‘এত রোদ মাথায় নিয়ে কাজ করে কে?’- গত ২৮শে এপ্রিল বিয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা মাথায় নিয়ে কর্মরত অবস্থায় এ প্রশ্নটি আমায় করেছিলেন এক নির্মাণ শ্রমিক। আট ঘণ্টার এমন ঝুঁকিপূর্ণ কষ্টসাধ্য কাজে তিনি মজুরি পান স্বল্পমূল্যের, ৪২৯ টাকা। কাজ চলাকালীন কোন দুর্ঘটনা ঘটলে পরে দায় নেই ঠিকাদারের।
এই কথা গুলি কথা বলবার কারণ, এ দিনটি ছিল, আইএলও ডাকে পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রচারের দিন। যথারীতি দিন অনুযায়ী কাজও হয়েছে। সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলি একত্রে বসে সিদ্ধান্তে এসেছে, দাবী রেখেছে যে, সমস্ত রাজ্যের হাসপাতালে পেশাগত অসুস্থতা নির্ণয়কেন্দ্র চালু করাবার। তবে এতেই কী শ্রমিকের স্বাস্থ্য জীবনের কোন পরিবর্তন কিংবা উন্নতি ঘটে! যখন শোষণ প্রতিনিয়ন বেড়ে চলে।
লোকসভা ভোটের মাঝেই চলে গেলো এবারের ১৩৮তম আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। লোকসভা ভোটে সমস্ত প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলি দেশের শ্রমজীবী মানুষকে ন্যায় পাওয়ানোর ‘গ্যারেন্টি’-র আশ্বাস দিয়েছে। তবে তাঁরা আশ্বাসের মাঝে শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিকের ‘কাজের বোঝা’ ক্রমশঃ বেড়ে যাওয়া এবং মজুরি কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে দু-শব্দ খরচ করতে নারাজ। কেন এমনটা হচ্ছে, এর প্রধান কারণগুলি কী কী, সে কথা শ্রমিককে জানাতে নারাজ। এই ভোটের কিন্তু দুটি দিক থাকে; এক, ভোটের পরে কে জিতবে তা নিয়ে ভাবনা; দুই, ভোটের প্রচার। দ্বিতীয়টি প্রধান সামাজিকভাবে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনার মান বৃদ্ধি ঘটাবার ক্ষেত্রে। দুর্ভাগ্যবশত কোন রজনৈতিকদলের-ই ভোটের প্রচারে শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক চেতনার মান বৃদ্ধির প্রচার লক্ষ্য করা যায়নি।
আমাদের দেশের নির্ধারক অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা এ দেশকে মূলত কয়েকটি আর্থ-সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালনা করছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষকে 'পাইয়ে দেওয়া'র রাজনীতির গভীরে তলিয়ে দিচ্ছে। তারপরেও এমন কোনও বিরোধীদল নেই যারা শক্তভাবে মাথা তুলে তা নিয়ে রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলতে পেরেছে। যদি এসব শুনে শ্রমজীবী মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে পড়ে তাহলে শ্রমজীবী মানুষকে ন্যায় পাওয়ানোর ঠেকার রাজনৈতিক দায়িত্ব দেবে কে?
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস – শ্রমিকদের কাছে ঐতিহাসিক ভাবেই গৌরবময় দিন। গৌরবের দিন শ্রমিক সংগঠনগুলির কাছেও। তবে এই দিনটির ইতিহাস এদেশে ক্রমেই মুছে যাওয়ার পথে। রাষ্ট্র যেমন চাইছে মুছে দিতে তেমনই বিরোধীরাও কিছু কম যায় না; তাঁরা আজীবন শ্রমিকের জীবন-উন্নতি করে দেওয়ার কথা মুখে বলেছে এবং তার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষকে পরনির্ভরশীল করে নিজেদের রাজনৈতিক অঙ্ক কষেছে। এখনো তাই করছে। তাই তাঁরা লগ্নি পুঁজির শোষণ তীব্র হওয়া নিয়ে ভুলবশতও বিরোধিতা করার পক্ষে নেই। বরং সেই শোষণের দিক থেকে শ্রমিকের নজর ঘোরানোর পক্ষে। তাই এরই মধ্যে বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন নামে সাহায্য-সংস্কারমূলক কিছু 'কাজ' হাজির করে ভোট চাইতে শ্রমজীবী মানুষের দুয়ারে আসে। শ্রমিক সংগঠনগুলিও এই একই রাজনীতির বন্ধনে আবদ্ধ। শ্রমিকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করার বদলে শ্রমিকের মস্তিষ্কে দর-কষাকষির অর্থনৈতিক অঙ্ক গেঁথে দিয়ে, তাঁদেরকে মালিকপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতি সম্পূর্নরূপে পরনির্ভরশীল করে তুলেছে। ফলে এতদিনে শ্রমিকেরা কোন সঠিক সুরাহা না পেয়ে আজ শক্ত-পোক্ত একনায়কের স্বরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়ে পড়েছে।
শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধকারী লেখক-লেখিকা, বিশিষ্ট সাংবাদিকেরাও যথেষ্ট পরিমাণে বোঝেন কেন আজ এমন হাল, কবে থেকে এদেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে দুর্দশার পরিমাণ ভারী মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রতিকার-ই বা হবে কী করে! তারপরেও তাঁরা সেই কারণের মূলগত বিষয় নিয়ে জনসম্মুখে বিরোধিতা করতে নারাজ, শ্রমিক-স্বার্থে কথা ভেবে, দেশের প্রকৃত অর্থে বিকাশের কথা ভেবে সে বিষয়গুলি নিয়ে রাষ্ট্র ও বিরোধীদলগুলির কাছে দাবী রাখতে নারাজ। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে 'নব্বইয়ের দশক' উচ্চারণ করে ফেললেও দাঁত কামড়ে জিভ টেনে ধরেন।
তাই শ্রমিক দিবসের গোড়ায় চা বাগান বন্ধ হল, শ্রমিক দিবসের দিনে রাজ্যের অনেক চটকলগুলিতে ঠিকা প্রথায় কাজ চললো, অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলির শ্রমিকদেরকে বিনা ছুটিতে কম মজুরির বিনিময় শ্রমিক দিবসের দিনেও খাটানো হল কিন্তু কোন বিরোধিতা লক্ষ্য করা গেলো না। আর্থ-সামাজিক ভাবে অসহায় শ্রমিকেরাও দিব্যি কাজ করলেন। বামপন্থী দল, শ্রমিক সংগঠনগুলি নিজেদের মধ্যে ছোট-ছোট কয়েকটি মিছিল আর পথসভায় ভোট প্রচারের দ্বারা এ দিনটির রুটিন মাফিক উদযাপন সারলেন। সরকার বদলালে সব ঠিক হয়ে যাবে - দশকের পর দশকের এই প্রতিশ্রুতিতেই শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ভাবনা, উন্নত-জীবনের কল্পনাকে সীমাবদ্ধ রাখবার অন্তিম রেখা টেনে দিলেন।
দেশের শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশ ঘটানোর বদলে পরনির্ভরশীল করে তোলার এমন সস্তার রাজনীতির চাষ, শ্রমজীবী মানুষের উন্নত-জীবনের ভাবনাকে আটকে দেওয়ার কাজ যে কতটা ক্ষতিকর তা এখন হারে হারে টের পাওয়া যায়। এর ফলে রাষ্ট্র শ্রমিকের কাজের বোঝা বিনা বিরোধিতায় ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে, শ্রমজীবী মানুষকে ধর্মীয় মোহে মাতিয়ে তুলে একের পর এক জনবিরোধী আইনগুলিকে জ্যান্ত করে লগ্নি পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করে, একের পর এক স্ব-তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজেদের কব্জায় নিতে পারে।
আজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের চেতনাগত রাজনৈতিক সংকটের ফলে ক্ষতি কেবল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষেরই নয়, বিরোধীদলগুলিরও হয়েছে, হচ্ছে। যার মাশুল তাঁদেরকে আগামীর ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট জমানায় সুদে-আসলে চোকাতে হবে, হয়তো তা বিরোধী শূণ্য হয়ে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।