দেশভাগ,দাঙ্গা এবং বাঙলার বাস্ত্যুচুত মুসলমান
কিন্ত ইতিমধ্যেই বাঙলায় মুসলমান এবং হিন্দু উৎখাত শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশভাগের অনতিপূর্বে এবং পরে কুখ্যাত কোলকাতা কিলিং এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের নিজগৃহ এবং নিজভূমী থেকে উৎখাত করা শুরু করে। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি সরকার মুসলমানদের জীবন এবং সম্পত্তির নিরাপত্তারক্ষায় পূর্ণ রূপে ব্যর্থ প্রমাণিত হন। ঘন ঘন মুসলমান বস্তিতে আগুণ, হত্যার ঘটনা এই ব্যর্থতা এবং উদাসীনতার অন্যতম উদাহরণ। প্রকৃত অর্থে এ কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিলোনা বরং মুসলমানদের ওপর একতরফা আক্রমণ এবংসরকারী নিস্ক্রিয়তার ইতিহাস। এই ক্রমাগত দাঙ্গার ফলে এবং ভয়ঙ্কর ভয়ের পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গের বিপুল পরিমাণ মুসলমান প্রাণ বাচাতে গৃহত্যাগী, দেশত্যাগী হতে বাধ্য হতে থাকে।দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধিষ্ণু মুসলমান সম্প্রদায় নিরাপত্তার খাতিরে হয় শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে অথবা সদ্য গঠিত পূর্ব পাকিস্তানে দলে দলে চলে যেতে থাকেন। এদের মধ্যে সকলেই যে দাঙ্গা পীড়িত এমনটা নয়,এপারের অনেক মুসলমান সরকারী কর্মচারী সদ্য গঠিত পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চ এবং নিরাপদ পদের আশায় স্বেছায় সম্পত্তি বদল করে চলে যেতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের বিষয়ে যেমন অসংখ্য তথ্য বর্তমান ঠিক তার উল্টোটা এই এপারের মুসলমানদের উল্টোমুখে যাওয়ার ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য। সাহিত্য, প্রবন্ধে এই বিপরীত প্রবাহের বিবরণ সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের আউট মাইগ্রেসন বিষয়ে দেশভাগের ইতিহাস রচয়িতাগণ প্রায় নীরবতা অবলম্বন করেছেন। যদিও এই বিচ্ছেদ, গৃহত্যাগ,নিরাপত্তার অভাব এবং পূর্ব পাকিস্তানে এই বাঙলার মুসলমান সম্প্রদায়ের নোঙ্গর ফেলার লড়াই দেশভাগের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু সম্ভবত তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ এই উদাসীনতার পেছনে অন্যতম কারণ। অতি সম্প্রতি এই ইতিহাস খুব অল্প সংখ্যায় লেখা পত্তর হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার প্রথম ঢেউ শুরু হয় কোলকাতা কিলিং এর পরবর্তী সময় থেকে। ১৯৪৬ এর শেষের দিকে বিহারে ৩০০০০ এর ওপর মুসলমান হত্যার পরে বিহারী মুসলমান এবং বাঙ্গালী মুসলমানেরা ক্রমে দাঙ্গার কেন্দ্র থেকে পূর্বের দিকে সরে আসতে থাকে। বিহারী মুসলমানেরা কেউ কেউ ধানবাদ, বর্ধমান, হাওড়া, এবং বেশির ভাগ পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। বাংলার উর্দুভাষী অভিজাত মুসলমানেরা পূর্ব পাকিস্তানে পালাতে থাকেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের জনপ্রিয় প্রফেসর কুদরৎ ই খুদা,বিখ্যাত চিত্রকর জয়নাল আবেদিন সমেত সেই সময়ের গণ্যমান্য মুসলমানেরা কোলকাতা ছাড়তে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, মধ্যবিত্ত, বিভিন্ন পেশায় দক্ষ কারিগর এমনকি বস্তিবাসী মুসলমানেরাও দেশ ত্যাগ করতে শুরু করেন নিরাপত্তা হীনতার কারণে। ১৯৪৬-৪৭ সালে কলকাতায় মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ২৩-২৪% অথচ ১৯৫১ সালের সেন্সাসে দেখা যাচ্ছে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ১২%এ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা গণ্যে রেখেও কলকাতার প্রায় অর্ধেক মুসলমান এই সময়ের মধ্যে দেশত্যাগ করেন ভয়ে এবং নিরাপত্তার অভাবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় ১৯৫০ এর সময়ে। সেই সময়ের সব থেকে ভয়ানক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে হাওড়ায়, ১৯৫০ এর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে হাওড়ার চটকল গুলীতে মুসলমান শ্রমিকদের নির্বিচারে কোতল করা হয়। এই দাঙ্গায় কমপক্ষে শতাধিক মুসলমান শ্রমিক মারা যান। অশোক মিত্র সেই সময়ে সেন্সাস কমিশনার ছিলেন তার বিভিন্ন বিবরণীতে সেই সময়ে হাওড়া থেকে আতঙ্কিত মুসলমান পলায়নের চিত্র বর্তমান। এমনকি অপেক্ষাকৃত অসাম্প্রদায়িক বর্ধমানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে। মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাসিম যিনি শরৎ বসুর সাথে একসাথে স্বতন্ত্র অখণ্ড বাংলার দাবী তুলেছিলেন দেশভাগের পরে তিনি দেশত্যাগী হননি বর্ধমানেই থাকতেন, তার বাড়ি আক্রান্ত হয়। এই ঘটনায় বিস্মিত আবুল হাসিম পরবর্তীতে পরিবার সহ পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন। সাথে সাথে তার বিপুল পরিমাণ আত্মীয়ও বর্ধমান ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান চলে যান। আবুল হাসিমের পুত্র বিখ্যাত লেখক বদরুদ্দিন উমর এক ইন্টারভিউতে পরবর্তীতে বলেছিলেন যে ওই দাঙ্গার ঘটনা না ঘটলে তার পিতা এবং তাদের বিপুল পরিমাণ আত্মীয় পশ্চিমবঙ্গের ভীটে মাটি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে হয়ত যেতেন না। নদীয়ার সীমান্ত অঞ্চলে মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে এক্সচেঞ্জ চলতে থাকে। নমশূদ্রদের ওপার থেকে খেদানো হয় আর এপার থেকে মুসলমানদের। নদীয়ার সীমান্ত অঞ্চল থেকে ২০০,০০০ এর ওপর মুসলমানদের ওই পারে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৫১ এর সেন্সাস চলাকালীন কেবলমাত্র কলকাতা থেকে ১৩১০০০ মুসলমান ওপারে চলে যান। পরিস্থিতির চাপে এপারের ব্যবসাদার মুসলমানেরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে বিনিময়ের মাধ্যমে পাগলের মত নিরাপত্তার খোঁজে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে শুরু করেন। ১৯৫০-১৯৫১ সালের সরকারী তথ্য অনুসার ৭ লাখ মুসলমান সেই সময়ে দেশত্যাগী হন যদিও পরবর্তীতে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিত হলে অনেকে আবার ফিরেও এসেছিলেন।
মুসলমানদের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয় ১৯৬৩-৬৪ সালের বিভিন্ন দাঙ্গার সময় থেকে। সেই সময়ে কাশ্মীরের হজরত বালের ঘটনায় খুলনায় হিন্দুদের ওপর শুরু হওয়া দাঙ্গা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে আগুণের মত ছড়িয়ে পরে। যশোর, ঢাকা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এই সমস্ত অঞ্চলে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের খবরে ততদিনে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের সংখ্যাগুরু অঞ্চল কলকাতা, বারাসত, চাকদা, তেহট্ট, বেলেঘাটা, এন্তালি, হাবড়া,শ্রীরামপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ১৯৬৪ সালের ১০ই জানুয়ারি দাঙ্গা শুরু হয় এই দাঙ্গা চলতে থাকে ১৫ই জানুয়ারি ১৯৬৪ পর্যন্ত। ততদিনে মুসলমান সম্পত্তি, বস্তি, দোকান ভস্মীভূত। এই তীব্র আক্রমণ এবং তার প্রভাবে প্রায় ৮ লাখ ভারতীয় মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর পূর্ব ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়।
দাঙ্গা’র কারণ ছাড়াও বিপুল পরিমাণ মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, সরকারী অফিস,এবং বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত বাঙ্গালী মুসলমান স্বেছায়, বেশি সুযোগের উৎসাহে এবং নব্য গঠিত পাকিস্তানে তাদের নূতন স্বীকৃতির স্বার্থেও চলে গেছেন। সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের ১৯ জন মুসলমান সিভিল সার্ভিস অফিসারের মধ্যে ১৮ জন পাকিস্তানে চলে যান , তাদের মনে হয়েছিল যে এই পারে হিন্দু প্রাধান্য তাদের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত করবে। তবে সব থেকে দুর্ভাগ্য জনক পরিস্থিতি হয়েছিল নদীয়া,মুর্শিদাবাদ এবং মালদার মুসলমান অধিবাসীদের - তারা ধরেই নিয়েছিল যেহেতূ তাদের অঞ্চল মুসলমান প্রধান স্বাভাবিক ভাবে এই অঞ্চল পাকিস্তানে চলে যাবে তাই তারা আর দেশত্যাগের ঝামেলা নেয় নি।কিন্তু তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ করে এই তিন মুসলমান প্রধান জেলা ভারতেই থেকে যায় ক্রমে হিন্দু প্রাধান্য গ্রাস করে নেয় তাদের পেশা, অর্থনীতি এবং সামাজিক পরিধি। অন্যদিকে এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা সম্পদ এবং শিক্ষার দিক থেকে হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়, সবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে মুসলান মধ্যবিত্তের সৃষ্টি হচ্ছিল তায় দেশভাগের ফলে অধিকাংশ পশ্চিম বঙ্গের শিক্ষিত মুসলমান নূতন দেশে বেশি সুযোগের আশায় স্বেছায় এবং বলপূর্বক দেশত্যাগ সাথে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত উদ্বাস্তুদের চাপে সন্মান জনক চাকরী পাওয়াই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে দায় হয়ে পরে। পূর্ব বঙ্গ থেকে দেশভাগের প্রথম দিকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের অধিকাংশ ছিল শিক্ষিত, অভিজাত হিন্দু বাঙ্গালী, তারা যে কেবল মুসলমানদের তুলনায় শিক্ষিত ছিল তাই নয় অধিকাংশ এপারের হিন্দু মধ্যবিত্তদের তুলনাতেও বেশি শিক্ষিত ছিল। এই উচ্চ শিক্ষিত পূর্ব বঙ্গের উদ্বাস্তু স্রোত পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের চাকরীর বাজার আরও সঙ্কুচিত করতে থাকে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুর ওদেশ থেকে এদেশে চলে আসা কেবল মাত্র এদেশের মুসলমানদের পক্ষে চাপের তাই নয় বরং তাদের এই দেশত্যাগ সদ্য গঠিত পাকিস্তানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং চাকুরির জগতে বিপুল শুন্যতার সৃষ্টি করে। পশ্চিম বঙ্গের চাকুরির বাজার তখন ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক এবং এই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এপারের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান ওপারের চাকরীর বাজারের বিপুল শূন্যতা পূর্ণ করার চাপে এবং লোভে দলে দলে স্বেছায় ওপারে চলে যেতে থাকেন। এই বিপুল পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানের দেশত্যাগের এর ফলে সৃষ্ট সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা কেবলমাত্র এপারের মুসলমানদের কাছে বিরাট ক্ষতি তা নয় বরং সারা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি। হিন্দু মুসলমান ভারসাম্যের চ্যুতি এবং প্রায় রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাওয়ার সূত্রপাত।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানদের দেশত্যাগের সাথে সাথে প্রায় সমস্ত প্রথমসারির মুসলিম লীগ নেতৃত্বের দেশত্যাগ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায় শূন্য করে দিতে থাকে। দেশভাগের পূর্বে পাকিস্তানের স্বপক্ষে মতামত সৃষ্টিকারী মুসলিমলীগের নেতৃত্বের পক্ষে এদেশ থাকা তখন লজ্জার ব্যাপার। দেশভাগের সাথে সাথে প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দেশত্যাগী হন। যদিও অখণ্ড বাংলার সমর্থক সুরাবর্দি, আবুল হাসিম এবং আরও অনেকে এদেশেই থেকে গিয়েছিলেন -পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে কিছু দিনের ব্যবধানে সুরাবর্দি, আবুল হাসিম সহ ৪০ এর দশকের প্রভাবশালী বিভিন্ন মুসলিম নেতাগণ পূর্বপাকিস্তানে চলে যান। এই দেশত্যাগী মুসলমান নেতা গনের মধ্যে পরবর্তীতে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানে অ্যাডভোকেট জেনারেল,সুরাবর্দি প্রথমে আইনমন্ত্রী পরে পূর্ব পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
দেশভাগের ফলে এই যে উচ্চ পর্যায়ের মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেশত্যাগ - নিঃসন্দেহে পূর্বপাকিস্তান তার লাভ পেয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যেই ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে রাজনীতি এবং পাকিস্তানি আধিপত্য বিরোধী ৭০ এর দশকে বাংলা জাতীয়তাবাদ এই রাজনীতির ফল হলেও - এই গণ দেশত্যাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজে বিপুল রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পশ্চিমবঙ্গে যে সমস্ত মুসলমান রয়ে গেলেন তার হটাৎ রাজনৈতিক অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন। সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ, দাবী এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করার নেতৃত্ব দেওয়ার মত সক্ষম নেতৃত্ব আর অবশিষ্ট রইলনা। অন্যদিকে এপার থেকে পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমানদেরও জীবন খুব একটা রঙ্গিন কিছু ছিলোনা, তাদেরও নূতন দেশে শিকড় গাড়ার পরিশ্রম,হার্ডসিপ কিছু কম ছিলোনা।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে যাওয়া মুসলমান সংখ্যায় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তু দের তুলনায় আনুপাতিক হারে কম হলেও মুসলমান সমাজে এই দেশত্যাগ সামাজিক, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব অসীম। এই মুসলমান দেশত্যাগীদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত,প্রফেশনাল ক্লাস এবং তাদের মধ্যে অনেকেই অবিভক্ত বাংলার প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। এই প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বদের দেশত্যাগ এপারে থেকে যাওয়া মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করল এক সামাজিক- সাংস্কৃতিক শূন্যতা। যারা এপারে রয়ে গেলেন তার মধ্যে অধিকাংশ দুর্বল,গরীব, সম্পদহীন ,মূলত কৃষিজীবী,যোগাযোগ হীন এক সংখ্যালঘু জন সম্প্রদায়। যাদের ওপারে গিয়ে খুব একটা কিছু উন্নতির আশা বা স্কিল নিয়োগ করে নূতন জীবন তৈরি করার উপায় ছিলোনা। যদিও কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল যাদের মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যোগাযোগ,অথবা পাকিস্তানের দাবীর প্রতি সমর্থন কোনটাই ছিলোনা, এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে কেউ বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। যারা দেশভাগের পরেও নিজেদের ভূমিতে রয়ে গেলেন তাদের নিজস্ব যুক্তি ছিল, এমনকি যারা পাকিস্তানের সমর্থনে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই দেশত্যাগে অনিচ্ছুক ছিলেন। অন্যদিকে সেই সমস্ত হিন্দু এবং হিন্দুমহাসভা’র নেতাগণ যারা বাংলা ভাগের সমর্থনে গলা ফাটিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই আবার পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে চাননি। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক যিনি বর্ধমানের জাবগ্রাম থেকে রাজশাহী তে মাইগ্রেট করেন বলেন যে তার কোন কোন কাকা এবং আত্মীয়রা যদিও পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু অবশেষে পাকিস্তানে যাননি।
মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ উচ্ছেদ
দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সেটেলমেন্ট প্যাটার্ন বিপুল পরিমাণে পরিবর্তিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট কিছু পকেটে মুসলমান সম্প্রদায় বসবাস করতে বাধ্য হতে থাকে। ১৯৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গার সময়ে এবং তার পরে ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমান পরিবার নিরাপত্তার সন্ধানে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়। পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার এবং এইধরনের মুসলিম ঘন বসতি অঞ্চলে মুসলমান’রা ক্রমশ সরে যেতে থাকেন। স্বাধীনতার পরে মূলত বড়বাজারের মারোয়াড়ী এবং হিন্দু অভিজাতদের মদতে শহরের প্রাইম এলাকা থেকে মুসলমান উচ্ছেদের এক কর্মযোগ চলে প্রায় ১৯৬০ -১৯৬২ সাল পর্যন্ত। মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল মুসলমানদের দোকান এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির দখল নেওয়া। অন্যদিকে হিন্দু বস্তি মালিকেরা এই সুযোগে তাদের বস্তি থেকে মুসলমান উচ্ছেদের সমর্থনে এবং হিন্দু উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে উচ্চ ভাড়ার আশায় এই দলে নাম লেখায়। বেছে বেছে মুসলমান বস্তি আক্রমণ করা শুরু হয়। মুসলমানেরা মিয়াবাগান, বেলেঘাটা, মতিঝিল, শ্যামবাজার, রাজাবাজারের কাছে সাহেব বাগান এবং এন্তালির বস্তিগুলি থেকে উচ্ছেদ হন। শহরের মুসলমান সেটেলমেন্ট প্যাটার্ন পরিবর্তিত হতে থাকে দ্রুত, মুসলমানেরা ঘেটোবন্দী জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়ে পরে। সেই সময় থেকে মুসলমানেরা হিন্দু এলাকায় সম্পত্তি, ফ্লাট কেনা দূরের কথা হিন্দু এলাকায় বাড়ি ভাড়াতেও পাননা। দেশভাগের ফলে এই যে সৃষ্ট হওয়া ফাটল, অবিশ্বাস, অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব তার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ না সংখ্যাগুরু হিন্দু বাঙালি করছে না সংখ্যালঘু মুসলমান। সেই অশান্ত সময়ে যে সমস্ত মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন ক্রমশ ঘেটোবন্দি জীবন হয়ে দাঁড়ায় তাদের সারভাইভাল স্ট্রাটেজি।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের নিরাপত্তা,পরিচিতি এবং ন্যায় এর সন্ধান
স্বাধীনতার পরবর্তী সময় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পক্ষে এক অতি দুর্যোগপূর্ণ সময়। প্রথমত জীবন ,সন্মান এবং সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিজস্ব ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতি বজায় রাখার তাগিদ এবং সংখ্যাগুরুর হিন্দুসম্প্রদায়ের সাথে একই শর্তে নিজেদের প্রতিস্থাপনের লড়াই। যদিও ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার পথ অবলম্বন করে এবং সেকুলার ভারতবর্ষ সর্ব ধর্মের প্রতি সহনশীল এবং সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার নিশ্চিত করন তার অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমানদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ইতিহাস এবং আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজকর্ম সর্ব ধর্মের প্রতি সহনশীলতার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠায়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে হিন্দু উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাদের ছায়া ততদিনে দীর্ঘায়িত করতে শুরু করেছে। সংখ্যালঘুদের সম্বন্ধে গড়ে উঠছে এক অসূয়া জনিত মনোভাব। মুসলমান'রা ততদিনে ঘেটোর বাসিন্দা, তাদের বিশ্বস্ততা ইতিমধ্যে সন্দেহর বস্তু, জাতীয় রাজনীতি তাদের সাথে এক দরকষাকষির অবস্থানে। কংগ্রেস নেতৃত্বের পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ এর মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দাঙ্গায় মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ প্রমাণিত। তার সাথে ১৯৬৫ এর ভারত পাক যুদ্ধের সময়ে সাধারণত মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখা হতে শুরু হয়। পাকিস্তানের চর সন্দেহে বিপুল পরিমাণ মুসলমান সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হয়। অন্যদিকে কংগ্রেস মুসলমানদের নিরাপত্তা দেওয়ার ডিল হিসাবে মুসলমান ভোট তাদের পক্ষে এক কাট্টা করতে থাকে, কিছু বিশিষ্ট মুসলমান নেতৃত্ব কে নিজেদের দলে স্থান দিয়ে চলতে থাকে এই দু মুখো নীতি।সংখ্যালঘু নিরাপত্তা ততদিনে এক সুবিধাবাদী চুক্তিতে পরিণত, কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট উভয়ের কাছেই ধর্মনিরপেক্ষতা সেই চুক্তির রাজনৈতিক মুখ। ১৯৬২-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই দুমখো নীতি কাজে দিলেও ১৯৬৭ এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে এবং আরও আটটা রাজ্যে কংগ্রেস ধরাশায়ী হয় - বিপুল পরিমাণ মুসলমান ভোট পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে জমা হতে থাকে। ১৯৬৭ সাল পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পক্ষে এক ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্ত - দাঙ্গার ভয় থেকে মুসলমান ততদিনে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বতা অর্জন হয়ে দাঁড়ায় তাদের অন্যতম লক্ষ্য।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের প্রতি সমদর্শিতার প্রশ্ন
তত্ত্বগতভাবে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সমস্ত নাগরিক আইনের চোখে এক হলেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই তাত্বিক অবস্থান বাস্তব অর্থে যে ভিন্ন ছিল তা প্রমাণিত হয় সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে। মুসলমানদের যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে যে তারা এদেশীয় নন। তাদের আনুগত্য বিষয়ে সদা সন্দিহান মনোবৃত্তির ফলে ভারতের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস মুসলমানদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ***(পাদটীকা )। ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারী অ্যাডমিনস্ট্রেসানের উচ্চ পদে মুসলমান সংখ্যা অতি নগণ্য। শিক্ষা ক্ষেত্রের উচ্চ পদে মুসলমান অবর্তমান। ভারতীয় রেলে যত সংখ্যক মুসলমান কর্মরত তার ৯৭ % চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা ঐতিহাসিক সময় থেকে হিন্দুদের তুলনায় সম্পদে, রাজনৈতিক ক্ষমতায় এবং শিক্ষায় পিছিয়ে থেকেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা ছিল জমিদার আর মুসলমানেরা রায়ত এবং ভাগচাষী। কেবলমাত্র ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ এর সময়ে অবিভক্ত বাঙলায় মুসলমান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী হিন্দুদের কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে দাঁড় করাতে পেরেছিল। মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র এবং ব্রিটিশ প্রবর্তিত কিছু সংরক্ষণের সুবিধা,সাথে মুসলিম লীগের রাজনীতি তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কিছুটা পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু দেশ ভাগের পরে সমস্ত প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের সাথে সাথে স্বাধীন সেকুলার ভারতবর্ষে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের পরিবর্তে চলে আসে জাতির ভিত্তিতে সংরক্ষণ।
যেহেতু মুসলমানরা তাত্বিক ভাবে তাঁদের ধর্মে জাতি বিভেদের অস্তিত্ব স্বীকার করেনা তাই এদেশে থেকে যাওয়া বিপুল পরিমাণ দরিদ্র মুসলমান সংরক্ষণের আওতার বাইরে চলে যায়। তার ওপর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শিক্ষিত হিন্দু উদ্বাস্তু এবং চাকরীর জন্যে তাঁদের মরিয়া প্রয়াস পশ্চিমবঙ্গে রয়ে যাওয়া তুলনামূলক কম শিক্ষিত মুসলমান যুবকদের কাছে চাকরীর বাজার ক্রমশ কঠিন করে তোলে। হিন্দু উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের হিন্দু প্রীতি বা সূক্ষ্ম মুসলমান বিদ্বেষ মুসলমানদের উচ্চ পদে উন্নীত হওয়ার এবং নূতন নিয়োগের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে সরকার অনুমোদিত স্কুলে নিয়োগের দায়িত্ব থাকতো স্কুল ম্যানেজিং কমিটির হাতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নিয়ন্ত্রণ ছিল হিন্দুদের হাতে এবং সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে মুসলমান ছাত্র থাকলেও মুসলমান শিক্ষক প্রায় ছিলইনা। যদিও পশ্চিমবঙ্গে সরকারী এবং বেসরকারি চাকরীর ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনুপাত খুবই কম ছিল এবং বাকি সমস্ত সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানেরা পিছিয়ে ছিলেন কিন্তু না কংগ্রেস না বামফ্রন্ট কেউই সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জন্য কোন রকমের সংরক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাননি**(পাদটীকা )। কিন্তু অন্যান্য রাজ্য যেমন কেরালায় মুসলমান জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম হওয়া স্বত্বেও ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ১৫(৪) এবং ১৬(৪ ) ধারা অনুসার তাদের রাজ্যে মুসলমানদের জন্য চাকুরি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। কেরালায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ১২% মুসলমান কোটা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ৫০% মুসলমান এবং খ্রিস্টান কোটার কারণে সারা পশ্চিমবঙ্গের সরকারী চাকুরিতে যখন মাত্র 2.1% মুসলমান কর্মরত তখন কেরালায় সরকারী চাকুরিতে মুসলমানের সংখ্যা 10.4%। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত PSU তে একজনাও গ্রুপ এ পোস্টে মুসলমান না থাকলেও কেরালায় ৯,৫% মুসলমান PSU গুলিতে গ্রুপ এ তে কর্মরত। পশ্চিমবঙ্গের আইন বিভাগে মাত্র ৫% মুসলমান অথচ কেরালায় ১2.3% মুসলমান আইন বিভাগে কর্মরত। যদিও কেরালার এই মুসলমান সংরক্ষণের পেছনে সেখানকার মুসলিম লীগের ( IUML) মত রাজনৈতিক দলের চাপ বর্তমান ছিল কিন্তু আমাদের রাজ্যে মুসলমানদের প্রতি এই ভয়ঙ্কর বৈষম্যের অন্যতম কারণ সংখ্যালঘু বিষয়ে আমাদের রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিপুল উদাসীনতা। ভদ্রলোক বাঙালীর সুপ্ত হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতার উত্তরাধিকার বহন করে আসার ধারবাহিকতা। উদ্বাস্তু রাজনীতির প্রভাব,উচ্চ বর্ণের হিন্দু প্রভাবিত পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রাজনৈতিক দলের মুসলমানদের প্রতি অসংবেদনশীলতা এবং মুসলমান স্বার্থ আদায় করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি।
অতএব...
দেশভাগ প্রকৃত অর্থে বাংলার মুসলমানদের কাছে ভীষণ ক্ষতিকর এবং বিধ্বংসী প্রভাব। দেশভাগের ফলে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মুসলমানদের দেশ ত্যাগ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা এবং বাকি যারা রয়ে গেলেন তাদের প্রতি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির ধারাবাহিক উদাসীনতা এবং বঞ্চনা। স্বাধীনতার পরের দুই দশক পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা ভোগ করেছেন করেছেন চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু বিশেষত পূর্ববঙ্গ থেকে এদেশে আসা হিন্দু - মুসলমানদের সম্বন্ধে প্রচার করেছে এক তীব্র ঘৃণা। পূর্ববঙ্গ থেকে উচ্ছেদের কারণ হিসাবে উদ্বাস্তুরা দায়ী করেন মুসলমানদের, তাদের এই মুসলমান বিষয়ক ঘৃণার সমবেত স্মৃতি অজান্তে চারিত হয়ে গেছে পরবর্তী প্রজন্মে। পশ্চিমবঙ্গে এই মুসলমান বিদ্বেষ সুপ্ত কিন্তু ভীষণ শক্তিশালী। আমাদের গর্বের শহর কোলকাতায় হিন্দু প্রধান এলাকায় মুসলমানদের বাড়িভাড়া,,ফ্ল্যাট,সম্পত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য অন্যদিকে কলকাতারই মুসলমান প্রধান এলাকাগুলি বিষয়ে হিন্দুদের বিভিন্ন অজ্ঞতা প্রসূত ধারনা। এই সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের স্বাধীনতার পরবর্তী দুই দশকের প্রাথমিকতা ছিল নিজেদের প্রান এবং সম্পত্তি বাঁচানো। কলকাতার মত শহরে তারা বাধ্য হয়েছে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বসবাস করতে। মুসলমানদের এই ঘেটো বন্দী জীবন,সামাজিক,সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক পরিসর থেকে ক্রমশ গুটিয়ে নেওয়া এবং বিচ্ছিন্ন জন সম্প্রদায় হিসাবে বেঁচে থাকা দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে এক দুঃখজনক কিন্তু কঠিন বাস্তব। দেশভাগের পরবর্তী বাঙলার মুসলমানেরা মোকাবিলা করতে থাকে আত্মপরিচয়ের জটিল সমস্যা। নূতন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের কি অবস্থান হবে, কেই বা তাঁদের দাবী দাওয়া তুলে ধরবে, অধিকারের স্বপক্ষে লড়াই করবে -এই দ্বন্দ্ব এবং সমস্যাকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলেও মুসলমানেরা রয়ে যায় ক্রমে বিচ্ছিন্ন,প্রান্তিক এবং খণ্ডিত জনসমাজ হিসাবে। একই রাজ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা জগত মুসলমানদের -দেশভাগ পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানদের কাছে মূলত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এবং তাদের প্রান্তিক স্তরে পরিণত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর বীতশ্রদ্ধ উত্তরবঙ্গের চা বাগানের আদিবাসীরা যেমন নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন ‘ আদিবাসী বিকাশ পরিষদ’। শত দুর্বলতা স্বত্বেও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা যেমন নেপালি সংখ্যালঘুদের স্বার্থে এক প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ করছে অথবা কেরলে’র মুসলিম লীগ মুসলমানদের দাবীর সমর্থনে কখনো সিপিআই(ম ) কখনো কংগ্রেসের সাথে মিলে নিজেদের দাবী আদায়ে চাপ সৃষ্টি কারি এক রাজনৈতিক সংগঠন। হয়ত ঠিক তেমনই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে সুবিধাবাদী এবং উদাসীন সুপ্ত সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী কংগ্রেস এবং সিপিআই (ম ), তৃনমূলের ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতার বাইরে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলবেন নিজেদের সক্ষম রাজনৈতিক সংগঠন। হয়ত কোনদিন স্বাধীনতা পূর্ব বাঙলার মত পশ্চিমবঙ্গের ২৭-২৯% মুসলমান এবং ২৩% নমশূদ্রদের জোটের রাজনীতি সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। কিন্তু ততদিন তহ্বা সিদ্দিকি,ইমাম ভাতার সস্তা রাজনীতি একটি কি দুটি পূর্ণ বা প্রতিমন্ত্রীর টোপ এবং বিবিধ কুনাট্য পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাসিন্দাদের দুর্ভাগ্য জনক ভবিতব্য হিসাবে রয়ে যাবে।
*** হুমায়ুন কবির মুসলিম লীগের পাকিস্তানের ফর্মুলায় বিশ্বাসী ছিলেন না,তিনি চেয়েছিলেন সেকুলার ভারতবর্ষ, এই খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ,পার্লামেন্টারিয়নের নাতি সমস্ত যোগ্যতামান পার করা স্বত্বেও কেবলমাত্র মুসলমান হওয়ার কারনে RAW'র এয়ার উইং তার নিয়োগ বাতিল করে। ১৯৬৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত RAW'র ১০০০০ কর্মী এবং NTRO'র ৭৫০০ কর্মী'র একজনাও মুসলমান নয়। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো'র ১২০০০ কর্মীর 0.5%এর কম কর্মী মুসলমান। ভারতে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো স্থাপিত হওয়ার ১২৫ বছর পরে ২০১২ সালে সৈয়দ আসিফ ইব্রাহিম প্রথম মুসলমান যিনি ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হতে পেরেছেন। স্বাধীন সেকুলার ভারতবর্ষ এই বিষয়ে ব্রিটিশ লিগ্যাসি'র সফল উত্তরাধিকার বহনকারি।
** ২০০৬ সালে সাচার কমিটি পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের হাল স্পষ্ট করার পরে ২০১০ সালে রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বামফ্রন্ট সরকার এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জন্য ১০% ওবিসি কোটার ব্যবস্থা নেন,অথচ কেরল স্বাধীনতার পূর্বে মুসলমানদের জন্য বর্তমান বিভিন্ন কোটা স্বাধীনতার পরেও বজায় রাখে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ১২% মুসলমান কোটা সেখানে প্রায় স্বাধীনতার পর থেকেই বর্তমান। ( দেখুন ঃ- A History of Reservation ঃ- R.Krishnakumar)
দেখুন ঃ-
Bengal Divided :- Hindu Communalism and Partition 1932-1947 :- Joya Chatterji
Sachar Commeitee Report
Bengal Pact :- Frontline
ABUL HASHEM HAD A POINT :- Ashok Mitra Telegraph June 22 2009
The Partion & Muslim Minority :- Tridib Kundu Indian Journal of Politics, Vol. XLII, No.1 & 2 (January-June 2009)
আমার জীবনে ঃ- ১৯৩১-১৯৫০ বদরুদ্দিন উমর
লেখাটির সংক্ষিপ্ত রূপ 'দুর্বার ভাবনা'য় প্রকাশিত হয়েছিল।