পর্ব ১
যাত্রারম্ভ
স্কুলে যাঁরা পড়ান তাঁরা একদম চোখের সামনে ছাত্রদের বড় হয়ে উঠতে দেখেন। শৈশব কৈশোর পেরিয়ে অ্যাডাল্টহুডের দোরগোড়ায় পৌঁছে বিদায় নেয় তারা। তাই শিক্ষকরা যে এই ছাত্রদের একেবারে হাতের তালুর মতো করে চিনবেন - এটাই তো স্বাভাবিক! তবু, বলার কথা এই যে, ঘটনাচক্রে আমি নিজেও শিক্ষক, আর এ পেশার সাথে যুক্ত আছিও সেই দু হাজার দশ সাল থেকে - কিন্তু, আমার ছাত্রদের আমি চিনি বললে একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা বলা হবে! কেন যে এতো বছর ধরেও তাদেরকে আমি চিনতে পারিনি সেই কারণটাই চেষ্টা করেছি বোঝার বিগত বারো-তেরো বছর ধরে। আর সেটাই আমাকে একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ দিয়েছে সমাজকে দেখার।
তবে প্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকাতে হয়, সে রকম এক্ষেত্রেও গল্পটা শুরু করতে হবে একটু আগের থেকে। যে সময়কার কথা বলছি তখন এসএসসি পরীক্ষা হতো নিয়মিত, এবং সেই সময়ে আমাদের মতো অনেকেই এই পরীক্ষাটিকে পাখির চোখ করে নিজের ভবিষ্যৎ কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখতো। যাদের বয়স এখন তিরিশের কম তারা হয়তো বুঝবেও না সে সময় স্কুল সার্ভিস কমিশন কতটা ঠিকঠাক ছিল। এবং, সবথেকে দুঃখের কথা হল, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে এসএসসির গঙ্গাযাত্রা হওয়ার আগে এটি যেন আরো বেশি করে স্বচ্ছ এবং সিস্টেমেটিক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। যেমন ধরুন, শুরুর দিকে সফল পরীক্ষার্থীদের কর্তারা নিজের ইচ্ছেমতো যোনের যেখানে খুশি সেখানে পাঠিয়ে দিতেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ধরিয়ে। কাকে কোথায় পাঠানো হবে সে ব্যাপারে নিয়মের বালাই ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নানা রকম অভ্যন্তরীণ করাপশন এবং স্বজনপোষণের সুযোগ থেকে যেত। কিন্তু আমাদের সময় নিয়ম হয়েছিল যে, প্রতিটি যোনের কোন কোন স্কুলগুলিতে পদ ফাঁকা আছে তার একটা তালিকা প্রকাশ করতে হবে - এবং সেই যোনের সফল পরীক্ষার্থীরা পছন্দমতো স্কুল বেছে নেবেন নিজের নিজের র্যাঙ্ক অনুযায়ী।
যে স্কুলটাতে আমি পড়াই সেটাই ছিল লিস্টে আমার বাড়ির সব থেকে কাছে। তাই সিলেকশনের সময় একেবারে চোখ বুঁজে ওটিকে বেছে নিই। একবার গিয়ে দেখিওনি পর্যন্ত। এছাড়া, আমার বাবা তখন ছিল ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কর্মচারী। আমাদের স্কুলের স্যালারি হতো যে ব্রাঞ্চ থেকে বাবা তখন পোস্টেড ছিল সেখানেই। ফলে আমার বাবার বোধহয় ধারণা হয়েছিল যে স্কুলটি তাদের অফিসের ভাই বেরাদর হবে। তাই বেশ খানিকটা ওকালতি করেছিল এর হয়ে। তবে ওই যে, বাবারা যেমন হয়! হামেশাই আধাখ্যাঁচড়া কথা বলে বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যায় ভুলভাল পথে! তাই স্কুল সিলেকশনের পর এসএসসি অফিস থেকে বেরিয়ে মিষ্টির দোকানে বসে যখন আমরা কচুরি এবং জিলিপি খাচ্ছি, তখন হঠাৎ আমার পিতৃদেব ঘোষণা করলেন যে স্কুলটি নাকি অতীব খারাপ - মাধ্যমিকে এমনকি দু-তিনটে ফাস্ট ডিভিশনও যায় কিনা সন্দেহ........ ইত্যাদি ইত্যাদি! এতক্ষণ পর্যন্ত চাকরি পাবার আনন্দে মনে মনে প্রায় মাইকেল জ্যাকসনের মতন নাচানাচি শুরু করেছিলাম। এবার হঠাৎ যেন ধাঁই করে আছাড় খেয়ে পড়লাম!
তখন আর কিছুই করার নেই। তবুও চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! তাই ঠিক করলাম যে জয়নিং-এর চিঠি আসা মাত্র স্কুলটাকে একবার সরজমিনে গিয়ে দেখে আসবো।
বিশাল কিছু প্রত্যাশা নিয়ে যাইনি। সেজন্যই হয়তো খারাপও লাগেনি। স্কুল বাড়িটা নেহাতই ছোটখাটো। তার উপর আবার বিল্ডিং সর্বস্ব - মানে এক চিলতে খেলার মাঠও নেই আশেপাশে! একতলার ক্লাসরুমগুলোর পাশ দিয়েই চলে গেছে রাস্তা। সেখানে বারো ভূতের কীর্তন চলছে অষ্টপ্রহর। ছেলেমেয়েরা যে অসম্ভব গরিব পরিবার থেকে আসে সেটা ইউনিফর্মের ছিরি দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু, কেন জানিনা, পরিবেশটাকে বেশ আন্তরিক বলে মনে হল আমার। হবু হেড স্যার বললেন পরের দিন থেকেই জয়েন করতে। আর আমিও এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। আর এভাবেই এক তথাকথিত 'মধ্যবিত্ত ভদ্দরলোকে'র পরিবার থেকে আসা সন্তান সুযোগ পেল বাঙালি লোয়ার ক্লাসের একটি বিশেষ অংশকে একেবারে নাকের ডগায় রেখে অবজার্ভ করার।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে - first impression is the last impression। আমার পরম সৌভাগ্য যে, ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে প্রথম যে ইম্প্রেশনটা হয়েছিল সেটা ছিল যথেষ্ট ভালো! তারা নতুন স্যারের সাথে কোন রকম অসভ্যতা করেনি। সিটি বাজায়নি বা বিড়ালের ডাক ডাকেনি। বা অন্য কোনও 'মজা' করার চেষ্টা করেনি। আমি কিন্তু মানসিকভাবে এসবের জন্য তৈরি হয়েই গিয়েছিলাম। এখন অবশ্য বুঝতে পারি এই জাতীয় চিন্তা অমূলক ছিল। এসব কার্যকলাপ ছেলেমেয়েরা তখনই করে যখন কোন টিচার ক্লাসটাকে ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে পারে না। তবু প্রথম বার ভেবেছিলাম হয়তো আমাকেও এসব জিনিস হ্যান্ডেল করতে হতে পারে। কিন্তু সেসব কিছুই যখন হলো না, এবং তেনাদের হাবভাব দেখে যখন বুঝলাম যে অধমের পড়ানোর ধরন সাহেবদের পছন্দ হয়েছে - তখন আমিও তাদের ব্যাপারে একেবারেই ভক্তির চরমে গিয়ে পৌছালাম।
মাঝে মাঝে ভাবি, ভাগ্যিস সেই শুরুর দিনগুলোতেই তাদের ব্যাপারে আমার ইমপ্রেশনটা ভালো হয়েছিল! নয়তো আমার শ্রেণীর মানুষজনের থেকে তারা এতটাই আলাদা যে হয়তো প্রেজুডিসড হয়ে যেতাম প্রথম থেকেই। আর সেটা যদি হতাম তাহলে কখনো চেষ্টাই করতাম না তাদেরকে বোঝার......
সবার আগে যে জিনিসটা আমার নজরে পড়েছিল তা হল আমার এই নবলব্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের মেন্টাল ম্যাচিউরিটি। এইট নাইনের কিশোর কিশোরীদের আচার-আচরণ প্রায় কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদের মতো। এবং সেটা কিন্তু ভালো অর্থে। কোন টিনেজার সুলভ ট্যানট্রাম নেই। ছেলেদের আলাদা করে হিরো সাজার চেষ্টা নেই। মেয়েদের পাপা কি পরি টাইপের হাবভাব নেই। এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, চলনবলন-কথাবার্তা ইত্যাদি আনসফিস্টিকেটেড হলেও অত্যন্ত ভদ্র এবং বাধ্য ছাত্র-ছাত্রী তারা। তবে এটা পড়ে কিন্তু মোটেও ভাববেন না তাদেরকে আমি অমিশ্রিত ভালো কিছু হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছি (এই পয়েন্টটা আশা করি আমার পরের দিকে লেখাগুলো পড়লে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন)। তাদের ভালোটা খাঁটি ভালো, খারাপটা খাঁটি খারাপ। অর্থাৎ, এদের কোনটাই বাপ-মায়ের ইনডালজেন্স বা ওভারপ্রটেকশনের ফল নয়। মানুষ হিসেবে তারা আসলে যা আমার চোখের সামনে তাদের সেই রূপটাই ধরা পড়ছে। তবে দোষের মধ্যে একটাই। লেখাপড়ার সাথে তাদের ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক (এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব)।
যে সময়কার কথা বলছি তার মাত্র বছর খানেক আগেই আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসে একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তখন আমার সামনে লড়াই করার কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। বেঁচে থাকারও যেন কোন উদ্দেশ্য নেই। সৌভাগ্যক্রমে খুব অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম যে একমাত্র পড়ানো ছাড়া আর কোন কাজই আমি ঠিকঠাক করতে পারি না। আর স্বভাবের দিক থেকেও আমি খানিকটা সিধু জ্যাঠা টাইপের। তাই ভেবেছিলাম যে এইসব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই বেঁচে থাকব। তাদের মধ্যে দিয়ে যাব আমার উত্তরাধিকার। কিন্তু জয়েন করার পর দ্রুত বুঝতে পেরেছিলাম আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। কারণ তাদের মধ্যে কেউই ভবিষ্যতে পড়াশোনার ধার দিয়েও যাবে না।
লেখার একদম শুরুতেই বলেছি যে, আমার ছাত্রকূলকে আমি চিনি না। আজকের এপিসোড শেষ করার আগে এই কথাটারই একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। না, তাদের যে আমি একেবারেই চিনি না, তারা যে আমার কাছে আদ্যোপান্ত আনপ্রেডিক্টেবল - তা হয়তো নয়। কিন্তু সে চেনা নেহাতই উপর উপর বাইরের থেকে চেনা। অর্থাৎ, সেটা যুক্তি এবং বুদ্ধি দিয়ে তাদেরকে বোঝার চেষ্টা, কিন্তু তাদের সাথে আইডেন্টিফাই করা নয়। এত বছরের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে তাদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছি তার প্রধান এবং একমাত্র কারণ হলো ক্লাস ডিফারেন্স। আর্থিক এবং সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের একদম তলার লেয়ারে পড়ে থাকা এবং উদ্বাস্তু কলোনিতে বেড়ে ওঠা শ্রমজীবী শ্রেণীর সন্তান-সন্ততির আউটলুক এবং ভ্যালু সিস্টেম - দুটোই যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের থেকে ফান্ডামেন্টালি আলাদা হয় সেটা অনেকেই দেখি বোঝেন না। এবং এই না বোঝাটার কিছু অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং বিপদজনক ফল আছে। আমাদের সরকারের পলিসি মেকাররা যেহেতু প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর থেকে আসেন, তাই তাদের পলিসিগুলি সমাজের নিচের স্তরের মানুষের জন্য সব সময় যে খুব এফেক্টিভ হয় এমনটা নয়। আমার এই লেখাটা ঠিক স্মৃতিকথা নয় - সীমিত বুদ্ধি এবং পড়াশোনার একজন মানুষের ওই শ্রেণি থেকে উঠে আসা শিশু-কিশোরদের সমস্যাগুলোর সাধ্যমত বিশ্লেষণের চেষ্টা। যা বলব সেই কথাগুলো মোটেও নতুন নয়। বিশেষ করে যেসব অর্থনীতিবিদ দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করেন তাদের লেখাতে এসব বিষয়ের ছায়া অল্পবিস্তর উঠে আসতে বাধ্য। তবু এই লেখাটা লিখবার সাহস করছি কারণ যা লিখতে যাব তা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল।
হে সুধী পাঠক, সঙ্গে থাকুন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।