‘The Rojava Revolution is the Paris Commune under German siege,Mardrid during the Spanish civil war,and Stalingrad during the second world war’
জর্জ অরওয়েল তার স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ‘Homage to Catalonia’ শুরু করছেন এইভাবে ‘In the Lenin Barracks in Barcelona, the day before I joined the militia,I saw an Italian militiaman standing in front of the officer’s table.’। ফ্যাসিবাদি বিরোধী ১৯৩৬-১৯৩৯সালের সেই লড়াই হাজারো স্বাধীনতাকামী মানুষের সাথে পেয়েছিলো অরওয়েল, হেমিংওয়ে, নরমান বেথুন এমনকি ইরানের প্রধানমন্ত্রীর মত ব্যাক্তিত্বকেও। ৫৩ টী দেশের গনতন্ত্রকামী ছাত্র যুবা শ্রমিক লেখক শিল্পীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের অপ্রশিক্ষিত সদস্যদের স্পেনের কমরেডের সাথে ভাঙ্গা রাইফেল নিয়ে যে জীবনপন লড়াই তা ছিল এক বৈকল্পিক সমাজব্যবস্থা রক্ষা সাথে ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিরোধ। স্পেনের জনতার সেই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াই, নারী স্বাধীনতার বৈপ্লবিক পথ এবং বৈকল্পিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী শক্তি দমন করেছিলো এক রক্তাক্ত পথে। ‘Homage to Catalonia’ সেই ইতিহাসের এক অনন্য দলীল।
স্পেনের সেই অসমাপ্ত বিপ্লবের প্রায় ৭৫বছর পরে আমাদের বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী ‘আবদুল্লা ওচালানের’ ( Abdullah Öcalan) 'ডেমোক্রাটিক কনফেডারিলিসম’ বা ‘রাষ্ট্রবিহীন গণতন্ত্র’ তত্বর ভিত্তিতে সিরিয়া তুরস্কের সীমান্ত অঞ্চলে বর্তমানে ঘটে চলছে এক অভূতপূর্ব ‘সামাজিক বিপ্লব'। একদিকে তুরস্কের ফ্যাসিবাদী সরকারের তীব্র অসহযোগিতা, কঠিন 'এমবারগো’র খাড়া প্রাচীর অন্যদিকে ধর্মান্ধ ইসলামিক স্টেট (ISIS) এর চূড়ান্ত বর্বরতা এবং প্রত্যহ সম্মুখ যুদ্ধ,একই সাথে পেছনে ফেলে আসা হাজারো বছরের চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় দমনের ইতিহাস। এই চরম প্রতিকূলতা এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের বীভৎসতার মধ্যেও ৫০লক্ষের অধিক কুরদ এবং অন্যান্য জনজাতি ১৮৪০০ স্কোয়ার কিলোমিটারের এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আবদুল্লা ওচালানের প্রদর্শিত পথে ২০১২ সাল থেকে গড়ে তুলছেন ‘রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের’ এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ‘Rojava Revolution’। আমাদের বর্তমান সময়ের সম্ভবত সবথেকে উচ্চাভিলাষী বৈপ্লবিক এক সামাজিক পরীক্ষা নিরীক্ষা।
মূলত পশ্চিমের মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা এই অঞ্চল থেকে হাজারে হাজারে মানুষের ইউরোপ অভিমুখে আশ্রয় সন্ধানের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার বিবরণ, সাথে ইসলামিক স্টেট নামক বর্বর ধর্মান্ধগনের সিরিয়া এবং ইরাকের ঐতিহাসিক স্থানগুলি ধ্বংস করে দেওয়ার সংবাদ, নিরস্ত্র অন্য ধর্মের অসহায় নাগরিকের গণহত্যার বীভৎসতা,মহিলাদের যৌন দাসী হিসাবে ব্যবহারের কদর্যতার সম্বন্ধে প্রত্যহ অবগত হচ্ছি। মার্কিন এবং রাশিয়ার সম্রাটদের ইসলামিক স্টেট বিরোধী হুমকি এবং মাঝে মাঝে বিমান হানার খবর আমাদের আশ্বস্ত করছে যাক বিশ্বের প্রধান নেতাগণ ইসলামিক স্টেট এর বর্বরতার অবসানে এতদিনে সত্যিই কিছু কাজের কাজ করছেন। অথচ একই সময়ে এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অভূতপূর্ব যে বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে যা প্রকৃত অর্থে একাধারে ইসলামিক স্টেটের অগ্রগতি রুখে দিচ্ছে পাল্টা সামরিক অভিযানে অন্যদিকে তত্বগতভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তথাকথিত গনতন্ত্র,কম্যুনিস্ট আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের ধারনা এবং ইসলামিক স্টেট এর নিরঙ্কুশ মুসলিম মৌলবাদ কে আক্রমণ করছে আবদুল্লা অকালনের তত্বের বাস্তব প্রয়োগে তার খবর আমাদের কাছে প্রায় অজ্ঞাত। যদিও রাজনৈতিক ইতিহাস পরিচিতি বিনা উল্লেখে রোজাভা'র মহিলা যোদ্ধাদের চিত্র আমাদের কাছে মাঝে মাঝে পরিবেশিত হচ্ছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে। এমনকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবী শক্তি যা এখনো কিছুটা জনমত তৈরিতে সক্ষম আশ্চর্যজনক ভাবে তারাও এই অসাধারণ ‘রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের’ ম্যাসিভ স্কেল এ ঘটে চলা সামাজিক বিপ্লবের বিষয়ে পাথরের মত নিস্তদ্ধ।
প্যারিস কমিউন টিকে ছিল মাত্র ৭০-৮০ দিন, স্পেনের বিপ্লব তিন বৎসরের কিঞ্চিৎ অধিক, অন্যদিকে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতেতে ‘রোজাভা বিপ্লব’ টিকে আছে তিন বৎসরের অধিক সময়। সম্প্রতি রোজাভা তার প্রাথমিক সংবিধানটি বিপুল গণভোটে পাস করেছে -এই সংবিধানের অন্যান্য অনেক বৈপ্লবিক সিধান্তের সাথে অন্যতম বৈপ্লবিক সিধান্ত ‘বাল্য বিবাহ এবং বহুবিবাহপ্রথা নিষিদ্ধ'। আরব মুসলমান প্রধান দুনিয়াতে যা প্রথম এবং অভূতপূর্ব। এই অসাধারণ সামাজিক বিপ্লব, তার সমস্ত প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে টিকে থাকা, বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ক্রম প্রসার এবং সেই নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে জ্ঞানবান বুদ্ধিজীবী বিশেষত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী গনের অদ্ভুত নীরবতা বিষয়ে David Graeber সম্প্রতি তার Gurdian এ প্রকাশিত এক লেখায় বলেছেনঃ- “Is the world -and this time most scandalously of all, the international left- really going to be complicit in letting history repeat itself?”
রোজাভা বিপ্লবের প্রেক্ষাপটঃ- কুর্দ লড়াইয়ের ইতিহাস
A mountain river has many bends.
—From a Kurdish folk song
পৃথিবীর সব থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা কুর্দদের এই ধারাবাহিক স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসে এত বাঁক, এত উথাল পাথাল, এত বিশাল জটিলতা এবং এত বিভিন্ন পথ এই দীর্ঘ সময়ে তা অতিক্রম করেছে তাকে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। প্রায় 3 কোটির অধিক জনসংখ্যার এই কুর্দরা মধ্য এশিয়ার 'নন আরব' রাষ্ট্রহীন এক অদ্ভুত স্বাধীনতা প্রিয় জনজাতি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্য এবং সরকার দ্বারা ব্যবহৃত,নিপীড়িত এই জনজাতির স্বাধীনতা এবং সতন্ত্রতার লড়াই এর ইতিহাসের সন্ধান আবদুল্লা ওচালান খুঁজে পেয়েছেন সেই সুমেরীয় সভ্যতার সময় থেকে।ভাষা গত এবং এথেনেসিটির দিক থেকে এরা পারস্য বা ইরানিদের জাতিগত ভাই গোত্রের। কুর্দিস্তান বা বর্তমানের সিরিয়া, তুরস্ক,ইরান এবং ইরাকের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী এই জনজাতির ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা পারস্য, আরব,গ্রিস এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা আক্রান্ত এবং অধিকৃত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। প্রতিটি সাম্রাজ্যই এই স্বাধীনতা প্রিয় কুর্দ জনজাতির বশ্যতা আদায়ে অসমর্থ হওয়ায় নামিয়ে এনেছে আক্রমণ। কুর্দরা ক্রমে দুর্গম থেকে অতি দুর্গম পাহাড়ি এলাকার আশ্রয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। কুর্দরা তাই বলেন “the Kurds have no friends but the mountains”।
বিভিন্ন সময়ের লড়াই,আধিপত্যকারী সাম্রাজ্যের দুর্বল হওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের প্রাক্কালে অবশেষে ১৫০০ সাল নাগাদ কুর্দ জনজাতি বর্তমানের কুর্দিস্তান অঞ্চলে এক ধরনের স্বশাসনের স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়। অটোমান সাম্রাজ্য উনবিংস শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৩০০-৩৫০ বৎসরের অধিক সময়কালে কুর্দদের এই অটোনমি নিয়ে বিশেষ একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ১৮৩০-৩৫ সাল নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্য এই স্বাধীন কুরদ এলাকাকে কস্তনাতিনওপোলের অধীনে নিয়ে আসতে ব্যগ্র হয়ে পরে। ছোট খাট যুদ্ধ বিগ্রহ অবশেষে ১৮৪৭ সালে বদর খান বেগ এর নেতৃত্বে কুরদদের এই বিদ্রোহ এক বিশাল যুদ্ধের আকার নেয়। অটোমান সাম্রাজ্য এই বিদ্রোহ দমন করে চূড়ান্ত নির্মমতার সাথে। শুরু হয় ১৭০ বছরের ধারাবাহিক নিপীড়ন এবং কুর্দ স্বাধীনতার এক অনন্য আন্দোলনের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৎকালীন তুরস্কের ‘ইয়ং তুর্কস’ পার্টি পরিকল্পিত ভাবে জনজাতি নিধনের যে অভিযান টি চালায় তা ইতিহাসে 'আর্মেনীয়ন জেনোসাইড' হিসাবে কুখ্যাত। ১০ ‘লক্ষের অধিক আর্মেনীয় হত্যার এই অভিযানের সাথেই চলতে থাকে কুর্দ'দের ওপর আক্রমণ। ১৯১৬ সাল থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৭০০,০০০ র অধিক কুর্দ জনজাতি কে সেই সময় বলপূর্বক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। অবশেষে ১৯২০ সালের আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হওয়ার পর কুর্দ দের প্রতি এই দমনের ধারাবাহিকতায় সাময়িক বিরতি ঘটে। পরাজিত অটোমান সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী পক্ষের সাথে অবমাননামূলক Treaty of Sevres চুক্তি সাক্ষর করতে বাধ্য হয়।এই চুক্তি অনুসার অটোমান সাম্রাজ্যের তুর্ক প্রধান অঞ্চলগুলিকে বাদ দিয়ে জয়ী পক্ষ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বাকি সাম্রাজ্য ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেয়।বালির ওপর দাগ কেটে সীমানা সৃষ্টি হয় বর্তমান আরব দুনিয়ার। আজকের সিরিয়া এবং তার পার্শ্ববর্তী চলে আসে ফ্রান্সের প্রভাবে, ইরাক হয়ে পরে ইংল্যান্ডের অধীন,আর কুর্দিস্তানের বিসয় টি ছেড়ে দেওয়া হয় এক রেফারেন্ডামের ফলাফলের ওপর। সদ্যগঠিত আর্মেনিয়া, ব্রিটিশ প্রভাবিত ইরাক, ফ্রান্স প্রভাবিত সিরিয়া এবং তৎকালীন খণ্ডিত অটোমান সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ বর্তমান তুরস্কের মধ্যে স্বাধীন কুর্দিস্তানের সীমানা কি হওয়া উচিৎ এ নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে থাকে। ভারসাই চুক্তির অবমাননাকর শর্ত যেমন পরবর্তীতে জার্মান জাতীয়তাবাদ এবং হিটলারের উত্থানের কারণ ঠিক সেইভাবেই Treaty of Sèvres এর অবমাননাকর শর্ত কেমাল আতাতুর্ক এর নেতৃত্বে তুরস্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্ম দেয়। ১৯২২ সালে কেমাল আতাতুর্ক এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে তুরস্ক থেকে সুলতানেত এর অবসান ঘটে। আতাতুর্কের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে ব্যবস্থা পরিবর্তন ব্রিটেন এবং অন্যান্য অ্যালায়েড শক্তি কে বাধ্য করে এক নূতন চুক্তির উপস্থাপনা করতে। এই চুক্তিটিকে আমরা Treaty Of Lausanne হিসাবে জানি। ১৯২৩ সালে সাক্ষরিত এই নূতন চুক্তি অনুসার কুর্দ দের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে কুর্দিস্তান কে পুনরায় কেমাল আতাতুর্ক এর তুরস্কর সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। Treaty of Sèvres এর মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্ন এবং আপাত শান্তি মাত্র কয়েকবছরের ব্যবধানে Treaty of Lausanne এর মাধ্যমে ডেকে আনে পুনরায় রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের ইতিহাস।
চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতাতুর্ক ৬৫ টি বিভিন্ন ধরনের ডিক্রি জারি করে কুর্দ দের অস্তিত্বই অস্বীকার করার জাতীয়তাবাদের নামে এক নিষ্ঠুর দমনের খেলা খেলতে থাকেন। কুর্দ অঞ্চলের সমস্ত জনজাতিকে পাহাড়ি তুর্ক’ বলে নূতন নামাকরন করা হয়। যে কোন পাবলিক স্পেস, স্কুল কলেজে কুরদিশ ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কুর্দ উৎসবগুলি রাতারাতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কুরদিশ বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে নামাঙ্কিত রাস্তা ঘাট,শহর এমনকি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামও বিশুদ্ধ তুর্কীয় নামে পরিবর্তিত করা হতে থাকে। কুর্দ দের গোষ্ঠীর জমি দখল করে নেওয়া হতে থাকে। কুর্দ কমুইনিটি ফান্ড বাজেয়াপ্ত করা হয়। কুরদিস রাজনৈতিক সংগঠন, কুর্দ দের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিষ্ঠান শেষ করার পর্ব চলতে থাকে এক কথায় কুর্দ অসিত্বই মিটিয়ে দেওয়ার পর্ব চলতে থাকে। Treaty of Lausanne র মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে কুর্দিস্তান কে বর্তমানের সিরিয়া, তুরস্ক,ইরাক এবং ইরানের মধ্যে চার টুকরো করে দেওয়া হয় এক কলমের খোঁচায়।
Rojava revolution বর্তমানের যে ভৌগলিক সীমানায় সংগঠিত হচ্ছে সেই সিরিয়া চুক্তিবলে ফ্রান্সের অধীন আধা কলোনি আধা স্বাধীন এক রাষ্ট্র হিসাবে পরিণত হয়। চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার সময় সিরিয়ার জনজাতির ১৮% ছিল কুর্দ (বর্তমানে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা ১৪-১৬% ) সিরিয়ার বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সিরিয়ার আরব এবং অন্যন্য জনজাতি ফ্রান্সের আধিপত্যর বিরোধে সংগঠিত করতে থাকেন অসংখ্য ছোট খাটো বিদ্রোহ। সিরিয়ার আরব সম্প্রদায়ের এই বিদ্রোহ দমন করতে ফ্রান্স পরিচিত ডিভাইড অ্যান্ড রুল সাম্রাজ্যবাদী পলিসি অবলম্বনে বিভিন্ন নন আরব ট্রাইব যেমন কুর্দ,খ্রিস্টান,দ্রুযে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে লোক জন নিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী সৈন্যবাহিনীটি গড়ে তোলে। সিরিয়ার আরবদের মধ্যে সংখ্যালঘু এবং কুর্দ বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠার এ এক অন্যতম প্রধান কারন। ১৯৪৬ সালে ফ্রান্সের কবল থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত সিরিয়া সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুদের শক্ত হাতে মোকাবিলা করা শুরু করে। প্রায় ২০০,০০০ লক্ষের অধিক কুর্দ দের পরিচয় পত্র কেড়ে নেওয়া হয়,কুর্দ রা হয়ে পরে এক stateless সংখ্যালঘু জনজাতি, রাষ্ট্রীয় মদতে আভ্যন্তরীণ শত্রুদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হতে থাকে। জমি হারা,নাগরিকত্ব হারা কুর্দ এবং অন্যান্য জনজাতি পরিবর্তিত হতে থাকেন দাস শ্রমিকে। কুর্দ এলাকার সমস্ত গ্রাম শহর ইত্যাদি নাম বদলে দেওয়া চলতে থাকে,সামাজিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে অন্য এলাকা থেকে আরব বেদুইনদের এনে কুর্দদের এলাকায় বসতি গড়ে দেওয়া হয়। আরব বেদুইন দের অঞ্চল প্রধান থেকে পুলিস প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করা চলতে থাকে সাথে উস্কে দেওয়া হতে থাকে কুর্দ বিরোধী জাতীয়তাবাদ। ফ্রান্সের দাবাড় বোড়ে হিসাবে ব্যবহৃত কুর্দ জনজাতি হয়ে পরে সিরিয়ার আরব সম্প্রদায়ের গণশত্রু। চলতে থাকে কুরদিস সংস্থা এবং প্রথার নিষিদ্ধকরণ,হাজারো কুর্দ নাগরিক এবংট্রাইবাল নেতাদের কে তুচ্ছ অজুহাতে গ্রেপ্তার এবং গুপ্তহত্যার এক মহোৎসব চলে সিরিয়ার স্বাধীনতার পরবর্তী প্রায় একযুগ ধরে।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের অবশেষে ইরাক ইরান সিরিয়া এবং তুরস্কের নব্য জাতীয়তাবাদী এবং মৌলবাদী সরকারগুলির কুর্দ নিপীড়নের মধ্যে এক ধরনের সাজুস্য বর্তমান। নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া, গন উচ্ছেদ, ভাষা,প্রথা এবং সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা। সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন গুলির নিসিদ্ধ্বকরন। ছোট খাট অজুহাতে সামরিক অভিযান, খেত, শস্য বোমাবর্ষণ ইত্যাদি। সাদ্দাম হুসেনের ১৯৮৬-৮৯ সাল জুড়ে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে ১০০,০০০ -২০০,০০০ কুর্দ জনজাতির নিধন সম্ভবত দীর্ঘকাল ধরে এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চলে আসা কুর্দ নিপীড়নের সর্ববৃহৎ গণহত্যার উধাহরন । এই দীর্ঘ সময় জুড়ে সভ্য জগত বিশেষত পশ্চিমের শক্তিগুলির ডিপ্লোম্যাটিক নীরবতা,আশ্চর্যজনক উদাসীনতা সাথে সময়ে সময়ে কুর্দদের উস্কে দিয়ে নিজেদের তেলএর ভাণ্ডারের ওপর দখল এবং আঞ্চলিক স্বার্থ বজায় রাখার জটিল খেলা কুর্দ জনজাতি বুঝতে শুরু করে রক্ত এবং নিপীড়নের বিনিময়ে ১৯৭০ দশকের শেষের দিক থেকে। জন্ম হয় Abdullah Öcalan এর নেতৃত্বে কুর্দিস ওয়ার্কার্স পার্টির।
কুর্দিস ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাঃ- কুর্দ আন্দোলনের নূতন গতিপথ
এই ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা, ২৫ বছরের যুবা আবদুল্লা ওচালান ১৯৭৩ সালে মাত্র ৬জন সাথী নিয়ে এক সংগঠন গড়ে কুর্দ প্রশ্ন বিভিন্ন ফোরামে প্রচার করতে থাকেন। সেই সময়ে কুর্দ দের আন্দোলনের চেহারাটা ছিল কতকটা আমাদের দেশের ১৯২০-৩০ দশকের ব্রিটিশ বিরোধিতার আন্দোলনের মত। একদিকে কুর্দ অভিজাত সম্প্রদায়ের কংগ্রেসি মার্কা আন্দোলন আর অন্যদিকে কিছু বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর সশস্ত্র আন্দোলন এবং গ্রামের দিকে ট্রাইবাল গোষ্ঠীপতিদের বিছিন্ন সরকার বিরোধী প্রতিরোধ। আবদুল্লা ওচালান এবং তার রাডিক্যাল সংগঠন প্রথমেই এদের বিরোধিতার মুখে পরেন,কিন্তু ধীরে ধীরে ছাত্র যুবা দের সমর্থন, গ্রামে বসবাস করে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে লেগে থাকার ফলে সেই সংগঠনের সমর্থন বৃদ্ধি পায় দ্রুত। সেই গনসংগঠনের ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালে তার ২৩জন সাথী কি নিয়ে গড়ে তোলেন কুর্দিস ওয়ার্কার্স পার্টি(PKK)। ওকালানের সামনে তখন রয়েছে চারটি রাষ্ট্র জুড়ে কুর্দ দের ওপর দমন পীড়নের ধারাবাহিকতা। Treaty of Lausanneর মাধ্যমে কুর্দদের সাথে বঞ্চনার ইতিহাস। বিশ্বজুড়ে রুসিয়া লবি এবং আমেরিকা, ন্যাটোর ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর্যায়, চীনের,ভিয়েতনামের প্রতিরোধের ইতিহাস এবং সারা পৃথিবী জুড়ে মাওবাদী গেরিলাযুদ্ধের কৌশলে বিভিন্ন সংগঠনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা একই সাথে প্রথাগত ট্রাইব ভিত্তিক অকার্যকরী বিচ্ছিন্ন কুর্দ সংগ্রামের চিত্র। এই শিক্ষার ভিত্তিতে আবদুল্লা ওচালান পি.কে.কে স্বাধীন কুর্দিস্তানের দাবীতে এক সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন হিসাবে গড়ে তোলেন। ওচালানের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা,অসাধারণ বাগ্মিতা,কম্যুনিস্ট সংগঠন গড়ে তোলার দক্ষতা এবং কুর্দদের দীর্ঘকালীন স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্ন সফলের বিশ্বাস্য বিকল্প হিসাবে পি.কে.কে র গ্রহণযোগ্যতা অকালান কে এক জনপ্রিয় সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হিসাবে পরিবর্তিত করতে থাকে। পার্টি গঠনের সাথে সাথেই কিছু হাই প্রোফাইল গেরিলা আক্রমণ ,দক্ষিণ তুরস্ক জুড়ে সফল গেরিলা বোমাবর্ষণের ধারাবাহিকতা এবং সেই সময়ের তুরস্ক জুড়ে সরকার বিরোধী ছাত্র, শ্রমিক আন্দোলন,কুর্দিস্তানের লড়াই এ প্রথম মহিলা গেরিলা বাহিনি সৃষ্টি পি.কে.কে স্বাধীন কুর্দিস্তানের সংগ্রামকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যায় যে তৎকালীন তুরস্কের সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রার্থী হতে বাধ্য হয়। কুর্দ জনজাতির এক আঞ্চলিক আন্দোলন আবদুল্লা ওচালান এবং পি.কে.কের নেতৃত্বে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষনে সক্ষম হয়।
সেই সময়ের তুরস্কে দক্ষিণপন্থি এবং বামপন্থিদের আভ্যন্তরীণ লড়াই। ছাত্র যুবা শ্রমিক দের স্ট্রাইক এবং সরকার বিরোধী আন্দোলন সাথে পি.কে.কের আন্দোলনের ডামাডোলে বিধ্বস্ত অশান্ত তুরস্কে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাহানায় ১৯৮০ সালের শেষের দিকে সামরিক অভ্যূথানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে MGK( ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল)। সমস্ত রাজনৈতিক দল,ট্রেড ইউনিয়ন ব্যান করে দেওয়া হয়, ভেঙ্গে দেওয়া হয় পার্লামেন্ট এবং সমস্ত সরকারী সংস্থা - মার্শাল ল এবং কারফিউ জারী করে চলতে থাকে এনকাউন্টার এবং ধরপাকর। পি.কে.কের কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু নেতা ধরা পড়েন,মিলিটারি বেশ কিছু আভিযান প্রতিহত করে, পি.কে.কের তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বের মুক্তাঞ্ছল মিলিটারি আক্রমণের মুখে পড়ে,তুরস্কের ভেতরে থেকে লড়াই করার বাস্তবিক অসুবিধার কারনে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা লেবানন,সিরিয়া,পশ্চিম ইউরোপ এবং ইরাকের কুর্দ এলাকায় আত্মগোপন করেন। পি.কে.কে তার গেরিলা বাহিনীর শক্তিক্ষয় এড়াতে ট্রেনিং বেস সিরিয়ার উত্তরে তুরস্ক সীমানায় দুর্গম কুর্দ এলাকায় প্রতিষ্ঠাপিত করে। এই সময়ে গ্রেপ্তার এড়াতে আবদুল্লা ওচালান লেবাননে তার HQ স্থাপন করে কুর্দিস্তানের সপক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং জনমত তৈরির কাজ করতে থাকেন। মাত্র বছর দুয়েক পূর্বে গড়ে ওঠা পি.কে.কে প্যালেস্টাইন লিবারেসান অরগানাইজেসান,কমুইনিস্ট লিগ অফ ইরান এবং মার্কসিস্ট আর্মেনিয়ান গেরিলা গ্রুপের সমর্থন পেতে থাকে। একই সময়ে কুর্দ দের প্রশ্নর আন্তর্জাতিক পরিচিতির উদ্যেশে পি.কে.কে ইউরোপ জুড়ে তুরস্কের এমব্যাসি দখল এবং বোমাবর্ষণ চালাতে থাকে। এই অবস্থা চলতে থাকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। অবশেষে ১৯৮৪ সাল নাগাদ তুরস্কে পুনরায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসে, মিলিটারি শাসনের অবসান ঘটে।নূতন নির্বাচিত সরকার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃউদ্ধারের স্বার্থে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গুলির চাপে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি এবং হৃত গনতান্ত্রিক অধিকারগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার এক প্রক্রিয়া শুরু করে। এই অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে পি.কে.কে পুনরায় তাদের সিরিয়া/তুরস্কের সীমানায় আশ্রয় গ্রহণকারী গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের তুরস্কের ভেতরে নিযুক্ত করতে থাকে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পি.কে.কে মিলিটারি শাসনের সময় হারানো জমি পুনঃউদ্ধারে সক্ষম হয়,১৯৮৪ সালের শেষ দিক থেকে শুরু হয় ফুলস্কেল গেরিলা যুদ্ধ। মূলত দক্ষিণ তুরস্কে এই অভিযান সীমাবদ্ধ থাকলেও ইস্তাম্বুলও চলে আসে এই যুদ্ধের আওতায়। একই সাথে পি.কে.কে তার কোর এরিয়া কুর্দ প্রভাবিত এলাকায় গেরিলাযুদ্ধের ফাঁকে সামাজিক সুরক্ষা, মহিলাদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গ্রামের দিকে কুরদিস সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমে জনসমর্থনের ভিত্তি বাড়াতে থাকে। ১৯৭৮ সাল থেকে চলে আসা পি.কে.কের নেতৃত্বে এই গেরিলাযুদ্ধ বর্তমানে কারাগার বন্দী আবদুল্লা ওচালান এবং তুরস্ক সরকারের মধ্যে এক সমঝোতার অবশেষে ২০১৩ সালে এক শান্তিচুক্তির মাধ্যমে আপাত এক ভঙ্গুর শান্তির অবস্থানে বর্তমান।
স্তালিনবাদি ‘গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র শুঁয়োপোকা থেকে ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলিসম’র প্রজাপতি তে বিবর্তনঃ-
আবদুল্লা ওচালান এবং পি.কে.কের প্রতিষ্ঠাতা অধিকাংশ নেতাগনের কেউই ঠিক ডাই-হার্ড কম্যুনিস্ট ছিলেন একথা বলা যাচ্ছেনা। তাদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন কুরদিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, পথ ছিল সশস্ত্র আন্দোলন। সময়ের দাবীতে এবং তৎকালীন সারা পৃথিবী জুড়ে চলে আসা বিভিন্ন মাওবাদী গেরিলা সংগঠনের অনুসরণে আবদুল্লা ওচালানের ব্যক্তিত্বশীল নেতৃত্বে অন্যান্য সব কম্যুনিস্ট পার্টির মতোই 'গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র স্তালিন বাদী পলিটব্যুরো,কেন্দ্রীয় কমিটি ইত্যাদি ছকে বাঁধা পথেই পি.কে.কে গড়ে ওঠে। তৎকালীন তুরস্কে আরও ছোট ছোট লেনিনপন্থি,ট্রটস্কি পন্থি, অ্যানারকিস্ট এমনকি টিটো পন্থী দলগুলির উপস্থিতি থাকলেও আবদুল্লা ওচালানের নেতৃত্বদানের সক্ষমতা,সবল সংগঠন,গেরিলা যোদ্ধা সংগ্রহের এবং কুর্দিস্তানের দুর্গম পাহাড়ে তাদের মিলিটারি ট্রেনিং দেওয়ার নেটওয়ার্ক, বিপুল পরিমাণে মহিলা সদস্যের উপস্থিতি সারা তুরস্ক জুড়েই পি.কে.কে কে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বিরোধী প্রধান মুখ হিসাবে অতি দ্রুততার সাথে প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের অন্ত্যভাগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় জুড়ে তুরস্ক, লেবানন,সিরিয়াতে বসবাস করে 'গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র কঠিন পার্টি ডিসিপ্লিনের স্তালিন বাদী পন্থা অনুসরণে ওচালান কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। সেই ডিসিপ্লিন এতটাই কঠিন ছিল যে পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা,দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং একই সাথে অকালানের স্ত্রী 'কেশীরে ইয়িলডিরিম' কে তুরস্কের গোয়েন্দা বাহিনীকে তলে তলে পার্টির খবর পাচার করার অভিযোগে পার্টি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ওচালানের সমর্থনেই গৃহীত হয়।
একই সময়ে বিশ্বজুড়ে একই সাথে দু তিনটি ঘটনা ঘটতে থাকে। তুরস্কের অভ্যন্তরে পি.কে.কের মাওবাদী ধারায় সংগ্রামের পদ্ধতি,অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, কখনো সাধারণ নাগরিকের উপর গেরিলা হানা এবং তৎপরবর্তী সরকারী দমনের ধারাবাহিকতা অপেক্ষাকৃত লিবারেল সমর্থকদের পার্টির প্রতি কিছুটা বিরূপ করে তোলে। পি.কে.কে.র আন্দোলনের ফলে কুর্দ দের প্রশ্ন সারা বিশ্বে আলোচিত এবং তুরস্ক সরকারের মানবধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি দেশের ভেতরে এবং বাইরে আলোচ্য বিষয় হিসাবে উঠে এলেও অনাবশ্যক হিংসা বিদেশী সমর্থকদের মধ্যেও বিরূপ মতামতেরও সৃষ্টি করতে থাকে।
ন্যাটোর বৃহৎ সহযোগী তুরস্কের এবং আমেরিকার চাপে পি.কে.কে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা হিসাবে ঘোসিত হয়। ব্যাঙ্ক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। ওচালান তখন সিরিয়াকে কেন্দ্র করে তার সংগ্রাম টি পরিচালনা করছেন, তুরস্ক সরকার সিরিয়া কে এই বলে হুমকি দেয় যে ওচালান কে বহিষ্কার না করলে ফল ভালো হবেনা। সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্ভাবিত যুদ্ধ এড়াতে আবদুল্লা ওচালান রুসিয়াতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন।আবদুল্লা ওচালানের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন রুশ পার্লামেন্ট ২৯৮-০ ভোটে পাস করলেও তুরস্কের এবং আমেরিকার চাপে রুসিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়েলেতসিন প্রেসিডেন্সিয়াল ভেটো প্রয়োগে আবদুল্লা ওচালানের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ওচালান রুসিয়া পরিত্যাগ করে ইউরোপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। রুসিয়ার এবং সমাজতান্ত্রিক ব্লকের প্রায় অবলুপ্তি,চীনের পুঁজিবাদী পথ অবলম্বন, মার্কসবাদী তত্বের অবলম্বনে প্রলেতারিয়েট ডিক্টেটারশিপ রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা,স্তালিন পন্থী কঠিন কমিউনিস্ট স্ট্রাকচারের কর্তৃত্বশালী আচার তাকে ধীরে ধীরে মার্কসবাদী পথের মাধ্যমে কুর্দ প্রশ্ন সমাধানের সফলতা অর্জন আদৌ সম্ভাব্য কিনা এ বিষয়ে ভাবাতে থাকে।একই সাথে প্রায় ২০ বছর ধরে চলে আসা গেরিলাযুদ্ধের ফলে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের প্রানের বিনিময়ে অর্জিত সফলতার হিসাব এবং যে কুর্দ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যেশে ১৯৭৮ সালে তিনি তার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা আদৌ মাওবাদী গেরিলাযুদ্ধের পথে অর্জন করা সম্ভব কিনা এবং সর্বোপরি কুরদিস সমস্যার অন্য কোন উপায়ে সমাধান সম্ভব কিনা এই সব প্রশ্ন ওচালানকে ভাবাতে থাকে। ওচালান নিষিদ্ধ পি.কে.কের গঠনতন্ত্রের এক আমূল বিকেন্দ্রীকরনের সাথে সাথে গন আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যেশে এবং লিবারেল সমর্থকদের একজোট করার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। পি.কে.কে স্তালিনবাদি খোলস মুক্ত হতে থাকে।
সেই সময় তুরস্ক বা সিরিয়ার সীমান্ত থেকে হাজারো মাইল দূরে মেক্সিকোতে ১৯৯৪ সালের ১লা জানুয়ারি NAFTA (নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসার মেক্সিকোর বাজার, চাষিদের জমি উৎপাদিত দেশীয় শস্য সমস্ত কিছু আমেরিকা এবংবাকি স্বাক্ষরকারী দেশের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার দিনেই এক অজানা সংগঠন Zapatista National Libaretation Armyর ( EZLN) হাজারো সশস্ত্র মায়া আদিবাসী গেরিলা মেক্সিকোর প্রধান শহর, জেলা শহর আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে। zapatista এক নূতন ধরনের মুক্তির লড়াই, মায়া আদিবাসী সমাজের স্বয়ংশাসন প্রতিষ্ঠা করার এই যুদ্ধ বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মিশ্রণে এক নূতন ধরনের বামপন্থী চিন্তার ফসল। Zapatista দ্রুত দক্ষিণ মেক্সিকোর জঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেদের স্বয়ংশাসন প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ‘they don't want to sieze power. This is something new. They want to create a democratic process that all Mexicans take part in. They want recognition of indegenious culture, history and autonomy ‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিহীন,পার্টির কন্ট্রোল বিহীন,পাল্টা রাষ্ট্র শক্তি তৈরি না করে বিপুল জনতার সায়ত্বশাসন অর্জনের এই সফল বামপন্থী পরীক্ষা ওচালান গভীর ভাবে অনুধাবন করেন। পার্টির দুইদিন ব্যাপী কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংএ zapatista আন্দোলনের বিস্তারিত বিশ্লেষণ এবং কুর্দ আন্দোলন সেই পথে পরিচালিত করা যায় কিনা এ নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা এবং দলিল প্রস্তুত হয়। ওচালান তার ইউরোপে বসবাস কালীন মার্কস পরবর্তী বামপন্থী লেখা পত্র এবং কুর্দদের প্রশ্নের সমাধানে পড়তে থাকেন বাকুনিন, এম্মা গোল্ডম্যান,ফোকাল্ট ইত্যাদি। চলতে থাকে সোভিয়েত পতনের পর বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আত্মবিস্লেসন। অবশেষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ কারি তুরস্কের সবথেকে বিপদজনক ব্যক্তিত্ব গ্রিসের সহযোগিতায় উপস্থিত হন কিনিয়াতে। ১৯৯৯ সালে CIAর সহযোগিতায় তুরস্কের গোয়েন্দা পুলিস নাইরোবি এয়ারপোর্ট থেকে ওচালান কে অপহরণ করে নিয়ে আসে তুরস্কে। ওচালানের এই নাটকীয় গ্রেপ্তার কে সরকারী প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে তুরস্কের সরকার পি.কে.কে এবং কুর্দ জনতার আন্দোলনের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে থাকে অন্যদিকে চলতে থাকে তুরস্কের ইতিহাসে বিগত ২২ বছর ধরে রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু আবদুল্লা ওচালানের এক হাই প্রোফাইল বিচার।
অসম্ভব প্রাণশক্তির অধিকারী অদম্য ওচালান এই অবসরে জেলখানার ১৫' x১৫' কুঠুরির অন্ধকারে আত্মস্থ করতে থাকেন বাকুনিন, প্রুধোর রাষ্ট্র বিহীন গণতন্ত্রের আইডিয়া। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইরাক, ইরান সিরিয়া,তুরস্কে বিভক্ত কুর্দ জনজাতির বাস্তব পরিস্থিতি এবং তার দীর্ঘ আন্দোলনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পারস্পেক্টিভে বিচার কোরতে থাকেন সেই আইডিয়ার বাস্তবসম্মত প্রয়োগের সম্ভাবনা। অবশেষে ২০০০ সালে কারাগারের অন্তরালে ওচালানের পরিচয় ঘটে আমেরিকান অ্যানারকিস্ট চিন্তাবিদ 'মুরে বুকচিন’ এর Ecology of Freedom নামক পুস্তকটির সাথে। বুকচিনের পুস্তকটির দ্বারা ওচালান এতটাই প্রভাবিত হন যে তার উকিলের মাধ্যমে জেলের ভেতর থেকে সমস্ত সাথিদের এই বইটি পড়তে অনুপ্রানিত করে এক নোট পাঠান। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় আবদুল্লা ওচালানের প্রথম প্রিসন রাইটিং ‘The roots of civilization’। বুকচিনের 'মিউনিসিপ্যালিসিম’ এর দ্বারা প্রভাবিত, মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষত কুরদ দের প্রশ্নের সমাধানে ওচালানের ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলসম ‘ তত্বের প্রথম ডিফেন্স। এই ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলসম’ তত্বের তাত্বিক ভিত্তিটি তৈরি হচ্ছে কারাগারের অন্তরালে ৬০০০ বছরের মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে ব্যাখ্যার মাধ্যমে।
‘The roots of civilization’ নামক এই দুই ভল্যুম এর আকর গ্রন্থ পর্যায়ের পুস্তকে আবদুল্লা ওচালান মার্কসবাদী বিশ্লেষনে সুমেরীয় সভ্যতার সময়ে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস,নগর রাষ্ট্রের উৎপত্তি, রাষ্ট্রের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা, পুরুষ প্রধান সমাজের প্রতিষ্ঠা, মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি,ইসলাম খ্রিস্ট ধর্মের উৎপত্তি এবং পতন থেকে শুরু করে কাপিট্যালের বিস্তার মার্কসবাদী বিশ্লেষনের পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করেছেন। (Bad এই অসাধারণ পুস্তকটিকে ৬০০০বছরের ইতিহাসের ব্যাপ্তিতে ওচালানের ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলসম’ তত্বের মুল রেফারেন্স হিসাবে আমরা গণ্য করতে পারি। পুরো কুর্দিস্তান আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন,সাথে স্তালিন বাদী ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’ নির্ভর এক সক্রিয় গেরিলাযুদ্ধ পদ্ধতিতে আন্দোলনরত পি.কে.কের চরিত্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটি ছিল তার প্রথম ডিফেন্স। স্বাধীন কুর্দিস্তান আরেকটা নূতন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সশস্ত্র লড়াইয়ের গতিমুখ পরিবর্তিত হয় 'ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলিসম’ বা কুর্দিস্তান এ ‘রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লড়াই এ। The roots of civilization এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক চিন্তা ‘politics beyond the state, political organisation beyond the party, and political subjectivity beyond class’ - ওচালান তাঁর ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলিসম’ পুস্তিকার ভূমিকা তে লেখেনঃ-
‘The right of self-determination of the peoples includes the right to a state of their own. However, the foundation of a state does not increase the freedom of a people. The system of the United Nations that is based on nation-states has re-mained inefficient. Meanwhile, nation-states have become serious obstacles for any social development. Democratic confederalism is the contrasting paradigm of the oppressed people.’
অসংখ্য স্বাধীনতাকামী কুর্দ জনতা, ওচালানের গ্রেপ্তারের পর তাঁর মুক্তির দাবীতে পুরানো গেরিলাযুদ্ধের টেকনিকে পরিচালিত পি.কে.কের নেতা এবং কর্মীগণ,পশ্চিমের মিডিয়া সাথে তুরস্কের সরকার আবদুল্লা ওচালানের মত দীর্ঘ দুই দশকের ওল্ড স্কুল গেরিলা যুদ্ধের নেতার এই নূতন তত্বের প্রকাশে বিভ্রান্ত হয়ে পরে। সরকার এবং মিডিয়ার মনে হতে থাকে এ হোল নিজেকে ফাঁসীর কড়িকাঠ এবং পি.কে.কে কে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ওচালানের এক নূতন বুদ্ধিদীপ্ত চাল।
আবদুল্লা ওচালানের তত্বের সমর্থনে রচিত দ্বিতীয় ডিফেন্স টি প্রকাশ পায় ২০০৪ সালেঃ- The PKK and the Kurdish question in the 21st Century। প্রথম পুস্তকটি যদি হয় ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলসম ‘তত্বের মুল রেফারেন্স তবে দ্বিতীয় পুস্তকটি কুর্দিস্তানের লড়াইয়ে পি.কে.কের ভূমিকা,সফলতা,ব্যর্থতা,আত্মবিশ্লেষন এবংপি.কে.কের ভবিষ্যতের লড়াইয়ের দিক নির্দেশ। মাইন্ডলেস ভায়োলেন্স এর পরিবর্তে কুর্দ জনতার গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জন,রাষ্ট্রের সীমানায় থেকেই রাষ্ট্র প্রচলিত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রর পরিবর্তে ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলিসম’এর ভিত্তিতে জনতার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গেরিলা মিলিশিয়ার মাধ্যমে তা রক্ষা করার এই দিক নির্দেশ। ওচালান বলেনঃ- 'Democratic confederalism is based on grass-roots participa- tion. Its decision-making processes lie with the communities. Higher levels only serve the coordination and implementa- tion of the will of the communities that send their delegates to the general assemblies. For limited space of time they are both mouthpiece and executive institutions. However, the basic power of decision rests with the local grass-roots institu- tions.’
এই ১৬ বছরের দীর্ঘ কারাবাসে আবদুল্লা ওচালান লিখেছেন ৫টি পুস্তক,দশটির অধিক পুস্তিকা,অসংখ্য প্রবন্ধ,চিঠি। ২০০৬ সাল থেকে তুরস্কের সরকার দীর্ঘ ৫বছর তার সাথে প্রকাশ্যে এবং গোপনে কারাগারে কুরদ প্রশ্নে নেগোশিয়েসন চালিয়েছেন,অবশেষে ওচালানের অধিকাংশ দাবী মেনে ২০১৩ সালে এখনো নিষিদ্ধ সংগঠন হওয়া স্বত্বেও পি.কে.কের সাথে তুরস্ক সরকারের এক শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। আবদুল্লা ওচালান গত ৪০ বছর ধরে কারাগারের বাইরে এবং ভেতরে কুরদ দের প্রশ্নের সমাধান খুঁজছেন নিরলস আর তার হাতে গড়া পি.কে.কে সেই তত্ব বর্তমানে প্রয়োগ করছে তুরস্ক এবং সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
২০০৬ সালের শুরুর দিক থেকে পি.কে.কে তুরস্কের কুর্দিস্তান অঞ্চলে ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলসম’ এর তত্বের বাস্তব প্রয়োগ করতে শুরু করে। বর্তমানে তুরস্কের কুর্দিস্তান অঞ্চলের সমস্ত প্রদেশে (Hakkari, Sirnak, Siirt, Mardin, Diyarbakir, Batman, and Van ) ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলিসম’এর ভিত্তিতে জনতার ডিসিশন মেকিং অ্যাসেম্বলি বর্তমান, এই সমস্ত প্রদেশে তুরস্ক সরকারের জনতার ওপর বস্তুত কোন প্রভাবই নেই, সরকারী এবং জনতার শাসনের এক সমান্তরাল ব্যবস্থা ক্রমশ তাঁর বিস্তার বাড়াচ্ছে অতি দ্রুত এমনকি নন কুর্দ প্রদেশেও। আমাদের কাছে এই আধাবোধ্য,বিমূর্ত রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের আইডিয়া, রাষ্ট্রের সীমানায় থেকেই রাষ্ট্রবিহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সশস্ত্র মিলিশিয়া বজায় রাখা এবং তার ইউনিকনেস ‘রোজাভা বিপ্লব’ এর মাধ্যমে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রয়োগের উদাহরণে পরিষ্কার হচ্ছে ধীরে ধীরে, পৃথিবী আশ্চর্য হচ্ছে এই যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চলে এক অদ্ভুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদাহরণে।
রোজাভা বিপ্লবঃ- শুরুর কথা
২০১১ সালে সিরিয়াতে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ পি.কে.কের কাছে আবদুল্লা অকালানের ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারিলসম’ এর তত্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বৃহৎস্কেলে প্রয়োগের এক অভূতপূর্ব সুযোগের সম্ভাবনা উপস্থিত করে। তিউনেশিয়া, ইজিপ্ট এ সরকারবিরোধী গন আন্দোলন (পশ্চিমের মিডিয়া যাকে ‘আরব স্প্রিং’ নামে আখ্যা প্রদান করে থাকে) এবং তার প্রভাবে সিরিয়াতে শুরু হয় ‘আসাদ’ বিরোধী শান্তিপূর্ণ গন আন্দোলন। জনতা ১৯৭০ সাল থেকে চলে আসা আসাদ পরিবারের বস্তুত এক পার্টির শাসনের ডিক্টেটরশিপ এর পরিবর্তে তুলনামূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু আসাদ তিউনেশিয়া, ইজিপ্ট,লিবিয়ার গন আন্দোলনের ফল দেখে শঙ্কিত বোধ করতে থাকেন, ১৫ই মার্চ ২০১১ সালে দামস্কাস এর শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র কামী জনতার মিছিলে আসাদএর বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। শান্তিপ্রিয় গনতন্ত্রকামি জনতার আন্দোলন ‘আসাদ’ সরকারের উচ্ছেদ আন্দোলনে পরিবর্তিত হয়। সেই বছরেরই ২৫ এপ্রিল আসাদের বাহিনী আন্দোলন দমন করতে ট্যাঙ্ক কামান সজ্জিত বাহিনী আন্দোলন দমনে ব্যবহার করে,শুরু হয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। ২০১২ সালের মধ্যে সিরিয়ার অর্ধেক ভূখণ্ড চলে যায় আসাদ বিরোধী এবং মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে।
বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াইরত আসাদবাহিনি যখন দুর্বল তখন ২০১২ সালের ১৯সে জুলাই কোবানে শহরের এক মসজিদে PYD (পি.কে.কে এখনো নিষিদ্ধ সংগঠন, তাই তুরস্কের ভেতরে এবং সিরিয়া তে পি.কে.কে গড়ে তুলেছে বেশ কিছু গন সংগঠন পি.অয়াই. ডি যার অন্যতম ) এবং তাদের মিলিশিয়া বাহিনী সন্মিলিত মিটিং এ সিধান্ত নেয় বিপ্লব শুরু করার এই মোক্ষম সময়। সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী কোবানে শহরে প্রবেশ এবং কোবানে থেকে বেরোবার সমস্ত রাস্তার দখল নেয়। পার্টির নেতৃত্বে এক সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মহিলা এবং সাধারণ নাগরিকগন সরকারী দপ্তর এবং সামরিক ঘাঁটি ঘেরাবন্দি করে। পি.অয়াই. ডি প্রতিনিধিগন আসাদের মিলিটারি অধিকর্তাদের সাথে আলোচনা চালাতে থাকেন -তাদের দুটি শর্ত দেওয়া হয় ১। ব্যারাক এবং শহর পরিত্যাগ করে নিজ নিজ যায়গায় ফেরত যেতে পারেন ২। সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের সাথেও থাকতে পারেন। কোবানের আসাদ বাহিনী যখন উপলব্ধি করে তাদের পক্ষে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য পাওয়া দূর অস্ত তখন অন্যনপায় আসাদ বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাক ত্যাগ করে। একটাও বুলেট খরচ না করে কোবানে অঞ্চল আসাদ বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় শুরু হয় রোজাভা বিপ্লব। জাজিরা(Cizre) কোবানে এবং আফরিন রোজাভার এই তিনটি cantonএ ১৮৪০০ স্কোয়ার কিলোমিটার জুড়ে গত তিন বছর ধরে প্রত্যহ পরিক্ষিত হচ্ছে আবদুল্লা ওচালানের রাষ্ট্রবিহীন গণতন্ত্রের এক অভূতপূর্ব সামাজিক বিপ্লব। অসংখ্য কুরদ এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রিয় মানুষের গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে নূতন পথ আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত জগতের বাইরে।
কুর্দ ভাসায় ‘রোজাভা’ শব্দটির অর্থ ‘পশ্চিম’। টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল,কুর্দিস্তানের পশ্চিমে,সিরিয়ার উত্তরে এবং তুরস্কের সীমানায় আবদুল্লা অচালানের ‘ডেমোক্র্যাটিক কনফেডেরালিস্ম’ বা রাষ্ট্র বিহীন গণতন্ত্রের তত্বের ভিত্তিতে রোজাভা গড়ে তুলছে এক অভূতপূর্ব গণতন্ত্রের মডেল। আইসিস মানেই যখন চরম পরধর্ম অসুহস্নিতা তখন রোজাভা সব ধর্মের মানুষের জন্য এক খোলা বাতাস। আইসিস মানেই যখন নারী গৃহবন্দী, বোরখা বন্দী,ইতিহাস বিহীন,রাজনীতি বিহীন এক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ইসলামিক স্টেট এ বিধর্মী হলে যখন গন ধর্ষণ আইনসম্মত,যৌনদাসী নিয়মানুগ তখন রোজাভায় বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ এবং বলপূর্বক বিবাহ আইনত নিসিদ্ধ্ব। আইসিস মানেই যখন চরম মধ্যযুগীয় পুরুষ আধিপত্য তখন রোজাভা প্রতিটি সংস্থায় তা রাজনৈতিক পার্টিই হোক বা মিউনিসিপ্যালিটি ৪০% নারী কোটা বাধ্যতামূলক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ভেঙ্গে দিচ্ছে হাজারো বছরের পুরুষ প্রাধান্য। প্রতিটি সংস্থা রোজাভা পরিচালনা করছেন যৌথ নেতৃত্বের ভিত্তিতে। কো প্রেসিডেন্ট, কো মেয়র, কো চেয়ারম্যান - এক জন পুরুষ হলে অন্যজন মহিলা হতে বাধ্য। মহিলারা অংশ নিচ্ছেন সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে এমনকি যুদ্ধ ক্ষেত্রে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমরা কিছুদিন যাবত যে সমস্ত মহিলা যোদ্ধাদের ছবি দেখছি তারা সবাই এই রোজাভার মহিলা যোদ্ধাবাহিনী YPJ এর সদস্য।
রোজাভা আমাদের সময়ে ঘটে চলা এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক পরীক্ষা। নারী স্বাধীনতার সফল আন্দোলন, সকল ধর্মের, জনজাতির শান্তির সহবস্থান। আত্মনির্ভর পুঁজিবাদ বিরোধী অর্থনৈতিক মডেল এবং বৈকল্পিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োগশালা। এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও রোজাভা সংগঠিত করছে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, প্রতিষ্ঠা করছে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় - যেখানে ছাত্রের এবং শিক্ষকের কোন বয়েসের বাধ্যবাধকতা নেই -কারন শিক্ষায় সকলের অধিকার।
আমাদের সামনে মৌলবাদ,সন্ত্রাসবাদ এবং বর্বরতা বিরোধী সবল, সফল এবং গণতান্ত্রিক মডেল বর্তমান। অথচ বিশ্ব উদাসীন। আশ্চর্যজনক ভাবে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীকুল বালির মধ্যে মুখ গুঁজে উটপাখি সদৃশ। সম্প্রতি রোজাভা ঘুরে এসেছেন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জনের এক প্রতিনিধি মণ্ডলী এবং তাদের মধ্যে ডেভিড গেওয়ার ‘গার্ডিয়ান’ এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ- ‘The autonomous region of Rojava, as it exists today, is one of few bright spots -albeit a very bright one .. Is the world and this time most scandalously of all, the international left -really going to be complicit in letting history repeat itself?’
যদি আমরা আদৌ মৌলবাদ সমস্যার প্রকৃত সমাধান চাই, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এবং গণতন্ত্র কামনা করে তাহলে রোজাভা এবং তার অভূতপূর্ব গণতন্ত্রের মডেল আমাদের সবল এবং সচেতন সমর্থনের দাবি রাখে।