ইতিহাসের বিশেষ সন্ধিক্ষণ ইতিহাসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরখ করার সৌভাগ্য হয় ক’জনের! বৃত্তের বাইরে থেকে নয়, একেবারে কেন্দ্রে থেকে পটপরিবর্তনের সাক্ষী থাকা এবং তাকে লিপিবদ্ধ করা গল্প বলার ছলে, এ নিতান্ত সহজ কাজ নয়। পাঠ্যবইয়ের ‘ইতিহাস’-এর বাইরে বেরিয়ে যে ভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা লেখক নিজে পরখ করেছেন, তার অভিঘাত যা নিজে চোখে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণী মন নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন, তা এই বইটিকে নিছক ভ্রমণ কাহিনী বা আত্মজৈবনিক অন্য কোনও রচনার থেকে পৃথক করেছে। এখানেই হীরেন সিংহ রায়ের পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি স্বতন্ত্র। গুরুচণ্ডালী-তে যে লেখা ইতিপূর্বে ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত হত, তা-ই এ বার দু’মলাটের মধ্যে।
ইতিহাসের কোন কোন সন্ধিক্ষণের কথা বলছিলাম? লেখক বলেছেন, দশ মাসের ভেতরে আমাদের ‘অল্প দেখা, কম জানা’ দুনিয়াতে তিনটি ঘটনা ঘটে। আপাতদৃষ্টিতে যে তিনটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে যার প্রভাব বিস্তর।
১৯৮৯, ৪ জুনে তিয়ানানমেন স্কোয়ার। গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজব্যবস্থা চেয়ে যে প্রতিবাদী মানুষেরা গোলাপ ফুল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন ট্যাঙ্কের মুখোমুখি, তাঁদের এবং সেই স্বপ্নের মৃত্যু হল চিনা লাল ফৌজের বন্দুকের গুলিতে।
পরের ঘটনা ১৯৮৯, ৯ নভেম্বরের। আঠাশ বছরের পুরোনো বার্লিন দেওয়াল এবং পঞ্চাশ বছরের পুরোনো পূর্ব ইউরোপীয় সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ল।
অতঃপর, ১৯৯০, ১১ ফেব্রুয়ারি। কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ মানুষের সমান অধিকার চাওয়ার অপরাধে ছাব্বিশ বছর কারাবাসের পরে মুক্ত এক ব্যক্তি এসে দাঁড়ালেন কেপ টাউনের পুরসভার বারান্দায়। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, সারা আফ্রিকা যখন সাদা বনাম কালোর এক আসন্ন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় কাল গুনছে, তখন নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, “যা বিগত, তা বিগত।” সমগ্র আফ্রিকা যেন নবপ্রাণের স্পন্দন পেল।
পারস্পরিক আপাত-সম্পর্কবিহীন এই তিনটি ঘটনার তাৎপর্য বুঝে নিজেদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে যখন বিশ্বের বড় বড় ব্যাঙ্ক ব্যস্ত, তার দেড় বছরের মধ্যে আরও কিছু ঘটনা ঘটল। ২৪ জুলাই, ১৯৯১। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম সম্মানে বিভূষিত এক অর্থনীতিক দাঁড়ালেন ভারতীয় সংসদে। অর্থমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিংহ তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ভারতীয় অর্থনীতির চার দশকের শৃঙ্খল খুলে দিলেন। গৃহীত হল উদারনীতিকরণ।
অতঃপর, আরও একটি ঘটনা। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বৃহত্তম দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্ত্যেষ্টি ঘোষিত হল।
বস্তুত, পরের পর এই আপাত-বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলির তাৎপর্য অসীম। যখন নতুন বাজারের সন্ধানে পশ্চিমের তাবৎ ব্যাঙ্ক হন্যে হয়ে ঘুরছে, তখনই বিশ্বজুড়ে নানাবিধ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল। বিশ্বজুড়ে এ হেন পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকের প্রাক্কালে ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে ইউরোপ যাত্রা করেছেন লেখক, যাঁর কর্মজীবনের সূচনা ১৯৭২-এ। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায়। পাঁচ বছর পর সেই ব্যাঙ্কের ফ্রাঙ্কফুর্ট শাখায় বদলি কয়েক বছরের জন্য। জার্মানিতে ভাষা শিক্ষা এবং চাকরির পরিবর্তনের কারণে দেশত্যাগ। ১৯৮৫ সাল থেকে লন্ডনের ইহুদি পাড়ায় সিকি শতকের আবাসন। কাজ লন্ডনের সিটি এবং পরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে, মুখ্যত ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং।
কৃতী ছাত্র হীরেনের জন্ম ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮। বাল্যকাল কেটেছে বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) ঝরিয়ায়। ১৯৬০ সালে কলকাতা, পাইকপাড়া। ক্লাস সেভেন থেকে ইলেভেন বরাহনগরের নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির। ১৯৬৫ সালে হায়ার সেকেন্ডারি, হিউম্যানিটিজ শাখায় প্রথম স্থান। তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাসে অর্থনীতি অধ্যয়ন। এমন এক ব্যক্তির লেখায় যে সমাজবীক্ষা থাকবে এবং ব্যাঙ্কিং সেক্টর ঘিরে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অবস্থা বদলের জ্যামিতি ধরা দেবে, তা অনুমেয়।
হীরেনের সেই সময় এখনকার কোনও পাঠকের কাছে মনে হতে পারে রূপকথার দেশ। প্রাক্কথনে জ্যোতিষ্ক দত্ত লিখেছেন, হীরেনের ইতিহাসের দেশে ‘‘ইন্টারনেট নেই, জিপিএস নেই, আমাজন ডট কম নেই, আছে লম্বা কাঠের বন্দুক হাতে সশস্ত্র প্রহরী, আছে অটোবানের রাস্তায় হঠাৎ মোড় নেওয়া দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার, আছে গভীর রাতের কড়ানাড়া, আছে হাইকের চিঠি, আর নিশানা হারিয়ে বহুদূর এসে শুনতে পাওয়া, ‘ঝাকশেভো? তাম’!’’
অথচ কথা ছিল অন্য— ফ্র্যাঙ্কফুর্টে দু’বছরের স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাজ সেরে পুবের পানে ফিরবেন। সেই ফেরা আজ পর্যন্ত হয়নি। পথ ক্রমশ গিয়েছে পুবের বদলে পশ্চিমে। কোন মায়া-বলে নিয়ম মতো প্লেনে ওয়ারশ না গিয়ে বার্লিন থেকে গাড়ি ভাড়া করে পোল্যান্ডের পশ্চিমে এক ছোট্ট গ্রামে হাজির হয়েছিলেন, এখনও জানেন না হীরেন। সেই যে পথ চলা শুরু হল, তা থামবে ১৫টি দেশে ঘোরার পর এবং এই যে যাত্রা যেখানে আলাপ হবে বহু মানুষের সঙ্গে। তাঁদের কারও সঙ্গে তৈরি হবে চিরস্থায়ী সম্পর্ক। কেউ শুধু থাকবেন স্মৃতিপটে খানিক জায়গা করে নিয়ে। হীরেনের গল্প বস্তুত, সেই সব মানুষ নিয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে নয়। তবে যেহেতু তিনি ব্যাঙ্কের কাজেই ব্যাপৃত থেকেছেন, ফলে পটভূমিতে চলে এসেছে ব্যাঙ্কিং কাজকর্মের কিছু কথা। তবে সে সব পড়তে খারাপ লাগে না। যেমন: ‘ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং’ শব্দটি বর্তমানে এ দেশে জনপ্রিয় হলেও আমাদের অনেকেরই এই ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। হীরেন গল্পের ছলে বিষয়টা বুঝিয়েছেন। যেহেতু তিনি এই ব্যবস্থার গোড়া থেকে কাজ করেছেন, ফলে তাঁর বিষয়টি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, কোনও অস্পষ্টতা নেই।
বইটির তিনটি পর্ব— পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি এবং রাশিয়ার পর পরিশিষ্ট। পোল্যান্ড পর্বে ছ’টি অধ্যায়। পূর্ব জার্মানি পর্বে চার অধ্যায় এবং রাশিয়া দশ অধ্যায়ে বিন্যস্ত। পরিশিষ্টাংশে রয়েছে মূল্যবান শব্দকোষ। লেখক বলছেন, আমরা ইউরোপ চিনেছি মূলত ইংরেজের জবানিতে। যেমন তারা লিখতে এবং বলতে শিখিয়েছে, আমরা তেমন শিখেছি। উদাহরণ হিসাবে, ‘মিউনিক’ অথবা ‘ব্রান্সউইক’। যদিও জার্মানরা এই শব্দগুলোর ভিন্ন উচ্চারণ করেন— মুয়নশেন, ব্রাউনশোআইগ। লেখক স্বীকার করেছেন, ওয়ারশ প্রাগ বুদাপেস্ট বুখারেস্ট বাদে পূর্ব ইউরোপে খুব কম জায়গার নামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। এই ডায়েরি লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে বাঙালির অচেনা কিছু নাম ল্যাটিন হরফে লিখলে কৌতূহলী পাঠক তাঁর গল্প পড়ে যদি এই সব দেশ ভ্রমণে যান, ম্যাপে বা গুগলে নামগুলো চিনে নিতে পারবেন। পূর্ব ইউরোপের বহু জনপদের একটি করে জার্মান নাম ছিল। অব্যবহারে মানুষের স্মৃতি থেকে তার কিছু বিলুপ্তি ঘটলেও ইতিহাসে খোঁজখবর করার পক্ষে সেটা জেনে রাখা উচিত বলে মনে করেছেন লেখক, তাই যেখানে প্রযোজ্য, জার্মান নামটি তিনি রেখেছেন। সাধু উদ্যোগ বলার অপেক্ষা রাখে না।
বইটি পড়তে গিয়ে অনেক তথ্য পাঠক গল্পের ছলে জানতে পারেন। যেমন, নাৎসি অর্থনীতি ছিল নগদভিত্তিক। নগদ টাকা নিয়েও যে কত ঝক্কি— ব্যাঙ্কে ক্যাশের টানাটানি, সমবাইকার দোকানে খুচরো পাওয়ার সমস্যা, ছেঁড়া নোট নিতে আপত্তি— এ সব শুনে লেখকের মনে পড়ে, তিনি শ্যামবাজার বা আশুবাবুর বাজারের বেশি দূর আসেননি! দীর্ঘ ইউরোপ প্রবাসে পশ্চিমি ব্যাঙ্কিংয়ের যে চরম দুর্দিন দেখেছেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সালে— তা-ও উল্লেখ করেছেন লেখক। কী সেই দুর্দিন, তার সঙ্গে ভারতে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের দুর্দিনের চরিত্রগত মিল ছিল কি না, তা পাঠক স্মরণ রাখতে পারেন। এমন তথ্যও জানতে পারেন, ১৯৯৩ সাল অবধি পূর্ব ইউরোপে বাণিজ্যিক ভাবে (পারস্পরিক সরকারি ঋণ বাদে) কোনও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ঋণের কারবার হয়নি। পুরো শূন্য থেকে শুরু করার মুহূর্তের বিবরণ এবং নতুন ব্যবস্থার দোলাচল সুন্দর ভাবে ধরা দেয় হীরেনের লেখায়। মনে পড়ে যেতে পারে, ভারত ভাগ হয়েছে এক বার, পোল্যান্ড তিন বার এবং এই ভাঙচুরের খেলা খেলেছে রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া। তার অভিঘাত কী, তা-ও জানা যায় বইটি থেকে। কত দেশ, কত মানুষ, কত অভিজ্ঞতা— হীরেনের লেখা পড়ে মনে হয় তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ। ‘রাজধানী থেকে বন্দরঘাটায়’ অধ্যায়ে আন্দ্রের সঙ্গে হীরেনের কথোপকথন, ঝাকশেভোর গ্রাতাসিনা গ্রাবোসকার আমন্ত্রণ, ড্রেসডেন থেকে ব্রেসলাউ যাওয়ার পথে সন্ধ্যের ট্রেনে জনৈক জার্মানের সঙ্গে কথালাপ ছাড়িয়ে বন্ধুত্ব, যার ফলশ্রুতি লেখকের বাধা দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিয়ারের দাম দেওয়া…। ট্রিভিয়া হিসেবে মাথায় রাখা যেতে পারে সেই জার্মানের উক্তি— ‘‘আমরা জার্মানরা আমাদের বিয়ারের যতই বড়াই করি না কেন, পোলিশ বিয়ারটাও পাতে দেওয়া যায়…।’’ কিংবা ডনজিগের মেরি মাতার নামাঙ্কিত গির্জাতে দাঁড়িয়ে লেখকের মনে হয়েছিল, ইতিহাসকে যেন ধরাছোঁয়া যায়। ডানিয়েলের সঙ্গে জমি কেনাবেচার অভিজ্ঞতা, তাপমাত্রা যখন শূন্যের চেয়ে আট ডিগ্রি নিচে…। সব মিলিয়ে পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি এবং রাশিয়া— তিন দেশের অসংখ্য ঘটনা, বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্ক তৈরি হওয়া, আড্ডা এবং সেই সঙ্গে নতুন ধরনের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রসার কী ভাবে ঘটেছিল, তার মনোজ্ঞ বিবরণ হীরেনের এই দিনলিপি।
রয়ে গিয়েছে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ। প্রচ্ছদ আরও আকর্ষণীয় হতে পারত। তবে সব কিছুকে অতিক্রম করে যায় হীরেনের সাবলীল ভাষা, এত দিন বিদেশে থেকেও যাতে এতটুকু মরচে পড়েনি। সব মিলিয়ে, এমন একটা বই প্রকাশ করার জন্য গুরুচণ্ডালীকে ধন্যবাদ। দ্বিতীয় ভাগ পড়ার জন্য পাঠকের উৎসাহ থাকবে।