আর সব জামা ঠিক ঠিক চিনলেও স্যান্ডো গেঞ্জিতে এসেই গোলমালটা লেগে যেত। বুয়া যেমন আলাদা করতে পারত না, তেমনি মাও ব্যর্থ হত শুকোনোর পর আমার ও বাবার নির্দিষ্ট করা ড্রয়ারে রাখতে। কিন্তু আমি ঠিকই চিনতে পারতাম একই আকৃতির ও আকারের গেঞ্জিগুলোকে; সে শুধু নিজের জামা বলে নয়, আরও একটা সূত্র ছিল। আমার গেঞ্জিগুলো কেমন নতুন আর টানটান দেখাত; অন্যদিকে, বাবারগুলো অতি ব্যবহারে জীর্ণ-শীর্ণ-দীর্ণ-ঝুলো।
প্রায়ই আমায় নিজের ড্রয়ার থেকে গেঞ্জি বার করে বাবার ড্রয়ারে রেখে দিতে হত; আর প্রতিবারই মনে হত, একটি নতুন স্যান্ডো আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে বাবার জন্য। কিন্তু তারপরই স্মৃতি থেকে ধুলোর মত উড়ে যেত সেই স্যান্ডো।
অবশেষে একদিন যখন অফিসেই এক হকার ঢুকে পড়ল এক গাদা জিনিসপত্র নিয়ে আর গার্ডদের তাড়া খেয়ে পালানোর আগে এক ঝলক দেখাতে সক্ষম হল আমাদের তার গুপ্তধন, সবকিছু ছাপিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জির গাদাটাই টেনে ধরল আমায় আর সব কিছু ভুলে হকারটির পেছন পেছন দৌঁড়ুতে লাগলাম আমিও, যেন এই-ই সূবর্ণ সুযোগ… আজ না হলে আর কখনোই মিলবে না এই বস্তু!
কিন্তু সব আনন্দ-উত্তেজনা মিইয়ে গেল দিনশেষে বাবার ঘোলাটে চোখজোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে। একটু ছুঁয়েও না দেখে তিনি বললেন, “খালি খালি পয়সা খরচের বাতিক তোমার গেল না!”
“কিন্তু বাবা আপনার স্যান্ডোগুলি খুবই পুরোনো ও ব্যবহার-অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল।“ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলি আমি।
“তুমি মনে হয় জান না, তোমার ফেলে দেয়া গেঞ্জিগুলো আমার ড্রয়ারে স্থান পায়; খুব সুন্দর মানিয়ে যায় সেগুলি আমার গায়ে।“ বাবার কণ্ঠে দায়িত্বশীলতা, মিতব্যয়ীতা, না কি অন্য কিছু ছিল, জানি না। তবে একটা প্রবল হতাশা মিশ্রিত বিরক্তি চেপে ধরে আমায়; কথা না বাড়িয়ে দ্রুত কেটে পড়ি।
এরপর মাত্রই তিন মাস পেরিয়ে ছিল; আর এরই মাঝে একদিন দুপুরে মা যখন শুয়ে ছিলেন তার ঘরে, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ কি হল…মা উঠে বসলেন, আর হঠাৎ ধ্যান টুটে গেলে যেরকম হয়, সেরকম জড়ানো স্বরে বলতে লাগলেন, ‘কাইল কয়েকজন ফকির-মিস্কিন ডাকছি বাসায়…তর বাবার জামা-কাপড়গুলো লইয়া যাইতে আইব… যদি এট্টু দোয়া-দরুদ ….!‘
‘না…না…‘ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি মায়ের কথা শেষ করতে না দিয়ে। এরপর কোথা থেকে একটা ঝড় এসে চারদিক কালো করে ফেলল, আর প্রবল একটা বাষ্পের আস্ফালনে দমবন্ধ হয়ে সেই ঘোর অন্ধকারেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি আমি!
একদিন পরের কথা। বেশ কিছু আনশিডিউলড কাজ অফিসে এমন করে ঠেসে ধরেছিল আমায় যে আর কোন দিকে মাথা গলানোর সুযোগ ছিল না! রাতে বাসায় ফিরেই ওয়্যারড্রবের দিকে হাত বাড়াই আমি; পড়ে থাকা কাপড়চোপড়গুলো ক্লান্তির স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনছিল প্রতিটা মুহূর্তে! কিন্তু চেম্বারের অর্ধেকটা খুলতে শুধু চোখই স্থির হল না আমার, হাত-পা’ও হারাল সঞ্চালনশক্তি!
ছোট্র সে পোশাকের ঘরটিতে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে কতগুলি অতিরিক্ত স্যান্ডো! আকার ও আকৃতিতে অবিকল আমারগুলোরই মত!
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।