সুশান্ত, তোমার মনে পড়ে
সরলার মাকে, যে এখানে
কাজ করত? হঠাৎ সেদিন
শুনলো যেই বন্যা পাকিস্তানে,
বুড়ি গিয়ে বসল বারান্দায়,
দেখি তার চোখে জল ঝরে।...
(চিঠি - মণীন্দ্র রায় )
বাঙলার অর্থব্যবস্থা, সামাজিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিচিতি, স্মৃতি এলোমেলো করে দেওয়া এই যে দেশভাগ। উদ্বাস্তু স্রোত এবং তাদের অসহায়তা। দাঙ্গার বীভৎসতা। রক্ত, ধর্ষণ। সারা জীবনের মত ভিখারি হয়ে যাওয়া অসংখ্য পরিবার। উদ্বাস্তু কলোনি এবং তা নিয়ে বামপন্থী রাজনীতি। এই সমস্ত সত্য তার তথ্যাবলি নিয়ে বর্তমান। কিন্তু অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় এই পুরো ব্যাখ্যানটিতে‘মুসলমান‘ আশ্চর্যজনক ভাবে অনুপস্থিত। দেশভাগ যেন কেবলমাত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ বর্ণ বাংলাভাষী হিন্দুদের সমস্যা। দেশ ভাগের বেদনা, স্মৃতি, ছিন্নমূল জীবন নিয়ে কত না কবিতা, গল্প, সিনেমা কিন্তু বিগত ৬৮ বছরের এই আখ্যানে নিন্মবর্গের হিন্দু এবং আপামর মুসলমান প্রায় অস্তিত্বহীন। আমার এক সাহিত্য পড়ুয়া বন্ধুর কাছে খোঁজ করাতে তিনি আমাকে মাত্র একটি উপন্যাসের খোঁজ দিতে পেরেছিলেন -‘ কালো বরফ‘ যেখানে মনি ভাইজান তাদের পড়শি এপারের ছবি'দির কাছ থেকে চুলের কাঁটা, ক্লিপ, ফিতে - স্মৃতি হিসাবে নিয়ে দৌড়ে ওপারে যাওয়ার ট্রাক ধরতে চলে যাচ্ছেন। ওই একটিই অথবা আরও দু একটি, কোথাও দিব্যেন্দু পালিতের ছোট গল্প, কোথাও আরও কিছু ছোট গল্প ইত্যাদিতে ধরা আছে বাঙ্গালী মুসলমানের দেশভাগের বেদনার উপাখ্যান কিন্তু মূলত দেশভাগের কাহিনীর বেদনার ইতিহাসে বাংলার‘মুসলমান‘ সত্যই অস্তিত্বহীন।
দেশভাগের প্রভাব নিয়ে পরবর্তীকালে যে বিভিন্ন গবেষণা তাতেও প্রায় একই চিত্র। মুসলমান সংখ্যালঘু সমাজে দেশভাগ এবং তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা প্রায় শূন্য। এমনকি বর্তমানের‘Bengal Muslims’ নামক যে স্কলারশিপ তাতেও আশ্চর্যজনক ভাবে দেশভাগের পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের অবস্থান, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব হওয়ার ইতিহাস, আর্থ -সামাজিক পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা প্রায় নগণ্য। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান যে কেবল আর্থ -সামাজিক অবস্থানে ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া এক পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় তাই নয়, সাহিত্যে, সিনেমায়, অ্যাকাডেমিক গবেষণায় এবং সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনে এক চরম উপেক্ষিত জন সমাজ। সেকুলার ভারতবর্ষ তাদের না দিতে পেরেছে জীবনের নিরাপত্তা না উন্নত করতে পেরেছে তাদের অর্থ -সামাজিক অবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের এই ধারাবাহিক অবক্ষয়ের চিত্র প্রথম প্রকাশ্যে আসে সাচার কমিটির রিপোর্টের মাধ্যমে। জম্মু কাশ্মীরে ৬৭%, আসামে ৩০% এর পরেই পশ্চিমবঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাসস্থান, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ২৭-২৯%। দীর্ঘকাল সংখ্যালঘু দরদী বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন যে রাজ্যে বর্গাদার আইন, ভূমিসংস্কার এবং ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজকর্ম হয়েছে সেই রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থা ভয়ঙ্কর এমনকি তফশিলি জাতি উপজাতি এবং আদিবাসীদের তুলনাতেও খারাপ। ২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পরে অতি সম্প্রতি অমর্ত্য সেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বর্তমান আর্থ সামাজিক অবস্থান নিয়ে আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন, সেই চিত্রও সাচার কমিটির রিপোর্ট এর থেকে উন্নত কিছু অবস্থানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করায় না উল্টে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা ২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির উল্লেখিত অবস্থার থেকেও খারাপ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা ২৭-২৯% হলেও সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুসার সরকারী চাকুরিতে তাদের অনুপাত ছিল মাত্র ২,১%!
অথচ দেশভাগের পূর্বে অপেক্ষাকৃত বর্ধিষ্ণু, বাংলার রাজনীতিতে নির্ণায়ক স্থানের অধিকারী, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের এই ক্রম অবক্ষয়ের কারণ কী ? দেশভাগ তাদের কাছে কি অর্থ বহন করে আনে ? তাদের চিন্তাধারা, জীবনযাপন, পেশা এবং প্রাত্যহিকতায় বা কী প্রভাব ? দেশভাগের পরবর্তী কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের সারভাইভাল স্ট্রাটেজিই বা কী ? এই সমস্ত প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই। রাজনৈতিক নেতাগণ মুসলমান ভোট ব্যাংকের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত এবং আমরা আমাদেরই পড়শি সম্বন্ধে চরম উদাসীন, নির্লিপ্ত। বাঙলায় মুসলমান - সাহিত্যে, সিনেমায়, রাজনীতিতে এবং সামাজিক অবস্থানে এক চরম উপেক্ষিত সম্প্রদায় - যেন ভিন গ্রহের বাসিন্দা।
বাঙলায় মুসলমানঃ
মোটামুটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর সময় থেকে বাঙলায় ইসলামের পদার্পণ। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশ লক্ষ করে যে বাংলার পূর্ব প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে মুসলমান জনসংখ্যার ঘনত্ব অস্বাভাবিক রকমের বেশি। ১৮৭২ সালের সেন্সাস পরবর্তী চমকে দেওয়ার মত মুসলমান জনসংখ্যার তথ্য এবং তার ফেনমেনা বিষয়ে ব্রিটিশ গবেষণা করতে শুরু করে। এই যে বিপুল পরিমাণ মুসলমান জনসংখ্যা কেন এবং কিভাবে তা ব্যখ্যা করতে উঠে আসে মূলত চার ধরনের মতামত। প্রথমত অভিবাসনের তত্ত্ব, দ্বিতীয়ত তরবারির ক্ষমতায় ইসলামে পরিবর্তনের মতামত, তৃতীয় মতামত অনুসার সামাজিক মুক্তির ধর্ম হিসাবে বাংলার নিন্মবর্গের ইসলামকে স্বীকৃতি দান এবং চতুর্থত মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইসলামের প্রসার বিষয়ক তত্ত্ব।
অভিবাসন তত্ত্ব অনুসার ভারতের অধিকাংশ মুসলমান বিভিন্ন সময় ধরে এদেশে আসা মূলত বিদেশী মুসলমান জনসম্প্রদায়ের বংশধর। সন্দেহ নেই দক্ষিণ এশিয়ার সে সমস্ত ভূখণ্ড যেখানে ইরান বা মধ্যপ্রাচ্য ভূমি পথের মাধ্যমে সংযুক্ত অথবা আরবসাগরের রাস্তায় আসা সম্ভব সেখানে ইসলাম ধর্ম প্রসারে এই বিদেশী মুসলমান অভিবাসীগণ সাহায্যকারীর ভুমিকা পালন করেছেন। তবে এই তত্ত্ব কেরল, গুজরাত, কাশ্মীর অথবা উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাংলার পূর্ব প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ মুসলমান জনসংখ্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনা। ইরান এবং আরব সাগর থেকে বহুদূরের এই ভূখণ্ডের ৯৯% মূলসমান স্থানীয় জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং শারীরিক গঠন আরব বা ইরানের অধিবাসীদের তুলনায় সম্পূর্ণ পৃথক।
তরবারির ক্ষমতায় ইসলামের বিস্তারের তত্ত্ব ক্রুসেড পরবর্তী পশ্চিমি চিন্তা জগত উৎসাহের সঙ্গে মেনে নিলেও বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের এবং বিভিন্ন মূলসমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে ইসলামের বিস্তারের এক যোগ সূত্র হিসাবে ধরে নিলেও ভারতে ইসলামের বিস্তারের সাথে এই তত্বের খুব একটা যোগসূত্র নেই। যদি সত্যই রাজনৈতিক অথবা সামরিক শক্তির বলে ভারতে মুসলমান ধর্মে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে থাকত তাহলে সে সমস্ত অঞ্চল দীর্ঘ কাল ধরে মুসলমান শাসনের অধীন ছিল সেখানে বা তার আশেপাশে মুসলমান জনসংখ্যা এতদিনে সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ার কথা অথচ ঘটনা বা বাস্তব তার বিপরীত। ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান জনসংখ্যা সংখ্যাগুরু যেমন বাঙলার পূর্বের জেলাগুলিতে,পশ্চিম পাঞ্জাবে সেই সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান শাসকের তরবারির ক্ষমতা ছিল দুর্বল। এই সমস্ত প্রান্তিক অঞ্চলে পাশবিক বল ছিল সব থেকে কম প্রভাবশালী। বাংলার পূর্ব প্রান্তে এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে যেখানে প্রথম সেন্সাস তথ্য অনুযায়ী ৭০-৯০% মুসলমান সেখানে গঙ্গার অববাহিকায় এবং উত্তর ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা মাত্র ১০-১৫%। অন্য অর্থে ভারতীয় উপমহাদেশে যে সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি দুর্বল ছিল সেই সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা তুলনামূলক অধিক এবং যে সমস্ত অঞ্চলে দীর্ঘ কাল যাবত মুসলমান রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি বলবত ছিল সেই সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং মুর্শিদাবাদ প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে মুসলমান নবাবদের রাজধানী হওয়া স্বত্বেও রাজশাহী, দিনাজপুর এবং নদীয়ার তুলনায় এই সমস্ত জেলাতে মুসলমান জনসংখ্যার হার আনুপাতিক হারে কম ছিল। সুতরাং তরবারির ক্ষমতায় ভারতে, বাঙলায় বা পশ্চিম পাঞ্জাবে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে তথ্যগত ভাবে তা সত্য নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসে ইসলাম অবলম্বন করে সামাজিক মুক্তির তত্ত্ব। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদগণ এবং এথনগ্রাফার্স'রা, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রসারের কারণ হিসাবে ইসলামের প্রগতিশীলতা, জাতিভেদ প্রথা না থাকা এবং হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে বিপুল সংখ্যক নিন্মবর্গিয় হিন্দুদের ইসলাম অবলম্বনের অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ করতে থাকেন। এই তত্ত্ব অনুসার হিন্দুধর্মের চূড়ান্ত জাতিভেদ প্রথা এবং সেই কারণে বিচ্ছিন্ন নিন্মবর্নের হিন্দু ইসলামের সামাজিক সমতার দর্শনে আকর্ষিত হয়ে দলে দলে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে যেতে থাকেন। বাঙলায় এবং ভারতে এই তত্বের সত্যতা যথেষ্ট দুর্বল, শুধু তাই নয় এই তত্ত্ব ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় ভূগোলের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৮৭২ সালের সেন্সাসের তথ্য অনুসার ভারতে সর্বাধিক মুসলমান জনঘনত্ব বাংলার পূর্বের জেলাগুলি, পশ্চিম পাঞ্জাব, বালুচিস্তান এবং নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার এলাকায়। এই প্রত্যেকটি এলাকাই হিন্দু হার্ট ল্যান্ড থেকে বহু দুরে। এই সমস্ত এলাকায় হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব ছিল তুলনামূলক ভাবে কম। মনুর বিধান ছিল প্রায় অজানা। বিশেষত বাংলায় মুসলমান ধর্মে পরিবর্তিত জনজাতি মূলত রাজবংশি, পোদ, চণ্ডাল, কোচ এবং অন্যান্য স্থানীয় ক্ষুদ্র সম্প্রদায় এই সম্প্রদায়ের ওপর ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব ছিল অতি নগণ্য। অনুরূপ ভাবে পশ্চিম পাঞ্জাবেও বিভিন্ন জাট গোষ্ঠী মূলত মুসলমান ধর্মে পরিবর্তিত জনজাতি। তাই হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে ইসলাম অবলম্বন এই তত্ত্বও বাঙলায় মুসলমান ঘনত্বর কারণ হিসাবে ঠিক প্রযোজ্য নয়।
অনেকে বলেন অতি ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন বাঙলার কৃষি এবং রাজনৈতিক সীমান্তে ঘটেছে। বাঙলার গ্রামীণ আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে ইসলাম এমন ভাবে মিশে গেছে যে স্থানীয় অধিবাসীদের ইসলামকে বিদেশী ধর্ম হিসাবে কখনো মনেই হয়নি। বাঙলার পূর্বের প্রদেশ গুলীতে কৃষি এবং কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের বিস্তারের সাথে সাথে কৃষিজীবী গ্রামীণ জনতার স্বাভাবিক ধর্ম হয়ে গেছে ইসলাম। ইসলাম বাংলার গ্রামীণ আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে মিশে তার আরবিয়ানা হারিয়ে এক বিপুল সংখ্যক জনতার ধর্মে পরিবর্তিত হয়ে গেছে - তার সাথে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, তরবারির ক্ষমতায় ধর্ম পরিবর্তন অথবা হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ইসলাম অবলম্বন এর কোনটাই বাঙলায় বিশেষত বাঙলার পূর্বের জেলাগুলিতে ৭০-৯০% মুসলমান জনসংখ্যার অস্তিত্বের কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনা।
বাঙলার মুসলমানদের সামাজিক বিভেদঃ
হিন্দু সমাজের মত গভীর এবং কঠিন চতুবর্ণ বিভাজন না থাকলেও বাঙলার মুসলমান সমাজের মধ্যেও স্পষ্ট সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিভাজন বর্তমান। বাঙলায় সব থেকে উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানেরা হলেন - আশরাফ অথবা শরীফ। এনারা মূলত জমিদার, ভূস্বামী, শিক্ষক উচ্চ পদাধিকারী ইত্যাদি। বিদেশী অভিবাসী মুসলমান, উত্তরভারতীয় মুসলমান বনিক এবং উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু পরবর্তীতে ইসলাম অবলম্বী সম্প্রদায়ের বংশধর বাঙলার মুসলমান সমাজের উপরের স্তরের এই গোষ্ঠীর অধিকাংশের উপাধি সৈয়দ, শেখ, পাঠান, মালিক ,মির্জা ইত্যাদি। মুসলমানদের মধ্যে দ্বিতীয় সামাজিক অবস্থানে আছেন আজলাফ অথবা আতরাপ/আতরাফ। এই শ্রেণীর অধিকাংশ অপেক্ষাকৃত নিন্মবর্গ হিন্দু থেকে মুসলমানে পরিবর্তিত হওয়া জন সম্প্রদায়। সৈয়দ বা শেখেদের চোখে নিচু শ্রেণীর মুসলমান। পেশাগত ভাবে জোলা( তন্তুবায় ) হাজাম (নাপিত ), ধুনকর, নিকারি, ধোপা, ক্ষুদ্র ব্যবসাদার ইত্যাদির অধিকাংশ এই আতরাফ শ্রেণীর মুসলমান। এদের উপাধি প্রায় হিন্দুদের মতই - মণ্ডল, সরকার, বিশ্বাস,সর্দার ইত্যাদি।
হিন্দু সমাজের শূদ্রদের মতই সবথেকে নীচের স্তরের সামাজিক অবস্থানের মুসলমানেরা হলেন - আরযুল। মূলত পতিত, দলিত এবং নমশূদ্র সমাজ থেকে মুসলমানে পরিবর্তিত জনগোষ্ঠীর অংশ। হিন্দু অন্ত্যজ গোষ্ঠীর সমগোত্রীয় এই আরযুল মুসলমানেরা তাড়ি বা মদ বানানোর পেশাতে যুক্ত, কসাই, মেথর, চামার, জিপসি ইত্যাদি। সামাজিক ভাবে প্রায় প্রান্তিক এই মুসলমানদের সাথে ওপরে বর্ণীত দুই মুসলমান সমাজের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোন সামাজিক, বৈবাহিক যোগসুত্র অবর্তমান। বাঙলায় মুসলমান সমাজের মধ্যেও কাস্ট এবং তার কুফল যথারীতি বর্তমান। আশরাফ এবং আতরাপ/আতরাফদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বর্তমান অথবা পেশা পরিবর্তন এবং সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে ওপরের গোত্রের মুসলমান হিসাবে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা বর্তমান - যেমন একজন আতরাফ মুসলমান বলতে পারেন ‘ গত বছরের আমি জোলা ছিলাম এই বছর আমি শেখ হয়েছি যদি এই বছর ভালো পাটের দাম পাই তাহলে আগামী বছর আমি সৈয়দ হয়ে যাব”। কিন্তু আরযুল অথবা একদম নিচের শ্রেণীর মুসলমান এই বৃত্তের বাইরে, মুসলমান সমাজে তাদের স্থান আমাদের দলিত সম্প্রদায়ের মতই -সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে উপেক্ষিত এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য আলাদা কবরস্থান বর্তমান। বাঙলার বিপুল পরিমাণ মুসলমানদের মধ্যে ১৮৭১ সালের সেন্সাসে দেখা যাচ্ছে মাত্র ১-১,৫% মুসলমান আশরাফ অর্থাৎ সৈয়দ, শেখ, পাঠান, মালিক, মির্জা ইত্যাদি বাকি ৯৯% হয় আতরাপ/আতরাফ অথবা আরযুল। এই ৯৯% এর মাতৃভাষা বাঙলা। সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ঐতিহ্য, আচার আচরণ পোশাক প্রায় হিন্দুদের মতই। নিজেদের মধ্যে কাস্ট সিস্টেম সূক্ষ্ম মাত্রায় বর্তমান। গ্রামের পূজা আর্চায় অংশগ্রহণ কারী, ঢাকি, মালাকার ইত্যাদি। এদের মধ্যে অধিকাংশ কৃষিজীবী অথবা তন্তুবায়, মাঝি, মাছুয়া, ধুনকর, নাপিত, চামড়ার কাজ এবং বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত মূলত নিন্ম বর্গের হিন্দু এবং বৌদ্ধ সমাজ থেকে মুসলমানে পরিবর্তিত জন সমাজ।
বাঙলার মুসলমান সমাজে পরিবর্তন এবং দেশভাগঃ
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে বাঙলার মুসলমান সমাজে এই স্থবির সামাজিক অবস্থানের বিপুল পরিবর্তন হতে শুরু করে। সব থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি ঘটে চিরাচরিত কৃষি ভিত্তিক পেশার পরিবর্তে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব। শিক্ষা, চাকরী, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে এই মুসলমান সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ক্রমশ লক্ষিত হতে থাকে। ১৮৭০/৭১ সালে বাঙলার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৪% ছাত্র ছিল মুসলমান অথচ ১৯২০/১৯২১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় প্রায় ১৪-১৫ %। বাংলার কোন কোন অঞ্চলে যেমন ঢাকা, হুগলী এমনকি প্রেসিডেন্সি কলেজে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যার সমপরিমাণ এমনকি কোথাও কোথাও বেশি হয়ে দাড়ায়। আর এই নব্য শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরবর্তীতে বাঙলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। মুসলমানদের এই অভাবনীয় অগ্রগতি তাদের হিন্দু কাউন্টার পার্টের সাথে প্রতিযোগিতা একই সাথে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি ক্রমে বাঙলায় হিন্দু জনসংখ্যা কে পেছনে ফেলতে শুরু করে। ১৯৩১ সালে বাঙলায় মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ৫৪.২৯%। পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
বাঙলার অধিকাংশ জেলায় তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা, নব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবক সম্প্রদায় মুসলমান সমাজের মধ্যে এক প্রত্যয়ের জন্ম দেওয়া শুরু করে। অপ্রত্যক্ষ ভাবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বলীয়ান, হিন্দুদের সাথে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে দর কষাকষি, রিজার্ভ সিট, মুসলিম কোটার অধিকারের মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে হিন্দু আধিপত্যের সাথে মুসলমানদের সূক্ষ্ম সংঘাতের সূত্রপাত হতে শুরু হয়। ১৯৩২ সালে ম্যাকডোনাল্ডের সম্প্রদায়ভিত্তিক রোয়েদাদের ফলে প্রদেশে নাটকীয় ভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রায় একই সাথে ঘোষিত হয় পুনা প্যাক্ট, প্রাদেশিক আইনসভায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পরে, ‘ মুসলমানদের কাছে তাদের চিরস্থায়ীভাবে অধীনতা সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ছবি হয়ে পরে‘। বাঙলায়, সিন্ধে, পাঞ্জাবে এবং আসামে মুসলমান জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে এবং মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কংগ্রেস মুসলিম লীগের হাতে পরাজিত হয়। অবিভক্ত বাঙলার শাসন ক্ষমতার শেষ দশ বছর ছিল মুসলিমলীগের সরকার। স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে ১৯৪৬ সালে সুরাবর্দির নেতৃত্বে বাঙলার সরকার সেই সময়ে সারা ভারতে একমাত্র মুসলিম লীগ সরকার।
১৯৩০ সালের সময় থেকেই বাঙলায় পরিষ্কার মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের সাথে সম স্পর্ধায় তাল ঠুকছেন প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে। বাঙলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগ যথেষ্ট প্রভাবশালী -এমত সামাজিক পরিস্থিতিতে পাঞ্জাব এবং বাংলার হিন্দু প্রধান জেলাগুলি যাতে পাকিস্তানে চলে না যায় সেই স্বার্থে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস এই দুই প্রদেশ কমিউনাল লাইনে ভাগ করার স্বপক্ষে দাবী জোরালো করতে থাকে। অন্যদিকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী যেরকম শরৎ চন্দ্র বসু, সুরাবর্দি , কিরণ শঙ্কর রায়, আবুল হাসিম, সত্য রঞ্জন বক্সী এবং মোহাম্মদ আলি চৌধুরী বাঙলা ভাগের বিরোধী "সংযুক্ত স্বতন্ত্র বাঙলার “ স্বপক্ষে দাবী পেশ করতে থাকেন। সুরাবর্দি এবং শরৎ চন্দ্র বসু বাংলার কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের এক কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলার জনতাকে সাম্প্রদায়িক লাইনে বঙ্গ ভঙ্গের বিরোধিতা করার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন, সাক্ষরিত হয় বেঙ্গল প্যাক্ট। ২৭ সে এপ্রিল ১৯৪৭ সালে সুরাবর্দি দিল্লীতে এক প্রেস কনফারেন্স এই স্বতন্ত্র অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা পেশ করেন। ২৯ সে এপ্রিল আবুল হাসিম কোলকাতায় সমরূপ ইচ্ছা প্রকাশ্য করে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। একই সময়ে ১৯৪৭ সালের ২১ এপ্রিল খ্যাতিমান বাঙালী নিন্মবর্ণ নেতা এবং তৎকালীন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানান, বাঙলার নিন্মবর্ণ হিন্দুরা বাঙলা ভাগের প্রস্তাবের বিরোধী।
কিন্তু কংগ্রেস, বাঙলার মারোয়াড়ী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং শ্যামাপ্রসাদের আগ্রহে স্বতন্ত্র অভিভক্ত বাংলার প্ল্যান দুঃখজনক ভাবে পরাজিত হয়। প্যাটেল সার্বভৌম বাঙলার দাবীকে বর্ণনা করেন‘ একটা ফাঁদ হিসাবে যেখানে কিরণ শঙ্কর রায় শরৎ বসুর সঙ্গে আটকা পড়বেন‘ ততদিনে কুখ্যাত কোলকাতা রায়ট দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন রেখা গভীর এবং প্রায় অলঙ্ঘনীয় করে তুলেছে। বর্ধমান মহারাজের সভাপতিত্বে হিন্দু প্রধান জেলাগুলির আইনপ্রনেতারা এক বৈঠকে ৫৮ জন বিভাজনের পক্ষে ভোট দেন কিন্তু সেই সভাতেই মুসলিম লীগের ২১ জনা বিভাজনের বিপক্ষে ভোট দেন। ৫৮ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো ভারতে যোগদান করবে। অন্যদিকে, মুসলিমপ্রধান জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ১০৬ জন যার মধ্যে ১০০ জন ছিলেন মুসলিম লীগের, ৫ জন ছিলেন নিন্মবর্নের হিন্দুদের প্রতিনিধি এবং এক জন ছিলেন খ্রিস্টানদের প্রতিনিধি বাঙলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেন। বাকি ৩৫ জন পক্ষে ভোট দেন। পরবর্তীতে বর্ধমান মহারাজের সভাপতিত্বে হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোর আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে ১০৭-৩৪ ভোটে মুসলিমপ্রধান এলাকার আইনপ্রণেতারা প্রস্তাবিত পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য, বেঙল ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাথে তাল মিলিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার বেঙল শাখার সাথে সংশ্লিষ্ট আইনপ্রণেতারা বাঙলা ভাগের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন।
মুসলিম লীগের এক বিপুল অংশ এবং বাঙলার নিন্মবর্ণ মূলত নমঃশূদ্র হিন্দুরা বাঙলা ভাগের প্রস্তাবের বিরোধী হলেও, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবংকমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার বেঙল শাখার আগ্রহে, নেহেরু প্যাটেল লবির কাছে শরৎ চন্দ্র বসু, সুরাবর্দি , কিরণ শঙ্কর রায়, আবুল হাসিম, সত্য রঞ্জন বক্সী এবং মোহাম্মদ আলি চৌধুরী বাঙ্লাভাগের বিরোধী সংযুক্ত স্বতন্ত্র বাঙলার স্বপ্ন পরাজিত হয়। অবশেষে ২০ সে জুন ১৯৪৭ সালে বাঙলার লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বাঙলা ভাগের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধে বাঙলার যে শিক্ষিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী অংশ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাত্র ৪ দশকের ব্যবধানে বাঙলার সেই শিক্ষিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী অংশ দেশভাগের পূর্বে ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করার পক্ষে সংবদ্ধ আন্দোলন চালায় এবং প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে বাঙলা ভাগ মেনে নেয়।
অবিভক্ত বাঙলার মুসলমান যারা দীর্ঘকাল বাঙলায় সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুবিধা ভোগ করে এসেছেন দেশভাগের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু হয়ে পরে। সেই অর্থে দেশভাগ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ধারাবাহিক অবক্ষয়ের ইতিহাসের এক জল বিভাজিকা বলা যেতে পারে।
( পরের পর্বে সমাপ্য)
লেখাটির সংক্ষিপ্ত রূপ 'দুর্বার ভাবনা'য় প্রকাশিত হয়েছিল।