কথায় বলে, তাঁর সাথেই প্রতিযোগিতা করো যাঁর সাথে করলে তোমার উন্নতি ঘটে। কিন্তু এ যে কথার কথা, মানে ক'জন? রাষ্ট্রনেতারা সবসময়ই নিজের মুখ পরিষ্কার ও ভালো দেখাতে চান। তাই তাঁরা জনগণের কাছে নিজের প্রতিযোগী হিসেবে খাড়া করেন নিজের থেকে কয়েকগুণ বেশি নোংরা ও খারাপ কোন এক বস্তুকে। এই হল তাঁদের সাময়িককালের ক্ষমতা ধরে রাখবার রাজনৈতিক ফর্মুলা। এর মধ্যে দিয়ে তাঁরা সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি নিজের নোংরা ও খারাপ অবস্থার থেকেও আরও বেশি নোংরা ও খারাপের দিকে করে দেন। একে আধুনিক সমাজে স্বৈরাচারী শাসকশ্রেণীর মনস্তাত্বিক রাজনৈতিক ফর্মুলা বলা চলে।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের রাজ্য সরকারও এই মনস্তাত্ত্বিক রাজনৈতিক ফর্মুলায় জনগণের আবেগকে পুঁজি করে, বিরোধী শক্তিকে খাদে ফেলে নিজের রাজনৈতিক খুঁটি শক্ত করে ধরে রেখেছে। রাজ্যে ঘটে গেছে একের পর এক অন্যায়, অবিচার তারপরেও সেগুলির 'ড্যামেজ কন্ট্রোল'-এ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশ রাজ্যকে নিশানা করে ক্ষমতার তালায় চাবি ঘুরিয়েছেন। এই রাজনৈতিক ফর্মুলাতে ভিত্তি করে এ রাজ্য যে সেই নোংরা ও খারাপ উত্তরপ্রদেশে রাজ্যেরই সমতুল্য হয়ে উঠেছে, আর এ রাজ্য সরকারও যে সেই রাজ্যের বিজেপি সরকারের মতন নিজের রাজ্যের জনগণের সাথে নোংরা ও খারাপ রাজনৈতিক দুর্ব্যবহার করতে লেগেছে তা এখন স্পষ্টত টের পাই আমরা সকলে। এর ফলে আর যাই ভালো-মন্দ হোক না কেন, এ রাজ্যে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক দলটিকে রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রসারিত করবার সুযোগ খোদ রাজ্য সরকারই করে দিয়েছে। এর পরেও রাজ্য সরকার নিজেদের কুকীর্তি, রাজনৈতিক অপকর্মগুলি না শুধরিয়ে সেই রাজনৈতিক দলটিরই নোংরা ও খারাপ ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক কায়দা ব্যবহার করছে জনগণের উপরে। শ্রমজীবী জনগণের ঘর, দোকানের উপরে বুলডোজার চালানো থেকে শুরু করে আর.জি.করের মর্মান্তিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে আরও বড় বড় রাজনৈতিক ভুলের পাহাড় তৈরি করে ফেলেছে। ফলে নোংরা ও খারাপ ফ্যাসিবাদী বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নৈতিকতার মুখও তারা হারিয়েছে।
এরই সুযোগ আজ কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী বিজেপি নেওয়ার চেষ্টায়। এই দলটি এখন ব-কলমে রাজ্যের জনগণকে বোঝাতে চায়, খারাপ যখন হয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি যখন খারাপের দিকে বইছে তখন তোমাদের শাসন করতে আমাদের আর দোষ কোথায়? বিকল্পই বা আর আছে কে? সত্যি তো, এ কথা তো আর মিথ্যে নয় যে, রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নোংরা ও খারাপের চূড়ান্ত স্তরে উত্তীর্ণ করতে বিজেপির বিকল্প কোন রাজনৈতিক দল নেই এদেশে। তাই তারাও এখন তাদের ঐতিহাসিক মতাদর্শগত নৈতিকতাতে জোর কমিয়ে এ রাজ্যের ঘটে চলা মর্মান্তিক ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে সদলবলে হাজির হয়েছে।
কেন? এই বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটি প্রত্যক্ষভাবে যে ঐতিহাসিক মতাদর্শগত অবস্থানে নিজেদের রাজনীতি প্রসারিত করে তার অন্যতম পোক্ত বস্তুগত ভিত্তি হল এদেশের ব্রাহ্মণ্যবাদী-পিতৃতন্ত্র যা বাকি দেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের তুলনায় চরিত্রগতভাবে ভিন্ন। ঐতিহাসিকভাবে এদেশের পিতৃতন্ত্রকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বপূর্ণ সমাজই জন্ম দিয়েছে এবং লালিত, পালিত করে দানবীয় আকার দেয়। আজকের ভারতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বস্তা পচা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বপূর্ণ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার ফলে ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে, অভিযুক্তের শাস্তি চাইতে গিয়েও নারী সমাজকে ব্রাহ্মণ্যবাদী-পিতৃতন্ত্রের মুখোমুখি হয়ে ধর্ষণের থ্রেট পেতে হয়। অথবা রাষ্ট্রের উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি ধর্ষণ ও ধর্ষকদের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। অথবা তাঁরাও অনেকে ধর্ষণ তথা নারী হিংসার মতন নানা ধরনের ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকেন। এ কথা খোদ এদেশের রাষ্ট্রশক্তি স্বীকার করে, বিভিন্ন সময়ের ঘটনা ও তথ্যের মাধ্যমে।
এই বিজেপি দলটি আদতে সঙ্ঘ পরিবারের অংশ। এই পরিবারের আদর্শ যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব তার প্রাণপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর "সিক্স গ্লোরিয়াস ইপকস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি" - বইতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, মুসলমান মহিলাদের ধর্ষণ করা যুক্তিযুক্ত। শুধু তাই নয়, বিশেষ ক্ষেত্রে তা না করা কাপুরুষতার প্রমাণ। অর্থাৎ, ধর্ষণ সাভারকরের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের আদর্শে রাজনৈতিক অস্ত্রবিশেষ। ফলে নৈতিকভাবেই বিলকিস বানুর ধর্ষকেরা 'উচ্চবর্ণের সংস্কারি' রূপে উপাধি পেয়ে মুক্তি পান। এই সাভারকর যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন, তার ভিত্তি আরও গভীরে। এ সমাজের আদি কালে, মনুসংহিতায়। এতে বলা হয়, “সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ। মুখবাহূরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।।"
অর্থাৎ, এই সকল সৃষ্টির অর্থ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য। মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ– এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এটি হল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বপূর্ণ সমাজ দর্শনের মূল উৎস এবং ভিত্তি বলা বাহুল্য। এতে নারী এবং শূদ্রদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে স্থান দিয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব সমাজের পায়ের তলায় ও নারীরা ব্রাহ্মণ্যবাদী-পিতৃতন্ত্রের পায়ের তলায় স্থান পায়। এমন তাত্ত্বিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তার একটি প্রবন্ধে লেখেন, নারীরা স্বাধীনভাবে সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য নন। কারণ নারীরা বিয়ের আগে তাঁর বাবার অধীন, বিয়ের পর স্বামীর অধীন এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের অধীন, এটি মনুসংহিতার বিধান। ১৯৫০ সালে বাবাসাহেব আম্বেদকর যখন হিন্দুকোড বিলের মাধ্যমে বিবাহিত মহিলাদের পৈতৃক সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার আইন আনেন তখন দেশ জুড়ে তার বিরোধিতা করে এই সংঘপরিবার(আজকের বিজেপি দল তৈরি হয়নি সেসময়)। অবশ্যই তাদের ঐতিহাসিক মতাদর্শগত নৈতিকতার জায়গা থেকে।
এ সমস্ত ঐতিহাসিক মতাদর্শগত নৈতিক অবস্থানের জায়গা থেকেই বিজেপি দলটি দেশের ঘটে চলা ক্রমবর্ধমান ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বপূর্ণ জাতি হিংসা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী-পিতৃতান্ত্রিক নারী হিংসা ও ধর্ষণের পক্ষ নেয়। এমন অবস্থান তারা নিজেদের দলের ভেতরেও অনুশীলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করে। এর ফলে রাজ্য বিজেপি দলটির ভেতরেও নারী নেত্রী, কর্মীর আত্মহত্যা খবর সমাজের বুকে উঠে এসেছে। এখন এরাই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অসহায়তার সুযোগে, ফাঁক তালে এ রাজ্যে ক্ষমতা দখলে আর.জি.করের মর্মান্তিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার রাজনৈতিক সৎকার করতে চাইছে। এ কী রাজ্যের নারী সমাজের অপমান বলে গণ্য হবে, নাকি বিজেপির ঐতিহাসিক মতাদর্শগত নৈতিকতার সন্মানের পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃতি পাবে? সম্ভবত, একই সাথে দুই ঘটতে পারে, ক্ষমতা লোভী শাসকশ্রেণীর অন্তর্দ্বন্দ্বে'র ফলাফল হিসেবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।