দুটি স্লোগানেই সব মুক্তি: সন্ত্রাস থেকে সন্ত্রাসীদের শাস্তি?
জয় শ্রী রাম+ভারত মাতা কী জয় = দেশপ্রেমী। চুরি-ডাকাতি-খুন-ধর্ষণ? কই বাত নেহি! সাতখুন মাফ হিন্দুরাষ্ট্রের নিয়মাবলীতে; যদি তুমি হও দেশপ্রেমী। পটাপট মানুষ মেরে এক নাগাড়ে দিতে পারো দেশপ্রেমের দুটি ধ্বনি...
কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম –তামিল সিনেমার নায়কের মতন পুলিশ-গোয়েন্দা'র সমস্ত বেড়াজাল টপকে ক্যামেরার সামনেই দুজন গুলি ছুড়লো জেল বন্দী আতিক আহমেদ এবং তার ভাইকে। তার ঠিক কয়েকমাস আগেই ছাড়া পেলো – বিলকিস বানো ধর্ষনের অভিযুক্তকারীরা। বিচারপতি বললেন, অভিযুক্ত'দের পক্ষ নিয়ে বললেন - এঁরা তো সংস্কারি। এবার ঈদের ঠিক দুইদিন আগে গণহত্যার সমস্ত কেসের দায় কাঁধ দিয়ে ঝেড়ে ফেলে মুক্ত হলো – কুখ্যাত ভক্তগণ; তথা দেশপ্রেমী। গণহত্যায় অভিযুক্ত বিজেপি’র প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোদনানি সহ ২০০২-এর নারোদা গাম গণহত্যায় জীবিত ৬৭জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করে দিলো। যাদের মধ্যে আছে বজরঙ দলের নেতা বাবু বজরঙ্গী ও ভিএইচপি নেতা জয়দীপ প্যাটেল। এদের নিয়ে বহুত লেখালেখি হয়েছে। হচ্ছে। চলছে পাল্টা প্রতিবাদও। তাই আর এদের সমন্ধে আমায় আলাদা করে কিছু বলবার আজ আর কোন প্রয়োজন নেই।
আমি বলতে চাই - এদের মতন কুখ্যাত ভক্তিবাদী –দেশপ্রেমী’রা যে হিন্দুরাষ্ট্রে এমন বীরের মতন কাজ করে মুক্তি পাবে না তা আমি একদম ভাবিনি। বরং আমি জানতাম এরা সমস্ত কেস থেকে রেহাইও পাবে এবং আরো গণহত্যার ছক সাজাবে। কারণ এরা নাম করা কুখ্যাত দেশপ্রেমী; এমন দেশপ্রেম জিন্দা রয়েই'ছে এদের হাত ধরেই। কিন্তু আমি সাম্প্রতিক কালে ঘটে চলা এই প্রতিটা কেসেই স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করলাম –দেশপ্রেমের দিক নির্দেশ করা স্লোগানগুলিকে। কথায় বলে, স্লোগান যত স্পষ্ট হয়, আগামীর রাজনৈতিক পথ টাও ততটাই নাকি মসৃণ হয়!
বর্তমানে ঘটে চলা প্রতিটি কেসের শেষেই দুটি স্লোগান খুবই জোরের সাথে দেওয়া হচ্ছে। এক, জয় শ্রীরাম; দুই, ভারত মাতা কী জয়। কেবল দেওয়া হচ্ছে নয়, প্রচারও করা হচ্ছে খুবই সু-কৌশলে প্রোপাগান্ডার আকারে। শুধু এই কেস গুলিই নয় এমনকি সরকারের তরফ থেকে ঘর-বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া কিংবা গ্রামে গ্রামে জোতদার-জমিদার, টিকিধারী'দের তরফ থেকে অত্যাচারিত-শোষিতের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পরেও দেওয়া হচ্ছে এই স্লোগান দুটি। শুনলেই যেন কানে বাজছে; মনে হচ্ছে টেপে রেকর্ড করে রাখা হয়েছে স্লোগান দুটি। প্রতিটা অন্যায় সংগঠিত হলেই রাষ্ট্র বাজিয়ে দিচ্ছে। কী তাই নয় নাকি? টিভি রিয়্যালিটি শো তে ‘বাগেশ্বর বাবা’র টক' শো থেকে ইউটিউবের অধিকাংশ রিলে'র পেছনে বাজছে এই দুটি স্লোগান। যা শুনে শুনে একঘেয়ে বোরিং হয়ে গেছে। আর শুনতেও ভাল্লাগছে না মোটে। কিন্তু ভালো না লাগলেও কিংবা শুনে শুনে গা জ্বললেও -এই স্লোগান দুটি কেন দেওয়া হচ্ছে সবেতে? কেন আরএসএস এর নেতারা ‘হিন্দু' কম বয়সী নারী'দের বলছে রিল বানাতে এই স্লোগান ব্যবহার করে। তাদের কথায় -পাপার পরী নয় বরং পাপার শেরনি হতে; কেন? এই স্লোগান দুটি কী এমন যা লাগলেই জাদু মতন সব বদলে যাবে এমন করে?
আসলে এই স্লোগান দুটি কে ব্যবহার করে আরএসএস-বিজেপি তথা হিন্দু-সেনাবাহিনী উগ্রধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে দেশ জুড়ে চলা ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলনের দপদপ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ঘি ঢালতে চাইছে। এদিক থেকে তারা এই স্লোগান দুটির মধ্যে দিয়ে দেশের সংখ্যাগুরুর ভেতরকার ধর্মীয় চেতনা সুড়সুড়ি দিয়ে ও দেশের প্রতি ভালোবাসার কৃত্রিম রস বাড়িয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে চাইছে। আরেকদিক থেকে সমস্ত অন্যায়ের উপরে এই দুটি স্লোগানের প্রলেপ লেপে সমাজে এক আতঙ্ক, ভয়-ভীতির সৃষ্টি করছে। এই ভয় কিসের ভয়? উগ্র দেশপ্রেমের ভয়। যাতে তাদের করা কোন কাজেই বিন্দুমাত্র বাধা দেওয়ার কেউ না থাকে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলনের পথ মসৃণ করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। এই পথ কে মসৃণ করতেই টার্গেট(আইওয়াশ হিসেবে)কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই রমজান মাসেই একের পড় এক কাজ তারা সংগঠিত করেছে; মুসলমান বস্তিতে, রামনবমী’কে উপলক্ষ্য রেখে সংগঠিত আক্রমন করা থেকে ঠিক ঈদের দুই দিন আগে মুসলমান গণহত্যায় দায় অভিযুক্ত'দের মুক্তি, হত্যাকারী বাবু বজরঙ্গী’দের। তারপরেই নাকি কোর্ট চত্বরে এই দুটি স্লোগান। পুলিশের বিনা বাধাতেই। সাথে মূল ধারার সংবাদমাধ্যম গুলোর প্রচারও তেমন। এই দুটি স্লোগান'কে সামনে রেখেই। যেন স্বয়ং রাম এবং ভারত মাতা আগে থেকেই এসব লিখে রেখে গেছিল! এসব করা হচ্ছে কেবল সমাজে ভয় পাওয়ানো স্বার্থে এবং সংখ্যাগুরু'র ভেতরকার জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় চেতনা উগ্র করে তুলতে। মানে ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলনের রথের চাকার গতি বাড়াতে। আর তা বাড়াতেই সবেতে এই দুটি স্লোগান উড়িয়েই সমাজের বুকে ভয়-আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি।
একথা আজ সত্যি স্বীকার করবার আছে – শ্রীমান নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার সাম্রাজ্যবাদী আইন- নীতি, প্রণালী তেমন ভাবে তাদের আমলে বাস্তবে লাঘু করে উঠতে পারেনি। সংসদের ভেতরে যেভাবে হোক পাশ করালেও। যেমনটা কংগ্রেস জমানায় চুপিসারে টুকটুক করে করেছিল শ্রীমান মনমোহন সরকার। শুধু বিজেপিকে আমাদের কংগ্রেসের থেকে বাড়তি বাগম্বর লাগবার কারণ, ওদের গরু নিয়ে খুনোখুনির রাজনীতি আর আরএসএস-এর সংগঠিত হিন্দুত্ববাদী ইডিওলজি। যা ধরেই বিজেপি সরকার টিকে থাকবার চেষ্টা করছে এখনো। তবুও আরএসএসের কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দিয়েও পেরে উঠছে না এদেশের সংখ্যাগুরু ’হিন্দু‘দের এক সুতোয় বেঁধে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ম-নীতি পুরোপুরি লাগু করতে।
আরএসএস-এর ‘হিন্দু’রাষ্ট্র হলো পুরোনো বাইকে নতুন সিট কভার লাগানোর মতন; যে বাইকের পার্টস সবটাই পুরানো কেবল পুরনো পার্টসের দিকে নজর এড়াতে উপরে সিট কভারটি নতুন। ঝা চকচকে একেবারে। সেই কভারে সংখ্যাগুরু ভেতরকার ধর্মীয় চেতনায় জিগির দিতে রাম কিংবা হনুমানের ছবি। যে রাম কিংবা হনুমান সাম্রাজ্যবাদী-ভোগবাদী সংস্কৃতিতে মত্ত। যার নিজস্ব কোন সত্তা নেই। সে এখন ডিজে গানে কোমর দোলায়। এই হিন্দুরাষ্ট্রের একটাই লক্ষ্য এদেশের বুকে যেভাবে হোক -শিক্ষার গৈরিকিকরণের মধ্যে দিয়ে বেসরকারিকরণ করা, শ্রমিক-কর্মীদের কাজের সময় বাড়ানো এবং দৈনিক মজুরি কমানো, কৃষকদের চাষের জমি উন্নয়নের নামে কেড়ে নেওয়া, আদিবাসীদের হাত থেকে যেভাবেই হোক জল-জঙ্গল-জমিন কেড়ে নেওয়া। তথা, ব্যবসার একচেটিয়া আধিপত্য - অধিক মুনাফার স্বার্থে –‘একদেশ এক আইন‘, ‘একদেশ এক ভাষা’, ‘একদেশ এক ধর্ম‘ লাগু করা। অতএব সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা পরিচালিত এদেশের অতি ধনী'দের স্বার্থ যে ভাবে হোক রক্ষা করা। বিশ্ব নয়া উদারবাদী অর্থনীতি টালমাতাল পরিস্থিতিতে। সুতরাং, এই ‘হিন্দু'রাষ্ট্র কেবল বড়লোকদের। রাম থেকে হনুমান সব তাদের হাতের এক একটা অস্ত্র মাত্র। যেখানে গরীবের কোন স্থান নেই; গরীবের জন্যে কোন রাষ্ট্র সুরক্ষা নেই। আর ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রধান অস্ত্র হলো সমাজে সবসময় ভয়-ভীতি, আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা। যাতে মানুষ ভয়ের বাইরে কিছু ভাবতে না পারে কখনো। তাই, এমতাবস্থায় আমাদের প্রথম কাজই হলো এসবের ফলে ভয় না পাওয়া। আবার অতিরিক্ত স্বতঃস্ফূর্ততার বসেও কোন হটকারী সিদ্ধান্তপূর্ন কাজ না করে বসা। প্রতিটা সময় সচেতন থাকা এবং অন্যকে সচেতন রাখা। ফ্যাসিবাদীদের প্রধান ওষুধ হলো ভয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা ভয় ধরানো।
আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র-আইন-বিচারব্যবস্থা-সংসদ, সংবাদমাধ্যম যে ভাবে কুখ্যাত দেশপ্রেমী বাবু বাজরঙ্গী’দের বাঁচাতে ব্যস্ত তা তো একথায় প্রশংসনীয়। কিন্তু তাহলেও এরপরে কী হবে! ৯০% সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগণের দেশে ফ্যাসিস্ট'দের সমস্ত দিক থেকেই তো পালানোর পথ একে একে হচ্ছে বন্ধ। জনগণের কাছে আজ জল-ভাতের মতন সবটাই স্পষ্ট।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।