বাস থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নেমে আবিষ্কার করা গেল আমার উন্নততর অর্ধাংশটি অনুপস্থিত। অন্য বাসে করে মিনিট দশেক আগেই তাঁর এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা, কিন্তু তিনি নাই। কোনও এক মধুর সময় ছিল যখন এই রকম দেখা করার জন্য বিরহিনী রাধিকার মত অনন্তকাল অপেক্ষা করা যেত, কিন্তু সে কৃষ্ণও নেই, সে বৃন্দাবনও নেই। তার ওপর এ দেখাও সে দেখা নয়। যুগলে যেতে হবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে। জরুরী দরকার। হাতে সময়ও বেশি নেই। এই সময়ে তিনি কই? এদিক ওদিক দোকানের শোরুমগুলো দেখতে শুরু করলাম, যদি আমার দেরি দেখে ম্যাডাম উইণ্ডো শপিং করতে বেরিয়ে থাকেন।
সময়টা বছর পনের-ষোল আগের। মোবাইল ফোন মহাশয় বাজারে এসেছেন ঠিকই, তবে আমাদের মত ম্যাঙ্গো পিপলের হাতে তখনও তিনি নেমে আসেননি। বরং সিম কার্ড, প্রিপেড কার্ড এসব শব্দ গ্রীক ল্যাটিন ভাষার মত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। অতয়েব পায়ে হেঁটে খোঁজা ছাড়া গতি নেই। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎই চারচক্ষুর মিলন হল। বাস বিভ্রাটে তাঁর দেরি হয়েছে, এবং বাসস্টপে আমায় না দেখে তিনিও আশেপাশে খুঁজতে শুরু করেছেন। দুজনেই দুজনকে খোঁজাখুঁজি করায় সমস্যা বেড়েছে। কোনও রকমে সে যাত্রা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করা গেছিল।
এই গোলমালের ফলস্বরূপ আমার একটি মোবাইল ফোন হয়ে গেল। আমার একারই হল, কারন অর্ধাঙ্গনীর যুক্তিটা ছিল এই রকম - যেহেতু চতুর্দিকে “এসটিডি আইএসডি পিসিও” লেখা কাঁচের বুথ পাওয়া যায় (তখন সত্যিই যেত), যেহেতু সেই সব বুথ থেকে মোবাইলে ফোন করে মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় (এটাও সত্যি কথা), যেহেতু মোবাইল ব্যবহার করা পুরুষদের পক্ষে সুবিধাজনক (এটা অবশ্য সত্যি কি না জানি না) - সেহেতু...
জিনিসটা ছিল ফিকে নীল রঙের, বোতামগুলো সাদা, ওজনে বেশ ভারি, স্ক্রিনটা ছোট - ফোনের সাইজের চার ভাগের এক ভাগ - তার হলদেটে আলোয় কালচে লেখাগুলো পড়া যায়। তার নিচে বোতামগুলো সাজানো। বোতামের গায়ে একটা সংখ্যা আর তিন-চারটে করে ইংরেজি অক্ষর বসানো। অক্ষর টাইপ করতে হলে তার ক্রমানুসারে বোতাম টিপতে হবে। যেমন এ, বি আর সি এক বোতামে – বি টাইপ করতে দু’বার আর সি লিখতে তিন বার বোতামে চাপ দিতে হবে। ফোন এলে সুন্দর বাজনা বাজে। এক পন্ডিত জানালেন সেটা নাকি নাইন্থ না নাইনটিন্থ কি একটা ‘সিম্ফনি’, খোদায় মালুম তার কি মানে। মেসেজ এলে আওয়াজ হয় – “টি টি টিট্টি... টি টি টিট্টি”, যেন ভোর বেলায় পাখির ডাক। ইয়া গাবদা এক ইউজার ম্যানুয়েল ঘেঁটে মোবাইলের অন্তর বোঝার চেষ্টা চলল।
তারপর দিন দুই বাদে এক সুন্দর সকালে ফোন নিয়ে বেরোলাম, অফিস যাব। সে সময়ে আর লোকের পকেটে পকেটে মোবাইল থাকত না। এক দম প্রথমে তো ফোন এলেও কড়ি গুণতে হত। টাক থাকলে নাকি লোকে ভাবে বিস্তর টাকা আছে, পকেটে মোবাইল থাকলেও একই ব্যাপার। তাই মনে বেশ একটা ‘না জানি কি হনু’ ভাব। ছোটবেলায় একবার মায়ের ঘড়ি পরে দোকানে গেছিলাম, রাস্তায় কেউ ‘কটা বাজে’ জিজ্ঞেস না করায় খুব মন খারাপ হয়েছিল। এখনও সেই রকম অবস্থা। বাসে বসে আছি, মোবাইলের ভারে বুকপকেট ঝুলে পড়েছে, অন্তত পাঁচ জন আমার নম্বর জানে, তবু একটা কল এল না! এ রাগ আমি রাখব কোথায়! অফিসে পৌঁছোবার পর অনেকেই ফোন... থুড়ি, মোবাইল দেখতে চাইল। আমিও পাগলা দাশুর শ্যামচাঁদের মত কায়দা করে তাদের কল-লগ, কন্ট্যাক্ট লিস্ট, কম্পোজ মেসেজ, রিং টোন, মেসেজ টোন, প্রোফাইল সেটিং এসব বোঝাতে লাগলাম। এসব করে মন কিঞ্চিৎ শান্ত হল।
এবার বাড়ি ফেরা। বাসে বেশ ভিড়, তবে আমি জায়গা পেয়েছি। বসে বসে যথারীতি ভাবছি – কখন কারোর আসবে টেলিফোন। ঠিক সেই সময়ে তিনি এলেন, কল নয়, মেসেজ। “টি টি টিট্টি... টি টি টিট্টি” পাখির ডাকে বাস ভরে গেল। বাসের সমস্ত লোক তাকিয়ে আছে শব্দের উৎসের দিকে। উফফ এই তো জীবন কাকা! আমি বেশ ডাঁটের মাথায় ধীরেসুস্থে পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখি বন্ধুর বার্তাঃ “কি রে শালা, বাসের লোকজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে মেসেজ পড়ছিস?” আড় চোখে দেখি পাশের যাত্রী ঘাড় বেঁকিয়ে মেসেজ পড়ার চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে গেলাম “পরে কথা হবে।” মানে পি-এ-আর-ই (পরে) কে-এ-টি-এইচ-এ (কথা) ইত্যাদি। কিন্তু পি-কিউ-আর-এস এক বোতামে, জে-কে-এলও তাই। ‘আর’ পেতে তিন বার বোতাম টিপতে হবে। জ্বালাতন!! পি-এ-আর-ই লিখতে চাইছি, কিছুতেই আসছে না। আর-এর জায়গায় পি কিম্বা কিউ চলে আসছে। ডিলিট করতে গিয়ে পি-টাও মুছে গেল। একটা শব্দ লিখতে মিনিট দেড়েক চলে গেল। বন্ধ করে দিই ফোন? ছিছি, তাই করা যায়? লোকে তো এখনও তাকিয়ে আছে, ভাববে আমি মেসেজ করতে পারি না। মহা মুস্কিল, চাপের মুখে আমি কোনও দিন ভাল খেলি না। মনকে বললাম - “ফোকাস ফোকাস”, দুটো বড় বড় শ্বাস নিয়ে, মানে যাকে ডিপ ব্রিদিং বলে, সেটা করে যতখানি সম্ভব একাগ্র হয়ে ‘পরে কথা’ অবধি লিখেছি, অমনি ফের বাস কাঁপিয়ে “টি টি টিট্টি... টি টি টিট্টি”। আবার কে? সেই বন্ধু, কোন আক্কেলে যে ভল্যুম ফুল করে রেখেছিলাম। “কি রে, উত্তর দিস না কেন? লিখতে পারছিস না?” রাগে গা রি-রি করে উঠল। নতুন শব্দে লোকে ফের ফিরে তাকিয়েছে। আরও মিনিট খানেক লাগল ‘হবে’ শব্দটা লিখতে। সবে ‘সেন্ড’ টিপে মেসেজটা পাঠিয়েছি, ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে, আবার “টি টি টিট্টি... টি টি টিট্টি”। পাখির ডাক তো নয়, ফোনটা যেন আমায় টিটকিরি দিচ্ছে। কে কী মেসেজ করল আর দেখার ইচ্ছে নেই।
আমার ইচ্ছে না থাক, মেসেজের আওয়াজ পৌঁছে গেছে মানব দেওয়ালের ওপারে থাকা লেডিস সিটেও। সেখান থেকে কাঁসার থালা মেঝেতে পড়ে যাওয়ার মত মধুর গলা ভেসে এল, “মোবাইল ফোন নিয়ে বাসে উঠেছে! হুঃ!” এবার একটা ফিসফিসে বামাকণ্ঠঃ “আস্তে, আস্তে।” কাঁসার থালাঃ “আস্তে আস্তের কি আছে! মোবাইল নিয়ে গাড়িতে যাবে, ট্যাক্সিতে যাবে। বাসে উঠেছে কেন?” ম্যাজিকের আসর ছেড়ে ‘চালিয়াৎ’ শ্যামচাঁদ ছুটে পালিয়েছিল। দুঃখের বিষয় আমি বসে আছি জানলার ধারে, চলন্ত বাস থেকে সেখান দিয়ে পালানো যায় না। তাই বাইরে তাকিয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে ফোনটা চুপিচুপি বার করে সাইলেন্ট করে দিলাম। আজও তাই রাখি।
বাস থেকে নেমে বন্ধুকে ফোন করে যা বলেছিলাম, তা শুনলে আপনারা কানে আঙুল দিতেন, কিন্তু সে ব্যাটা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল।
এ সব তো অনেক আগের ব্যাপার। এখন বাসের মধ্যে শুধু মোবাইলের রিং নয়, কথোপকথনও এত চলে যে সেটা কন্ডাকটরের “খালি গাড়ি খালি গাড়ি”, “আস্তে লেডিস কোলে বাচ্চা”-র মত গা সওয়া হয়ে গেছে। অনেকের মোবাইল বার্তা শুনে মনে হয় তাঁরা ভুলেই গেছেন বাড়িতে আছেন, না বাসে। আমি কন্ডাকটর হলে দিনে বহু বার বলতাম, “আস্তে লেডিস, কানে ফোন।”
সাহিত্যিক তারাপদ রায় নিজের হেঁড়ে গলার বিড়ম্বনা নিয়ে অনেক কথা লিখে গেছেন। তখন মোবাইল ছিল না। ল্যান্ডলাইনে কথা বললে ওপারের লোক নাকি বলতেন, এমনিই শোনা যেত, বেকার ফোন কোম্পানিকে পয়সা দেওয়া হচ্ছে। বাসে যাঁরা মোবাইলে কথা বলেন তাঁদের অনেককে দেখে আমার তারাপদ রায়ের কথা মনে পড়ে। আপনার চানঘরের কল খারাপ হয়ে গেছে, আপনার ছোট বৌদি দেবের সাংঘাতিক ফ্যান, আপনার আমড়াতলার বাড়ির গলিতে একটা ষাঁড় রোজ জাবর কাটে, -- এসব খাস তথ্য বাস ভর্তি আম জনতা বিনা আয়াসে জেনে যায়। কার্টসি চলভাষে আপনার কথা। আজ যে সবাই জানে আপনি একনম্বরের মি- মানে ইয়ে অনৃতভাষণে পটু, তার জন্যও দায়ী আপনার মোবাইল। বাস দাঁড়িয়ে রুবিতে, আর আপনি ফোনে জানাচ্ছেন দু মিনিটে উল্টোডাঙ্গা পোঁছবেন!
বাসে বসে লোকের কথা শুনতে আমার ভালই লাগে। বাইরের দিকে বা বই-এর পাতায় চোখ রেখে এসব শুনতে শুনতে একটা নিষিদ্ধ কাজ করার মত রোমাঞ্চ হয়। তবে আরও ভাল লাগে সেই সব কথা যা সাধারনতঃ মোবাইলে বলা হয় ফিসফিসিয়ে।
ঠিকই ধরেছেন, মোবাইল বাহিত প্রেমালাপের কথা বলছিলাম। একবার এক সন্ধ্যায় বেহালা চৌরাস্তা থেকে উঠে পাশে বসা এক যুবার ফিসফাসানি (লাইনের ওপারে কিঞ্চিৎ ফোঁসফোঁসানিও ছিল বলে সন্দেহ হয়) শুনতে শুনতে আর একটু হলেই ক্যারেড ওভার হয়ে যাচ্ছিলাম। আর একবার এক সুন্দর স্বর্ণালি সকালে হাওড়া স্টেশন যাওয়ার সময়ে আমার পিছনের আসনে বসে এক তরুণী যে ভাষায় - না, এবারে খুব একটা ফিসফিসিয়ে বলা হচ্ছিল না - বাক্যালাপ করলেন তাতে বোঝা গেন ওপারের মানুষটি ‘প্রাক্তন’ হয়ে গেলেন।
জানি আপনারা ছিছিক্কার করছেন। বলছেন, না বলিয়া পরের দ্রব্য পকেটস্থ করা যেমন ঠিক নয়, তেমনই না জানাইয়া অন্যের কথা কানে তোলাও ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু যদি বলি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এমন করতেন, তখন?... কি বলছেন?... ও আচ্ছা, স্বীকার করছি রবীন্দ্রনাথের সময়ে বাস ছিল কি না জানি না, কবিগুরু সে সব বাসে চড়তেন কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু আপনারা ওনার “আমি কান পেতে রই” গানটা অবশ্যই শুনেছেন? শোনা না থাকলে বা মনে না পড়লে একবার দেখে নিন না মোবাইলের নেট খুলে। দেখলেন কি বলছেন কবি?... বলছেন, কেমন করে তিনি “গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে বারে বারে” কান পেতে থাকতেন। আবার কি বলছেন অ্যাঁ?... অ, উনি “আপন হৃদয়গহন-দ্বারে” কান পেতে থাকতেন, অন্য লোকের কথা শুনতেন না? আরে বাবা, মনটাকে একটু উদার করুন না, আপন-পরে এত ভেদাভেদ করেন কেন?
(২০১৮ সালে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত, এখানে কিঞ্চিৎ পরিমার্জিত রূপে দেওয়া হল)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।