্য মন্দ বলিয়া আপনার বিক্রম মন্দ হইয়া যায়। কিংবা যুধিষ্ঠির বা দ্রৌপদীর প্রীতিলাভের জন্যই আপনি আপনার বিক্রম অল্প প্রকাশ করেন, তাহা বুঝিতে পারি না"। দ্রৌপদীর প্রীতিলাভের ইংগিতটা কিন্তু যাকে বলে বিলো দ্য বেল্ট আঘাত হল।আরো বললেন এইবারে আপনিই স্থির করুন। আপনি আমাদের সেনাদের সামনেই থাকবেন না পিছনে চলে যাবেন।

    অশ্ব্ত্থামা বললেন ঠিক কথা যে পান্ডবেরা আমাদের বিশেষ স্নেহের পাত্র। কিন্তু এই সম্পর্কটা যুদ্ধক্ষেত্রে চালু নয়। আমরা দুই পক্ষেই নিজেদের যথাসম্ভব সামর্থ্য দিয়ে যুদ্ধ করে থাকি। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলি না।"কিন্তু কুরুরাজ! আপনি অত্যন্ত শঠ, সর্বাভিশংকী (সব বিষয়েই ভয় পান) ও অভিমানী। অতএব আপনি আমাদের উপরে আশংকা করিয়া থাকেন।"যাহোক, আমি কথা দিচ্ছি আমি এখন তুমূল লড়াই করব।

    তবে দুর্য্যোধনের এই একটানা অভিযোগ চলতেই থাকবে। কর্ণ আর শকুনি ছাড়া আর কাউকেই তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারতেন না।

    এদিকে অন্ধকার তো ঘনিয়ে আসছে,তায় ধুলোর আস্তরন। লোকে যুদ্ধ করবে কী করে? পদাতিক সেনারা হাতে প্রদীপ নিয়ে দাঁড়ালেন। রথে,ঘোড়ার উপরে ও হাতীর পিঠেও প্রদীপ ঝুলিয়ে দেওয়া হল। দুই পক্ষেই। সেই আলোর রোশনাইতে চললো নিশাযুদ্ধ। পদাতিরা বোধহয় আর যুদ্ধ করেন নি। কেনোনা দুর্য্যোধন স্বপক্ষীয় পদাতিদের "কোমলভাবে" বলেছিলেন তোমরা অস্ত্রত্যাগ করে হাতে প্রদীপ নিয়ে দাঁড়াও।
    অস্ত্র,বর্ম,মুকুট,অলংকার - এই সবে সেই আলো ঠিকরাতে লাগলো। সূর্য্যের আলোয় অগ্নি যেরকম আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সেই রকম রণাংগন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। হাজারে হাজারে প্রদীপ আর মশালের আলোয় আর কোনো অন্ধকার থাকলো না, এ যেন ফ্লাড লাইটে ক্রিকেট খেলা।

    সঞ্জয়ের একপেশে বর্ণনা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বোধহয় বিরক্ত হয়েছিলেন। উনি সরাসরি জিজ্ঞেশ করলেন, পান্ডবপক্ষের সেনাদের যেরকম বীর, আনন্দিত, অপরাজিত এইসব ভালো ভালো কথা বল, কই, আমার সেনানীদের বিবরণ দিতে গেলেই শুধুমাত্র "নিহত,বিদীর্ণ ও বিক্ষিপ্ত" বলো কেন?

    সঞ্জয় তখন দ্রোণের যুদ্ধযাত্রার কথা সবিস্তারে জানালেন। সেই ঘোর রাত্রে এক ভয়ানক লড়াই শুরু হল। কর্ণের সাথে সহদেবের দ্বৈরথ শুরু হলে কর্ণ সহজেই তার অশ্ব সারথি ধনুক সব ছিন্ন করে এমন কি সহদেবের ঢাল তরোয়ালও ছিন্ন করে দিলেন। নিরস্ত্র অসহায় সহদেবকে নিজের ধনুক দিয়ে একটা ছোট্টো চাবকিয়ে বললেন, ও হে। নিজের সমান যোদ্ধাদের সাথেই যুদ্ধ কর। ঐ দেখো অর্জুন ঐ দিকে। হয় ওর আশ্রয় নেও, নয়তো শিবিরেই ফিরে যাও। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সপ্তদশতম দিনে এই কর্ণই নকুলকে সম্পুর্ণ অসহায় পেয়েও বধ করেন নি। যেরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন ভীমসেনকে চতুর্দশ দিনের যুদ্ধে।

    এইরকম ভয়ানক লড়াই চলা কালীন দুর্য্যোধন আবার তার ধৈর্য্য হারালেন। কর্ণ আর দ্রোণকে ডেকে বললেন, জয়দ্রথ বধের পর আপনাদের ইচ্ছাতেই এই নিশাযুদ্ধ শুরু হয়েছে আর এখন আমার সেনারা সদলে মারা যাচ্ছে আর আপনার তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছেন? অথচ যুদ্ধের আগেই আপনারা বললেন যে পান্ডবদের আজই জয় করবেন।আগে জানলে আমি এই সৈন্যক্ষয়কারী যুদ্ধের প্রস্তাবে আমি রাজী হতাম না।

    এইরকম কটুবাক্যে আহত হয়ে দ্রোণ আর কর্ণ, দুজনেই "দুইটা সর্পের ন্যায় উত্তেজিত হইয়া পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন"।
    তাদের লড়াইতে বহু পান্ডবসেনা নিহত হচ্ছেন দেখে যুধিষ্ঠিরও অর্জুনের কাছে গিয়ে বললেন কিছু একটা কর। কর্ণ তো সব সেনাদেরই যমালয়ে পাঠাচ্ছেন। কৃষ্ণ তখন অর্জুনকে বললেন, মহারাজা দেখছি কর্ণের পরাক্রম দেখে ভয় পেয়েছেন। এখন কর্ণকে ঠেকাতে পারে মাত্র দুইজন, এক তুমি অর্জুন নয়তো রাক্ষস ঘটোৎকচ। কিন্তু তোমার এখন কর্ণের সামনে যাওয়া উচিৎ হবে না।

    কৃষ্ণ তখন ঘটোৎকচকে ডেকে বললেন,দেখো আমাদের মধ্যে বীর তো তিনজনই। সাত্যকি, তোমার বাবা ভীমসেন আর তুমি। আর এই নিশাকালে কর্ণকে আর তুমি ছাড়া কে সামলাবে? অতএব, বাছা তুমি কর্ণের সাথে যুদ্ধ কর।

    কর্ণ আর ঘটোৎকচের ভয়ানক লড়াই বাঁধলো। অনেক অলৌকিক বর্ণনা রয়েছে সেখানে। উল্লেখযোগ্য ঘটনা একটাই, যে একবার ঘটোৎকচ কর্ণের উপর এক চক্র ছুঁড়ে মারবেন। চক্র নিয়ে লড়াইএর বর্ণনা বিশেষ নেই কিন্তু মহাভারতে। ওটা যেন একমাত্র কৃষ্ণেরই খাসতালুক ছিল।

    ঘটোৎকচের অমানুষিক বিক্রম দেখে কৌরব রথীরা সখেদে বলতে থাকলেন "এ কৌরব সৈন্য আর থাকিল না"।

    ইতিমধ্যে বকরাক্ষসের ভাই অলায়ুধ পুরোনো শত্রুতার জেরে কুরুপক্ষে যোগ দিলেন। তার প্রতিজ্ঞা ছিলো ভীমসেনকে বধ করবার। ভীমের সাথে তার লড়াইতে ভীম কিছুটা বেকায়দায়ও পড়েছিলেন কিন্তু ঘটোৎকচ এসে অলায়ুঢকে ছিন্নমস্তক করে দিলে দুর্য্যোধন আবার বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ভাবলেন, এই ভীম নিহত হলে আমার বাকী ভাইএরা প্রাণে বাঁচতো এখন তো সেই সুযোগও গেল। তাহলে ঐ ভীমের প্রতিজ্ঞাই পুর্ণ হবে।

    ঘটোৎকচের সামনে তখন কুরুবীরেরা আর কেউ নেই, সেই কর্ণ ছাড়া। কুরুসেনারাও সদলে তখন পালাচ্ছেন। ঘটোৎকচের অস্ত্রাঘাতে কর্ণের রথের ঘোড়াগুলি নিহত হলে অচল কর্ণ বেসামাল হয়ে পড়লেন। কৌরবেরা সমস্বরে চেঁচাতে লাগলেন ,হে কর্ণ। আপনি এখনই আপনার একাঘ্নী শক্তি দিয়ে রাক্ষসটাকে বধ করুন। না হলে আমরা আর কেউ বাঁচবো না। টিঁকে থাকলে না হয় কৃষ্ণ আর অর্জুনের মোকাবিলা করা যাবে। কর্ণ নিজেও পরিশ্রান্ত ও নিতান্ত আহত হয়েছিলেন। পুরো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেই দেখবো কর্ণ অল্প আঘাতেই কাতর হয়ে পড়তেন। অসহিষ্ণু হয়ে উনি তখন সেই মহাশক্তি নিক্ষেপ করে ঘটোৎকচের প্রাণ হরণ করলেন।

    ঘটোৎকচের মৃত্যুর সাথে সাথেই কিন্তু যুদ্ধ থামলো না। শোকাহত ক্রুদ্ধ যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম গেছেন দ্রোণকে ঠেকাতে।অতএব কর্ণের বিরুদ্ধে আমিই যুদ্ধ করব।

    কৃষ্ণ তো হাঁ হাঁ করে উঠলেন। দ্রুত গিয়ে অর্জুনকে বললেন যুধিষ্ঠির তো রেগেমেগে চলেছেন কর্ণের মোকাবেলায়। এখনই চল, ওনাকে অনুসরণ করি। তারপরে সেই কৃষ্ণই যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কর্ণের সাথে দ্বৈরথ থেকে আটকালেন।

    তখন মাঝরাত অতিক্রান্ত হয়েছে। সবাই ক্লান্ত আর ঘুমে কাতর। তাদের অস্ত্র শস্ত্রও সব নিঃশেষ। অনেকেই রথের উপরে বা ঘোড়ার উপরে বসেই ঘুমিয়ে পড়তে লাগলেন। তখন অর্জুনই যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করলে কুরুসেনারাও কর্ণকে বললেন যুদ্ধ থামাও। অর্জুন বিরতি চাইছেন।খুসী হয়ে কুরুসেনারাও অর্জুনের প্রসংশা করে ঘুমিয়ে পড়লেন। শিবিরে ফিরে বর্ম ও যুদ্ধসাজ ছাড়বারও ইচ্ছা ছিলো না অনেকের। রণাংগনেই তার বাকী রাতটুকু ঘুমাবেন। হাতী আর ঘোড়াগুলিও ঐ কুরুক্ষেত্রের মাটীতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
    অনেক অনামা সেনানী নিহত হয়েছে। আর তাদের বাহন। মহারথীদের মহাপ্রস্থানের পালাও শুরু হয়েছে। আরো চারদিন চলবে এই রক্তক্ষয়ের পালা।তাও সুর্য্যোদয়ের আগেই দুই পক্ষই হতক্লান্ত ঘুম থেকে উঠে আবার প্রস্তুতি নিলেন

    পঞ্চদশতম দিনের যুদ্ধের।
    দ্রোণ পতন
    ****************************************
    সেই প্রতিদিনের মতই নানান দ্বৈরথ শুরু হল। এর মধ্যে সহদেবকে দেখে দুঃশসন খুবই দ্রুত গতিতে তার দিকে ধাবমান হলেন। সহদেব এক ভল্ল ছুঁড়ে দুঃশাসনের সারথির মাথা কেটে ফেললেন। পুরো ঘটনাটাই এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে কেউই এটা খেয়াল করেন নি, এমন কি দুঃশাসনও নয়। কিন্তু ঘোড়াগুলি যখন বেসামাল ছুটতে শুরু করলো তখনই দুঃশাসনের খেয়াল হল, তাই তো, "সারথির প্রাণ গিয়াছে"। দুঃশাসন অবশ্য রথ ছাড়লেন না তিনি নিজেই রথ চালনা ও যুদ্ধ একই সাথে করতে লাগলেন।

    গতকাল কর্ণ আর ভীমের অনেকবার লড়াই হয়েছিলো, আজও দিনের শুরুতেই দুজনের আবার যুদ্ধ বাঁধলো। দুজনেরই শরাসন ছিন্ন হলে দুজনেই গদাযুদ্ধ শুরু করলেন তবে গদায় গদায় ঠোকাঠুকি করে নয়। কর্ণ তার গদা ভীমের রথের দিকে ছুঁড়লে ভীম নিজের গদায় সেটি আটকে এক বিশাল গদা ছুঁড়লেন কর্ণে রথের দিকে। কর্ণও চটপট বাণ নিক্ষেপ করে সেই গদাটাকে রিবাউন্ড করিয়ে ভীমের রথের উপরেই আছড়ে ফেললেন। ভীমের সারথি মুর্চ্ছা গেলেন। পরে কর্ণ ভীমের ঘোড়াগুলিকেও মেরে ফেললে ভীম অন্য রথে উঠে চলে গেলেন। কর্ণেরই জয় হল।

    আর উল্লেখযোগ্য লড়াই দ্রোণ আর ধৃষ্টদ্যুম্নের। রোজই হয়। ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রোণের রথ একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে একই দিকে ছুটতে থাকলে ধৃষ্টদ্যুম্ন দুই ছুটন্ত রথের কাঠের উপর দুই পা রেখে তরোয়াল নিয়ে দ্রোণকে আক্রমণ করলেন। দ্রোণ তখন বিতস্তিকা মানে এক বিঘৎ লম্বা বণ দিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘোড়াদের বধ করলে সেই ঘোড়াগুলি মুখ থুবড়ে পড়লো। অগত্যা ধৃষ্টদ্যুম্নকেও রথ থেকে লাফিয়ে নামতে হল।ধৃষ্টদ্যুম্নের অসিক্রীড়ার বিবরণ আছে। ৩২ রকমের অসি চালনার মধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্ন তেরো রকমের অসি চালনা দেখিয়ে সকলকে চমৎকৃত করেছিলেন। কিন্তু দ্রোণ বাণ নিক্ষেপ করে তার ঢাল আর তরোয়াল দুটোই ছিন্ন করে দিলেন।

    এই রকম যুদ্ধ চলাকালীনই কৃষ্ণের পরামর্শে এমন কি যুধিষ্ঠিরও রাজী হলেন দ্রোণকে অশ্ব্ত্থামার মৃত্যুর ভুল খবর দিয়ে শোকাহত করবার। অর্জুন কিন্তু এই কূট যুদ্ধে আদৌ রাজী হন নি। ভীমের ছিলো উকিলের যুক্তি। উনি অশ্ব্ত্থামা নামে একটা হাতী মেরে ফেলে বললেন, এইবারে তো "অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছে" বললে মিথ্যা ভাষণ হয় না। ভীম তখন দৌড়ে গিয়ে দ্রোণকে বললেন অশ্বত্থামা হত হইয়াছে। ভীমের কথা কে আর বিশ্বাস করে। দ্রোণ বিমনা হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। অগত্যা যুধিষ্ঠিরই দ্রোণকে এই খবরটা দিলেন। "অশ্ব্ত্থামা হত" কথাটা চেঁচিয়ে বলে অস্পষ্ট স্বরে বললেন "ইতি গজঃ" টেকনিকালি এটি মিথ্যা ভাষণ নয় কিন্তু সম্পুর্ণ সত্যও নয়।

    সত্যবাদী ধার্মিক যুধিষ্ঠিরের মুখে এই কথা শুনে,দ্রোণ এইবারে ভেঙে পড়লেন। কার জন্য তবে এই যুদ্ধ। কী হবে আর বেঁচে থেকে। কিন্তু শোকাহত দ্রোণ তখনও যুদ্ধ থামালেন না। অগত্যা ভীমসেন আবার এলেন।কড়াকথাও শোনালেন অনেক। বললেন ব্রাহ্মণ হয়েও আপনি স্বধর্মচ্যুত। নির্লজ্জের মতন ক্ষত্রিয়দের মতন যুদ্ধ করছেন।

    দ্রোণ তখন ক্লান্ত। সময় তখন মধ্যাহ্ন। সমবেত সেনাকূল ও তৃষ্ণার্ত্ত ও শ্রান্ত। দ্রোণের তুনীরও নিঃশেষ। সামনে ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে তিনি ধনুক ত্যাগ করলেন। কর্ণ, কৃপ ও দুর্য্যোধনকে স্মরণ করে বললেন তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও। তোমাদের ও পান্ডবদের মংগল হক। এই আমি অস্ত্রত্যাগ করলাম।

    দ্রোণ ঘোষণা করে অস্ত্রত্যাগ করে চোখ বুঁজলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন খোলা তরোয়াল নিয়ে ছুটলেন। দুই পক্ষের সেনারাই চিৎকার তাকে বারণ করতে লগলেন। দূর থেকে অর্জুন চেঁচিয়ে বললেন "আচার্য্যকে বন্দী করো, হত্যা করো না"। তাকে থামাতে অর্জুন ছুটলেন ধৃষ্টদ্যুম্নের পিছনে পিছনে।কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন কারুর কথাই শুনলেন না। তিনি চুলের মুঠি ধরে এক কোপে দ্রোণের মাথা কেটে সেই ছিন্নমুন্ডকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন রণক্ষেত্রে।

    স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত কুরুসেনারা রণক্ষেত্র থেকে পালতে লাগলেন। সঞ্জয় বললেন পলাতকদের মধ্যে ছিলেন কর্ণ আর দুর্য্যোধনও। তবে এটা বোধহয় প্রতীকি বর্ণনা। সাধারন সেনানীদের মতন এঁরা রণভুমি ত্যাগ করেন নি কেনো না এর পরেও তো দুই পক্ষের ভয়ানক সংঘর্ষ চলতেই থাকবে।
    আর কেউ না হোক, ভীম কিন্তু খুসী। তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিংগন করে বললেন "যুদ্ধে কর্ণ ও পাপাত্মা দুর্য্যোধন নিহত হইলে আবারও আমি আপনাকে বিজয়ী বলিয়া আলিংগন করিব"।

    এই এতোক্ষনে অশ্ব্ত্থামার সন্ধান মিলল। উনি কৌরবসেনাদের পলায়ন দেখে দুর্য্যোধনের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন কী হয়েছে।দুর্য্যোধন অশ্বত্থামাকে দেখে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। কৃপাচার্য্যকে অনুরোধ করলেন, ঘটনাটা আপনিই বলুন। সব শুনে অশ্বত্থামা "অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া জ্বলিয়া উঠিলেন"।যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মৃত্যু তো এক স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু আচ্ছন্ন বৃদ্ধের চুলির মুঠি ধরে হিঁচড়ে টেনে ছিন্নমুন্ড করা তো যুদ্ধকর্ম নয়। কোন ছেলে বাবার এই অবমানমা সহ্য করতে পারে?
    বললেন এই "অনার্য্য ও নৃশংস যুধিষ্ঠিরের চরিত্রও জানিলাম"। প্রতিজ্ঞা করলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সব পাঞ্চালদের উনি বধ করবেন। তাঁর কথা শুনে কুরুসেনারা আবার উৎসাহ ফিরে পেল। হাজার হাজার ভেরী ও ডিন্ডিম বেজে উঠলো। অশ্বত্থামা চলনে স্বজন হারানো শ্মশানে পান্ডবদের চিতা তুলতে।

    দুর্য্যোধন তখন তাঁর সেনাদের আবার একত্র করে আশ্বাস দিয়ে বললেন,আমি তো আপনাদের বাহুবলের উপর ভরসা করেই এই যুদ্ধ শুরু করেছি। এখন দ্রোণ নিহত হয়েছে শুনে আপনারা যেরকম বিষন্ন হয়ে আছেন, এটা সংগত নয়। যুদ্ধে তো বীরের মৃত্যু এক অতি স্বাভাবিক ঘটনা।"যোদ্ধারা রণস্থলে যুদ্ধ করিতে থাকিয়া সর্বত্রই নিহত হইয়া থাকেন। রণস্থলে যুধ্যমান ব্যক্তিগণের জয়ও হইয়া থাকে আবার বধও হইয়া থাকে। সুতরাং এই দ্রোণবধে আর কি বৈচিত্র হইয়াছে ? অতএব আপনারা সর্ব্বপ্রকারে যূদ্ধ করুন"। ঐ কর্ণকে দেখুন। উনি ভীমসেনকেও যুদ্ধে হারিয়েছেন। যুদ্ধে অপটু অর্জুন তো কর্ণকে দেখিয়ে পালিয়ে যায়। এই কর্ণ তো ঘটোৎকচকেও নিহত করেছেন। এইরকম নানান আশ্বাস দিয়ে তিনি হতোদ্যম সেনাদের আবার উৎসাহিত করলেন। আবার কুরুসেনারা রিগ্রুপিং করে সগর্জনে রণাংগনে ফিরে আসলে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, এরা তো সকলে পালিয়েই গেছিলো, এখন কেনো এতো উৎসাহ ভরে আবার ফিরে আসছে?

    অর্জুন তখন রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন যে রকম চুল ধরে টেনে দ্রোণকে মারা হয়েছে তা কি অশ্বত্থামা ভুলতে পারবে?মহারাজা, আপনি নিজেই মিথ্যাবাচন করে মহাপাপ করেছেন। পুরাকালে বালিবধ করে রাম যেরকম অকীর্ত্তি স্থাপন করেছিলেন, আপনার এই অকীর্ত্তিও চিরকাল বজায় থাকবে। দ্রোণ আপনাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছিলেন। এখন যান, এই রোষতপ্ত অশ্বত্থামার হাত থেকে ধৃষ্টদ্যুম্নকে আপনি ও আপনার সহচরেরাই বাঁচান। আরো বললেন, আমাদের সকলেরই তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসে অধর্মের কলংক আমাদের গায়ে লাগল।

    এই সকল কথা শুনে প্রথমে মুখ খুললেন ভীমসেনই।বললেন,হে অর্জুন, তুমি কেন বনবাসী ঋষিদের মতন কথা বলছ? আমাদের ও দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা তোমার মনে নেই ? সেই সবের প্রতিশোধ নিতেই আমরা তো এককাট্টা হয়ে এই যুদ্ধে নেমেছি। তুমি বাপু তো এই সব জেনেশুনেই এই যুদ্ধে তোমার সম্মতি দিয়েছিলে, আর এখন আমাদের নিন্দা করছ? বেশ, তাহলে তোমার আর যুদ্ধ করার দরকার নেই। আমি এই গদা হাতেই চললাম অশ্বত্থামাকে ঘায়েল করতে।

    এইবারে সাহস পেয়ে মুখ খুললেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। বললেন হে অর্জুন। এই দ্রোণ তো ব্রাহ্মণের স্বধর্ম ছেড়েছেন অনেকদিনই। কূট যুদ্ধ করে আমার ও আপনার বন্ধু ও আত্মীয়দের নিয়মিত বধ করে গেছেন এই যুদ্ধে। সংঘর্ষের সময়ে কি কে ব্রাহ্মণ কে ক্ষত্রিয় এইসব বিচার করে যুদ্ধ করা যায়? আর আপনি নিজেও জয়দ্রথের মাথা ছিন্ন করে দূরে নিক্ষেপ করেছিলে, নিজের বাবার বন্ধু ভগদত্তকে বধ করতেও আপনার কোনো দ্বিধা হয় নি। যাক গে। আমি শুধু দ্রৌপদী আর তার সন্তানদের কথা ভেবেই যুদ্ধ করে যাবো।আরো বললেন, আর এই দ্রোণের সাথে যে পাঞ্চালদের যে এক বহু পুরোনো জাতিশত্রুতা আছে সেটা বোধহয় আপনারা ছাড়া সারা দুনিয়াই জানে। তবে আপনাকেও অনুরোধ যে এই শিষ্যবধী দ্রোণের বিরুদ্ধে আপনিও যুদ্ধ চালিয়ে যান।

    ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা শুনে পান্ডব মহারথীরা সবাই স্ট্র্যাটেজিক সাইলেন্সই বজায় রাখলেন। অর্জুন শুধু বাষ্পাকূল লোচনে গাঢ় নিঃশাস ফেলে ধিক ধিক বললেন।

    চটে গেলেন সাত্যকি।যিনি আবার অর্জুনের শিষ্য।তিনি সরাসরি বললেন, আমাদের মধ্যে কি এমন একজনও নেই যে এই পাপাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নকে এখনই বধ করতে পারেন?আর ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্বোধন করে বললেন, তুই মিথ্যুক। তোর ভাই শিখন্ডী হচ্ছেন ভীষ্মের ঘাতক। আর বেশী কি, তোরা পাঞ্চালেরাই সদলে "ধর্মভ্রষ্ট, এবং মিত্র ও গুরুদ্রোহী"।তুই আমার গুরুর সামনে তাঁর গুরুর নিন্দা করিস? আয়, এখনই গদার আঘাতে তোর মাথা চূর্ণ করি।

    ধৃষ্টদ্যুম্নও যা তা গালি দিলেন সাত্যকিকে। বললেন, তুই এক নিতান্ত ছোটোলোক। তোর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত্য পাপে ভর্তি। ছিন্নহস্ত ভুরিশ্রবা যখন অসহায় নিরস্ত্র হয়ে চোখ বুঁজেছেন তখন তুইই গিয়ে তাঁর মাথা কেটে ফেলেছিলি, আর এখন আমায় দোষ দিস? আরে,দ্রোণ তো অস্ত্রত্যাগ করেও আমাদের বধ করবার ফন্দী সাঁটছিলো, তাকে বধ করে কোন অন্যায়টা করেছি?যখন ভুরিশ্রবা তোর চুল ধরে টেনে মাটীতে ফেলে লাথি মারছিলো, তখন তোর এই বীরত্ব কোথায় ছিলো?

    বাস্তবিক, সাত্যকির পক্ষে কোনো যুক্তিই ছিলো না। এ সবই রাগের কথা। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে রথ থেকে গদা হাতে লাফিয়ে নামলেন। তখন কৃষ্ণের ইংগিতে ভীমসেন তাকে জাপটে ধরে আটকালেন। সাত্যকি সেই অবস্থাতেও ভীমসেনকে নিয়েই আরো ছয় পা গেলে ভীম তার পা দিয়ে সাত্যকির পা দুটো "বেঁধে" দিলেন।

    সহদেব এসে তখন খুব মিষ্টি কথা বলে মিটমাট করতে চাইলেন কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্নের রাগ তখনো কমে নি। বললেন, ওঃ, ঐ দেখুন কৌরবেরা আসছে। আপনি এই সাত্যকিকে দিন তো ছেড়ে। এ বোধহয় আমাকে হাতকাটা ভুরিশ্রবা ভাবছে।
    যাই হোক,কুরুসেনাদের আসতে দেখে কৃষ্ণ আর অর্জুন দুজনেই মধ্যস্ত হয়ে ওদের তফাৎ করলেন।

    ফের লড়াই শুরু হলে, ভয়ানক ক্রোধী অশ্বথামা কে রোখা যাচ্ছিলো না। সাত্যকি গুরুতর আহত হয়ে অবসৃত হলেন।ভীমসেন আর ধৃষ্টদ্যুম্নও আহত হলেন। প্রাণ হারালেন পান্ডবপক্ষীয় মালব রাজা সুদর্শন(এই নামের একাধিক রাজা রয়েছেন দুই পক্ষেই) ও চেদী বংশের যুবরাজ। পান্ডব সেনা তখন "যূথভ্রষ্ট"। অর্জুন তখন নিজেদের সেনাদের সীমালংঘন করে অশ্বত্থামার মুখোমুখী হয়ে তাঁকে বললেন, আপনার যতোটা শক্তি, যতোটা ধনুর্বেদজ্ঞান, যতোটা পুরুষকার, যতোটা দুর্য্যোধনের প্রতি প্রনয় - সব একত্র নিয়েই, আসুন আমার সাথে লড়াই করুন। "আজ যুদ্ধে দর্পোদ্ধত আপনার দর্প চুর্ণ করব"।

    অর্জুন অশ্বত্থামাকে কখনই এইরকম রুঢ় কথা বলেন নি।
    এরপর কিছু অলৌকিক যুদ্ধের কথা আছে। সেসব বিফলে গেলে অশ্বত্থামাও কুরুসেনাদের কাছে গিয়ে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলেন। দুই পক্ষের সেনারাই নিজের নিজের শিবিরে ফিরে গেলেন।

    ভীষ্ম ও দ্রোণ, দুই কুরু বৃদ্ধ নিহত হলেন। কিন্তু এই দুই মহাগুরু পতনেও পান্ডবেরা কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন না। ছলযুদ্ধেই তাঁরা বিজয়ী কিন্তু কলংকিত হলেন।

    *****************************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ জুলাই ২০১৬ | ২৬২৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চম - dd
    আরও পড়ুন
    ও শানওয়ালা - dd
    আরও পড়ুন
    কর্ণসংহার - dd
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ১৩ জুলাই ২০১৬ ০১:২৭58282
  • দীপ্তেন দা, খুব ভালো লাগলো।

    একটা ছোট প্রশ্ন। দ্রোণের মৃত্যুর পরে অশ্বত্থামা একটি বাণ ছোঁড়েন পান্ডবদের দিকে। এই অস্ত্রের নাম আমি ভুলি গেছি। এই অস্ত্রের বৈশিষ্টি ছিল কেউ যদি অস্ত্র ত্যাগ করে তাহলে ও ই অস্ত্র তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তো কৃষ্ণের পরামর্শে পান্ডব দের সব যোদ্ধা অস্ত্র ত্যাগ করে। শুধু ভীমসেন বললো আমি এই অস্ত্র কে প্রতিহত করবো। তো এই অস্ত্র শুধু ভীমের দিকে যেতে লাগলো।তখন কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন এবং অন্য রা জোর করে ভীমসেন থেকেন নিরস্ত্র করে। এবং এই অস্ত্রের আর কোন প্রভাব থাকে না।

    এই বিবরণ মনে হচ্ছে রাজশেখর র মহাভারত এ পড়েছি। ঠিক মনে করতে পারছি না। একটু কনফার্ম করবেন প্লিজ।
  • d | ***:*** | ১৩ জুলাই ২০১৬ ১১:৩০58281
  • তুলে রাখি। পরে পড়বো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন