এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • চম

    dd লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | ২০২২ বার পঠিত
  • চম

    সিরিয়ে লিওন - ২০১৬, ১ ডিসেম্বর
    ****************************

    জর্জি যুবক ডেভিড ব্রাউন ট্রেকিং পাগল। কিন্তু একটু অচেনা অজানা যায়গা না হলে তার ভালো লাগে না। মহাজনপন্থা ধরে বিখ্যাত সব ট্রেকিং রুট - যেগুলি ক্রমশঃই এক একটা ট্যুরিস্ট স্পট ওঠে, ডেভিড সেগুলো থেকে দূরেই থাকে।
    পশ্চিম আফরিকার এই দেশ খুব সম্প্রতিই ভয়ানক গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে উঠেছে। এখনো দেশটা ক্ষত বিক্ষতই আছে। সাধারন পর্য্যটকেরা তাই খুব একটা ভীড় বাড়ান না এখানে। আর যারাও আসে তারা ঐ শহরের পাশ ঘেঁষে বেলাভূমিতেই ঘোরাঘুরি করে বাড়ী ফিরে যায়।

    তবে ডেভিড তো সেরকম "শখের পর্য্যটক" নয়। এই অখ্যত দেশটার উত্তর অঞ্চলে আছে এই দেশের সব থেকে উঁচু পাহাড়। নাম বিন্টুমানি। পাহাড় - তবে খুব উঁচু কিছু নয়। দুইদিন ট্রেকিংএই পাহাড়ের চুড়ায় ওঠা যায়। সব মিলিয়ে চারদিনের ট্রেক। অনেকেই পুরো ট্রেকিংটা তিনদিনেও সারেন।তবে পর্যটকদের অভাবে কোনো সুব্যবস্থা কিছু নেই।
    যখন নদী নালা শুকিয়ে যায় বা কম জল থাকে তখন মেঠো রাস্তায় জীপ চালিয়ে এই বিন্টুমানি পাহাড়ের কাছের গ্রামে যেতে হয়। এই দেশে গাঁওবুড়োর প্রতিপত্তি খুব। তার অনুমতি ছাড়া পাহাড়ে ওঠা যায় না। অল্পস্বল্প পয়সা দিতে হয় তাকে। আর সেইই যোগার করে দেয় গাইড কাম কুলি। পেশাদার তো নয়, গ্রামেরই কোনো ছেলে ছোকরা। ট্রেকিংএর সেরকম চেনা রুটও কিছু নেই। প্রথমটায় থাকে ঘন জংগল, তার ওপর উঠলে ফাঁকা,পাথুরে জমি।

    কাবালা নামে এক ছোট্টো শহর থেকে গাড়ী ভাড়া করে ডেভিড এলো ইয়েফিন নামের গ্রামে। গাড়ীর ড্রাইভার ফিট্টি দোভাষীর কাজও করেছিলো। স্থানীয় কিরো তো ওর মাতৃভাষা, আর চলনসই ইংরেজী ও বলতে পারে। ওর ব্যবস্থাতেই ডেভিড গ্রামের দুটো কিশোর ছেলে পেলো- গাইডের কাজ করবে আর কিছুটা কুলিরও।

    পরের দিন ভোর থাকতেই ডেভিড রওয়ানা হওয়ার সময় ফিট্টি এলো খুব চিন্তিত ভাবে। বললো যতো তাড়াতাড়ি পারো ফিরে এসো। আমি এই গাঁয়ে বেশীদিন অপেক্ষা করতে পারবো না। তুমি ফিরলেই আমি সোজা নিজের শহরে ফিরে যাবো- এক মুহুর্ত্তও আর অপেক্ষা করবো না।

    তিনদিন পর ডেফিড ফিরতেই, সেই খবর পেয়েই প্রায় ছুটে এলো ফিট্টি। এক্ষুনি চলো - সে জানায়। ডেভিডের ইচ্ছে ছিলো একটু স্নান টান করে পরিষ্কার হয়ে নেয়। ধুলো আর ঘামে শরীরটা র জবজব করছে কিন্তু ফিট্টি এক মিনিট সময় দিতেও নারাজ। ওর গোঁ দেখে ডেভিড আর কথা বাড়ায় নি।

    গ্রাম ছেড়ে রওয়ানা হতেই ফিট্টি বললো, এক ধরনের অপদেবতা মানুষের উপর ভর করছে। মানুষকে একেবারে জড়বুদ্ধি করে দিচ্ছে আর তারপর সেই মানুষ নিজেই রাক্ষস হয়ে যাচ্ছে। অন্য মানুষদের মেরে কাঁচা মাংস চিবিয়ে খাচ্ছে।
    কিরো ভাষায় চিবোনোকে বলে চম। ফিট্টি বল্লো মানুষ চম হয়ে যাচ্ছে।

    অল্প কিছুদিন পরেই এই চম কথাটা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে।

    ফিট্টি এই গাঁয়ে এসেই জানতে পেরেছিলো এই কথা। ডেভিডকে তখন'ই বারন করে নি বিন্টুমানিতে উঠতে কিন্তু ঐ গাঁয়ে থাকতে তার ভয় করছিলো। গাঁয়ের আশেপাশেই না কি মানুষেরা চম হয়ে যাচ্ছে।

    যে তিনদিন ডেভিড ট্রেকিং'এ ব্যাস্ত ছিলো - সেই সময়েই সারা গাঁয়ে আতংক আরো বেশী করে ছড়িয়ে পড়ে। আর ডেভিড গ্রামে ফিরবার একটু আগেই না কি একজন গ্রামবাসীর উপর সেই অপদেব্তা ভর করেছিলো।

    ডেভিড খুব হু হা করে উড়িয়ে দেয় না। একে তো দারুন রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে এই দেশটা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তায় বছর তিনেক আগেই এক মারাত্মক ছোঁয়াচে ভাইরাল অসুখ দেশটাকে আরো দুর্বল করে দিয়েছিলো। এবোলা ভাইরাসকে মোটামুটি ভাবে কবজায় আনা গেছে। কিন্তু এই ধরনের দুঃস্মৃতি নানান হিস্টিরিয়ার জন্ম দেয়।

    সে শুধু একবার জিজ্ঞেশ করে ফিট্টিকে, ঐ অপদেবতা ভর হলে কী হয়? ফিট্টি বলে প্রথমে মানুষটা একেবারে উল্টোপাল্টা কথা বলতে থাকে- পরে আর কথাও বলে না, শুধু দুর্বোধ্য আওয়াজ করে। তার পরে চুপ করে যায়। পুরো ঘটনাটাই ঘটে তিন চার দিনের মধ্যে। তারপরে তার সারা গা ফুঁড়ে এক ধরনের পোকা বের হয় আর ঐ সময়েই সেই মানুষটা আর মানুষ থাকে না। সে শুধু মানুষের মাংস খেতে চায়। সামনে যাকে পায় তাকে কামড়ে দেয়। আর তার শিকার যদি মারা না যায় তাহলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেও আবোল তাবোল কথা বলতে শুরু করে।

    নিউ ক্যাসেল, ২০ জানুয়ারী ২০১৭
    **************************************

    সারাদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর বেশ শীত। তবে নিউ ক্যাসেলে যেরকম রক্ত জমানো ঠান্ডা পড়ে সে তুলনায় কিছু নয়। ডেভিড ঘড়ি দেখছে। এই অফিস শেষ হলেই সে ছুটবে তার ক্লাবে। তার আজ স্কোয়াশ খেলার দিন। বেশ চার পাঁচ সেট খেলে গা গরম করে অতঃপর দু পাঁইট বিটার খাওয়া যাবে।

    হঠাৎ ফোন বাজে ডেভিডের । অপরিচিত নম্বর। ফোন তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে এক মহিলার গলা। "আমার নাম অ্যান। আমি ওয়ার্ল্ড হেল্থ ওর্গানাইজেশনে চিকিৎসকের কাজ করি। আপনার সাথে এখন দেখা করতে চাই"।

    -"কী ব্যাপারে? তাছাড়া আমি এখন'ই আমার ক্লাবে যাবো।"
    মহিলার গলা খুব দৃঢ় শোনায়। "না, এটা খুব, খুবই জরুরী তলব। খুবই জরুরী। "

    ডেভিড শান্ত মাথার ছেলে। বিরক্ত হলেও বোঝে এটা কোনো আড্ডার ব্যাপার নয়। "এখন কোথায় আছেন? কোথায় দেখা করতে হবে? ডেভিড প্রশ্ন করে।

    "আপনার অফিসের সামনেই আমরা অপেক্ষা করছি।"অ্যান জানায়। "এখুনি চলে আসুন"। না অনুরোধ নয়। এ একেবারে তলব। অ্যানের উচ্চারণটা কিন্তু ঠিক বৃটীশ নয়। তবে অ্যানের গলার স্বর শুনেই মনে হয় আদেশ, হুকুম দিতে সে খুবই অভ্যস্ত।

    *********

    ডেভিড ল্যাপটপ নিয়ে আপিসের বাইরে আসতেই দুজন লোক - মাঝ বয়েসী এবং সাধারন পোষাক পরা - কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় কোনো সামরিক শিক্ষা পাওয়া লোক, কোনো কথা না বলেই তাকে প্রায় টেনে এক গাড়ীতে বসিয়ে দিলো পিছনের সীটে। নিজেরা সামনে বসল।

    ডেভিড দ্যাখে এক্জন এশিআন মহিলা। প্রৌড়ই বলা যায়।কোনো রকম সম্ভাষণ না করেই মহিলা বলেন "আমি অ্যান। জন্মসূত্রে কোরিয়ান। এটা আমার ক্রিশ্চিয়ান নাম, যাতে ককেসিয়ানদের বুঝতে সুবিধে হয়। আপনি তো গত মাসেই সিরিয়া লিওনএ গেছিলেন। প্রায় দেড় মাস হল ফিরেছেন। কোনো রকম অসুস্থতা কি বোধ করেছেন?'অ্যানের পোষাক খুবই কেতা দুরস্ত - যাকে বলে স্মার্ট, বিজনেস ড্রেস। হাতেও গুগুলের ঘড়ি। আংটি নেই। কোনো প্রসাধনও নেই।
    ডেভিড মাথা নাড়ে। ভদ্রমহিলা খুবই কাঠ কাঠ কথা বার্ত্তা বলেন দেখছি।

    অ্যান চুপ করে থেকে বলে আপনাকে সবই বলছি। তবে গাড়ীতে নয়। এখন আমরা যাবো হোটেল ইন্ডিগোতে। সেখানে গিয়েই কথা বার্ত্তা হবে।

    বাকী রাস্তাটা চুপ করেই থাকেন মহিলা। ডেভিডো কথা বলে না। সে এমনিতেই চুপ চাপ ধরনের মানুষ। আর এটাও বুঝতে পেরেছে এই মহিলা ও তার সংগীরা চোর ডাকাত কিছু নয় তবে এরা প্রত্যেকেই বেশ কতৃত্ত্বশালী লোক, লোককে আদেশ করতে পারে দ্বিধা ছাড়াই।

    হোটেল ইন্ডিগো
    *****************
    গাড়ী থেকে নেমে অ্যান আর অন্য কোনোদিকে না তাকিয়েই গট গট করে হেঁটে চলে। তার পিছন ফিরে দেখবার প্রয়োজনও নেই ডেভিড ও পিছনে পিছন আসছে কি না !

    সোজা হোটেলের কফিশপে ঢোকে। তার পিছনেই ডেভিড। অ্যান কোনের এক টেবিলে বসে। সপ্তাহান্তের ভীড় তখনো শুরু হয় নি। সারা রেস্টুরেন্টে এক কোনে এক অল্পবয়স্ক দম্পতি - তো তারা নিজেরাই মশগুল। অ্যান আর ডেভিড আরেক কোনে বসলে, সেই দুই বডিগার্ড কাছেরই আরেকটা টেবিলে বসে পড়ে - তাদের সদা সতর্ক চোখ নিমেষে রেস্টুরেন্টের ভিতরটা দেখে নেয়।

    অ্যান কফির অর্ডার দেয় এবং যতক্ষন ওয়েটার এসে কফি না দিচ্ছে ততক্ষন ঘাড় নীচু করে তার হ্যান্ডসেট থেকে কাজ করে যায়। ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেলে অ্যান মুখ তুলে তাকায় ডেভিডের দিকে। "সামান্যই কথা আছে আমাদের। আপনি এক মাস হল মাউন্ট বিন্টুমানি থেকে ফিরেছেন। ওখানে যখন গেছিলেন তখন এক সংক্রামক অসুখের কথা শুনেছিলেন। আমাকে বলুন ঠিক কী কী শুনেছিলেন।

    ডেভিডের যতটুকু মনে ছিলো সবটাই বলে।
    অ্যান বলে"আমরা খবর পেয়েছি ওখানে কিছু একটা ঘটেছে। আমাদের রিসার্চ টিম তখুনি পৌঁছেছে এবং কাজ শুরু করে দিয়েছে। এর আগে, বছর তিনেক আগে এবোলা ভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়েছিলো তখন অনেক চিকিৎঅক আর নার্স সেই রোগে মারা যান। এটা যে একটা ছোঁয়াচে অসুখ সেটা বুঝতে আমাদের দেরী হয়েছিল। আপনাকে আমার আর প্রশ্ন করার নেই। আপনাকে এইবারে আমাদের সংগী নিয়ে যাবে একটা ক্লিনিকে, সেই খানে আপনার কয়েকটা পরীক্ষা করা হবে। ঘন্টাখানেক লাগবে। ব্যাস। তারপর আপনি ক্লাবে যান বা বাড়ীতে - কোনো চিন্তা নেই।" টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অ্যান বলে"আবারও বলি। ঘুনাক্ষরেও এ নিয়ে কোনো কথা কাউকে বলবেন না"।

    "আমি খুবি একাকী মানুষ। বন্ধুটন্ধু তেমন নই। চুপচাপ মানুষ। আমি কাউকেই বলবো না।"ডেভিড বলে"তবে আপনাকে একটা প্রশ্ন ছিলো। আপনি ফোনে আমাকে বলেছিলেন আপনি WHO'র একজন ডাক্তার। সেটা বোধহয় সত্যি নয়। তাই না?"

    অ্যান এবারে একটু মুচকি হাসে" না।আমি ডাক্তার নই। আর যে সংস্থায় কাজ করি সেটা না জানাই ভালো।আচ্ছা,গুডবাই"।
    কয়েক মাসের মধ্যেই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে এই চমের আতংক। সভ্যতা এক ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে।
    ততদিন পর্যন্ত্য ডেভিডের আর কোনো ভুমিকা থাকবে না।

    লাইখেনস্টাইন, ভাডুজ, ২০ মার্চ,২০১৭
    *******************************
    ডেভিড ব্রাইনের সাথে সাক্ষাত হওয়ার একমাস পরেই এই মিটিং। মিটিংএর উদ্যোক্তা প্যানডেমিক রিসার্চ ওর্গানাইজেশন বা সংক্ষেপে পি আর ও।

    নব্বইর দশকে পর পর দুটো মহামারী,চিকেন ফ্লু আর সোয়াইন ফ্লু সারা দুনিয়াকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। কোনো রকমে সেই সংক্রমন কে ঠেকানো গেছিলো এবং পরে দেখা গেছিলো যতোটা ভয়ে পাওয়ার মতন গুজব রটেছিলো, ঐ ব্যাধি ওরকম মারাত্মক প্রাণঘাতী ছিলো না। কিন্তু বিশ্বের হোমড়া চোমড়াদের টনক নড়ে। এখন কোনো সংক্রামক অসুখ দুনিয়ার কোথাও হলেই, বাকীরাও আর নিরাপদ নয়। মানুষের গতায়াত চলছেই।
    প্রতিদিনেই প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ আকাশ পথে উড়্র যায় দেশ বিদেশে। আর এই সংখ্যাটা তো বেড়েই চলেছে। সুতরাং এক ঝটকায় সারা দিন্যাই বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে।

    ২০০০ সাল নাগাদ পি আর ও গঠন করা হয়। তখন'ই ঠিক হয় যে এই আন্তর্জাতিক সংস্থা মূলতঃ গবেষণা নিয়েই থাকবে।সত্যি যদি, কোনোদোন দুনিয়া জুরে মহামারী লাগে তাহলে সেই বিপদেরর মোকাবিলার সর্বোচ্চ ক্ষমতা এই সংস্থার হাতেই থাকবে। আরো ঠিক হয়, যদিও গোপন সংস্থা নয় কিন্তু এর কাজ কর্ম যতোটা সম্ভব প্রচার ছাড়াই চলবে। গতো কয়েকবারের মহামারীর আশংকার সময়ে কিছু কর্মকর্ত্তা নানান মিডিয়ায় আসবার লোভে যথেচ্চ ভুল ভাল খবর দিয়ে সকলকে খামোখাই শংকিত করেছিলেন। এইবারে তাই একেবারে সম্পুর্ণ সঠিক খবর সংগ্রহ আর তা যাচাই করে পরিবেষণের খুব জোর দেওয়া হয়। কোনো খবরই যেনো গুজব বা উড়ো খবরের ভিত্তিতে না দেওয়া হয়।

    লাইখেনস্টাইনের ভাডুজ শহর এমনিতেই নেহাৎ পুঁচকে। মেরে কেটে হাজার ছয়েক লোকের ব্সবাস। সেই শহরের'ও বলা যায় শহরতলীতে এক বাংলো বাড়ীতে এই মিটিং। বাড়ীটা বাইরে থেকে দেখে কিন্তু বোঝাই যায় না,এটা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্তার অন্যতম বড় দফতর। না আছে উঁচু পাচিল, না আছে পাহারাদার।

    এগারোজন মানুষ। বিরাট ডিমের মতন টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। রিপোর্ট পেশ করছে অ্যান।
    অ্যান এই সংস্থার প্রধান কো অর্ডিনেটর। তার কাজই হচ্ছে দুনিয়ার সব মহামারী নিয়ে খবর এবং গবেষণা নিজে যাচাই করে মিটিংএ পেষ করা। যাতে কোনো রকম তথ্য বিচ্যুতি না ঘটে।

    অ্যান প্রথমে জানায় যে এই চম রোগের খবরটা সত্য। সে কয়েক্জন আক্রান্ত মানুষের ভিডিও দেখায়। প্রায় সাতশো লোক মারা গেছে । এই রোগে আক্রান্ত হলেই অন্য মানুষকে কামড়ে দেবার এক প্রবল ইচ্ছে হয় ,কিন্তু যা প্রথমে রটেছিলো, যে অন্য মানুষদেরকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে সেই রকম ঘটনা নয়।শুধু একবার কামড় দিয়ে রক্তপাত করেই আক্রান্ত মানুষ তার অন্য শিকার খোঁজে।

    অ্যান বলে, এর কারন বিশ্লেষণ করতে অসুবিধা হয় না। এই রোগে আক্রান্ত মানুষ চায় এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ুক তাই রেবিসএ আক্রান্ত কুকুরের মতন সে কামড়াতে চায়। যাতে ঐ রোগ আরও ছড়িয়ে পড়ে। এটা একটা সচেতন সিদ্ধান্ত। ক্ষিদের জ্বালায় বা নিছক আক্রোশ বা স্রেফ পাগলামী নয়।
    দু নম্বর পয়েন্ট,অ্যান বলে, এই কামড়ানো শুধু অন্য মানুষের উপরেই। অন্য কোনো জীবের উপর নয়।

    আর তিন নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে এই কামড়ে দেওয়ার পরেই,সে একবার হোক বা কয়েকবার , রোগীএকেবারে নেতিয়ে পড়ে। যেনো কামড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই তার প্রাণশক্তি চলে গেছে। সে প্রায় কোমার মতন অচৈতন্য হয়ে পড়ে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত হলে তার নাক চোখ মুখ, সব রন্ধ্র দিয়ে খুব ছোটো এক ধরনের সাদা পোকা বেরিয়ে আসে,খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না। ।

    আপনারা আগে এক এক করে রিপোর্ট গুলো শুনুন। আমি প্রথমে যাবো শিকাগোতে আমাদের মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে। ডক্টর কারস্টিন লারসুন তার রিপোর্ট দেবেন।
    অ্যান ভিডিও মনিটর অন করেন।

    শিকাগো। নেপারভিল।
    ***********************

    ইওরোপে তখন দুপুর দুটো। শিকাগোয় তখন সন্ধ্যা সাতটা। কারস্টিন খুবই চিন্তিত দেখা গেলো। কপালে স্পষ্টই ভাঁজ। কথা বলতে বলতে বার বারই মাথায় হাত দিয়ে টিপছিলেন তার কপাল।

    "আমরা দুজন আক্রান্ত লোককে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। স্ট্রেইট জ্যাকেট পরিয়ে ,মিলিটারী প্লেনে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে আসা হয়েছিলো আমাদের ল্যাবে। তাদের উপর পরীক্ষা করে কতকগুলো - না ঠিক সিদ্ধান্ত নয় - কিন্তু বলতে পারেন একটা দিক নির্দেশ পেয়েছি।

    এক , যে সংক্রমন হয়েছে সেটিকে কোনো একটি নিদৃষ্ট পরিচয় দেওয়া যায় না। ভাইরাস? হতে পারে। অথবা কোনো প্রাণী বা কোনো ফাংগাস। বা বীজগুটি। কেনো না ঠিক একই ধরনের জীব নয়, বরং অনেকগুলি আলাদা ধরনের জীব সমষ্টি আমরা খুঁজে পেয়েছি। আর এদের মধ্যে রয়েছে ভয়ানক দ্রুত পরিবর্ত্তনের ক্ষমতা।

    আচ্ছা, এইখানটায় বুঝিয়ে বলি। আপনারা পর্তুগীজ ম্যান ও' ওয়ার এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।যার বৈজ্ঞানিক নাম ফিসালিয়া ফিসালিস। জেলি ফিসের মতন এই প্রানী অ্যাটলান্টিক সাগরে প্রচুর পাওয়া যায় -অন্য সাগরেও থাকে। এই ভয়ানক বিষাক্ত প্রানীটি কিন্তু একটি মাত্র প্রাণী নয়, বরং গোটা চারেক সম্পুর্ণ আলাদা প্রাণের সমষ্ঠি। এরা একইসাথে এমন ভাবে থাকে যে মনে হয় এরা একটিই প্রাণী। আসলে এই ভাসমান কলোনী হচ্ছে চারটি প্রাণী বা পলিপের সমষ্ঠি। এদের কেউ পুরো কলোনীকে ভাসিয়ে রাখে, কেউ শিকারকে বিষ প্রয়োগ করে আর একটি তো শুধু সকলের হয়ে খাবার হজম করে। এরা আলাদা হলেও একসাথে না থাকলে টিঁকতে পারে না।

    আমরা চম রোগের আক্রান্ত মানুষের শব ব্যবচ্ছেদ করে যেটুকু জানতে পেরেছি যে এদেরকে আক্রমণ করেছিলো একটি নয়, অনেকগুলি জীব। পোকা বলতে পারেন, বা ভাইরাস বা ছত্রাক।কিন্তু এরা কাজ করে এক যোগে।

    সব থেকে চিন্তার ব্যাপার আমরা এখনো এই রোগে মৃত মানুষগুলির শব ব্যব্চ্ছেদ করে নানান পরীক্ষা করে যাচ্ছি, কিন্তু একটা কোনো নিদৃষ্ট প্যাটার্ন পা্ছি না।মানে একটা দেহে হয়তো এরকম চারটি জীবের সন্ধান পেলাম তো আরেক দেহে পেলাম ছটি। এবং সব ক্ষেত্রেই একই জীব দেখছি না। যার ফলে আমরা সন্দেহ করছি এরা ক্রমাগত মিউটেট করে যাছে।
    আর শুধু জীবই বা বলি কেনো, কয়েকটি দেহে পেয়েছি অতি ক্ষুদ্র ক্রিস্টাল। সেগুলিও নানান কেমিক্যাল নিঃসরণ করে।
    ক্রিস্টিনা একটু থামেন।

    বলেন এই শিকাগোর ল্যাবে শুধুমাত্র মৃত আক্রান্ত লোকেদের উপরেই নানান পরীক্ষা করা হয়েছে। যে কজন এই রোগে আক্রান্ত ও জীবিত , তাদের কয়েকজনকে আমরা বলতে গেলে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছি। তাদের উপর পরীক্ষা চলেছে আমাদের ওকিনাওয়ার ফেসিলিটিতে।

    অধিকর্ত্তাদের একজন বাধা দেন , বলেন "ক্রিস্টিনা, আপনি কি সবটাই বলেছেন ? আমি তো শুনেছিলাম শব ব্যবচ্ছেদ করে আপনারা আরো কিছু জানতে পেরেছেন, বেশ ভয়ংকর কিছু"। ক্রিস্টিনা খুব বিচলিত হাসি হাসেন।"না, ব্যাপারটা গোপন নয়। ইয়ামমতোর পর আপনাদের মধ্যেই উপস্থিত প্রাণীবিদ ডক্টর জাসিম আছেন। তিনিই পুরোটা বলবেন তার প্রেসেন্টেশনে। তাও ও আমি বলে দেই। হ্যাঁ শব ব্যবচ্ছেদ করে দেখেছি মৃত মানুষগুলির মগজটি সম্পুর্ণ উধাও। মানে এই ভাইরাস বা যা কিছু বলেন, সেগুলি আক্রান্ত মানুষের ঘিলু খেয়ে ফেলে। সেটাই ওদের খাদ্য।যা হোক ,আপনারা এইবারে ইয়ামামতোর কাছে শুনুন।তিনি আপনদের জানাবেন তিনি কী কী দেখেছেন।

    ইশিকাগি শহর । সানসেট বীচ। সকাল দশটা
    *************************************

    ইয়ামামতোকেও চিন্তিত দেখায়।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উনি সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে কাজ করেছেন। সিরিয়া লিওনেও এবোলা মহামারী নিয়ে অনেকদিন মাঠে ঘাটে ঘুড়েছেন। পেশায় ডাক্তার হলেও ওনার স্পেশালিটি হল কোনো মহামারী কী করে ছড়িয়ে পড়ে সেটা নিয়ে গবেষনা করা। এই কাজের জন্য ওনাকে অনেক ভাষাও শিখতে হয়েছে। পথে ঘাটে সাধারন মানুষে কী ভাবে, কেমন ভাবে জীবন কাটায় , এ সবই তাকে জানতে হয়।

    কোনো ভূমিকা ছাড়াই উনি সরাসরি বলেন, "দেখুন, আমার একমাত্র জানার ইচ্ছে যে কেনো এই রোগে আক্রান্ত মানুষেরা অন্যকে কামড়াতে যায়। সত্যি তো ওরা ক্যানিবাল নয়। ক্ষিদের জন্য নয়। অহৈতূকী হিংস্রতাও নয়। আমি যেটুকু চর্চা করে দেখেছি এই রোগীরা শুধু মানুষকেই কামড়াতে চায়, অন্য কোনো জীব জন্তুদের নয়।

    এর কারন এরা চাইছে রোগটা ছড়িয়ে পড়তে। আমি এদের লালা বিশ্লষণ করে দেখেছি যে এই অসুখের যাবতীয় গুটিবীজ, ভাইরাস এই সবই খুব বেশীমাত্রায় এদের মুখের লালায় রয়েছে। এদের অন্য মানুষদের কামড়ে দেওয়ার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই - শুধু রোগটা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া।

    কিন্তু এরা কেনো এমন করে? সামনে অন্য মানুষ না থাকলে এরা নিস্তেজ হয়ে থাকে, ঝিমায়। কিন্তু সুস্থ মানুষ দেখলেই কামড়াতে ছোটে। আমরা দুজন,তিনজন করে আক্রান্ত মানুষকে এক সাথে এক ঘরে রেখে দেখেছি - কেউ কাউকে নজরই দেয় না।কিন্তু কোনো সুস্থ মানুষ হরে ঢুকলেই এরা পাগল হয়ে যায়।
    প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে, নিজেদের হাত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে প্রাণপন চেষ্টা করে। কোনো ব্যাথা বেদনাই গ্রাহ্য করেনা।

    মিটিং থেকে একজন প্রশ্ন করেন "কী ভাবে এরা টের পায় কে আক্রান্ত কে সুস্থ মানুষ ?"

    "গুড কোয়েশ্চেন।" ইয়ামমতো সায় দেন। "এরা গন্ধ পায়। বা অন্য কোনো ভাবে জানতে পারে। চোখ বেঁধে রাখলেও, বা নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে , এরা ঠিক টের পায় । কাছাকাছি কোনো সুস্থ মানুষ আসলেই এরা ভয়ানক উতলা হয়ে ওঠে। তখন আর এদের আর কোনো কান্ডজ্ঞান থাকে না। কাঁচের ঘরে এদের রাখা হয়। সাধারন মানুষের পক্ষেঐ ঘরের বাইরে কোনো মানুষের গন্ধ পাওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো ভাবে এরা টের পায়। হয় গন্ধ বা রেডিয়েশন। "

    “ইয়ামামতো বলেন " এই নিয়ে আমি আরো অনেক বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করেছি। নিকোলা বেটস এই ব্যাপারে এক পন্ডিত। উনি একজন প্রকৃতিবিদ। তবে ওর স্পেশালিটি হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে যে কয়েকটি প্রজাতির পোকা ,এমন কি ছত্রাকও অন্য প্রাণীদের সংক্রমন করে তাদের একেবারে বোধহীন করে তোলে তাদেরকে নিয়ে। এই ছবিগুলি দেখুন -
    কোস্টারিকায় এই ধরনের এক বোলতা রয়েছে যারা বেছে বেছে প্লেসিওমেটা আর্গাইরা নামে মাকড়সাকে হুল ফুটিয়ে দেয় । আর সেই মাকড়সাও তখন এক বিশেষ ধরনের জাল বুনতে শুরু করে। সাধারন যে জাল বোনে শিকার ধরার জন্য, তার থেকে একেবারেই আলাদা ধরনের। অনেক শক্তপোক্ত। সেই জাল বুনে তার মধ্যে সে বসে থাকে - একেবারে নির্জীব হয়ে। ইতিমধ্যে সেই বোলতা, যার লাতিন নাম হাইমেনোপিমেসিস আর্গাইরাফবা, সেই জালের মধ্যে তার ডিম পেড়ে যায়। ডিম ফুটে তার বাচ্চারা ঐ মাকড়াসাকে ধীরে সুস্থে খেয়ে ফেলে। “
    বা ধরুন ল্যানস্লেট লিভার ফ্লুক - যা এক ধরনের ফিতে ক্রিমি - সেটি কোনো পিঁপড়ে যদি খেয়ে ফেলে সে তখন ঘাসের উপর উঠে চুপচাপ বসে থাকে, যাতে কোনো তৃণভোজী প্রাণী তাদের সহজেই খেয়ে ফেলতে পারে, কেনো না সেই তৃণভোজী প্রাণীদের পেটেই ঐ ফিতে ক্রিমি বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার করবে।
    আরো অনেক উদাহরন আছে। আমি আর একটাই বলব। সমুদ্রবাসী হর্ন স্নেইল এক ধরনের শামুক যার লার্ভা এক ধরনের মাছের কানকো দিয়ে ঢুকে তার মগজে পৌঁছে যায়। তখ্নই সেই লার্ভা সেই মাছের মগজে সেরোটনিন কমিয়ে দিয়ে ডোপামাইন বাড়িয়ে দেয়। জানেনই তো এই ডোপামাইন ক্ষরণ বেশী হলে সব প্রাণীই উত্তেজিত বোধ করে। ফলে সেই মাছটিও প্রচন্ড লাফ ঝাঁপ শুরু করে দেয় - যেটি একেবারে আত্মহত্যার সামিল। ঐ শামুকের লার্ভাও তাইই চায়। ঐ লাফ ঝাঁপে আকৃষ্ট হতে পাখীরা সহজেই সেই মাছটিকে খেয়ে ফেলে আর সেই পাখীর পেটে গিয়ে সেই লার্ভা তাদের প্রজনন শুরু করে দেয়।

    দেখুন, আরো অনেক উদাহরন আছে। কিন্তু আমি আর সংখ্যা বাড়াতে চাই না। আমারও নিজস্ব ধারনা এই চম রোগ আসলে এক পরজীবীর আক্রমন যারা মানুষকে তাদের ফসল হিসেবে দেখতে চায়।

    "মাইন্ড কন্ট্রোল?"

    "হ্যাঁ। তাই ই। জীবজগতে এটা আদৌ অপ্রচলিত নয়। এমন কি প্রাণীদের উপর ছত্রাকের আক্রমনও চলে"।

    " কিন্তু এই আক্রান্ত রোগীরা কতদিন বাঁচে? একজন প্রশ্ন করেন।

    ইয়ামমতো বলেন "ছদিন, সাতদিন। যদি অন্য কোনো মানুষকে কামড়ে এরা সংক্রমন ছড়িয়ে দিতে পারে তাহলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই প্রথম মানুষটি মারা যায়। না হলে ঐ নির্জীব ভাবে ছয় কি সাতদিন বেঁচে থাকে।'

    "মারা যাওয়ার পরে যে পোকাগুলি বার হয়?"
    "সেগুলি, আমার ধারনা এক ধরনের পোকা মাত্র যাদের কাজ হচ্ছে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া। হয়তো এরা সেরকম ক্ষতিকরও কিছু নয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বংশ বিস্তার করে - তাই মৃতদেহের ভিতরে এরা ঢুকে ভিতর হেকে শরীরে সব মাংস খেয়ে নেয়। এটা খুবই সুলভ শুককীট। সারা দুনিয়াতেই আছে। এরা বোধহয় চম রোগের চালিকাদের সাথে এক যোগে একটা মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

    " কিন্তু না কামড়ে দিলে এই রোগের সংক্রমন তো ছড়াবে না? তাই তো?"
    "আক্রান্ত মানুষের মুখের লালা অন্য কোনো ভাবে সুস্থ শরীরের রক্তে ঢুকলেও হতে পারে। আমরা ইঁদুর আর আরো কয়েকটি প্রাণীর উপর পরীক্ষা করে দেখেছি - এই লালার কুফল শুধুমাত্র মানুষেরই উপর কাজ করে।"
    "তার মানে এই আক্রান্ত লোকেদের কোথাও অন্তরীন করে ছ সাতদিন রেখে দিলেই এই সংক্রমনের ভয় আর থাকবে না।"
    "ঠিক তাই, এখন পর্যন্ত্য এই অসুখকে সামাল দেওয়া কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এর আগে ক্রিস্টিনাও যেরকম বলেছেন - এই পরজীবী রা দ্রুত, খুব দ্রুত মিউটেট করার ক্ষমতা রাখে। সেই সম্ভাবনার কথা ভেবেই চিন্তা হয়।"

    এর পরের প্রেসেন্টেশন ডক্টর জামিরের। উনি প্রাণীবিদ্যাবিশারদ , এ ছাড়াও আরো অনেক বিষয়েই ওনার বিজ্ঞানী মহলে পান্ডিত্য সুবিদিত।

    জামির বলেন " আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এই পরজীবীরা , এদের উৎস কোথায়। এরা কী পশ্চিম আফ্রিকার এক স্থানীয় ঘটনা না আরো বড় তাৎপর্য্য আছে।আমি সব রকমের বিশ্লেষন একত্র করে যে সিদ্ধান্তে এসেছি যে এরা বোধহয় মহাজাগতিক কোনো প্রাণী সমষ্ঠি।

    সমবেত দীর্ঘ নিঃশ্বাসের পর ডক্টর জামির বলেন, "বা, এটাও সম্ভব যে কোনো খুব খুব প্রাচীন কোনো অর্গানিজম, যারা এতোদিন সুপ্ত ছিলো সেগুলি আবার ফিরে এসেছে। যদিও এই অসুখের যে কেন্দ্রবিন্দু - সেই পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো সাম্প্রতিক কোনো বড় ঘটনা ঘটে নি। মানে ভূমিকম্প, বা বন্যা। যাতে করে একটা খুব প্রাচীন জীবগোষ্ঠী আবার মাটীর নীচ থেকে ভূতলে উঠে আসে। না সেরকম কিছুই ঘটে নি।
    "উল্কাপাত?" একজন প্রশ্ন করেন।
    "সম্ভব, খুবই সম্ভব। বছরে প্রায় কম বেশী আশী হাজারের মতন উল্কা পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে, আর এই হিসেবটা শুধু দশ গ্রাম বা তার থেকে ভারী উল্কার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মহাজাগতিক ধুলিকনার কোনো বিশ্বাসযোগ্য হিসেব নেই।এ ছাড়া রয়েছে মহাশুণ্য থেকে ভেঙে পড়া নানান যানের টুকরো,টাকরা। কোনো ভাবেই বাইরের জগতের থেকে এই সংক্রমণ এই দুনিয়ায় পৌঁছাতে পারে।"

    "বাইরের জগতের প্রানী হওয়ার আর কোনো কারন থাকতে পারে?"

    ডক্টর জামির একটু চিন্তা করে বলেন, "দেখুন, এই যে পলিপ মানে চার পাঁচটি প্রাণী মিলে এক যোগে কাজ করা যেনো তারা আলাদা নয় বরং একই প্রাণী, তারপর মৌমাছি বা উইপোকার মতন একটি ঝাঁক বেঁধে চলা এবং তাদের বুদ্ধি বা সহজাত প্রবৃত্তি সেটা একটা সমষ্টিগত স্বত্তা , আদৌ কোনো একক স্বত্তা নয়, অন্য জীবের দেহে প্রবেশ করে তার বুদ্ধি নিয়ন্ত্রন করা - এই সব গুনগুলোর কোনোটাই আমাদের এই পৃথিবীর মধ্যে বিরল নয়। কিন্তু একই যোগে এইরকম যোগাযোগ আগে কখনো দেখি নি।

    দুই নম্বর পয়েন্ট হল , এই চম রোগের আক্রমন হচ্ছে একাধিক অর্গানিজমের মাধ্যমে। যেমন আছে ভাইরাস, তেমনই রয়েছে ক্ষুদ্র কীট, আছে ছত্রাক এমনকি অতি সুক্ষ স্ফটিক যাকে বলতে পারি ইন্টেলিজেন্ট কৃস্টাল। অর্থাৎ সব কিছু মিলিয়েই এক গোষ্ঠী। আর এদের সবারই খুব দ্রুত মিউটেট করে যাওয়ার ক্ষমতা। এতোটা ব্যাতিক্রমী বৈশিষ্ট , না, মোটেই সুলভ নয়।

    আরো দেখুন, এরই মধ্যে এরা মাংসভোজী কৃমির সাথে একটা মিথোজীবী মানে সিম্বায়টিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
    সব থেকে আশংকার ব্যাপার এরা বেছে বেছে মানুষের উপরেই বিস্তার করছে।

    না,না। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আরো গভীরে। বলুন কী আছে মানুষের মগজে? ৭৫% জল আর বাকীটা চর্বি। হ্যাঁ, নিউরন আছে, রক্ত ধমনী রয়েছে। কিন্তু খাদ্য হিসেবে এটার কী এমন বৈশিষ্ট আছে যে মানুষকেই বেছে বেছে এই জীব আক্রমণ করছে?"

    মৃদু গুন্জন ওঠে সভায়। "সব থেকে যেটা রহস্যজনক যে এই চম রোগের জন্য দায়ী কোন কোন প্রাণী সেটাও আমরা এখনো ঠিক জানি না। কেনো না অল্প যা কিছু দেহ পেয়েছি বা আক্রান্ত জ্যান্ত মানুষ, তাদেরকে পরীক্ষা করে নানান রকমের ফল পাওয়া গেছে। মনে হয় কেউ যেনো নানান পরীক্ষা চালাচ্ছে। যে কম্বিনেশনটা সবথেকে সুফল দেবে, সেটাই নেবে। ততক্ষন খুব প্রত্যন্ত প্রদেশে এক্ষপ্বেরিমেন্ট চলুক। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, শূককীট, ছত্রাক, কৃস্টাল ।।।।সবেরই নানান পার্মুটেশন, কম্বিনেশন চলছে।"

    "আমার বক্তব্য শেষ। খালি বলি খুবই সাবধান। আমার কিন্তু ভালো বোধ হচ্ছে না।
    "
    মিটিং'এ একটু নীরবতা এসে যায়। অ্যান উঠে বলে আমি তাহলে সকলের অনুমানের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেই।
    এক, যে সংক্রমন হয়েছে, সেটা আমাদের বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস আমাদের এও পৃথিবীর কোনো জীব নয়।
    দুই, এটির একটা অন্য কোনো প্রাণীর এক হস্টাইল অ্যাক্ট। প্রথম দফায় সিরিয়া লিওনে যা হয়েছে সেটি বেশ কাঁচাহাতের কাজ। এর পরের আক্রমণের ফলাফল আরো সংগীন হতে পারে।
    তিন, তবে সিরিয়া লিওনের সংক্রমণ আমরা আটকে দিয়েছি। কেনো না, সংক্রমনের শুরুতেই বেশ কিছু লক্ষণ দেখা গিয়েছিল যেগুলিতে আমরা আগাম সতর্ক হয়ে আক্রান্ত লোককে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছি । আর আরেকটি সুস্থ মানুষকে কামড়ে দিয়ে সংক্রমণ ছড়ানো, এটা তো খুবই ইনেফোশিয়েন্ট পদ্ধতি । শারীরিক ভাবে সড়িয়ে দিলেই আর আক্রান্ত মানুষেরা কোন সুস্থ মানুষকে সংক্রমন করতে পারবে না।

    এখন পর্যন্ত্য যা খবর মিলেছে তাতে দেখা যাচ্ছে গত সাতদিনে একটিও নতুন সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় নি। যারা আক্রান্ত ছিলো এবং মারা গেছে তাদের শবদেহ চুল্লীতে সম্পুর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে একজনই জীবিত। একটি মেয়ে, ১৩ বছর বয়সী। তাকে সম্পুর্ণ নিরাপদ ভাবে আমাদের ওকিনাওয়ার দফতরে রাখা হয়েছে ,খুবই সুরক্ষিত অবস্থায়।
    সে যেরকম আমাদের কাছে একটা ভয়ের কারন, সেই রকম আমাদের কাছে আশারও কারন। কেনো না তার ওপরেই আমরা নানান পরীক্ষা করে দেখছি কোন ওষুধটা কার্য্যকর হতে পারে।

    "মেয়েটির নাম কি? স্রেফ কৌতূহল?"
    "ও। মেয়েটির নাম ডরিস। ক্রিশ্চিয়ান নাম রাখা ও দেশে খুবই প্রচলিত।"
    "কতদিন হল সে ওকিনাওয়ার ফেসিলিটিতে আছে?"

    অ্যান একটু বিমর্ষ হাসে। বলে " বুঝতে পেরেছি আপনি কি উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন করলেন। ডরিস রয়েছে এগারোদিন হল। এর আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই রুগীরা পাঁচ ছয়দিনের বেশী বাঁচে না। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে কেমন নিঃসার হয়ে পড়ে। যেন একটা খোলস । কিন্তু ডরিস এখন খাওয়া দাওয়া করছে - যদিও টিউবের মাধ্যমেই। তার চোখের পাতাও নড়ছে। আর ই ই জিতে মাঝে মাঝে একটা নড়াচড়া দেখা দিচ্ছে।পুরোপুরি ব্রেইন ডেড বলা যাচ্ছে না। "

    পি আর ও'র মুখ্য অধিকর্ত্তা এতোক্ষনে প্রশ্ন করেন " কিন্তু এটা কি নিরাপদ?"
    সবাই চুপ করে থাকেন। এই প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে কারুরই অসুবিধে হয় না। মুখ্য অধিকর্ত্তা এবারে বলেন। "সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে হবে, এটা আমি জানি। তাই আমিই সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত দায়িত্বে বলছি ডরিসএর লাইফ লাইন বন্ধ করে দেওয়া হোক। এবং সেটা অবিলম্বে হোক।"
    অ্যান বলে "কিন্তু ওকিনাওয়ায় এখন রাত। কাল সকালে যদি .....?"
    মুখ্য অধিকর্ত্তা বলেন "না। এখুনি মানে এখুনি। চীফ সিকিউরিটি অফিসারকে তলব কর আর এখুনি বল ডরিসের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দিতে।"

    ইশিকাগি।
    ***************
    ডমিনিক এ'টিম এই ইশিকাগি লেবোরেটরীর মুখ্য নিরাপত্তা অধিকর্ত্তা। তাকে তখ্নই ফোন করা হল।নাইজেরিয়ান বাবা মা'র সন্তান এই মানুষটি জন্মসূত্রে আমেরিকান। সি আইএর অনেক গোপন কর্মকান্ডের দায়িত্ব ছিলো এর উপর। এখন আর মাঠ ঘাঠের কাজ করবার দক্ষতা বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। তাই এই শান্তির চাকরী।

    অ্যানের ফোন পেতে সে কোন প্রশ্ন করে না। শুধু বলে এটা অন্যকে দিয়ে সম্ভব নয়। আমি নার্স কিয়োনাকে বাড়ীর থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি , আমাকে নিজেই যেতে হবে। ওর সাথে। এখন রাত তিনটে। আমি এখনই রওয়ানা হচ্ছি।

    আধ ঘন্টা পরেই ফোন আসে, কিওয়ানা বাড়ীতে নেই। কালকে ওর ছুটি - তাই একটু দুরের এক দ্বীপে গেছে স্কুবা ডাইভিং করতে। কিন্তু আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি - ঘন্টা দুয়েক লাগবে। আমি ল্যাবে পৌঁছে, কাজটা সেরেই আপনাকে ফোন করব।

    ভাডুজ , পি এম ও মিটিং হল। সন্ধ্যা সাতটা।
    ***********************************
    উপস্থিত সকলেই বেশ বিভ্রান্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।মিটিং শেষ। সবাই একটু দমেই আছে। খুব সাধারন ডিনারের ব্যব্স্থা করা হয়েছে। স্যুপ আর স্যান্ডউইচ। একটা গ্রীন স্যালাড। তেমন উচ্চকিত কথা বার্ত্তাও নেই। যদিও মুখে কেউ কিছু বলছে না কিন্তু সকলেই একটা অপরাধবোধে ভুগছে। ডরিস নামের একটি তেরো বছরের কিশোরীর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হবে। হয়তো বিভিন্ন ওষুধে কাজ হচ্ছিল। হয়ত না। কিন্তু বিপদের আশংকা বড় বেশী।

    ডিনার শেষ হতে না হতেই , দেওয়ালের মনিটরে ডমিনিকের ছবি ভেসে উঠলো।
    "খুব খারাপ খবর" কোনো ভূমিকা না করেই সে জানায়।“
    আধ ঘন্টা আগেই আমি কিয়োনাকে নিয়ে ল্যাবে পৌঁছাই। কিয়োনা কাঁচের ঘরের বাইরে রাখা মনিটর দেখে বলে ডরিস এখনো কোমায় আছে। ওর ই ই জি অ্যাকটিভিটি প্রায় নেই বললেই চলে।

    সে তখন সাধারন নিরাপত্তার পোষাক পরেই ডরিসের চেম্বারে ঢোকে। তার সমস্ত লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেয় এবং নিশ্চিত হবার জন্য নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা একবার দেখতে যায়।
    এইবার কী হলো সেটা সিসিটিভ ক্যামেরাতে দেখুন।
    সিকিউরিটি ক্যামেরায় দেখা গেল ডরিসের নিথর দেহ শুয়ে আছে । ডরিসের কাছে গিয়ে কিয়োনা একটু ঝুঁকে পড়তেই হঠাৎ করে ডরিসের মুখ খুলে যায় আর সজোরে একটা কুয়াসার মতন কিছ বেরিয়ে আসে আর কিয়োনাকে ছেয়ে ফেলে। আর তখনই মারাত্মক ভুল হয়ে যায়। আতংকে অস্থির হয়ে কিয়োনা তখুনি চেম্বারের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। আমিও তো দরজার বাইরেই ছিলাম। আর রাত্রের নার্স হিনা আর আমার সহকারী টমোও ছিলো।

    হঠাৎ এরকম একটা অস্বাভাবিক বা বলা যায় অলৌকিক ঘটনাত আমরা এমনই চমকে গেছিলাম যে যতোটা সাবধানতা নেওয়া উচিৎ ছিলো প্রথম থেকেই - সেটা নেওয়া হয় নি।
    আমরা এর পরে ডিকন্টামিনেশন চেম্বারে গিয়ে সব প্রতিষেধকই নেই। কিন্তু আমি একেবারে নিশ্চিত ঐ রকম সবেগে ছুটে আসা খুব বীজগুটির মেঘ খোলা দরজা বাইরের করিডরেও পৌঁছে গেছে। আর আমরা যারা বাইরে ছিলাম, মানে হিনা, টমো আর আমি। আমরা তো সম্পুর্ণ অরক্ষিত ছিলাম।"

    স্তম্ভিত একজন চেঁচিয়ে ওঠেন -" এ তো মিরাকল। মৃত মানুষ কী করে এটা ঘটাবে?"

    উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন তনুশ্রী ঘোষ। উনি উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। উনি বললেন "প্রকৃতিতে এটা কিন্তু বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। এর বিজ্ঞানিক নাম বল্লোচরী বা ব্যালেস্টিক ডিস্পারসাল। বিভিন্ন গাছে যেমন স্যান্ডবক্স ট্রী তার বীজদের এরকম ভাবে এতো জোরে ছুঁড়ে দেয় যে সেগুলি প্রায় একশো মিটার দূর পর্যন্ত্য যায়। বোমা ফাটার মতন আওয়াজও হয় তাই এই গাছকে ডায়নামাইট ট্রি ও বলা হয়। স্প্যাঘনাম বা পীট মসও এই রকমের বন্ধুকের গুলির মতন তার বীজদের দূরে ছুঁড়ে দেয় প্রায় বুলেটের গতিতে। কয়েক হাজার এইরকম প্রজাতির গাছ রয়েছে।"

    পি আর ও'র মুখ্য অধিকর্ত্তা বলেন "এখনই পুরো ফেসিলিটি সীল করে দেও। কেই যেন না ঢোকে বা বার হয়। তবে একবারে ল্যাবের করিডরে পৌঁছে গেলে কোনো না কোনো ভাবে বাইত্রে ছড়িয়ে পড়া আটকানো মুশকিল। আর ডরিসের চেম্বারের সিসিটিভি টা আরেকবার দেখাও - কোনো নতুন কিছু হোলো কিনা দেখি।

    সেই সুরক্ষিত চেম্বারের সিসিটিভিতে জুম করে দেখা গেলো ডরিসের সারা শরীরে অজস্র ছোটো ছোটো নীল রংএর তিল ফুটে উঠেছে। "এটা কি আগে ছিলো?"

    ডমিনিক মাথা নাড়ে। "না, একটা দুটো থাকতেও পারে কিন্তু এতো দেখছি সারা শরীরে ছড়িয়ে আছে । অজস্র। "
    বাকী দুজন নার্স আর তোমার সহকারী কোথায়?
    "ওরা, আমারই মতন কোনো সুরক্ষিত কেবিনেই অন্তরীন আছে। আমি ওদের ঘরের ক্যামেরাও অন করে দিচ্ছি - আপনারা নিজেরাই দেখুন বা কোনো প্রশ্ন করতে চান করুন।"
    কিয়োনোকে ডরিসের ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয় "তুমি প্রথম যখন ডরিসের ঘরে ঢুকলে, তখন কি ওর সারা গায়ে এরকম নীল বুটি দেখেছিলে?'
    কিয়োনো একেবারে স্তম্ভিত হয়ে থাকে। সে যেন কথাই বলতে পারে না। অবশেষে অস্ফুটে বলে "না ছিলো না।" তার দুই চোখ জলে ভরে আসে"এই দেখুন"। সে তার গাউনের হাতা গুটিয়ে দেখায়। একটা দুটো করে নীল রঙের তিল তার গায়েও ফুটে উঠছে।

    বাকী দুজন, নার্স হিনা আর সহকারী টমো - তারাও তাদের পোষাক খুলে ফেলে। সারা শরীরে - যেমন সন্ধ্যা বেলায় একটা দুটো করে তারা ফুটে ওঠে কালো আকাশে - সেই রকম তাদের সাদা চামড়ায় একটা দুটো করে নীল স্পট ফুটে উঠছে।

    বিজ্ঞানীরা আতংকে স্থির হয়ে দেখে।

    ডমিনিক হেসে ফেলে। আমার চামড়া কালো বলে প্রথমটায় আমি ঠিক বুঝতে পারি নি। তবে আমি জানি এখন আমাকে কি করতে হবে।

    সে হাতে তুলে নেয় চারটি সিরিঞ্জ।মুখ্য অধিকর্ত্তাকে বলেন "আপনি স্টেটাস অরেঞ্জ জারী করুন। সর্ব্বোচ্চ স্তরের সতর্কবার্ত্তা। তো সেটা চালু হতে হতেও ঘন্টা দুয়েক তো লাগবেই। এখন ভোর পাঁচটা, প্রায় পাঁচটা।আর ইতিমধ্যেই তো শেষ রাত থেকেই আন্তর্জাতিক বিমান যাত্রা শুরু হয়ে গেছে নাহা এয়ারপোর্ট থেকে। সিংগাপুর, টোকিও, সাংহাই। হংকং। হাওয়ায় ভেসে ভেসে এই সংক্রমন কোথায় পৌঁছে গেছে কে জানে? আর আমার ও কিয়োনা, টোমো আর হিনার তরফ থেকে গুডবাই।" কেউ তাকে প্রশ্ন করে না ঐ চারটে সিরিঞ্জ কিসের।

    মুখ্য অধিকর্ত্তা বিষাদে মাথা নাড়েন। "না, এটা সংক্রমন নয়। এটা আক্রমণ। কোনো বুধ্হিমান শত্রু। যে তার আক্রমনের ট্যাকটিক পাল্টাতে পারে পছন্দ মতন। আমরা যদি শুধু নাহা এয়ারপোর্ট, আঅর শুধু নাহা এয়ারপোর্ট কেনো, পুরো ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জও সীল করে দেই। তাহলে ও বাঁচবো না। শত্রুরা আবার বদলে যাবে। মাছ আর পাখীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে মৃত্যুবান। মুরগী আর শুয়োরের মাধ্যমে যা করেছিলো বছর খানেক আগে। সেটা ছিলো স্টেজ রিহার্স্যাল। এইবারে আসল আক্রমণ শুরু হয়েছে।

    আমি সব যায়গাতেই চেষ্টা করছি। অ্যারপোর্ট থেকে পুরো ওকিনাওয়াকেই সীল করে দিতে। আপনাদের অনুরোধ করব নিজের নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যান। শেষের কদিন স্বজনের সাথেই কাটান।
    বন্ধুগন। বিদায়।"

    লন্ডন, ২৫ মার্চ। ২০১৭
    ***********************
    অ্যান সুস্থির হয়ে বসে। আর তার কিছু করনীয় নেই। প্রত্যাশাও নয়। বহুদিন ঘর ছাড়া অ্যানের না আছে পরিবার না আছে দেশ বলে কিছু।

    টিভি স্টেশন যে কটা চালু আছে তাতে শুধু একই জিনিস দেখাচ্ছে। দ্রুত,খুব দ্রুত পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাচ্ছে মানুষেরা। প্রথম দু একদিন দেখাচ্ছিল। কী ভাবে বিভিন্ন ক্যামেরায় ধরা পড়ছে - আক্রান্ত লোকের মুখ দিয়ে ছুটে আসছে ফোয়ারার মতন বীজগুটির "মেঘ"। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আক্রান্তের দেহে নীল বুটির মালা। যেখানে সেখানে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ। সাবধান হওয়ার মতন আগাম কোনো লক্ষণ নেই।পালানোর কোনো পথ নেই। হাওয়ায় ভেসে যাওয়া এই মৃত্যু সর্বত্রগামী। আর এখন তো ক্যামেরা চালাবার লোকও নেই, নেই চ্যানেল চালানোর লোক। মুহুর্ত্তে মুহুর্ত্তে দেশে দেশে হু হু করে ছুটছে মৃত্যুর মেঘ।

    বিশে মার্চ, ইশিকাগির ল্যাবরেটারীতে সুরক্ষা বিদীর্ণ হওয়ার পর, যেমন ডমিনিক বলেছিল, সেইরকমই হল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই এমার্জেন্সী জারি করে লাভ হল না কিছুই। একটার পর একটা এয়ারপোর্টে মানুষ নামতে থাকল, তাদের সারা গায়ে নীল তিল। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ফোয়ারার মতন বীজগুটির স্রোত। হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে। বন্দর থেকে বন্দরে। শহর থেকে শহরে। এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেই সংক্রমন যে লোককে বুঝাবার বা খবর দেওয়ারও উপায় রইলো না।

    কে বন্ধ করবে উপচে ওঠা বাঁধের জল। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট।কল কারখানার হাজারো মেশিন। পথে,জলে,আকাশের যান। কাতারে মানুষ মরছে দুনিয়া জুড়ে। যত প্রত্যন্ত গ্রাম তত দেরী হবে এই মৃত্যু কুয়াসার সেই খানে পৌঁছাতে। কিন্তু আটকানো তো যাবে না। সংক্রমন আর মানুষের উপর নির্ভরশীল নয়। হাওয়ায় ভেসে ভেসে সেটা দিক দিগন্তে ছড়িয়ে যাবে। এবং যাচ্ছে।

    সংক্রমন নয়। এটা আক্রমন।

    সুস্থির মনে অ্যান বসে থাকে। নির্বিকার ভাবে। সে জানলা খুলে দেয় তার ছোট্টো ফ্ল্যাটের। বাইরে খুব ঠান্ডা নয়। বোধ্হয় ১২ কি ১৩ ডিগ্রী। আরামদায়্ক।

    তার ডায়ারীতে লিখে রাখে - "এই যে মানব সভ্যতা। বিবর্ত্তনের পথ ঘুড়ে, নানান অন্ধগলি ও গোলোকধাঁধায় ঘুড়ে, হোঁচোট খেতে খেতে এই যায়গায় পৌঁছেছে। আজ তার মৃত্যুদিন উপস্থিত। যে সভ্যতাকে আমরা নিতান্ত স্বাভাবিক আর নিশ্চিত বলে ভেবে নিয়েছিলাম, সেটি শেষ হল। বিদায়।

    আর দেখতে থাকে কেমন ভাবে তার হাত,পা সারা গায়ে নীল বুটি ফুটে ওঠে। যেমন ফোটে বসন্তের আগমনে হাজার ফুল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | ২০২২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ও শানওয়ালা - dd
    আরও পড়ুন
    দ্রোণ পর্ব - dd
    আরও পড়ুন
    কর্ণসংহার - dd
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৫:২৭61151
  • বাপরে কি লিখছেন ডিডি!!

    টাইপোগুলো একটু যদি একবার দেখে দেওয়া যেত।।।।
  • T | ***:*** | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৫:৪৪61152
  • শেষটা ঠিক পছন্দ হল না।
  • amit | ***:*** | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১০:১৬61153
  • এটা পুরো হলিউড ব্লকবাস্টার এর প্লট। দারুন হয়েছে।
  • dc | ***:*** | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২৮61156
  • দুর্দান্ত হয়েছে। কিন্তু এটা প্রথম চ্যাপ্টার না?
  • শঙ্খ | ***:*** | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৭:১৪61154
  • জোম্বি অ্যাপোক্যলিপ্স এমনিতেই ফেভারিট টপিক। লেখাটা যে ভালো লাগবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে শেষটায় একটু ট্যুইস্ট আশা করেছিলুম সেটা হলো না
  • Amit Sengupta | ***:*** | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১২:৪৩61155
  • খাসা হয়েছে। বানানগুলো ঠিক করে নিতে হবে। আরো কয়েকটা এরকম নামালে জমে যাবে।
    অমিত সেনগুপ্ত
    বেঙ্গালুরু
  • reek | ***:*** | ১০ মার্চ ২০১৭ ১১:৩০61157
  • অরে বাপ রে বাপ্ , দারুন সাইফাই ।
  • গবু | 42.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৭:৩৫97390
  • ডিডি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন একেবারে

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন