যাঁরা এখনো মনে রেখেছেন, তাঁদের জন্যে। আমরা কখনো ভুলতে পারিনি, কারণ বড্ড বেশি রিয়েল, র আর রাফ ছিল সেই দিনটা। এখানে এই নিউ ইয়র্কে।
এই নিয়ে অনেক লিখেছি। কিন্তু মনে হয় গুরুচণ্ডালির পাঠক পাঠিকাদের জন্যে লেখা হয়নি। তাই আজ একটু লিখলাম।
আমি তখন নিউ জার্সিতে মেডিকেল রাইটার হিসেবে কাজ করতাম পারসিপেনি বলে একটা জায়গায়। দু হাজার সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমের ডিগ্ৰী করে বেরোনোর পর সেই চল্লিশ বছর বয়েসে কে আমাকে আর হঠাৎ কাজ দেবে? তাই পুরোনো সায়েন্সের ডিগ্রী আর লেখার দক্ষতার ওপর ভিত্তি করেই কাজ খুঁজে নিতে হলো। নিউ ইয়র্ক শহরে ভদ্রভাবে ফ্যামিলি নিয়ে বাঁচতে গেলে ভালো কাজ একেবারে জরুরি।
এখানে বাঁচার খরচ বড্ড বেশি।
আমি সকাল সাতটায় গাড়ি নিয়ে ব্রুকলিন থেকে বেরিয়ে যেতাম, আর দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করে সাড়ে আটটার সময়ে আমার অফিসে গিয়ে পৌঁছতাম। ফেরার সময়ে রাশ আওয়ারে দুই বা আড়াই ঘন্টাও লেগে যেত।
আমার স্ত্রী সেই সময়টা বাড়িতেই থাকতেন। অলব্যানি থেকে নিউ ইয়র্কে আসার পর নতুন শহরে নতুন কাজ খুঁজে নিতে একটু সময় লাগছিলো। সেই সময়ে আমাদের কন্যা যাতে এই টাফ পরিবেশে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, এবং একটা ভালো হাই স্কুলে ভর্তি হতে পারে, তার জন্যে মেয়ের সঙ্গে ঘরে থাকার প্রয়োজন ছিল।
হয়তো জানেন না, নিউ ইয়র্কে যেমন দারুণ ভালো ভালো স্কুল আছে, তেমনি আবার একেবারে শোচনীয়, বিপর্যস্ত অবস্থার স্কুলও অনেক আছে। তার সংখ্যাই বেশি। ঠিকমতো পরিবেশে মানুষ না করতে পারলে, এবং ভালো স্কুলে না যেতে পারলে নিউ ইয়র্কে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ড্রাগ, বন্দুক, জেল। স্কুল টু প্রিজন পাইপলাইন।
আমাদের মেয়ে খুব প্রতিযোগিতামূলক একটা ভর্তির পরীক্ষা দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের নামকরা সরকারি স্কুল স্টাইভেসেন্টে ভর্তি হয়ে আমাদের নিশ্চিন্ত করেছিল।
এগারোই সেপ্টেম্বর, দুহাজার এক সাল। মঙ্গলবার।
ঠিক আগের সপ্তাহে নতুন স্কুলবর্ষ শুরু হয়েছে। আমি প্রথম দু একদিন মেয়ের সঙ্গে সাবওয়ে ট্রেনে করে গিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। বোধহয় আগের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। এবং তারপর সোমবার সে নিজেই গেছে স্কুলে। মঙ্গলবারও। আমি সকালে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছি নিউ জার্সি।
নটার একটু পরেই আমাদের কাজের জায়গায় একটি মেয়ে বললো, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ওপরে নাকি একটা প্লেন আক্রমণ করেছে। এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা আসল ব্যাপারটা কী। টিভিতে কিছু দেখাচ্ছে না। আরো পনেরো কুড়ি মিনিট পর থেকে আসল ব্যাপারটা জানতে পারা গেলো। এবং ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতচকিত হয়ে পড়লাম। এ কী ব্যাপার! তারপর শুরু হলো টিভিতে একটানা ঘটনার বর্ণনা। টিভি স্ক্রীনে নিচের দিকে স্ক্রোল করে যেতে লাগলো ধারাবাহিক বর্ণনা। এবং একটু পরেই এক এক করে দুটো টাওয়ার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। অবিশ্বাস্য ধুলোর ঝড়। একটানা অ্যামবুলেন্স, পুলিশের নানারকম গাড়ি, এবং ফায়ার ইঞ্জিনের নিরবচ্ছিন্ন সাইরেন। ঘটনার বীভৎসতায় আমরা সবাই স্তম্ভিত।
এর পরে প্রথমেই যেটা মনে হলো, তা হলো, আমার মেয়ে কোথায় গেলো? সে নিরাপদে আছে তো? কিন্তু তা জানার আর কোনো উপায় নেই। সেল ফোন কাজ করছেনা, টিভিও মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার চালু হলেও স্টাইভেসেন্ট হাই স্কুল সম্পর্কে কোনো খবর আমরা পাচ্ছিনা। আমি বাড়িতে বারবার ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি আমার স্ত্রীর কাছে। সেও উৎকণ্ঠা, উদ্বেগে আকুল। মেয়ের নতুন বন্ধুদের দু একজনের বাবামায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল গত কয়েক মাস ব্রুকলিন অঞ্চলে থাকা এবং ক্লাস এইটে শেষের কয়েকটা মাস পড়ার সুবাদে নতুন শহরের সঙ্গে একটু পরিচিতি। আমরা সেই অভিভাবকদের ফোন করছি। তারাও কিছুই জানেনা। এইভাবে কেটে গেলো দুপুর বারোটা অথবা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত।
আমি এর মধ্যে আমার পুরোনো দু একজন সহকর্মী -- যারা ম্যানহ্যাটানে কাজ করতো -- তাদের ইমেল করেছি। কার্ট এপস্টাইন বলে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী ছিল তাকে লিখলাম, “ব্রাদার কার্ট, তুমি একটু খোঁজ নেবে স্টাইভেসেন্টের কী অবস্থা? ওখানকার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? আমার মেয়েও ওখানে আটকে গেছে মনে হয়। তুমি একটু দেখবে?”
কার্ট চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওকে পুলিশ ওই এলাকায় ঢুকতে দেয়নি। কারুকেই ঢুকতে দিচ্ছিলনা। সে জায়গা ততক্ষণে একেবারেই যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে।
ধোঁয়া এবং ধুলোর ঝড়। মানুষ দিশেহারা হয়ে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাচ্ছে। চতুর্দিকে বিষাক্ত একটা গন্ধ। বাতাসে হাজার বিষাক্ত, ভয়ঙ্কর রাসায়নিক পদার্থ ভেসে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যেই পুলিশ, মিলিটারি, ফায়ারফাইটাররা, মেডিকেল কর্মীরা, এবং অগণিত স্বেচ্ছাসেবক দৌড়োদৌড়ি করছে। মৃতদেহ বয়ে বয়ে নিয়ে আসছে অনেকে।
আহত অসংখ্য। মুখ থেকে পা পর্যন্ত ছাইতে ঢাকা পুরুষ ও নারীর দল ছুটোছুটি করছে। কেউ কেউ চীৎকার করে কাঁদছে। কেউ কেউ অভিশাপ দিচ্ছে। আর কেউ বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে।
এসব অবশ্য আমি নিজের চোখে দেখিনি। কার্ট কিছুটা বলেছিলো। আর বাকীটা শুনেছি আমার মেয়ের কাছে, অনেক পরে।
আমার মেয়ে নিজের চোখে তার নতলার কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি থেকে দেখেছিলো, অসহায় মানুষরা সব ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের একেবারে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ছে। সেসব দৃশ্য দেখে তার কয়েকজন বান্ধবী ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছিল। কয়েকজন স্কুল ছেড়ে দিয়েও চলে গিয়েছিলো।
প্রথম টাওয়ার আক্রান্ত হওয়ার প্রায় পাঁচ ঘন্টা পরে আমরা প্রথম টিভিতে খবর পেলাম, স্টাইভেসেন্টের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা সকলে নিরাপদে আছে। কিন্তু আমার মেয়ে ও তার বন্ধুদের কাছে আমরা জেনেছি, এতো বড় স্কুলের প্রায় বারোশো ছাত্রছাত্রীকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে -- ইভ্যাকুয়েট করার জন্যে -- কোনো সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেউ বলতে গেলে তাদের কথা তেমন করে ভাবেই নি। সে সময়ে ওদের স্কুলে ট্রিয়াজ সেন্টার করা হয়েছে। অর্থাৎ, আহত ও পঙ্গু মানুষদের নিয়ে এসে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুলের স্টুডেন্টদের বলে দেওয়া হলো, তোমরা দল বেঁধে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকো। অর্থাৎ, সামনেই ঘটতে থাকা নারকীয় অবস্থা থেকে যতটা সম্ভব দূরে চলে যাওয়া যায়। ব্যস, এই পর্যন্ত।
আবার আমরা মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেললাম। আসলে, সকালের পর থেকে কোনোভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। কোনো ফোন কাজ করছিলো না। এসব ঘটনা আমরা পরে জেনেছি।
রাত দশটার কিছু পরে আপাদমস্তক ধুলোমাখা আমাদের মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পাঁচ মাইল হেঁটে, কিছুটা এক বান্ধবীর মায়ের গাড়িতে, হেঁটে ব্রুকলিন ব্রিজ পার হয়ে -- বাড়ি ফিরে এলো তার মায়ের কাছে।
আমি সেদিন নিউ জার্সি থেকে বাড়ি ফিরে আসতে পারিনি। সব ট্রেন, সব যানবাহন সম্পূর্ণ বন্ধ। একদিন এক সহকর্মীর বাড়িতে কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন দুপুরবেলা ব্রুকলিন ফিরে এসেছিলাম। গাড়ি রেখে এসেছিলাম সহকর্মীর বাড়িতেই। গাড়ি নিয়ে নিউ ইয়র্কে ঢোকা আমার মতো একজন “আরব-জাতীয়-দেখতে” লোকের পক্ষে মোটেই নিরাপদ ছিলনা।
"মুসলমান-মুসলমান চেহারার লোক" আমরা। শিখদের পর্যন্ত মারছে ধরে ধরে।
একদিন ছুটি দিয়েছিলো আমাদের মেডিকেল রাইটিং কোম্পানি। আহা, কী বদান্যতা। ভাবলেই চোখে জল আসে আজও।
নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সির সদাশয় সরকার বাহাদুর ট্রেন ও বাসের ভাড়া মকুব করে দিয়েছিলেন কয়েকদিনের জন্যে।
আহা, কী বদান্যতা। ভাবলেই চোখে জল আসে আজও।
###
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।