মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন্দ্র সিংহ কি রাজধর্ম পালন করেছেন? ৩ মে থেকে দুই জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ে রক্তাক্ত উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিকে দেখে এই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। ধর্ষণের পর রাস্তায় নগ্ন করে তরুণীদের হাঁটানোর ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এলে ভেতরে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। প্রশ্নটি তখন শুধু বিরোধীদের স্বর হিসাবে থাকবন্দি করে রাখা যায় না। নির্যাতিতার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবার চেষ্টা করলে অস্বস্তি বাড়ে। উঠতে থাকে বহু প্রশ্ন। রাষ্ট্র কি তার কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করছে? ঘটনাটি ঘটার এত পরে কেন পদক্ষেপ করল প্রশাসন? কেনই বা ৭৯ দিন পর মুখ খুললেন প্রধানমন্ত্রী? কোন নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মূল্যায়ন করা যায়?
ভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন সময়ে এমন প্রশ্ন উঠেছিল। ২০০২ সালে গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ঘিরেও তৈরি হয়েছিল নানা প্রশ্ন। সে সময় মোদীকে পাশে বসিয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মোদীর উদ্দেশে বলেছিলেন, রাজধর্ম পালন করতে হবে। স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর বই রাজধর্ম–র মুখবন্ধে এই ঘটনাটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সময় বদলেছে, প্রেক্ষিত পাল্টেছে, নরেন্দ্র মোদী এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। মণিপুরের ঘটনার পর তাঁকে কিন্তু অটলবিহারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি। স্বাতী বলেছেন—রাজধর্মের পালন কখন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা নির্ধারণ করার উপায় কী—তার অন্বেষা যেমন চলছে রাজনীতি, অর্থনীতির নানা তত্ত্বের অন্দর থেকে, তেমনই তার অনুসন্ধান জারি দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের আঙিনা থেকেও। এই প্রসঙ্গে এসেছে ‘কেয়ার এথিক্স’ কিংবা ‘এথিক্স অফ কেয়ার’-এর অনুষঙ্গ—যার সুন্দর একটি বাংলা করা হয়েছে—শুশ্রূষাবাদ। বইটির তিনটি পর্যায়—বিধি বনাম প্রেক্ষিত, প্রজ্ঞার বারান্দা থেকে এবং শুশ্রূষা ও রাষ্ট্র। ১৯ পাতার ছোট্ট বইটি গভীরসঞ্চারী। প্রবন্ধ আকারে যে লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালের শারদীয়া অনুষ্টুপ-এ, ‘আইনের হাত, ধর্মের পা’ শিরোনামে। এই প্রবন্ধ বর্তমানে গুরুচণ্ডালীর ‘চটি’ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত।
স্বাতীর রাজধর্মের আলোচনা আবর্তিত দার্শনিক বৃন্দা ডালমিয়ার বই Caring to Know: Comparative Care Ethics, Feminist Epistemology, and the Mahābhārata (Oxford, 2016),-এর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। স্বাতী দেখিয়েছেন, মহাভারতে রাজার কর্তব্য বিষয়ে যে কথালাপ রয়েছে, বৃন্দা তা থেকে নৈতিকতার তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের নানা দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেছেন। স্বাতী মনে করছেন, বৃন্দা যে ভাবে শুশ্রূষাবাদকে চিন্তা করেছেন, তা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নৈতিকতা বিচারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র জোগায়। সেই সূত্র ধরেই বইটি এগিয়েছে।
বস্তুত, নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা জারি সেই প্রাচীন কাল থেকে। কিন্তু সমাজে নৈতিকতার কোনও সমরূপী ধারণা নেই, থাকা সম্ভব নয়। যে কারণে নৈতিকতা নিয়ে চর্চারও অন্ত নেই। মিল-বেন্থামের উপযোগবাদ হোক বা কান্টের কর্তব্যবাদ— কাকে বা কোন কাজকে নৈতিক বলা হবে, তা নিয়ে কূট তর্কের শেষ নেই। প্রাচীন কাল থেকে নৈতিকতা নিয়ে আলোচনার আরও একটি ধারা চালু আছে। সেই ধারা অনুযায়ী, নৈতিকতা চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য নিজের মধ্যে নানা সদ্গুণের বিকাশ। নৈতিকতার এই তত্ত্ব ‘ভার্চু এথিক্স’ নামে পরিচিত। ‘ভার্চু এথিক্স’-এর নানা রূপ রয়েছে। তার মধ্যে একটি ‘শুশ্রূষাবাদ’।
‘বিধিপালনই নৈতিকতা’ — এমন অবস্থানের বিপ্রতীপে শুশ্রূষাবাদের স্থান। যেখানে নৈতিক আচরণের মূলে রয়েছে বরাভয়, মানুষের উপর ভরসা, সর্বমঙ্গলা সমাজ গড়ার প্রত্যয়। স্বাতী দেখিয়েছেন, এই মত অনুসারে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের মধ্যেই নিহিত নৈতিকতার প্রাণভ্রমরা। অন্যের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, অন্যের প্রতি মনোযোগ, অন্যের কথা শোনার আগ্রহই নৈতিক কাজ।
শুশ্রূষাবাদের কতগুলি গুণের কথা বলেছেন লেখক। তার মধ্যে রয়েছে মনোযোগ, দায়গ্রহণ, দক্ষতা, যে শুশ্রূষা গ্রহণ করছে, তার প্রতিক্রিয়ার নিরীক্ষণ এবং স্বীকৃতি। এ কথা অজানা নয় যে, ‘এমপ্যাথি’ বা ‘সমানুভূতি’ শুশ্রূষাবাদের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে।
ক্যারল গিলিগানকে উদ্ধৃত করে স্বাতী বলছেন, শুশ্রূষাবাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে অহিংসার উপর। এই প্রসঙ্গে এসেছে মহাভারত-এর কথা। যক্ষ শুধিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে, ‘‘ধর্ম কী?’’ জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের উত্তর ছিল, ‘অনৃশংসতা’ অর্থাৎ অনিষ্ঠুরতাই ধর্ম। এখানে ‘অনৃশংসতা’র অর্থ জীবনধারণের জন্য বা সংসার প্রতিপালনের জন্য হিংসার আশ্রয় নিতে হতে পারে, কিন্তু কথায় বা কাজে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজের মধ্যে অন্যকে অনুভবের শিক্ষা যে কারণে জরুরি। স্বাতীর মতে ‘অনৃশংসতা’ শব্দটির সঙ্গে জড়িত ‘অনুক্রোশ’ শব্দটি। তিনি লিখছেন, ‘‘‘ক্রোশ হল বিপন্নের আর্ত চিৎকার, ‘অনুক্রোশ’ হল তা শুনে অন্যের কণ্ঠ থেকে নির্গত প্রতিধ্বনি। অন্যের সঙ্গে একাত্মতায় শুশ্রূষাবাদের শিকড় প্রোথিত রয়েছে।’’ এই হল ‘এমপ্যাথি’ বা ‘সমানুভূতি’।
অন্যকে জানার চেষ্টা করলে তবেই তো সমানুভূতি জন্ম নেবে। কিন্তু অপরকে জানব কী ভাবে? অন্যের পাদুকায় নিজের পা গলানোর যে পদ্ধতি, তাকেই দার্শনিকেরা বলেন ‘সিম্যুলেশন’। ‘সিম্যুলেশন’-এর মাধ্যমে অপরকে জানা যায়। শুশ্রূষাবাদের গোড়ায় রয়েছে এমন ভাবনা।
স্বাতী দেখিয়েছেন, শুশ্রূষা যেমন এক সামাজিক দায়িত্ব, যেমন এক নৈতিক সম্পর্ক, তেমনই তা রাজনৈতিক সম্পর্কও বটে। লেখকের কথায়, ‘‘বিপন্নের চাহিদার নিরসন রাজনীতিরও প্রধান কাজ, কেবল নিয়মরক্ষা, আইনপালন তার কাজ নয়। বিপন্নের প্রতি মনোযোগ, তার দায়গ্রহণ, তার প্রয়োজন মেটানোর দক্ষতা, এবং রাষ্ট্রের সেই চেষ্টায় তার প্রতিক্রিয়াকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ— এই চারটি গুণ রাজনীতিরও নৈতিকতা নির্ধারণ করে।’’
বৃন্দা ডালমিয়ার বইয়ে উল্লিখিত মহাভারতে বর্ণিত ধর্ম এবং নৈতিকতার নানা ব্যাখ্যা উপস্থিত করে স্বাতী লিখছেন, নৈতিক কর্তৃত্ব স্বীকার করতে হলে শাসককে এসে দাঁড়াতে হয় ‘প্রজ্ঞার বারান্দায়’। হতে হয় সমদর্শী। সব বিকল্প বিবেচনা করে তাকে দেখতে হয় কোন পরিস্থিতিতে, কোন প্রেক্ষিতে কোন বিকল্প সর্বাধিক উপযোগী।
প্রশ্ন করেন স্বাতী— শুশ্রূষায় আগ্রহী রাষ্ট্র তার নৈতিক কর্তব্য প্রকাশ করবে কী ভাবে? বৃন্দা ডালমিয়ার দর্শনের সূত্র ধরে উত্তর খুঁজেছেন লেখক। বলেছেন, রাষ্ট্রের নৈতিকতা প্রকাশ পাবে জানার প্রকরণে। এই ভাবে নতুন যে ব্যাখ্যান তৈরি হয়, তাতে দর্শনের দু’টি ধারা জ্ঞানতত্ত্ব এবং নৈতিকতাকে আর থাকবন্দি করে রাখা চলে না। সত্যকে জানতে হলে যেমন প্রত্যক্ষ, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তেমনই দরকার হয় পক্ষপাতহীনতা, সমদর্শিতা, মনঃসংযোগ এবং ধৈর্যের মতো বৌদ্ধিক গুণ।
বর্তমানে যে ভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, তাতে এই সব গুণের অভাব দেখা যাচ্ছে। রচনার শেষে সে সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। যে আলোচনা কোনও নির্দিষ্ট সময়ে বা কোনও একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বর্তমানে মণিপুর বা দেশের অন্যত্র যা ঘটছে, যখন আলোচনা ছাড়া বিভিন্ন বিল পাশ হচ্ছে কেন্দ্র বা রাজ্যের আইনসভায়, তখন রাজধর্ম নিয়ে এই আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। বইয়ের শেষে স্বাতী উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কী ভাবে রাজনীতি থেকে শুশ্রূষা দূরে সরে যাচ্ছে। আইনসিদ্ধ অথচ অনৈতিক নির্দেশের অজস্র উদাহরণ বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অতঃপর স্বাতীর প্রশ্ন— কোন নীতির নিরিখে রাজধর্মে শ্রদ্ধাশীল শাসক আপন সিদ্ধান্তের নৈতিকতা-অনৈতিকতা বিচার করবেন? শুশ্রূষাবাদের গুরুত্ব এই সঙ্কটকালে আরও বেশি যেন অনুভূত হয়। স্বাতীর এই বই চোখে আঙুল দিয়ে সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার দিকে আমাদের দৃষ্টিআকর্ষণ করে। লেখার শুরুতে মণিপুরের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করছিলাম। মণিপুর আবারও আমাদের এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। এবং, এখানেই ক্ষীণতনু এই গ্রন্থের উপজীব্য কালের সীমা অতিক্রম করে যায়। গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি— রাজধর্ম পালন নিয়ে আলোচনা সব যুগেই জরুরি। সেই জরুরি কাজটি প্রাঞ্জল এবং সহজবোধ্য ভাবে করার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। বইটি নির্মাণে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে। এর জন্য প্রকাশককে কৃতজ্ঞতা।
প্রজা তো এই বইয়ের পাতা ওল্টাবেন। কিন্তু ‘রাজা’ কি এই বই পড়বেন? এই গ্রন্থের শিক্ষা গ্রহণ করবেন? অন্তত কিছুটা?
রাজধর্ম
স্বাতী ভট্টাচার্য
গুরুচণ্ডা৯
মূল্য – ৩০ টাকা