বাকি আর পাঁচটা সরকারি প্রকল্পের মতন উচ্ছেদও আজ একটি সামাজিক প্রকল্প। কোন ব্যক্তি কিংবা কোন গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করবার মনোভাব রাজনৈতিক ভাবে সমাজের শিকড়ে আঁকড়ে বসেছে। সাধারণত এটি দুর্বলের প্রতি সবলের একটি বলপ্রয়োগ অভিযান। এমনটাই মনে করেন, দত্তপুকুরের পূর্ণিমা বারুই। অভিযোগ, তিনি তাঁর জীবনদশায় এখনও পর্যন্ত তিনবার উচ্ছেদ হয়েছেন। প্রথমে, স্বামীর ঘর থেকে, তার পর হকারি জীবনে দু'বার। প্রথমবার হাওড়া স্টেশনে আরপিএফের হাতে, দ্বিতীয়বার ওই একই ভাবে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে। এখন তিনি গত পাঁচ বছর ধরে ধর্মতলার সিটিমার্ট, হগ-মার্কেট চত্বরে ঘুরে ঘুরে জুট, ক্যানভাসের ব্যাগ বিক্রি করেন। ২৫শে জুন সকালে হঠাৎ করে শোনেন, সেখান থেকেও তাঁদের উচ্ছেদ করা হবে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এ ঘোষণা করেছেন।
তাহলে আর করার আছে কী? পূর্ণিমার মস্তিষ্কে অতীতে উচ্ছেদের জীবন্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবারে তিনি সেখান থেকে মুখ বুঝে সরে যেতে নারাজ। প্রতিদিন সকালে গৃহপরিচারিকার কাজ সেরে দু'ঘণ্টা পথ অতিক্রম করে হকারি করতে আসেন। 'সিঙ্গেল মাদার', পূর্ণিমা এখন ছয় বছরের অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে অর্ধেক পেট খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এই প্রথম, পাঁচ বছরের হকারি জীবনে টানা পাঁচ দিন কাজ বন্ধ। পাঁচ দিনের মাথায়(২৯শে জুন) যখন সেখানকার হকাররা জায়গা ছোট করে বসতে যান তখন সামনের দোকানদারদের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হন। তখনি বদলে যায় চেনা হগ-মার্কেট চত্বরের মুখ। চলে দফায় দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শন। পূর্ণিমা তাতে উপস্থিত ছিলেন। এই বিক্ষোভ প্রদর্শনের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন থাকলেও, সেই দলেরই ঝান্ডা হাতে পূর্ণিমার গর্জন ভিন্ন, "এ সমাজে গরীরের পক্ষে কোন সরকার নেই কেন? রাজ্য সরকার আমাদেরকে এমন হুট করে সরে যেতে বললে আমরা কোথায় যাব, কী খাব?", "আমাদের থেকে ভোট নিয়ে ভোটের পরেই আমাদের পেটে আক্রমণ, কেন?", তখনি এ কথা তাঁর পাশ থেকে আরেক হকার বলেন।
ধর্মতলা গ্রান্ড হোটেলের সামনের হকার, তাজ। প্রায় কুড়ি বছর সেখানে ডালা পেতে জামাকাপড় বেচছেন। এখন রোজগার অনেক কমেছে। দিনে মেরেকেটে দু থেকে আড়াইশো টাকা লাভ থাকে, তবুও তিনি এত বছরের হকারি জীবন ত্যাগ করতে নারাজ। সরকারের সমস্ত কথা শুনেই তিনি হকারি করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পুলিশ-প্রশাসনকে। কিন্তু তার পরেও কী উচ্ছেদ থেকে সমাজের নিস্তার রয়েছে!
উচ্ছেদের বলি শুধুই কী রাস্তার হকার? না, তা নয়। রাজ্য-কেন্দ্র দুই সরকারের নীতি উচ্ছেদ। কোথাও রেলকে আধুনিকীকরণের স্বার্থে রেল লাগোয়া বস্তি উচ্ছেদ, রেলের হকার উচ্ছেদ। আবার কোথাও বিনা নোটিশে স্বমহিমায় চলছে 'দখলকারী’ দাগিয়ে রাস্তার হকার উচ্ছেদ। এতেও স্বস্তি নেই। বনাধিকার আইনগুলিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিন থেকে উচ্ছেদ। এই প্রতিটি উচ্ছেদ আসলে সমাজে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনধারনের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে, সমাজের প্রগতির নিয়ম-নীতিকে উচ্ছেদ করে। যেখানে শুধু পার পায় এবং নিজেদের ক্ষমতা বাড়ায় একদল, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানেরা।
তবে উচ্ছেদ চালাতে দুই সরকার নীতিগত ভাবে একই জায়গায় অবস্থান করলেও উচ্ছেদ অভিযানের কৌশলগত পদ্ধতি আলাদা। কেন্দ্র সরকার এ উচ্ছেদ অভিযানে সরাসরি সামিল হলেও রাজ্য সরকার দুই দিকের সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে চলবার পক্ষে। একদিকে উচ্ছেদ, আরেকদিকে গণভিত্তিও অটুট রাখবার প্রচেষ্টা। তাই উচ্ছেদের কথা ঘোষণার পর বাস্তবে তা প্রয়োগ হওয়ার পথেই 'কাঁটা ঘায়ে মলম লাগাতে', ব্যক্তি ক্যারিশম্যাটিক ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রী বললেন, "উচ্ছেদ আমাদের লক্ষ্য নয়, এক হকারের একটি জায়গা।" আদতে যদি এমনটাই লক্ষ্য হয় তাহলে কেন কোন নির্দিষ্ট তথ্য, পরিকল্পনা, বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া পৌরসভা পুলিশ-প্রশাসন সমেত বুলডোজার নিয়ে রাস্তায় নামবে? এ বিপন্ন সময় রাজ্য সরকারের শাখাসংগঠন গুলিও পুলিশের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সরব হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি রাজ্য সরকারের প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ যা শাসকশ্রেনীর রাজনৈতিক 'সেফটি ভাল্ব' হিসেবে কাজ করে। এই মুহূর্তে যতটুক প্রয়োজন ছিল, এতখনে সেসব হাসিলও হয়ে গেছে। গনতন্ত্রের জন্যে এ এক ভয়ংকর বিপদ। রাজ্য রাজনীতিতে জনগণ-পক্ষের নীতি মেনে কোন শক্তিশালী বিরোধী শক্তি না থাকবার ফলাফল।
অবশ্যই রাস্তা পরিষ্কার রাখবার প্রয়োজন। শহর থেকে রাজ্য তথা দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার, আধুনিকীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই কারণে জনগণের রুজিরুটিতে আঘাত হানলে, তার মানে কী দাঁড়াবে? সরকারের এ কারণ তো সমাজের বুকে নিতান্তই এক অজুহাতে পরিণত হবে এবং লক্ষ্যবস্তু উচ্ছেদ। এ তো কোন সমাধান নয়। এর ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। এর থেকে সমাজে হিংসাত্মক চিত্র, চরিত্র বৃদ্ধি পেতে বাধ্য, সমাজ রসাতলের পথেই এগোবে। তাই রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়প্রাপ্ত নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থে, রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালনে বুক উঁচিয়ে যেখান সেখানে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালাতে পারেন। ফলে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছোট ব্যাপারে হিংসার সৃষ্টি হয়, তার থেকে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক ভাবে দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে আজ সমাজের গোড়ায় উচ্ছেদপূর্ণ মনোভাব গেঁড়ে বসে আছে।
এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। উচ্ছেদ যে কোন সমাধান নয়, বরং সমাজে শিকড়ে ঢুকে তা এক নতুন বৃহৎ সামাজিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটাচ্ছে, সরকার নিজের রাজনৈতিক অপদার্থতা ঢাকতে এটিকে ব্যবহার করছে তা সকলেরই বোঝবার দরকার। এ কথাই বলেন, সমাজকর্মীরা। যাঁরা এখনও এ বিষয় বুঝতে অপারগ, তাঁদের বিরুদ্ধে চতুর্থবার উচ্ছেদ হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্ণিমার গর্জন। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে গর্জন, সামাজের বিরোধীদের বিসর্জন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।