দীপ: আর যদি এখানে সেই পোস্টটা দিই, আপনার এই "নির্লজ্জ মিথ্যাবাদী" ধরনের কথাগুলো উইথড্র করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন তো? যদিও আলোচনাটা আপনি যে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন, তা খুবই অবভিয়াস। _______________________________
(1)
#যাদবপুরেরস্বপ্নদীপবিচার_পাক
#রামকৃষ্ণমিশনেরউজ্জ্বলওবিচারপাক
#দীপক_রায়
◾ যাদবপুর হত্যা/আত্মহত্যাকান্ড আগস্টের শুরুতে। আর রামকৃষ্ণ মিশনের হত্যা/আত্মহত্যাকান্ড জুলাইয়ের মাঝামাঝি। দুটি ঘটনার মধ্যে সময়ের ফারাক এক মাসেরও কম। কিন্তু স্বপ্নদীপের বিচার চেয়ে ফেসবুক, মিডিয়া সবাই ঝাঁপিয়েছে। ওদিকে উজ্জ্বলের বিচার চেয়ে একটা পোস্ট নেই ফেসবুকে, মিডিয়াও নীরব। কোন নিউজ, কোন মিছিল, কোন সভা কেউ কি দেখেছেন কোথাও? না, দেখন নি। দেখবেনও না।
◾ কারণ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সুনাম নিয়ে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করবেন না। কিন্তু মাত্র ক'দিন আগেই সেখানে ১৮ বছরের উজ্জ্বল গোস্বামী জুওলজি অনার্সে ভর্তি হবার ৫ দিনের মাথায় মিশনের পুকুরে মৃতদেহ হিসাবে ভেসে ছিল। এই তো গত ১৮ জুলাই ২০২৩ তারিখের ঘটনা।
◾ রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, 'সম্ভবত সাঁতার কাটতে গিয়ে ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু কোন সিসিটিভি নেই, ফলে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়'। কেন সিসিটিভি নেই, এই প্রশ্নে মহারাজ জানিয়েছিলেন, ‘একটি ঘটনা ঘটেছে। ওই ছাত্রটি প্রতিদিনই পুকুরে স্নান করতে যেত। আমরা ইতিমধ্যেই ওখানকার থানায় এই বিষয়ে জানিয়েছি। তারা তদন্ত করে দেখছে'।
◾ বর্ধমান শহরের সুকান্ত নগরের বাসিন্দা উজ্জ্বলের পরিবার রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরব হলেও পুলিশ, সাংবাদিক, প্রচারমাধ্যম কেউই কোন পাত্তা দেয় নি। এই ঘটনায় কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা, হোস্টেলে অন্য কোন ঘটনা ঘটেছিল কিনা, সেই নিয়ে কোন আলোচনা, জিজ্ঞাসাবাদ, গ্রেফতার বা তদন্তের খবরও কেউই জানতে পারে নি।
◾ মৃতদেহ উদ্ধারের পর সন্ধ্যায় উজ্জ্বলের মৃতদেহ বর্ধমানের বাড়িতে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন এবং বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা দিতে গেলে তাঁদের ওপর ওই পরিবারসহ এলাকার মানুষজন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিন্তু বর্ধমান থানার পুলিশের হস্তক্ষেপে সেই ঘটনা 'খবর' হয়ে ছড়াতে পারেনি। পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে ওই সন্ন্যাসীদের উদ্ধার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। তারপরের ঘটনা কেউ জানে না।
◾ মৃত উজ্জ্বলের কাকা সুবীর গোস্বামী বলেছিলেন, ‘উজ্জ্বল সাতাঁর জানত। একজন সাঁতার জানা ছাত্র কীভাবে ওইটুকু পুকুরের জলে ডুবে মারা গেল? আমরা চাই এর পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক তদন্ত হোক। হোস্টেলে জিজ্ঞাসাবাদ হোক। দোষীরা শাস্তি পাক। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে কোন নিরাপত্তা নেই। তাই এই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে। সেখানে কোনও সিসিটিভিও ছিল না। কেন ছিল না'?
From. Saswati দত্তরায়
_________________________________
(2)
কাল থেকে যাদবপুরকে মন্দির বানানোর টেন্ডার রামকৃষ্ণ মিশনকে দেওয়ার দাবি উঠছে দিকে দিকে। সেই রামকৃষ্ণ মিশনের পরিসরে কি ভয়ঙ্কর হেনস্থা ও ভায়োলেন্স চলে, সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন প্রাক্তন ছাত্র Sabuj Ganguly। যথেষ্ঠ পুরুষ হয়ে উঠতে না পারার ফলে যে পরিণাম আজ যাদবপুরের ছাত্রটির হয়েছে, সেই একই মাশুল, প্রায় একই কারণে গুণতে হত সবুজকে। নেহাতই বরাতজোরে প্রাণটা বেঁচে গেছে।
সবুজ লিখছে:
Not being man enough
কিছু সময় আমি চুপ করে যাই কারণ আঘাতগুলো অনেক ব্যক্তিগত হয়, আঘাতগুলো এমনভাবে দুমড়েমুচড়ে দেয় যে খানিক বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। একজন সতেরো বছরের বাচ্চা খুন হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা। কেন তাকে খুন করা হল? কেন তাকে র্যাগিং এর সম্মুখীন হতে হল? এসবের কারণ বিচার বিশ্লেষণ পুলিশ করছে, সাথে মিডিয়া তো আছেই, মিডিয়া ট্রায়ালের যুগে থানা কোর্ট থাকা না থাকা একই ব্যাপার। আমি এ বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য করতে রাজি নই। তবে আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই বাচ্চাটির সাথে যা হয়েছে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দেশের প্রতিটি স্কুলে, প্রতিটি কলেজে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানেই একদল পুরুষ মনে করেছে ক্লাসরুমের লাস্টবেঞ্চে একা বসে থাকা ছেলেটি ঠিক ছেলেসুলভ নয় সেখানেই তারা নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। 'বয়েজ হোস্টেল' বিষয়টা একবার ভেবে দেখুন, পাঁচটা ছেলে একজায়গায় বসলে যেখানে মেয়েদের 'বুক' 'পাছা', 'দুদু' ছাড়া অন্য কোনো টপিক থাকেনা ডিস্কাশনের, সেখানে ৬০০ টি ছেলে একজায়গায়। ভাবা যায়! যারা আজকে ফেসবুকে বড়ো বড়ো বাতেলা মারছে 'যাদবগাছিতেই এসব হয়, ভামপ্যান্টিদের জায়গা, তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হোক', তারা স্কুল কলেজে আমাদের মতো মানুষদের সাথে ঠিক কেমন আচরণ করতেন মনে পড়ে?
(১)
আজ সকালে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখলাম 'যাদবপুর বন্ধ করে রামকৃষ্ণ মিশনের তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেওয়া হোক'। এরা সকাল বিকেল বিনা পয়সায় লোক হাসিয়ে কি লাভ পায় আমি জানি না। আমার স্কুল জীবন রামকৃষ্ণ মিশনেই কাটে। আমি ছোটবেলা থেকেই যেহেতু 'মেয়েলি', পেছন দুলিয়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি তাই পাড়ার দু তিন ক্লাস উঁচুতে পড়া দাদারা 'লেডিজ' বলে ডাকত রাস্তাঘাটে। তাই রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে আলাদা কোনো ট্রিটমেন্ট পাব এমন এক্সপেকটেশন আমার ছিল না। স্কুলে আমার নিজের নামে কতজন ডাকত আমার মনে নেই, মোটামুটি সবাইই 'হিজড়ে', 'লেডিজ' এসব নামেই ডাকত। ছোটবেলা থেকেই যেহেতু ঘরে বাইরে এসব শুনেই বড় হয়েছি তাই আলাদা করে খারাপ কখনোই লাগেনি। আমার মতো মানুষদের 'আলাদা করে খারাপ' লাগে না, লাগতে নেই। লাগতে নেই কেন? কারণ, আপনারাই বলেন, 'এসব তো মজা করে হয়েই থাকে'। প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডটা ছিল আমার জন্য বিভীষিকা। আমি এবং আমার আরেক বন্ধু (যে তার স্কুল জীবনে আমার থেকেও বেশি বুলিড হয়েছে, মোলেস্টেড হয়েছে সে 'মেয়েলি' হওয়ার জন্য) টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসরুমের বাইরে বেরোলেই চলত নোংরা অশ্রাব্য গালিগালাজ, "হিজড়ে গুলো পোদ নাচিয়ে যাচ্ছে দেখ"। কখনো কখনো সেটি শারীরিক হেনস্থার পর্যায়েও যেত, যেমন ধরুন হঠাৎ কেউ আমার যৌনাঙ্গে হাত দিয়ে চলে গেল, কিংবা 'চল আমার সাথে বাথরুমে চল'। আমার ক্লাসে আমি বাদে আমার যত ক্যুইয়ার বন্ধু ছিল তাদের অভিজ্ঞতা আমার থেকেও হাড়হিম করা। আমার কোনো কোনো সময়ে বিশেষ ছাড় ছিল কারণ আমি 'এ' সেকশনে পড়তাম (স্কুলে তখন নম্বর অনুযায়ী সেকশন হত), আমি নালিশ করলে মহারাজ বা টিচাররা পাছে স্টেপ নিয়ে নেয় সেই ভয়ে। কিন্তু নিজের সেকশনের ছেলেদের থেকে রেহাই পাই কিভাবে? একদিন সবাই মিলে দেখতে চাইল আমার যৌনাঙ্গে কি আছে। আমি কিছুতেই স্পর্শ করতে দিলাম না। তারপর চলল বেদম প্রহার, গলা টিপে দেওয়ালে চেপে ধরে প্রচন্ড মারতে থাকল সবাই। আমিও কম যাইনা, ওদের মধ্যে দলের হেডটার কানের গোড়ায় দিলাম সপাটে থাবড়া। সেদিন আমার এক বন্ধু ওই সময়ে ক্লাসরুমে না থাকলে আমাকে ওরা গলা টিপে মেরেই ফেলছিল। মিশনে পড়াকালীন নিত্যদিনের অত্যাচারের ঘটনা বলা শুরু করলে লিখে শেষ করা যাবেনা। তখন আমার যা বয়স, 'মলেস্টেশন' কাকে বলে সেটা বোঝারও বয়স নেই। আমার সাথে একদল মিলে যখন 'যৌন নির্যাতন' চালায়, আমি যখন সেটি ওপেনলি বলি গোটা ক্লাস তখন হো হো করে হাসে। 'ছেলেদের আবার যৌন নির্যাতন! এই জন্যই তুই হিজড়া'।
নাহ! আমি এটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নয়। এটি রামকৃষ্ণ মিশন, বরানগরের ঘটনা। এটি আমার স্কুল, যেখানে আমি জীবনে আর একটি বারের জন্যও ফিরে যাইনি।
(২)
কলেজ জীবনে যখন আমি পাড়ি দিই, তখন কিছু পরিবর্তন আসে। আমি সেন্ট জেভিয়ার্সে স্ট্যাটিস্টিক্স ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই। প্রথম দিনই ইনট্রোডাকশনের সময় ক্লাসমেটদের আমি জানিয়ে দিই আমি ক্যুইয়ার। ক্লাস বা শ্রেণি এই বিষয়টা খুবই জটিল, জেভিয়ার্সে বসে কেউ যখন আমাকে 'ছক্কা' বলতে যাবে তখন তাকে তার 'রেপুটেশন' হারানোর ভয় পেছন থেকে টানবে। মনে মনে কিছু থাকলেও সেটি প্রকাশ করার বোকামি কেউ করে না। যদিও এতেও কিছু ব্যতিক্রম ছিল, তা নিয়ে আমি আগেও বহুবার লিখেছি। তবে ওই যে বললাম শ্রেণির সাথে ডিস্ক্রিমিনেশনের রকম ফের ঘটে। যেমন ধরুন, আপনি ইন্টারভিউ দিয়েছেন খুব ভালো। আপনার ইন্টারভিউয়ার আপনার মেয়েলি গলা শুনে বিরক্ত হয়ে শুধু ওই কারণেই আপনাকে রিজেক্ট করলেন। আপনি বুঝলেনও না আপনাকে কেন রিজেক্ট করা হয়েছে, অনেকটা এরকমই, এখানে সহজে কেউ আপনাকে হিজড়ে ছক্কা বলতে আসবেনা। যদিও যারা জানে তারা জানে, কলেজেও আমাকে 'হিজড়া', '৩৭৭', 'ছক্কা' ইত্যাদি কটুক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কলেজের তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন একবার সোশ্যাল মিডিয়ায় কলকাতার মীম সার্কেলের লোকজন আমার পেছনে পড়ে। ডেইলি আমাকে নিয়ে মীম বানাতো, আমার সেক্সুয়ালিটি, জেন্ডার আইডেন্টিটি ছাড়া আমাকে নিয়ে মীম বানানোর সুন্দর উপাদান ওই ছোট্ট মস্তিষ্কে থাকার কথা নয়। রোজ সকালে উঠে আমি নিজেকে নিয়ে নতুন নতুন নোংরা মীম দেখতাম। তার ওপর মাঝে মাঝেই হামলা করত বিজেপির আইটি সেল। একবার ঘটনা এতদূর গড়িয়েছিল যে একপাল গরু আমার কলেজের কর্তৃপক্ষকে মাস মেইল করেছিল আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। আমার মেসেঞ্জার মেসেজ রিকোয়েস্ট যাদের পড়িয়েছি তারা জানে আমাকে রোজ ঠিক কি কি গালি খেতে হয় শুধুমাত্র 'মেয়েলি' হওয়ার জন্য।
নাহ! এটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নয়। এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটে যাওয়া আমার জীবনের একটা অত্যন্ত খারাপ সময়ের ঘটনা। আমার প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনা। আমার স্কুলের ঘটনা, কলেজের ঘটনা।
(৩)
আমি কলেজজীবন অবধি কখনো হোস্টেলে থাকিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে যাই, সেই প্রথম আমার হোস্টেল জীবন। আমাকে যারা ব্যক্তিগত পরিসরে চেনেন তারা জানেন, স্কুল ছাড়ার পর থেকে আমার কোনো সময়েই সে অর্থে পুরুষ বন্ধু হয়নি। সেখানে ভিনরাজ্যে গিয়ে বয়েজ হোস্টেলে একই সাথে অতগুলো ছেলের সাথে একই রুমে একসাথে থাকাটা বেশ আনকম্ফর্টেবল ছিল আমার জন্য। ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম, তেমনটাই। তখনো হোস্টেলে সেভাবে লোকজন আসেনি, আমার রুমমেটরা কেউই আসেনি। কলকাতা থেকে একজন 'মেয়েলি' 'মেয়েলি' অদ্ভুত প্রাণী এসেছে বলে ভিড় করে মাঝে মাঝেই সবাই আলাপ করতে আসত প্রথম প্রথম। একদিন রাতে একটি পেছনপক্ক নেতাগোছের ছেলে সাথে কিছু গাছপাঁঠাকে নিয়ে রুমে ঢুকল এবং একপ্রকার জোর করেই আমাকে বাধ্য করল ওদের সাথে বসতে, 'ইন্ট্রো' করতে চায় আরকি। সেই নেতাগোছের ছেলেটি হঠাৎই বলতে শুরু করে, "তুমি যেভাবে পেছন দুলিয়ে দুলিয়ে যাও, হোস্টেলে চলাফেরা করো সেটি আমরা কেউ ভালো চোখে দেখছি না।" আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে ওরা আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে জিজ্ঞেস করে। আমি কোনোকালেই রাখঢাক করার ব্যক্তি নই, বড়জোর খুন করে দেবে এর থেকে বেশি কিই বা হবে? আমাদের মতো মানুষরা জানে এ দেশে যে কোনো সময় আমাদের মতো মানুষরা খুন হয়ে যেতে পারে। আমেরিকার ট্রান্স ক্যুইয়ার মানুষদের খুন হওয়ার সংখ্যাতত্ত্বটা তাও প্রকাশ্যে আসে, আমাদের দেশের সরকারই চায় আমরা মরে যাই,সেখানে স্ট্যাটিস্টিক্সের আর প্রয়োজন নেই। যাইহোক, সেই নেতাগোছের ছেলেটি কিছু না বুঝেই বলতে থাকে, "আমরা কিন্তু গে নই, আমরা স্ট্রেট।", তার কিছুক্ষণ পরেই বলতে থাকে, "তুই সাবধানে থাকিস, আমরা হোস্টেলে মেয়ে পাইনা, ক্ষুধা মেটানোর জন্য কোনদিন তোর প্যান্ট খুলে পেছনে গুঁজে দেব তখন কিন্তু আমাদের দোষ দিবি না।" আমি ভয়ে শিউরে উঠি কিছুক্ষণের জন্য, একটা ঘরভর্তি ছেলে, সেখানে আমি একা। তারপরেই হঠাৎ বলতে থাকি, "শুনেছি তুই ভালো ইংরেজি বলিস, চল আমার ঘরে চল আমাকে ইংরেজি বলা শেখাবি, আমি আর তুই একা।" ছেলেটির বাড়াবাড়ি এমনই পর্যায়ে যায় যে তার পোষ্যগুলিও এতক্ষণ যারা মজা নিচ্ছিল তারা ভয় পেয়ে যায়। এরপর তাকে অন্য ঘরে তারাই নিয়ে গেলে আমি দরজা ভেতর থেকে লক করে রাত দুটোর সময়ে আমার এক প্রফেসরকে টেক্সট করি। প্রফেসর সাথে সাথে আমার সাথে কনট্যাক্ট করেন এবং পরেরদিন তিনি এবং আমার জেভিয়ার্সের দুজন সিনিয়র যারা আমার ইউনিভার্সিটিরও সিনিয়র ছিল তারা সবাই বিভাগীয় প্রধানকে জানাই। তারপর তার সাথে যা হয় সেটি খুবই মজাদার। আমাকে দেখলেই তারপর থেকে গোটা হোস্টেলের ছেলেরা পালাতো। আমি বরাবরই বলতাম, আমাকে দেখে এদের মতো ছেলেরা ভয় না পেলে, আমার লিপস্টিক পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আনকম্ফোর্টেবল ফিল না করলে আমার এতদিনের পলিটিক্স ব্যর্থ। আমার এখনো মনে আছে ওই ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন আমি দরজা বন্ধ করে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতাম। এর বেশ কিছুমাস পরে হোস্টেলের আমার রুমের থেকে কিছুটা দূরেই ফিজিক্যাল এডুকেশন বিভাগের একটি ষণ্ডা মতন ছেলে একদিন রাতে মদ্যপান করে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ওর ঘরে এবং জোর করতে থাকে আমাকে ওর সাথে শুতে। তার বন্ধুরা আমাকে ওর থেকে ছাড়ায়, গোটা হোস্টেলে চেল্লামেল্লি শুরু হয়ে যায়। তারপর আমি দৌড়ে আমার রুমে চলে আসে। আবারও এসে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় সে। আবারও আমাকে তার বন্ধুরা তার হাত থেকে ছাড়ায়। এরপর আমি রুমে এসে দরজা লক করে আমার এক বন্ধুকে খবর দিই, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসায় আর উপদ্রব করার সাহস পায়নি।
নাহ, আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি। এটি সাবিত্রীবাঈ ফুলে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা, মহারাষ্ট্রের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের বারো নম্বর র্যাঙ্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা।এখানে ছাত্র সংসদ এবিভিপি চালায়, বামেদের 'ব' ও কোথাও পাবেন না। হোস্টেলের কোণায় কোণায় সিসিটিভি লাগানো আছে, মদ গাঁজা সিগারেট কোনোটিই ক্যাম্পাসে খাওয়া যায়না। তবু আজকেও স্পষ্ট মনে আছে ওই রাতের কথাগুলো, "প্যান্ট উতারকে গান্ড মে ঘুষা দুঙ্গা"।
বাচ্চাটি মারা গেছে তার মা'কে বলে, "মা আমি গে নই"। ভেবেছিলাম এই তথাকথিত 'মেয়েলি' স্বভাবের পুরুষরা, ক্যুইয়ার - ট্রান্স মানুষরা ছোট থেকে ঘরে-বাইরে যেরকম অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে পড়াশোনা করে বেড়ে ওঠে,এত 'স্বপ্নখুনি'র মাঝেও যারা স্বপ্ন দেখতে ভোলেনা তাদের নিয়ে আমরা আপনারা কথা বলবেন। কিন্তু নাহ! মেইনস্ট্রিম মিডিয়া গোটা ঘটনাটাই সব দোষ 'বামপন্থার', সব দোষ 'যাদবগাছি'র, আর সিসিটিভির বলে প্রচার করতে ব্যস্ত। আর সাধারণ মানুষ বাচ্চাছেলেটির কথা ভুলে গিয়ে আপাতত যাদবপুরের সবাই খুনি, যাদবপুরে 'মধুচক্র' হয়, যাদবপুরের ছেলে মেয়েরা সবাই সমকামী, যাদবপুরে সারাদিন সবাই গাঁজা খায়, সারাদিন সবাই মদ খায় আর বোতল ছুড়ে মারে এসব নিয়েই বিশ্লেষণে ব্যস্ত। কে তাকে বিবস্ত্র করল? কেন তাকে বিবস্ত্র করা হল? 'আমি গে নই' কেন সে বলল? 'গে' হলেই বা কেন তাকে বিবস্ত্র করা হবে? কিসের অধিকারে এই শক্তি প্রদর্শন? এসব প্রশ্ন আপাতত মিলিয়ে গেছে 'এবার যাদবপুরকে বাগে আনতে পেরেছি'র উচ্ছ্বাসে। একরাশ ঘেন্না ছাড়া আর কিছু দেওয়ার নেই।
###