এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ও শানওয়ালা

    dd লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ | ১৩৩৮ বার পঠিত

  • "নাচতে না জানলে তো উঠান ব্যাঁকাই বলবে।" "না,না। তা নয়। কিন্তু এইসব টুলস ফুলস গুলো ভালো হলে রাঁধবার যে আনন্দ সেটা আরো জমে", আমি রমাকে বলি,"দ্যাখো না, ভালো সবজি বা মাছ হলে রান্না এম্নিতেই খুলে যায় । তারপর বাসোন কোসোন ছুরি কাঁচি - এগুলোও ঠিক হলে মজাটাই ইয়ে হয়"।
    রমার কোনো উৎসাহ নেই রান্নায়। একবার বলেছিল "এ সব ফালতু কথা, তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি। মনে নেই?"
    আমি তাও তর্ক করি"আরে, পেইন্টিংএও তো দরকার ভালো তুলি,ভালো রং, ঠিক ঠাক ক্যানভাস।"রমা মনে করিয়ে দেয় "আর এটাও তুমি বলেছিলে, আমার নাম রমা বলেই না কি তোমার প্রেমে দ্বিধা ছিল। ফার্স্টের দিকে। বলো নি? অ্যাতো পুরোনো নাম। তোমার সেটাও অপছন্দ ছিলো"।


    আরে ধুর। বাড়ীর ছুরি,কাঁচিগুলো অ্যাতো ভোঁতা হয়ে গেছে যে তরিতরকারি তো দুরের কথা কলাও কাটা যায় না। কলকাতায় বেশ ছিলাম। সারাদিনই নানান হকার চলত রাস্তা দিয়ে - "শান ওয়াল্লা , শানোয়াল্লা" বলে ডাক শুনলেই বাড়ীর ভোঁতা ছুরি,কাঁচি আবার ঝকঝকে ধারালো করে দিতাম। এই ব্যাংগালোরে সেসব কখনো শুনি নি। ভাষাটাও তো রপ্ত নেই। কে কী সওদা করবার জন্য হাঁক দিচ্ছে বুঝিও না।
    অ্যামাজন,, ফ্লিপকার্টে খুঁজি নাইফ শার্পনারের। পাওয়া যায়, দামও তেমন বেশী নয় - কিন্তু কতোটা কাজের কে জানে। বাচ্চু তো বেশ করিৎকর্মা,ওকেই জিজ্ঞেশ করে দেখতে হবে।
    কিন্তু রমা কিছুতেই রাজী হয় না। বলে আর একটাও আমি রান্না ঘরে গ্যাজেট ঢোকাতে পারবো না। তোমার তো সখ শেষই হয় না। মিক্সার,ব্লেন্ডার, তার ওপর ফুড প্রসেসর,কফি মেশিন, স্লো কুকার, ওয়িং স্কেল ।।।।। এ তো শেষই হয় না দেখছি।
    কিন্তু এতো ভোঁতা ছুরি দিয়ে কোনো কাজও তো হয় না। কী মুষ্কিল।


    বাচ্চুকে বলতেই ও বলে, সে কি দাদা। বাড়ীর সামনে দিয়ে তো নিত্তি হেঁটে যায় এক শানওয়ালা। তবে ঠিক কথা, কলকাতার মতন চেঁচায় না অতো। লোকে কিভাবে জানি ঠিক টের পেয়ে যায়।ঐ, দশটা , এগারোটা নাগাদ। রমা বিরক্ত হয়ে বলে ,তোমার দাদা তো কোন জগতে থাকে। কানের কাছে চেঁচালেও টনক নড়ে না। আর গুনগুন করে গেলে বুঝবে?
    আমি কিন্তু ঘন ঘন বারান্দায় দাঁড়ালাম। বার বার গেলাম। নীচে সিকিউরিটিকেও কোনো রকমে বুঝিয়ে বল্লাম। তবে সে বুড়ো ব্যাটা সব সময়েই ঝিমিয়ে থাকে। তাকে দিয়ে কোনো কাজ হবে বলে তো মনে হয় না। কিন্তু আমিও একদিনও দেখলাম না।
    কতোরকমের ফেরিওয়ালা আসে - এই প্রথম টের পেলাম। শাক নিয়ে, ছোটো মাছ নিয়ে, লেবু নিয়ে, কলা নিয়ে- ঠেলা গাড়ীতে করে নিয়ে যায় - আর এ ও ঠিক, কেউই তেমন চেঁচায় না।
    বাড়ীতে ঢুকলেই আজকাল প্রায়ই সিগারেটের গন্ধ পাই। রমা কিন্তু বলে আমার মনের ভুল। বা ওপরের তলায় কেউ খেয়েছে। কিন্তু বাচ্চু যে সিগ্রেট খায়, ও কাছে বসলে যে গন্ধ পাই - ঠিক সে রকম।


    ব্যাংক থেকে ফিরে এসে দু বার বেল দিলে তারপর দরজা খোলে রমা। "অ্যাতো তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেলো?" যেন অনুযোগই করল রমা। আমিও অবাক হয়ে গেছিলাম। "ফর্মটা একবার দেখেই কাউন্টারের মহিলা হাসি মুখে জানালেন, সব ঠিক আছে। এক হপ্তার মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে। ভীড়ও ছিলো না। তুমি শুনতে পাও নি, দু বার বেল বাজালাম?
    রমা কি একটা উত্তর দেয়। দেখি বাচ্চু ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো। "এ পাড়া দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম টুক করে একবার তোমাদের সাথে দেখা করে যাই। নাঃ, দাদা, অলরেডী লেট হয়ে গ্যাছে। আমি কাটি।" বলে প্রায় দৌড়েই চলে গেলো।


    পার্থ জাপানে ছিলো বছর চারেক। খুবই জাপান ভক্ত। বল্লো, "বুঝলি, একটা পুরো দোকানই আছে শুধু কিচেন নাইফ বিক্রি করে। প্রচন্ড দাম। আর তেমনই ধারালো। একবার যদি অন্যমনষ্ক হয়েছিস তো আঙুল ফাঙুল কেটে একাক্কার। আরে, কাটিং বোর্ডও দু টুকরো হয়ে যায়।"
    "ইইস, আমারও খুব সখ। আমাদের ছুরি গুলো অ্যাতো ভোঁতা হয়ে গেছে যে টমেটোও কাটতে পারি না।কোথায় শানওয়ালা পাবো বল তো?"

    "পাড়াতেই তো দেখেছি অনেক বার। নাহলে চলে যা না , ঈগল মলের পাশেই দেখবি ঐ কম্পিইটারাইজড চাবি বানিয়ে দেয় না? তার কাছেই একটা শানওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকে তার যন্তর নিয়ে।"
    রমা বিরক্ত হয়ে বলে"আরে, ওর কি কোনো নজর আছে? সারাক্ষনই কি চিন্তা করে কে জানে? কোনো খবরই রাখে না।"
    আমি ব্যাস্ত হয়ে বলি "না,না। আমি কালই গিয়ে একবার দেখে আসবো।"
    রাত্রে বিছানা করতে গিয়ে অবাক হই। "দ্যাখো,দ্যাখো" আমি রমাকে বলি" আমার বালিশের নীচে এই ইনহেলারটা এলো কোথ্থেকে? বাচ্চুরটা না তো?'
    রমা ফ্যাকাশে মুখে আমার হাত থেকে নেয় ইনহেলারটা, বলে " কবের থেকে বলছি,পিসীকে একটা ফোন করো। আমি মনে না করিয়ে দিলে তুমি কি একটাও কাজ করতে পারো না?"
    কিন্তু আমি অবাক হই। "কিন্তু আমার খাটে ওর ইনহেলার আসবেই বা কেনো? আর দ্যাখো, ছেলেটার অ্যাজমা আছে কিন্তু সিগেরেটটা ছাড়ে না।"
    রমা বলে " তুমি কিন্তু কালকেই পিসীকে ফোন কোরো। বিজয়াতেও বলে বলে শেষ পর্যন্ত্য করলেই না।"



    সকালে বাজার করতে বেরোতেই শানওলাকে দেখলাম! বাব্বা, যেনো ঈশ্বরের দেখা পেলাম। খুব বুড়ো একটা লোক, আর অসম্ভব নোংরা জামা কাপড় পরা। ভিখিরির মতন। খুব পা টেনে টেনে চলছে - যেনো হাঁটতে খুব কষ্ট। একটা কি দুর্বোধ্য আওয়াজ করছিলো - কোন ভাষায় কে জানে। সেও খুব জোরে নয়।
    দাঁড়াও,দাঁড়াও। এক মিনিট। কলা আর ডিমটা কিনে নিতেই হবে - কাল সকালেই তো ব্রেকফাস্টে লাগবে। আমি ঝট করে দোকান থেকে কলা আর ডিম কিনে নিলাম। তার পরে তো অবাক কান্ড। মিনিট দুয়েক হয়ত হয়েছে।আর লোকটাকে দেখতেই পেলাম না। কোথ্থাও। এই তো ছিলো। সোজা রাস্তা। রাস্তার দু ধারে দোকানে আর ফ্ল্যাট বাড়ী। খুব কষ্ট করে টেনে টেনে হাঁটছিলো - গেলো কোথায়? কাছাকাছি তো সবই দোকান ঘর। সেখানে তো ঢোকার কথা নয়।
    ফ্ল্যাটবাড়ীগুলো রাস্তার দুই পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়াবে আরো একটু এগিয়ে গেলে। দু পাশে তাকাই। ফটোগ্রাফের স্টুডিও। ওষুধের দোকানা। কিরানা স্টোর। বাসন পত্রের দোকান। হোসিয়ারির দোকান। ওষুধ। তরকারি।মোবাইল এর দোকান। এখানে তো ঢোকার কথা না?
    আর অ্যাতো আস্তে চলছিলো - যে দু মিনিটে বেশীদুর যাওয়ার কথা তো নয়।আর সেই আওয়াজটাও আর পেলাম না।
    মুখ চুন করেই বাড়ী ফিরতে হল।


    কিন্তু শানওয়ালার সেই ডাকটা মনে ছিলো। দু দিন পরেই আবার বাজারে করতে গিয়ে সেই ডাকটা শুনলাম। চমকে গিয়ে, কান খাড়া করে আবার শুনতে পেলাম। নাঃ, নির্ভুল সেই আওয়াজ। "গাস্তার" না কি যেন বলছে। ঠিক বুঝতেই পারি না। মেইন রোডের দিকে তাকিয়ে দেখি,কোথাও দেখলাম না সেই বুড়োটাকে। ছেঁড়া পোষাক, জটধরা চুল। কাঁধে সেই শান দেবার চাকা। পিঠে একটা ভীষণ নোংরা ঝোলা। খুব পা টেনে টেনে চলে।
    পাশের গলিতেই আওয়াজটা শুনে তখুনি গেলাম। ওটা একটা ডেড এন্ড। দু পাশে দুটো করে বাড়ী আর তারপরেই উঁচু পাঁচিলে গলির পিছনটা আটকানো। কিন্তু লোকটা এখানেও নেই। কিন্তু আমি আওয়াজটা তো শুনেছি স্পষ্ট। এ কি ম্যাজিক না কি?
    রাত্রে দেবুর বাড়ীতে আড্ডা মেরে ফিরে ঘরে ঢুকতেই একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম। "এ কি? তুমি কি রুম ফেশনার স্প্রে করলে না কি?" রমাকে জিজ্ঞেশ করি। যে কোনো গন্ধেই আমার নাক জ্বালা করে। ধূপকাঠিও সহ্য হয় না।
    রমা উত্তর দেয় না। একমনে টিভি দেখতে থাকে। কবে আনলো রমা রুম ফ্রেশনার? দোকানপাটে তো ও বিশেষ যায় না। সব সময়ে আমাকেই বলে।


    বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার এইবার বধিব পরাণ। এ এক খেলা হয়েছে - শানওয়ালা আর আমার। কিন্তু এইবারে মোড়ের মাথায় একেবারে মুখোমুখী। কাটাকুটি করা রোদে পোড়ামুখ। সারা গায়ে যেন মাটীর গন্ধ লেগে আছে। খুব কষ্টে হাঁটছে। মুসলমান না কি? ঐ রকমই দাড়ি তো। হয়তো সাদা ছিলো - একটা কেমন ধুলো মাখা। "গস্তার" না কি জানি বলে হাঁক দিচ্ছে। ভালো বুঝিও না।
    আমি হাত নেড়ে ওকে ডাকি। এক কদম দু কদম সামনে সামনে চলি। আমি তো গ্রাম বাংলার ছেলে, হু হা মাইল খানেক হেঁটে যেতে পারি স্বচ্ছন্দে। আর হাঁটিও খুব স্পীডে। বার বার পিছন ফিরে তাকাই। ব্যাটা আসছে আমার পিছু পিছু। কষ্টে।
    বাড়ীর কাছে আসতেই সেনশর্মাদার সাথে দেখা। বড্ডো কথা বলেন ভদ্রলোক। অ্যাভয়েড করারও উপায় নেই। দু একটা খেজুরে কথা বলেই আমি বলি"আজকে চলি সেনশর্মাদা। ঐ শানওয়ালাকে পেয়েছি বহু তপস্যা করে - হা হা হা। ওকে নিয়ে বাড়ী পৌঁছোতে হবে।"
    সেনশর্মাদা অবাক হয়, "কোন শানওয়ালা?"
    আর আমিও পিছন ফিরে তাকাই। অবাক,অবাক। সত্যি কেউ নেই তো। লম্বা রাস্তা চলে গেছে মোড় পর্যন্ত্য। লোক জন। দু একটা কুকুর। গাড়ী। অটো। খুব তেমন ভীড়ও নয়। পাড়ার রাস্তা যেমন থাকে। গেলো কোথায় লোকটা। এই তো এক মিনিট আগেও আমার থেকে দুই পা পিছনে ছিলো।

    আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে বাড়ী ফিরি। রহস্যটা কোথায়?বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে রুমফ্রেশনারের গন্ধের সাথে সিগেরেটের গন্ধও পেলাম। মনে হল।


    বাচ্চু বলল, "চলো দাদা, তোমাকে আর বৌদিকে নিয়ে তিরুপতি দেখিয়ে আনি। বৌদির অ্যাতো সখ- ব্যাংগালোর থেকে অ্যাতো কাছে। আর অ্যাদ্দিনেও যাও নি ওহ, তুমি তো আবার এথিস্ট, না কি যেন বলে?"
    আমি বিব্রত হই" না,না। ওরম নাস্তিক টাস্তিক কিছু না, আসলে কি......"
    রমা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে "ধুর। ওসব কিছু না। যাস্ট কোনো পরিশ্রম করবে না। ঐ যে একটু নড়ে চড়ে বসতে হবে - সেটাতেও ইচ্ছা নেই। কোনো উৎসাহই নেই বাড়ীর বাইরে যাবার"। রমার গলায় অপরিসীম বিরক্তি ঝরে পড়ে। "ভলান্টারী রিটায়ারমেন্ট নিয়েই একেবারে বাড়ীতে বসে গেলো। ব্যাস"
    বাচ্চু বলে "তাহলে দাদা, আমি আর বৌদি চলে যাই? দুদিনের তো ব্যাপার।"
    আমি খুব খুসী হই। "বা,বা। তাহলে তো সবথেকে বেস্ট হয়"
    রমাও খুসীতে ফেটে পড়ে" বাচ্চুর ওখানে প্রচুর চেনা। আর ওর নতুন গাড়ীতে যাবে - নিসান। টেরানো? না?"
    বাচ্চু স্মিত হাসে। "তুমি গেলেও ভালো হত দাদা"। বাচ্চু বলে। আমি বাধা দেই, আমার ঐ ভীড় ভাট্টা পছন্দ হয় না বাপু। আর ঐ দেবস্থানে, সকলের কী ভক্তি আর উদ্দীপনা - তার মাঝে আমি বিরক্ত হয়ে বসে থাকি - ও আমার পোষাবে না।
    রমা আর বাচ্চু খুব তৃপ্তির হাসি হাসে। দুজনে দুজনের দিকে তাকায়। "তাহলে পরশু? সকালেই? " বাচ্চু বলে।

    ১০
    দেবু আর কল্লোল আর আমি। এই তিনজনের আড্ডা বসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এর ওর বাড়ী। মাঝে মধ্যে একটু আধটু ড্রিংকও চলে। তবে সেও ও হয়তো মাসে বার দুয়েক বা তারও কম। রোজকার মদের ঠেক কিছু নয়। সস্তার মদ আর সেও দু আড়াই পেগ। সাড়ে নটা বাজলেই মানে মানে কেটে পড়তে হয়। সে যার বাড়ীতেই হোক।
    আজকের দিনের "ব্যাচেলর" বলে আমার বাড়ীতেই আড্ডা। কল্লোল আবার স্বভাব কবি। সারাক্ষণই কবিতা আওড়ায়। আর দেবু মুচকি হাসে, খুব কম কথা বলে।
    আমি সবিস্তারে ওদের সেই অলৌকিক শানওয়ালার গল্প শোনাই। কল্লোল বলে, ভায়া ,তো তুমি নিজের নাকের নীচেই কী চলছে দেখতে পাও না। তো কেমন করে টের পাবে সেই শানওয়ালা তোমার পিছন থেকে কেমন ভ্যানিস করে গেলো।
    দেবু বলে "একটু চোখ খুলে থাকো হে দীপ্তেন। দিনকাল, বুঝলে না, তেমন সুবিধের ঠেকে না।"
    সাড়ে নটা বাজলে ওরা উঠে দাঁড়ায়। কল্লোল যাবার আগে বলে যায় "অন্ধ থাকলেই কিন্তু প্রলয় আটকানো যায় না"।
    দেবু হেসে বলে"ফেমাস লাস্ট ওয়ার্ড। অ্যান্ড গুড নাইট"।

    ১১
    রাতে খেতে বসেছি তখন রমার ফোন এলো। উচ্ছ্বল,উত্তেজিত গলা। খুসী, খুব খুসী। রাতে ডিনার করেছে কার বাড়ীতে - একেবারে অথেন্টিক অন্ধ্র কুইজিন, কিন্তু অতো ঝাল ছিলো না। কাল খুব ভোরেই দর্শনের ব্যবস্থা আর তার পর কার এক আমবাগানের মালিকের বাড়ীতে যাবে। বিকেল গড়ালেই রওয়ানা হবে, রাতে পৌঁছাবে। "আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না। আমরা পথেই কোথাও খেয়ে নেবো। তুমি কাল কী খাবে?"
    আমি খাওয়ার ফিরিস্তি দেই। ফোনে শুনতে পাই টিভির আওয়াজ। "ও বাচ্চুতো, ইওরোপে ফুটবল হচ্ছে আর আমেদাবাদে ক্রিকেট। দুটো'র কোনোটাই ছাড়তে পারছে না। চ্যানেল ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখে যাচ্ছে পাগোলের মতন। "হি হি হি করে হাসে রমা।

    ১২
    সকালে এ ঘর ও ঘর ঘুর ঘুর করি। রমা তো এইসময়ে ওর স্কুলেই থাকে। আমার সময় কাটে ঘড়ি দেখে দেখে। কী মনে হল বারান্দায় গিয়ে দেখি - ও বাবা। এতো তাজ্জব ব্যাপার।
    সেই শানওয়ালা। সেই জাদুগর। নোংরা পোষাক, ধুলোটে সর্বাংগ। চুলে জট। হাঁ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের তিনতলার বারান্দার দিকে, যেন জানতোই আমি এসে উঁকি দেবো।
    অহো, ঠাকুরের কী কৃপা। আমি ছুরি কাঁচিগুলো জড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে নামি। নাঃ, ভ্যানিশ হয় নি। ঐ ত্তো দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কেমন মাটীর গন্ধ। চোখদুটো বড়ো ঘোলাটে।
    নিঃশব্দে আমার কাছ থেকে ছুরিগুলো নেয়। চাকার ঘষায় ফুলকি ওঠে। তারাবাতির মতন ফুলকি ওড়ে। ঝকঝক করে ওঠে ছুরিগুলো। যেন সোনার তৈরী। আমি ওর হাত থেকে নেই ধারালো ছুরিগুলো। "কিতনা?" আমি প্রশ্ন করি। সে কী উত্তর দেয় বুঝতে পারি না। আমি একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিলে সে মাথা নাড়ে - নিজের ছেঁড়া পকেট চাপড়ায়। খুচরো চায়। আমি বলি অপেক্ষা করতে, সে আমার দিকে অস্বচ্ছ চোখে তাকায়। তার ঘোলা চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগে। সে কাঁদে। আমার বড় অস্বস্তি হয়। এ কি পাগল না কি? হয়তো সারাদিন ঘুরে ক্ষিদে পেয়েছে। বা পায়ের ব্যাথায় কষ্ট পায়। সে কেনো কথা বলে না।
    কিন্তু খুব বিষাদে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
    তার নোংরা মাটীর গন্ধওলা হাত দিয়ে সে আমায় একবার খুব স্নেহে স্পর্শ করে। আমি লক্ষ্য করি তার কালচে নখ, ব্যাঁকা ত্যারা আঙুল। সাদা খড়ি ওঠা কনুই।
    আমি খুচরো আনতে ওপরে উঠি। আর ফিরে এসে, আমি তো জানতাম, আর তাকে দেখতে পাবো না। কোথাও নেই। রাস্তার দু দিকে তাকাই। মানুষ, একটা দুটো কুকুর। টেম্পো। অটো। দু চাকা চলছে ছুটে। মায়ের সাথে বাড়ী ফিরছে শিশু। কিন্তু সে নেই।শুতে যাবার আগে মনে হল কি জানি একটা কথা ছিলো, না কি কোনো কথাই ছিলো না।

    ১৩
    বেশ রাতেই ফেরে রমা। চোখ মুখ উচ্ছ্বল উজ্জ্বল। খুসীতে ঝল মল করে। ঐ রাতেই আমাকে বলে তিরুপতির লাড্ডুটা খেতে। "প্রসাদ তো, খেয়ে নাও না"। "ক্যামন জানি টেস্টটা" আমি বলি।
    অনেক গল্প আছে রমার। কিন্তু ক্লান্ত। আমি ওর পাশে শুয়ে ওর গাঢ় প্রশান্ত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

    ১৪
    ঘুম ভাঙলো। না কি স্বপ্নই দেখছি। কিন্তু অবশ হয়ে আছে শরীর। পাথরের মতন , নিথর। একটা আঙুলও নড়াতে পারছি না। বাঁ হাতের কবজিতে একটা ধারালো ব্যাথা। একটা নরম উষ্ণতার ভাব।একটা তরল গড়িয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। নদীর মতন। এঁকে বেঁকে যেমন যায় পাহাড় ও উপত্যকার মধ্য দিয়ে।

    ১৫
    কিছু স্বপ্নের মতন গন্ধ আমায় আচ্ছন্ন করে।
    ভোর রাতের এক ফালি চাঁদের টুকরোর গন্ধ, গনগনে রোদে নদীর পাশে তপ্ত বালির গন্ধ, শিশির ভেজা শিউলির গন্ধ, ইলেকট্রিক তারের আগুনের গন্ধ, রমার ব্লাউজে তামাকের গন্ধ, আমার ছোটোবেলার মায়ের সেই লাল সবুজ চেককাটা শাড়ীর গন্ধ।
    আমি স্পর্শ,বর্ণ ,স্মৃতি সব মনে করতে চেষ্টা করি। পারি না। কেমন ঘোর লেগে যায়।
    মনে হল গভীর নিশুতি রাতে কেউ যেন নিঃশব্দে খুব ধারালো ছুরি দিয়ে আমার বাঁ হাতের কবজিতে, কেউ যেন আড়াআড়ি চিড়ে দিল। সেই অলৌকিক শানওয়ালার ধার লাগানো ছুরি। আলো ঠিকরানো ছুরি।
    কার হাতে ছিল সেই ছুরি? আমার হাত, রমার হাত?
    আমি চেষ্টা করেও তাকাতে পারি না। আমার ব্যাথাও আর অনুভব করতে পারি না।আমি কথা বলতে পারি না। আওয়াজ করতে পারি না।

    ১৬
    একবার দেখতে পাই সেই শানওয়ালার চোখ। তার মুখে মাটী লেগে ছিল। তার চুলে ছিলো হাজার বছরের ধুলো। সে আমার দিকে দারুন বিষাদে দেখেছিল।
    আর কিছু না। থেমে যাওয়া বৃষ্টির পর ভেজা পাতার থেকে যেমন পড়ে,পড়ে যায় টুপ টাপ জল । সে রকম, টুপ টুপ টুপ টুপ করে রক্ত ঝরে পড়ে যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ | ১৩৩৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চম - dd
    আরও পড়ুন
    দ্রোণ পর্ব - dd
    আরও পড়ুন
    কর্ণসংহার - dd
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • avi | ***:*** | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:০৯61212
  • খুব ভালো। স্ট্যান্ডিং ওভেশন।
  • শঙ্খ | ***:*** | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০৯:৩৪61209
  • টানটান লেখা,একটানা নেশার ঘোরে পড়ে গেলাম। ১৫ নম্বর প্যারাটি পিংক ফ্লয়েডের কম্ফর্টেবলি নাম্ব মনে করালো।
    স্ট্যান্ডিং ওভেশান।
  • a | ***:*** | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ১০:৫৭61210
  • বাহ্‌, বেশ লাগল। খুবই ভাল। পড়তে পড়তে হাল্কাভাবে মনে আসছিল "কীট"।
  • dc | ***:*** | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ১১:০২61211
  • দুর্দান্ত।
  • h | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:৩৭61219
  • ভালো লেগেছে। ইনহেলার এর এপিসোড টা না থাকলে কি আরো জমত?
  • i | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩২61213
  • ভীষণ ভালো লাগল।
  • শিবাংশু | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৫:১১61220
  • টিপিক্যাল dd ঘরানা। জয় হোক...
  • একক | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৫:১৮61221
  • পড়ে ফেল্লুম । ভালো -মন্দ কী বলবো ? বেশ খোশবাই বেরিয়েচে , তবে ঝোলটা একটু মরলে , রুটি দিয়ে জমতো । ভাতের মুখে ফাসক্লাস ।
  • Phutki | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৫:৫৫61214
  • ৪ এর পর থেকেই সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম পড়তে পড়তে। টানটান।
  • anag | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৭:৩১61215
  • ডিডিদা দীর্ঘজীবী হোন। সোনার কলম ইত্যাদি -
  • AP | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৯:৫৯61216
  • মুগ্ধ এবং...
  • d | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ১০:৪৫61217
  • বাপরে! মারাত্মক তো!
  • Arpan | ***:*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭ ১১:৩২61218
  • শান দেওয়া ছুরির মত ঝকঝকে, ছুঁয়ে দেখতে গেলে হাতে চেপে বসে।

    ডিডিদাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন।
  • কল্লোল | ***:*** | ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩61222
  • একি আমাদের দীপ্তেন? ফ্রান্জ দীপ্তেন।
  • de | ***:*** | ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:১৩61224
  • আরিব্বাস! ক্ষী সাংঘাতিক!
  • ranjan roy | ***:*** | ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০৬:১৩61225
  • বড্ড কম লেখো ডিডি!
    হয়ত এই ভালো, তাই লেখাগুলো বাঁকানখ ছুরির মত ধারালো।
  • Blank | ***:*** | ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০৯:২১61223
  • ভালো লেগেচে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন