“Beauty, no doubt, does not make revolutions. But a day will come when revolutions will have need of beauty.”
― Albert Camus, The Rebel: An Essay on Man in Revolt
মালেক ব্লাক্তভিচে
২০১১ সালে আরব স্প্রিং এর অভিঘাতে সিরিয়ার রাজপথ যখন স্বৈরতন্ত্রের অবসান এবং গণতন্ত্রের দাবীতে আসাদ বিরোধী গণআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠছে, ‘মালেক ব্লাক্তোভিচে’ সেই সময়ে সিরিয়ার বানিজ্যিক রাজধানী আলেপ্পো শহরে এক সাধারন জাভা সফটওয়্যার প্রোগ্রামার। একদিন এক বন্ধুর উৎসাহে নিছক নিরামিষ কৌতহলে নিজের স্মার্ট ফোন দিয়ে সরকার বিরোধী রাস্তার লড়াইয়ের ছবি তুলতে শুরু করেন। দেশব্যাপী তখন কঠিন সেন্সার, সমস্ত গণমাধ্যম সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, আসাদ বিরোধী আন্দোলনের ভিডিও, অডিও বা ছবি প্রচার নিষিদ্ধ। সিরিয়ার আর দশটা যুবকের মতই ব্লাক্তভিচে আসাদ বিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের প্রভাবে ধীরে ধীরে প্রভাবান্বিত হতে শুরু করেন। সাধারণ কৌতহল পরিনত হতে থাকে অন্যায় অত্যচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শক্তির সমর্থক হিসাবে। অবশেষে মালেক ব্লাক্তোভিচে রাজী হয়ে যান বন্ধুর অনুরোধে। শুরু করেন নিজের অ্যান্ড্রয়েড স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ছবিতোলা এবং সেই কাজের মধ্যে খুঁজে নিতে থাকেন জীবনের নূতন অর্থ।
মালেক ব্লাক্তোভিচে নামক সেই সাধারণ সিরিয়াবাসী,দৈনিক সফটওয়্যার প্রোগ্রামারের কাজ সেরেই ছদ্মনামে ইউটিউব, বিভিন্ন পোর্টালে আপলোড করতে থাকেন সেই সমস্ত আসাদ বিরোধী প্রতিরোধের ও গণআন্দোলনের মুহূর্তগুলি। তার কথায় “আমি এতো আনন্দিত ছিলাম, আমার মনে হত সত্যই আমি কাজের কাজ কিছু করছিলাম। তিনি সেই হাজারো সাধারণ সিরিয়ানদের একজন যারা প্রত্যেকে, নিজেদের স্মার্ট ফোন, অডিও রেকর্ডার এবং কলম ব্যবহার করে বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত রেকর্ড করে রাখছিলেন দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধ ও আসাদের বর্বরতার প্রতিটি মুহূর্ত। সিরিয়ায় তখন একদিকে বিদেশী মিডিয়ার প্রবেশ নিষেধ, লুকিয়ে প্রবেশ করা সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের হুমকি অন্যদিকে সরকারী মিডিয়ায় বিরোধীদের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে দেগে দেওয়ার মিথ্যা অপপ্রচার আর তার মাঝে এই সমস্ত হাজারও ব্লাক্তভিচেরা না থাকলে দুনিয়া জানতেই পারতোনা আসাদের বর্বরতার ইতিহাস।
মালেক ব্লাক্তোভিচে তার প্রথম আসাদ বিরোধী গণ আন্দোলনের পরিস্থিতি কভার করার পরে নিয়ম করে প্রতিদিন কাজের ফাঁকে ঘণ্টা খানেকের ছুটি নিয়ে নিয়মিতভাবে শহরের বিভিন্ন মিছিল এবং আসাদ বিরোধী আন্দোলন কভার করা শুরু করেন। আর প্রতিদিন নিয়ম করে সন্ধ্যেবেলায় কাজ থেকে ফিরে বিভিন্ন মাধ্যমের সূত্রে শুরু করেন গণপ্রচার। ২০১২ সালের শুরুর দিকে আসাদ বিরোধী গণআন্দোলন আসাদের নির্মম অত্যাচারের মোকাবিলায় ক্রমে সশস্ত্র প্রতিরোধের রাস্তা নিতে শুরু করে,অন্য বন্ধুরা হাতে অস্ত্র তুলে নিলেও মালেক ব্লাক্তোভিচে চাকরী ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণের জন্য নাগরিক সাংবাদিকতার পথ বেছে নেন; প্রতিটি সংঘর্ষ, প্রতিটি মিছিল, সরকারি স্নাইপারের আঘাতে লুটিয়ে পরা সাধারণ প্রতিবাদী মানুষের ঠোঁটের কষ দিয়ে গড়িয়ে পরা রক্ত কভার করা হয়ে দাঁড়ায় তার কর্মক্ষেত্র এবং কর্তব্য। কলম, কিবোর্ড এবং ক্যামেরাই আসাদ বিরোধী আন্দোলনে তার প্রতিবাদের অস্ত্র। তিনি বলেন “আমার ভূমিকা ছিল ক্যামেরা হাতে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখা, এবং সেই ভিডিও ডকুমেন্ট যথা সম্ভব সূত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া”। যথারীতি এ কোন সূচীকর্ম অথবা বাগানে গাছের পরিচর্যা নয়। ভীষণ রক্তাক্ত,নির্মম গৃহযুদ্ধে সামনাসামনি যুদ্ধের এবংসংঘর্ষের চিত্র গ্রহণ,দু পক্ষ থেকেই গুলি খাওয়ার সম্ভবনা আর তার মধ্যেই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে প্রত্যহ ভিডিও সম্প্রচার। অবশেষে মালেক ব্লাক্তোভিচে ২০১২ সালে কুখ্যাত আসাদ পন্থী মিলিশিয়া ‘শাবিহা’র হাতে ধরা পড়েন,স্থান হয় আলেপ্পোর কেন্দ্রীয় কারাগারে,চলে অকথ্য অত্যাচার। বেশ কিছুদিন পরে নিরস্ত্র হওয়ার সুবাদে ছাড়াও পান কুখ্যাত কারাগার থেকে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া ব্লাক্তোভিচে ভয়ে এবং শঙ্কায় বাড়িতে বসে থাকেন বেশ কিছুদিন – কিন্তু তখন আলেপ্পো ফুটছে,গণতন্ত্রকামী বিপুল জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ঢেউ প্রত্যহ আছড়ে পড়ছে রাজপথে। আসাদ এবং আসাদ বিরোধীদের প্রত্যহ লড়াইয়ের ময়দানে মুখোমুখি সংঘর্ষ – মানসিক ভাবে শক্তিশালী করতে থাকে ব্লাক্তভিচেকে,অবশেষে বিবেক দংশন তাকে আবার পথে নামায়। ব্লাক্তভিচে সিদ্ধান্ত নেন সিরিয়ার এই সর্বব্যাপী ধ্বংস,গণহত্যা,শিশু,নারী সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র যথা সম্ভব রেকর্ড করবেন তিনি, তার তথ্যভিত্তিক ভিডিও,অডিও এবং কিবোর্ড আসাদের বর্বরতার অবসান ঘটাবে একদিন।
২০১৩ সালে মালেক ব্লাক্তোভিচে তার মত আরও তিন জন স্বাধীন সাংবাদিকের সাথে মিলে তৈরি করেন Hadath Media Center। সম্পদ বলতে কয়েকটা কম্পিউটার আর সহায় বলতে নিজেদের জমানো অর্থ। তাদের এই মাল্টি মিডিয়া সাইট সিরিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বেচ্ছা সেবক নাগরিক সাংবাদিকদের পাঠানো গৃহযুদ্ধের ভিডিও,ছবি,অডিও ক্লিপ ক্রমাগত আপলোড করতে থাকে। যেহুতু এই সমস্ত কর্মকাণ্ড বিনা পয়সায়,অর্থ উপার্জন দূরের কথা যে কোন মুহূর্তে গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা তাই পেট চালানোর দায়ে মালেক ব্লাক্তোভিচে খুলে ফেলেন একটা কাফে আর পাশাপাশি শুরু করেন গরু ছাগল ভেড়া কেনা বেচার ব্যবসা। অবশেষে এই স্বাধীন সংবাদসংস্থার যা হওয়ার ছিল তাই হল, একবছরের মধ্যে আসাদ বাহিনীর ব্যারেল বোমের আঘাতে চুরমার হয়ে গেল Hadath Media Center এর অফিস, ভাগ্য ক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেন ব্লাক্তোভিচে। আসাদের ব্যারেল বোমা ব্লাক্তভিচে এবং তার দুই বন্ধুর সৃষ্ট স্বাধীন নাগরিক সাংবাদিকতার উদ্যোগ ধ্বংস করে দিলেও সিরিয়ার এই গৃহযুদ্ধে ততদিনে গড়ে উঠতে শুরু করেছে অসংখ্য অকুতোভয় যুবকদের স্বাধীন সংস্থা। কোথাও একা কোন সাংবাদিক তার মাত্র একটা স্মার্ট ফোন সম্বল করে যুদ্ধ চালাচ্ছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোথাও এই ধরনের সাংবাদিকদের ছোট ছোট গ্রুপ। আর এই যুদ্ধের মধ্যেই গড়ে উঠল LCCSy, লোকাল কোঅডিনেশন কমিটি অফ সিরিয়া। সিরিয়ার বিভিন্ন প্রান্তর জুড়ে নিজেদের উদ্যোগে কাজ করে যাওয়া স্বাধীন নাগরিক সাংবাদিক এবং ৭০টির অধিক বিভিন্ন ছোট ছোট নাগরিক সাংবাদিক গ্রুপের সমন্বয় কমিটি এই LCCSy। এই সমন্বয় কমিটি দেশের বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাওয়া সাংবাদিকদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার স্বাধীন সংস্থা। সরকারি মিডিয়ার বাইরে আমজনতার মিডিয়া।
সিরিয়ার বিভিন্ন প্রান্তরের গৃহযুদ্ধের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক মতামত এবং আন্তর্জাতিক খবর নিজেদের কমিটির সাংবাদিকদের মধ্যে সংবাদ ভিডিও আদান প্রদান ছাড়াও LCCSy গড়ে তুলছেন যুদ্ধে মৃত সমস্ত মানুষের ব্যাক্তিগত তথ্যের এক বিস্তৃত তথ্য সম্ভার। সমস্ত সিরিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের আঘাতে প্রতিটি মৃত মানুষের ব্যক্তিগত ইতিহাস,পারিবারিক জীবন এবং যথাসম্ভব তথ্য জমা করছেন নিজেদের সার্ভারে। যুদ্ধ আজ না হয় কাল সমাপ্ত হবে কিন্তু এই সমস্ত নিরীহ সাধারণ মানুষের গণহত্যার ইতিহাস যাতে ভবিষ্যৎ সিরিয়া এবং বিশ্ববাসী বিস্মৃত না হয়, সিরিয়াবাসী যেন যুদ্ধের নির্মমতা মনে রাখে তার এক অনবদ্য প্রয়াস এই যথাসম্ভব নিখুঁত, অতি পরিশ্রমসাধ্য তথ্য সম্ভার প্রস্তুতির কার্যক্রম চলছে স্বেছায় এবং সমস্তটাই জনতার সাংবাদিকদের নিজেদের উদ্যোগে। সরকারি, বেসরকারি বা বিদেশী মিডিয়ার সাহায্য ছাড়াই সিরিয়ার সাধারণ জনতা সাংবাদিকরা যুদ্ধের মধ্যে নিয়মনিষ্ঠ ভাবে ইতিহাস রেখে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
এখনো পর্যন্ত LCCSy সবথেকে উল্লেখযোগ্য কাজ ২০১২ সালের দামাস্কাস শহরের প্রান্তে “Daraya” গণহত্যার ভিডিও তথ্যচিত্র। ১৯৮২ সালে সিরিয়ার বর্তমান শাসক বাসার আসাদের পিতা হাফিজ আসাদের জমানায় ‘হামা’ শহরের সুন্নি মুসলমানেরা সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত করলে হাফিজ আসাদের সরকারি বাহিনী পুরো হামা শহর মিলিটারি ট্যাঙ্কের গোলার আঘাতে গুঁড়িয়ে দেয়। আনুমানিক ২০০০০ সুন্নি মুসলমান কে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়, কিন্তু স্বাধীন মিডিয়া, ইন্টারনেট,স্মার্ট ফোন এবং ইউটিউব বিহীন সেই জমানার এই বীভৎস গণহত্যার তথ্য সরকার সহজেই জনচক্ষু এবং বিশ্বের নজরের বাইরে রাখতে সমর্থ হয়। সরকার পুনরায় যাতে সেই হামা শহরের গণহত্যার মতই সমস্ত গণহত্যা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে সমর্থ না হয় সেই উদ্দেশ্যে LCCSy এবং তার সহযোগী স্বাধীন নাগরিক সাংবাদিকরা ২০১২ সালের Daraya গণহত্যার দীর্ঘ এবং তথ্য নিষ্ঠ ডকুমেন্টারি তৈরি করা শুরু করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আসাদ বাহিনীর হাত থেকে আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীরা দামাস্কাসের বাইরে এই Daraya শহর ছিনিয়ে নেয় ২০১২ সালের শুরুর দিকে। মুক্তাঞ্চলে পরিনত হয় Daraya শহর – কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে উন্নত অস্ত্রে বলীয়ান আসাদের বাহিনী Daraya শহর পুনঃদখল করে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এবং তার পরে শুরু হয় উন্মত্ত সরকারি বদলার গণহত্যা। প্রতিটি বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় টেনে এনে নির্দোষ সাধারণ জনতা নারী পুরুষ নির্বিশেষে লাইন দিয়ে গুলি চালাতে থাকে আসাদ সমর্থক বাহিনী আর এই নির্মম হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ক্যামেরাবন্দি করতে থাকে LCCSy এবং তার সহযোগী স্বাধীন নাগরিক সাংবাদিকরা। বিভিন্ন সাংবাদিকদের সংগৃহীত ভিডিও সম্পাদিত অবস্থায় ইউটিউবে আপলোড হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে বয়ে যায় নিন্দার ঝড়, আসাদ বাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমালোচনার মুখে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন এ সব মিথ্যা, জালিয়াতি, বিরুদ্ধ শক্তির অপপ্রচার। কিন্তু LCCSy এর এই ডকুমেন্টারি তিনটে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত নানাবিধ ডকুমেন্ট এবং ভিডিও সূত্রের সত্যতা যাচাই করবার পরে এতটাই নিখুঁত ভাবে সম্পাদিত এবং তথ্যনিষ্ঠ ছিল যে আসাদের চরিত্র এবং বর্বরতা আড়াল করার আর কোন উপায়ই ছিলোনা। আমজনতার সাংবাদিকদের তোলা এই Daraya গণহত্যার ভিডিও তথ্যচিত্র দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে আসাদ বিরোধী রাজনীতির অভিমুখ ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দেয়।
বিশ্বের ঐ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে যেখানে মিডিয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ,প্রতিমুহূর্তে গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিরিয়ার এই অসংখ্য নাম না জানা স্বাধীন উদ্বুদ্ধ জনতার সাংবাদিকতা না থাকলে বিশ্ব জানতেই পারত না আসলে সেখানে ঠিক কি ঘটছে। বিশ্বকে ভরসা করতে হত সরকার সরবরাহকৃত বিভিন্ন সাজানো গোছানো মিথ্যা তথ্যের ওপর। সিরিয়ার এই নাগরিক সাংবাদিক অ্যাক্টিভিস্টদের কাজ কতটা বিপদসংকুল তার নমুনা তুলে ধরেছে পিও রিসার্চ সেন্টার। তাদের তথ্য মতে ২০১১-২০১৩ সালের মধ্যে সিরিয়াতে ৬৫ জন নাগরিক সাংবাদিক যুদ্ধের ছবি তুলতে গিয়ে মারা গেছেন, অন্যদিকে একই সময়ে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার ২৪ জন পেশাদার সাংবাদিক মারা গেছেন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে। কিন্তু তবুও বিপদ মাথায় করে, প্রায় বিনা পয়সায় এই প্রবণতা পুরো আরব দুনিয়াকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও সংবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যাবে বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ব্লাক্তভিচে সম্প্রতি তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসাবে এক আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্রহণের অনুষ্ঠানে লন্ডনে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন “For 50 years…media was so false,” আরও বলেছেন “Using our mobile phones and cameras we could show the ugly truth of this dictator and we were able to convey our voice to the whole world.” সিরিয়ার মালেক ব্লাক্তোভিচেরা কেবল নাগরিক সাংবাদিকই নন প্রত্যেকে এক একজন গণতন্ত্র স্থাপনের সৈনিক।
মধ্যপ্রাচ্যে আমজনতার সাংবাদিকতার বিস্তার
দিনকে দিন আধুনিক প্রযুক্তি,ইন্টারনেট এবং অনলাইন মিডিয়ার প্রসার,আধুনিক মোবাইল ফোনের শক্তিশালী ক্যামেরা এবং সরাসরি ভিডিও প্রচারের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রায় রিয়েল টাইম ভিডিও প্রসারণ মধ্য প্রাচ্যে আধুনিক মিডিয়ার পটভূমি দ্রুত পরিবর্তিত করে দিচ্ছে। আমাদের মত বা অধিকাংশ আপাত শান্তির দেশে এই প্রযুক্তি সাধারণ আনন্দ বা সীমিত খবরের মাধ্যম হিসাবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ব্যবহৃত হলেও ২০১০-২০১১এর সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু অংশে নাগরিক সাংবাদিকতা কেবল শৌখিন ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয় বরং তা এক মুক্তি, স্বাধীনতা, বিদ্রোহ এবং সহমর্মিতার আন্দোলনে পরিনত হয়েছে। ব্লগার, স্বাধীন সাংবাদিক, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ, টুইটার অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক এবং অনলাইন বিশেষ গুপ্ত পোর্টালের মাধ্যমে স্বদেশী এবং বিদেশী ভাষায় খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মিশরে তাহিরির স্কোয়ারের গণআন্দোলনের পর থেকে এই সাংবাদিকতা মধ্যপ্রাচ্যে আর কোন শৌখিন ব্যক্তিগত সচেতন জনতার উদ্যোগ নয় বরং বর্তমানে তা এক আন্দোলন, রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং মুক্তির স্বাদ। জনতার সাংবাদিকতা সেখানে স্বাধীন শিল্পকর্ম; গ্রেপ্তার, মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে সামাজিক স্বার্থে অকুতোভয় স্বাধীনতা প্রিয় জনতার সক্রিয় যোগদান। ২০১০-২০১১ সালের সময়ে মিশরে তিউনিসিয়ায় এবং সিরিয়ায় যখন লক্ষ লক্ষ জনতা গণতন্ত্রের দাবীতে রাস্তায় নামছে, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, সরকারী দমন, সংবাদ সংস্থায় কঠিন নিয়ন্ত্রণের ফলে সত্য খবর বাইরে আসছেনা তখন সরকারী মাধ্যমকে এড়িয়ে বিপুল জনতার কাছে প্রকৃত খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এর জন্ম। সেই সময়ে মিশরের জনতা Bambuser, Ustrem প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোনে তোলা ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার করতে শুরু করে। শুধু তাই নয় এই সমস্ত ভিডিও সম্প্রচার হওয়ার পরেও যাতে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করা যায় এবংপরবর্তীতে যাতে এই সমস্ত ভিডিও চাইলেই পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা হতে থাকে। সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এড়িয়ে সাধারণ জনতার কাছে সত্যি খবর পৌঁছে দেওয়ার এই প্রতিস্পর্ধা মুহূর্তের মধ্যে কায়রোতে পুলিশের গুলি চালনার দৃশ্য পৌঁছে দিতে থাকে সারা বিশ্ব জুড়ে। যদিও প্রথাগত সাংবাদিকতার বাইরে সাধারণ মানুষের এই অসাধারণ সাংবাদিকতা আরব স্প্রিং দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া এবং জনমত সৃষ্টির পেছনে অন্যতম কারণ কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আজকের দিনে নাগরিক সাংবাদিকতা এক বিপুল আন্দোলনে পরিনত হওয়ার পেছনে নানাবিধ অন্যান্য কারণও বর্তমান। তার মধ্যে প্রধান কারণ দীর্ঘদিন যাবত মিশর,ইরাক,সিরিয়া,লিবিয়া,তিউনিসিয়া ইত্যাদি দেশে একনায়কতন্ত্র,আধিপত্যবাদি ক্ষমতার দাপট। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বেড়ে চলা অসাম্য। দেশের ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর মধ্যে চূড়ান্ত গোষ্ঠীতন্ত্র,আকণ্ঠ দুর্নীতি এবং ক্রম হতাশ জনতার বিক্ষোভ। একই সাথে ২০০০ সালের মধ্যভাগ থেকে বৈদ্যুতিন যোগাযোগ,মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের বিস্তার গণতন্ত্রের দাবীতে এই নাগরিক সাংবাদিকতাকে আজকে প্রায় আন্দোলনে পরিনত করেছে। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নজরদারি, যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ এবং বিপুল ধরপাকড়,মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রয়াস সত্ত্বেও গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নাগরিক সাংবাদিকতার এই বিপুল এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বৃদ্ধি রোধ করতে প্রায় সমস্ত দেশের সরকার আজকের দিনে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত। প্রতি মুহূর্তে নাগরিক সাংবাদিকতা এতদিনের প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমকে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলছে এবং নাগরিক সাংবাদিকতার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নির্ভরতা অর্জন করছে।
নাজি আলি জের্ফের কথাঃ-
ব্লাক্তভিচে এবং LCCSy যদি আসাদের কুকীর্তির কথা বিশ্ববাসী কে জানানোর ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন তাহলে ‘নাজি আলি জের্ফ’ আইসিস (ইসলামিক স্টেট) এর কুকীর্তি বিশ্বের দরবারে তুলে আনার পেছনে প্রধান এবং অন্যতম কারিগর। মধ্য প্রাচ্যের এই আইকনতুল্য নাগরিক সাংবাদিক, Hentah monthlyর প্রধান সম্পাদক নাজি জের্ফ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তখন তুরস্কে ‘গাজিয়ানটেপ’ শহরে বসে প্যারিসে যাওয়ার কাগজ পত্র তৈরি করছেন। শেষ মুহূর্তে সহকারীদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন,তার স্ত্রী এবং দুই শিশুকন্যা ইতিমধ্যে প্যারিসে সরকারি অভিবাসন পেয়ে চলে গেছেন, নাজি জের্ফএর প্লেনের টিকিট পর্যন্ত প্রস্তুত এমন একটা সময়ে প্রকাশ্য দিবালোকে আইসিস গুপ্তঘাতকের হাতে নিজের বাড়ির সামনে খুন হয়ে গেলেন তিনি। প্রশিক্ষিত আইসিস খুনি সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল নিয়ে দিনের পর দিন নাজি জের্ফকে অনুসরণ করেছে, সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে অবশেষে ২০১৫ সালের ২৭সে ডিসেম্বর ২০১৫ নাজি তাঁর আবাস থেকে বেরোনোর সাথে সাথে একদম কাছ থেকে গুলি চালিয়ে মিশে গেছে জনতার ভিড়ে।
সিরিয়ায় প্রশিক্ষিত নাগরিক সাংবাদিকদের গেরিলা বাহিনী সৃষ্টির কারিগর ছিলেন নাজি জের্ফ। এক দিকে আসাদ এবং অন্যদিকে আইসিস উভয়েরই চরম শত্রু। নাজি নিজেকে ঠিক সাংবাদিক হিসাবে ভাবতেন না তার নিজের কথায় “our group members do not consider themselves journalists, but activists, dedicated to overthrowing the Assad regime as much as the Islamic State” সহজবোধ্য যে তার জীবনের ঝুঁকি ছিল অপরিসীম। নাজি জের্ফের মৃত্যুর পর ‘রিপোর্টার উইদাউট বর্ডার’ ফরাসী দূতাবাসের প্রতি নাজি জের্ফ এর ভিসার আবেদন পত্র প্রকাশ করে,যেখানে তিনি লিখেছিলেন “I now live in the Turkish city of Gaziantep and my safety is more and more difficult after an increase in the threats to me and my family – above all because I am a secularist and belong to the Ismaili minority, which is targeted by the jihadis.”
নাজি জের্ফ সেই বিরল অকুতোভয় সাংবাদিকদের অন্যতম যিনি এবং তার হাতে গড়া Raqqa Is Being Slaughtered Silently (RBSS) গ্রুপের সদস্যরা নিয়মনিষ্ঠ ভাবে আইসিসের নির্মম অত্যাচারের ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করেছিলেন একেবারে আইসিস নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের রাজধানী রাক্কা শহরের ভেতরে বসে। প্রথম দিকে নাজি জের্ফ সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর অত্যাচারের ভিডিও এবং অডিও তথ্য প্রচার করতে থাকেন। নাজির ভাষায় “২০১২ সাল থেকে দেখতে শুরু করলাম আসাদ বাহিনী আমার বন্ধুদের যখন খুশি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং আমরা জানতাম দ্বিতীয় দিনের মাথায় বন্ধুর পরিবার তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ এসে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের কাছ থেকে খবর পাবে”। এই অত্যচারের তথ্য রেকর্ড করার জন্য নাজি হাতে তুলে নেন ক্যামেরা। আসাদের অত্যাচারের দলিল,তাঁর প্রথম তথ্য চিত্র সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে ‘আল আরাবিয়া’ চ্যানেলে প্রচারিত হয়। সারা বিশ্বজুড়ে প্রায় ১২মিলিওন মানুষ আজ পর্যন্ত নাজি জের্ফের আলেপ্পো এলাকায় আসাদের অত্যাচারের এই নির্মম দলিলটি দেখছেন।
এই তথ্যচিত্রটি প্রসারণের মুহূর্তের মধ্যে নাজি জের্ফ আসাদের সরকারি বাহিনীর বিষনজরে চলে আসেন, আসাদের গুপ্ত ঘাতক হন্যে হয়ে নাজিকে খুঁজতে থাকে। বিপন্ন নাজি তাঁর পরিবার সমেত সিরিয়ায় – অনেক সাংবাদিকদের মতই আশ্রয় নিতে বাধ্য হন সিরিয়া তুরস্ক সীমান্ত শহর গাজিয়ানটেপ-এ। ইতিমধ্যে স্বপ্রশিক্ষিত নাজি লক্ষ করেন যে মধ্যপ্রাচ্যের এই বিপুল পরিমাণ সাংবাদিকদের মধ্যে উৎসাহের অভাব নেই, বিপদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা অনস্বীকার্য কিন্তু প্রথাগত সাংবাদিক হওয়ার যে ট্রেনিং,সঠিক সূত্র সহকারে তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে পার্টিজান মানসিকতা বাদ দিয়ে যথাসম্ভব নির্লিপ্ত ভাবে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের যে পারিপাট্য, তার যথেষ্ট পরিমাণ অভাব বর্তমান। এই দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। কারণ দেশে গৃহযুদ্ধর পূর্বে এই বিপুল পরিমাণ উৎসাহী নাগরিক সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় কেউই সাংবাদিকতার পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন না। কেউ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা স্কুল শিক্ষক অথবা কেউ কেউ নাজির মত আইনজ্ঞ। আর এই পেশাগত দুর্বলতার কারণে সততা থাকলেও অনেক সময়েই খবর অতিরঞ্জিত ও সূত্রের অস্বচ্ছতার ফলে তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। তুরস্ক সিরিয়ার সীমান্তের সেই গাজিয়ানটেপ শহরে ততদিনে প্রবাদে পরিনত নাজি এই দুর্বলতা দূর করে প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর মত উপযোগী একদল সাংবাদিক বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে দলে দলে নাগরিক সাংবাদিকের সাংবাদিকতার প্রাথমিক ট্রেনিং দিতে শুরু করেন। মুখোমুখি ক্লাস রুম ট্রেনিং,সেমিনার এবং skype প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিও ট্রেনিংএর মাধ্যমে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নাজি জের্ফ প্রায় ১০০০ নাগরিক সাংবাদিকদের ট্রেনিং দিয়েছেন। অসংখ্য ছোট ছোট গেরিলা বাহিনীর মত সাংবাদিক বাহিনী তৈরি করে যুদ্ধের সঠিক এবং ধারালো খবর পরিবেশনের জন্য সূত্র সৃষ্টি করেছেন। তাঁর হাতে তৈরি এই ধরনের গ্রুপের মধ্যে কোহিনূর সমান গ্রুপ Raqqa Is Being Slaughtered Silently (RBSS)।
RBSS গঠিত হওয়ার আগে আইসিস নিয়ন্ত্রিত বিপুল এলাকার খবরের একমাত্র সূত্র ছিল আইসিস প্রচারিত বিশ্ববাসীকে ভয় দেখানোর জন্য উদ্দেশ্যে নির্মিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ভিডিও এবং প্রায় হলিউডি দক্ষতায় নির্মিত কিছু প্রচারমূলক ভিডিও – দেখ আমাদের এলাকায় মানুষ কত শান্তিতে বসবাস করছে। প্রায় গুপ্ত গেরিলা বাহিনীর কায়দায় তৈরি RBSSএর সদস্যরা গোপনে, এনক্রিপ্টেড মেসেজ পাঠাতে থাকে সিরিয়ার সীমান্ত শহরে বসবাসকারী নাজি জের্ফের কাছে আর তিনি RBSS-এর টুইটার অ্যাকাউন্ট,ফেসবুক এবং পোর্টালের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিতে থাকেন বিশ্ব জুড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে RBSS আইসিস সম্বন্ধে বিশ্বস্ত খবর সংগ্রহের সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। এপ্রিল ২০১৪ সালে সারা বিশ্ব যখন আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকার বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত তখন RBSSএর আন্ডারকভার সাংবাদিকরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ক্যালিফেটের রাজধানী রাক্কার ভেতর থেকে সেখানকার দৈনিক অবস্থার খবর পাঠাতে শুরু করে। আজকে RBSSএর খবরের প্রতি আস্থার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক পেন্টাগনের উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিক, সারা বিশ্বের সাংবাদিক এবং বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রায় ৫০০০০ সদস্য RBSS টুইটার আক্যাউন্টের নিয়মিত অনুসরণকারী। প্রায় ৪৫০০০ এর ওপর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ নিয়মিত RBSS কে অনুসরণ করে। অন্যদিকে RBSS এর কাজকর্মের ফলে আইসিসের ভেতরের খবর প্রচার এবং প্রকাশ হয়ে যাবার বিড়ম্বনায় RBSS হয়ে পড়ে আইসিসের অন্যতম শত্রু। আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকার মসজিদের শুক্রবারের নমাজে ইমামরা ফতোয়া দেওয়া শুরু করে যে কেউ যদি খবর পাচারকারী হিসাবে ধরা পড়ে তাহলে ইসলামিক স্টেটের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে তার সাজা হবে। কেবল RBSSএর প্রতি নজরদারির কারণে রাক্কার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বসানো হয় CCTV। ছবি বা ভিডিও লুকানো আছে কিনা তা দেখার জন্য যেখানে সেখানে যখন তখন মোবাইল তল্লাশি শুরু হয়। টুইটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ধমকিপূর্ণ মেসেজ দেওয়া হতে থাকে। তুরস্কে নাজি জের্ফের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই বিস্ফোরণে নাজি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
অন্যদিকে RBSS সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবীদের মত স্লিপার সেল হিসাবে কাজ করা শুরু করে, এমনকি গ্রুপের লোকেরাও একে অপরের পরিচয় বিষয়ে অজ্ঞাত থাকে, মেসেজ পাঠানো হতে থাকে এনক্রিপ্টেড সফটওয়্যারর মাধ্যমে। কিন্তু ভুল তো আর সব সময়ে এড়ানো সম্ভব নয়, RBSSএর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য “মোয়াতাজ বিল্লাহ”, ক্যামেরা, মোবাইল ফোন এবং ভিডিও সমেত ধরা পড়ে যান এক আইসিসের চেকপয়েন্টে। প্রমাণিত হয়ে যায় যে মোয়াতাজ বিল্লাহ খতরনাক সংবাদ সংস্থা RBSSএর সাথে যুক্ত। আইসিসের হাতে এক মাস বন্দী থাকার পর খুন হয়ে যান তিনি। অন্য আরেকটি ঘটনায় গত বছরে এক সাধারণ নাগরিক তেল আবিয়াড শহরে সংযুক্ত বাহিনীর বিমান হানায় আইসিসের বিপুল ক্ষতির ভিডিও পাঠিয়েছিলেন RBSSকে। দুর্ভাগ্য ক্রমে সেই ভিডিও তে ভিডিও প্রেরকের কণ্ঠস্বর ছিল। আইসিস সেই সূত্রে ভিডিও প্রেরক এবং তাঁর অবস্থান খুঁজে বার। তারপর সেই সাধারণ নাগরিক সাংবাদিকের আর কোন খবর নেই। RBSS এর আরেক প্রতিষ্ঠাতা আবু মোহাম্মেদ ২০১৩ সালে আইসিসের বিদেশী জঙ্গিদের ফটো তোলার দায়ে প্রায় ৬ মাস আইসিসের রাক্কার কারাগারে বন্দী ছিলেন। তিনি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তাদের কাজের বিপদ সম্বন্ধে বলেছেন “Any mistake means death. If you are arrested, they will kill you।”
যদিও যুদ্ধ ক্ষেত্রের এবং আইসিসের এলাকার ভেতর থেকে পাঠানো খবরের সত্যাসত্য বিষয়ে সন্ধেহ থেকেই যায় তবে এখনো পর্যন্ত RBSS এর কোন স্কুপ বা খবর ভুল বলে প্রমানিত হয়নি। যেমন,গত বছরের জুলাই মাসে রাক্কা শহরের গোপন এলাকায় লুকিয়ে রাখা আমেরিকান সাংবাদিক জেমস ফলি এবং অন্যান্য বিদেশী বন্দীদের উদ্ধার করার জন্য আমেরিকা এক গোপন কমান্ডো অভিযান চালায়। সেই অভিযান যে চূড়ান্ত রূপে ব্যর্থ ছিল তার খবর RBSS রাক্কার ভেতর থেকে ছবি এবং ভিডিও সমেত প্রকাশ করলেও সেই খবরের সত্যতা প্রায় ৬ সপ্তাহ পড়ে আমেরিকার প্রশাসন স্বীকার করে। আমেরিকাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সাংবাদিক জেমস ফলিকে পরবর্তীতে আইসিস ভিডিও ক্যামেরার সামনে হত্যা করে খবর সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। গত বছরে জর্ডনের পাইলট কে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার খবর RBSS প্রথম বিশ্বের গোচরে আনলেও ঘটনার প্রায় একমাস পরে আইসিস তাদের প্রচার মাধ্যমে ভিডিও প্রচার করে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে।
নাজি জের্ফের প্রতিষ্ঠিত RBSS যে কেবল যুদ্ধ বা আইসিসের বর্বরতার খবর করে তা নয়। বরং,আইসিস অধিকৃত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক দুর্দশার চিত্র, জল, ওষুধ,বিদ্যুতের অপ্রতুলতা, রেশনের দোকানে লাইন,ভেঙ্গে পরা আর্থ- সামাজিক অবস্থা এবং বিভিন্ন দেশের নির্বিচার বিমান হানায় সাধারণ মানুষের দুর্দশা, আর্তনাদের রিপোর্ট কেবল মাত্র RBSSএর অকুতোভয় সাংবাদিকদের কারণেই আজকে সমস্ত বিশ্ববাসী জানতে পারছেন। প্যারিসে প্রথম সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পরে ফরাসি সরকার রাক্কায় যে নির্বিচার বিমান হানা চালায় RBSS প্রায় রিয়েল টাইম সেই আক্রমণের বীভৎসতার চিত্র রাক্কার ভেতর থেকে প্রসারণ করে। নাজি জের্ফ এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন “We are nonviolent activists. We can’t fight Daesh(ISIS) with weapons. We can only fight them with words,”। সুতরাং আশ্চর্যের নয় কেন আইসিস নাজি জের্ফ কে হন্যে হয়ে খুঁজছিল, নাজি জের্ফ কে দুনিয়ে থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই Raqqa Is Being Slaughtered Silently (RBSS), আইসিসের বিরুদ্ধে সব থেকে প্রবল যোদ্ধার মাজা ভেঙ্গে দেওয়া যাবে।
অতএব .......
************************************************************************************************************
আজকের দিনে নাগরিক সাংবাদিকতা সিরিয়া ইরাক সহ মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে একপেশে সরকারি প্রচার এবং উলটোদিকে বিদ্রোহীদের প্রচারের মধ্যে যে বিপুল শূন্যতা সেই শূন্যতা পূরনে এক অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করছেন। প্রতিদিন তাদের সংবাদ পরিবেশন উন্নত এবং পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করছে। সংবাদ পরিবেশন থেকে পক্ষপাতিতা দূর করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস তাঁরা চালাচ্ছেন এবং বিপুল পরিমাণ জনতার কাছে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, স্থানীয় ভাষায় পৌঁছে দিচ্ছেন বিশ্বস্ত খবর। মধ্যাপ্রাচ্যের এই নাগরিক সাংবাদিকতার এই অসামান্য আন্দোলন সাধারণ জনতাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করছে,নিরুত্তাপ অবস্থান থেকে নাগরিক যাতে সক্রিয় অবস্থান নেন সেই বিষয়ে বিভিন্ন খবরের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতামত সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদসংস্থা এই বিপুল সংখ্যক স্বাধীন সাংবাদিকদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছে, রাজনৈতিক মতামত সৃষ্টি হচ্ছে আর এই প্রকল্পে নাজি জের্ফরা আইসিস সন্ত্রাসবাদী অথবা আসাদ সরকারের রোষের শিকার হয়ে প্রাণ দিচ্ছেন। সত্য যে কোন ক্ষমতার কাছে অস্বস্তিকর।
যেখানে প্রথাগত সাংবাদিকতা ব্যর্থ,যুদ্ধের ময়দানে অনুপস্থিত, নির্দিষ্ট মিডিয়া হাউসের রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী খবরকে বিকৃত উপায়ে পরিবেশন করতে বাধ্য,সেখানে স্বাধীন আমজনতার সাংবাদিকতা এখন ভবিষ্যতের নূতন প্রহরী। নাজি জের্ফের মত এই সমস্ত স্বাধীন দেশপ্রেমী সাংবাদিকরা সংবাদের দুনিয়ায় গণতন্ত্র বজায় রাখছেন। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের ভূমিকার তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রস্তুত করছেন। সরকার এবং বিদ্রোহীরা যাতে গণতান্ত্রিক অবস্থান বজায় রাখে এবং আরও স্বছ ভাবে কাজ করতে বাধ্য হয় তার জন্য নিরলস কাজ করছেন। আর মধ্য প্রাচ্যের এই নূতন মিডিয়ার দুনিয়ায় নাজি জের্ফ এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব। আজকের দুনিয়া যেখানে জনসেবা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ এবং সাংবাদিকতার চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত,সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্ত স্বাধীন নাগরিক সাংবাদিকদের গ্রুপ, ক্রমে আরও বেশি বিশ্বস্ত, বেশি নিরপেক্ষ এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মতামত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্রমশ নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন। অন্তত মধ্যপ্রাচ্যে নাগরিক সাংবাদিকতা প্রথাগত মিডিয়ার জায়গা সক্ষম ভাবে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে। নাগরিক সাংবাদিকতার এই হটাৎ বিস্ফোরণ সাময়িক কোন ঘটনা নয় বরং এইটাই ভবিষ্যতের ছবি হতে চলেছে। নাজি জের্ফ যেমন বলেছিলেন “To defeat us, they would have to shut down the Internet. And they can’t do that because all of them use the Internet.”
————————————————————————————————————————————————————————
উৎসাহী পাঠক নাজি জের্ফ এবং LCCSyর কাজকর্মের ব্যাপকতার বিষয়ে ধারণার জন্য দেখতে পারেনঃ- http://www.raqqa-sl.com/en/ এবং http://www.lccsyria.org/en/
লেখাটি ‘একক মাত্রা' পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১৬ সংখ্যাতে ছাপা হয়েছিল।