এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  শিক্ষা

  • আমার অচেনা অজানা ছাত্রকূল পর্ব ২

    Surya Dipta Nag লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | শিক্ষা | ২২ মার্চ ২০২৩ | ৮১৮ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
    পর্ব ২

    নষ্ট হওয়া মানবসম্পদ


    স্কুলে জয়েন করার পর ক্লাস সিক্সে যাদেরকে পেয়েছিলাম তাদের অধিকাংশকেই আমার এখনো মনে আছে। তো সেখানে একটি অতিশয় বুদ্ধিমতি, সপ্রতিভ এবং বিশ্ব বকাটে মেয়ে পড়তো রিঙ্কু বলে।  রিঙ্কুর পদবী আমার জানা ছিল না। একদিন খাতা দেখতে গিয়ে দেখি মলাটের উপর ইংরেজি হরফে তার নাম লেখা আছে Rinku Pasone। আমি 'পাসোনে' বলে কোনও পদবী হয় জানতাম না। সেজন্য ওর পুরো নাম কি জিজ্ঞেস করলাম। না,  'পাসোনে' নয়, ওর নাম 'রিঙ্কু পাসোয়ান'। কিন্তু ওর নামের ইংরেজি বানান কেউ কখনো বলে দেয়নি বলে বুদ্ধিমতী বালিকা 'pass' (এক্ষেত্রেও বানানটা ঠিকঠাক মনে ছিল না ওর) আর 'one' শব্দদুটি পাশাপাশি বসিয়ে নিজের পদবীর বানান নিজেই স্থির করে ফেলেছে। এর উপর আবার সে কি ভয়ানক কনফিডেন্স তার! যতই বোঝাই পাসোয়ান বানান এমন হয় না, ততই সে বলতে থাকে, "স্যার, pass বানানটা না হয় আমি ভুল লিখেছি, কিন্তু one তো ঠিকই আছে। তাহলে Paswan কেন লিখবো আমি?" অনেক অনুনয়-বিনয় করেও পাসোয়ানের সেই অপরূপ বানান অন্তত ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন আমি বদল করতে পারিনি (যদিও আরেকটু বড় হয়ে সে নিজেই ঠিক করে নিয়েছিল)।

    আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে রিঙ্কুর বাবা-মা ছিলেন নিরক্ষর। রিঙ্কু যে নিজের নামের বানানটাও জানে না এটাই তার প্রমান (যদিও প্রাইমারিতে কিভাবে ব্যাপারটা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে সেটা আমি বলতে পারবো না)। আর, যে স্কুলে আমি পড়াই সেখানে রিঙ্কুর মত ছেলে-মেয়েরাই মেজরিটি। অর্থাৎ, অধিকাংশের অভিভাবকই হয় পুরোপুরি নিরক্ষর, অথবা নামমাত্র স্বাক্ষর।  ফলে সন্তানের লেখাপড়া এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের থেকে শকিংলি আলাদা! 

    এটা যে কতটা আলাদা হতে পারে সেটা বোঝাতে আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমার জয়নিং-এর বছরই যেই ছেলেটার রোল নম্বর এইট এ সেকশনে এক ছিল (অর্থাৎ সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠতে যে প্রথম হয়েছিল), সে সেশনের মাঝখানে হঠাৎ স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। আমরা ভাবলাম হয়তো ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে, কিছুদিন পরে স্কুলে এসে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে যাবে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অতিদরিদ্র মানুষজন অনেক সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাইগ্রেট করে কাজের খোঁজে।  কিন্তু না, ছেলেটা আর এলো না। প্রায় মাস ছয়েকের উপর কেটে গেল। আমরাও ওর কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। এমন সময় আবার ওকে দেখতে পেলাম একদিন। আমাদের স্কুল বিল্ডিং-এর চতুর্থ তলার পাকা ছাদ তৈরি হয় আমি জয়েন করার পরে। তাতেই কাজ করতে এসেছিল ছেলেটি। খুব সম্ভবত সাধারণ মিস্ত্রি, মজুর বা হেল্পার হয়ে। 

    এই ঘটনাটা আমার কাছে (এবং আমার কয়েকজন সহকর্মীর কাছেও) একটা জোরদার ধাক্কা ছিল। সত্যি বলতে কি, ছেলেটা যদি পড়াশোনায় একটু খারাপ হতো, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা হজম করা আমাদের সকলের পক্ষেই সুবিধাজনক হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে নিজেকে প্রবোধ দেবার কোন জায়গাই ছিল না! 

    এইখানে পৌঁছে বরং আপনাদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন রাখি। এই দ্বিতীয় ঘটনাটার মধ্যে আপনারা ঠিক কি দেখতে পেলেন? লেখাপড়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস এবং সম্ভাবনাময় একটা ছেলেকে এমন মাঝপথে স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হল যে তার জন্য দায়ী কে? শুধুমাত্র দারিদ্র্যের অভিশাপ? হ্যাঁ, দারিদ্র তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ছিল। তবে তার সঙ্গে আমি যোগ করব, কারণটা হয়তো শুধু সেটা নাও হতে পারে। মধ্যবিত্ত মানুষ আধপেটা খেয়েও চেষ্টা করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনাটাকে ফোকাসে রাখতে। কিন্তু আমি যেই শ্রেণীর মানুষের কথা বলছি তাদের ক্ষেত্রে সব সময় সন্তানের শিক্ষাটা প্রায়োরিটি হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা এর গুরুত্ব বোঝেন না, অনেক ক্ষেত্রে বুঝলেও গুরুত্ব দেন না, আবার অনেক সময় গুরুত্ব দিলেও নিজেরা লেখাপড়া শিখেননি বলে সন্তানকে ঠিকঠাক গাইড করতে পারেন না। যে ছেলেটির কথা লিখছি তার ক্ষেত্রে ঠিক কি ঘটেছিল এত বছর পরে আর বলা সম্ভব নয়। স্কুলে যখন ছিল তখন তার বাবা মা কি করেন সে কথা জানার চেষ্টা করিনি (বা করলেও হয়তো আলাদা করে লক্ষ্য করার মতো কিছু পাইনি বলে এখন আর মনে নেই)। আর যখন সে মজুর হিসেবে স্কুলে কাজ করতে এল তখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার লজ্জা লাগতো। কিন্তু এটা অবশ্যই দেখেছি যে অধিকাংশ বাবা-মাই সন্তানের লেখাপড়া এবং অন্যান্য সম্ভাবনার ব্যাপারে কমবেশি উদাসীন।  সেজন্য যেসব শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী, entrepreneur, ডাক্তার, প্রশাসক, শিক্ষক বা লেখক হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তারা হামেশাই নষ্ট হয়ে যায় শুধুমাত্র যত্নের অভাবে। আমার মতে সমাজের নিচের তলায় জন্মানোর সবথেকে বড় অভিশাপ এটাই - আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য নয়। এমনকি সকলেই যে চরম আর্থিক সংকটে থাকে তাও নয় (এটা নিয়ে পরে কথা বলব)। একজন মানুষের ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে দাম না থাকা, তার ট্যালেন্টের ভবিষ্যত না থাকা, তার ভিতরে থাকা সম্ভাবনাগুলোর বিকাশের পরিস্থিতি আদৌ তৈরি না হওয়া - এগুলোই হল লোয়ার ক্লাসে জন্মানোর আসল অভিসম্পাত।

    একটু আগেই যে উদাহরণটা দিলাম সেটা একটু চরম প্রকৃতির বলে লোকজনের নজরে পড়বে সহজে। কিন্তু আসল অপচয়টা হয় অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। বলছি কিভাবে। লোকে এটা প্রায়ই ভুলে যায় যে সম্ভাবনা কিন্তু শুধুমাত্র তাদেরই থাকে না যারা ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়। একটা অত্যন্ত ট্যালেন্টেড বাচ্চারও স্কুলের পারফর্মেন্স ভালো নাই হতে পারে - কারণ যে বিষয়গুলোতে তার আগ্রহ সেই বিষয়গুলো স্কুলে হয়তো আদৌ পড়ানোই হয় না! এইজন্য প্রচুর ছেলেমেয়েকে দেখবেন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে হঠাৎ দুর্দান্ত রেজাল্ট করতে শুরু করেছে। সেজন্য, স্কুলের  গন্ডি পেরোনোটাই হয় তাদের আসল চ্যালেঞ্জ। আর এক্ষেত্রে তাদের উপরে যেটা কাজ করে তা হল বাড়ির চাপ। আপনি যদি 'মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক' শ্রেণীভুক্ত হন, তবে বাপ-মা হিসেবে যতই অপদার্থ এবং সন্তানের পোটেনশিয়াল সম্পর্কে অজ্ঞ বা উদাসীন হোন না কেন - অষ্টপ্রহর 'পড় পড়' করে তার জীবন অতিষ্ঠ এবং হাড় মাস ভাজা ভাজা প্রতিনিয়ত অবশ্যই করে থাকেন! আর, আমাদের এই অজস্র গলদযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার নিচের দিকের ক্লান্তিকর স্তরগুলো পেরিয়ে আসতে মাতাপিতার এই কনস্ট্যান্ট উপদ্রবই কাজ করে গাড়ির ইঞ্জিনের ন্যায়। ঠিক এইটাই থাকে না সমাজের নিচের স্তর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের বেলায়। আর, আসল ক্ষতিটা করে তাদের এই চাপবিহীন নির্ভার শৈশব। 

    আমি নিজে পড়াতে গিয়ে এটা উপলব্ধি করেছি যে আমাদের মতো 'খারাপ' তকমা পাওয়া স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধিতে কারো থেকে এতটুকু কম নয়! ঠিকঠাক বোঝালে ক্লাসের পড়াটা তারা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। কিন্তু শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু শুধুমাত্র পড়া বোঝা নয়, বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে সেটিকে ধারণ করাও। আমাদের মতো স্কুলের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়ে ঠিক সেখানটাতেই। এবার ভেবে দেখুন, ক্লাস সিক্স বা সেভেনে যে যে জিনিসগুলো শেখার কথা সেগুলো যদি কেউ ভালোভাবে না শেখে, তাহলে দশম শ্রেণীতে উঠে কি পড়াশুনাটা তার কাছে একটু অতিরিক্ত কঠিন বলে মনে হবে না?  ফলে যত উপরের দিকের ক্লাসে উঠতে থাকে তারা, ততই তাদের লেখাপড়ার মান পড়তে থাকে।

    এছাড়া বাবা-মা এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের থেকেও বেশি করে যেই জিনিসটা সহায়তা করে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে তা হল একটা বাচ্চার পিয়ার গ্রুপ। প্রচুর নামকরা স্কুল আছে দেখবেন যেখানে লেখাপড়া একদমই হয় না, কিন্তু বোর্ডের পরীক্ষার রেজাল্ট কিন্তু হয় দুর্দান্ত রকমের ভালো! এর প্রধান কারণ কি জানেন? এই পিয়ার গ্রুপ। একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, এই সমস্ত স্কুলগুলিতে সাধারণত যে শ্রেণীর মানুষজন নিজের ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করানোর জন্য বিশেষ সচেষ্ট থাকেন তাদের অধিকাংশই সন্তানের লেখাপড়া এবং আনুষঙ্গিক বিকাশ সম্পর্কে কমবেশি সচেতন। স্বাভাবিকভাবেই বাপ-মায়ের থেকে এই চিন্তাগুলো খানিকটা হলেও সঞ্চারিত হয়ে যায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে। অন্যদিকে, একটা শিশু যেহেতু প্রতিদিনের বেশ কিছুটা করে সময় কাটায় স্কুলে, তাই স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের চিন্তাভাবনার বিষয়গুলো হয়ে দাঁড়ায় তার নিজের চিন্তার রেফারেন্স পয়েন্ট। এইসব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তারা কমপিট করে, তাদের সাথে কথা বলে নিজেদের সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ব্যাপারে ধারণা তৈরি করে। এইভাবে তাদের মধ্যে বিকাশ ঘটে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির। আশা করি এতক্ষণে বুঝতে পেরেই গিয়েছেন যে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী কোন ধরনের অর্থনৈতিক শ্রেণী এবং সামাজিক পরিবেশের থেকে আসছে তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাও স্পষ্টতার জন্য না হয় একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ভেবে দেখুন তো, আজকের দিনে একটা 'মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক' শ্রেণীর থেকে আসা মেয়েদের মধ্যে কজন ভাববে যে কোনরকমে স্কুলের গন্ডিটা পেরিয়েই বিয়ে করে ঘর সংসার করতে শুরু করবে? অথচ নিম্নবিত্ত শ্রেণীর প্রচুর মেয়ে কিন্তু ঠিক ওটাই ভাবে। এবং এই ভাবনাটা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চলে আসে তাদের সহপাঠীদের মধ্যেও। এবারে ভাবুন দেখি, একটা নিম্নবিত্ত মেজরিটি স্কুলের অধিকাংশ মেয়ে যা ভাববে একটা মধ্যবিত্ত মেজরিটি স্কুলের মেয়েরা কি সেই একই কথা ভাবতে পারে?

    যদি গুলিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এইখানে এসে আরেকবার নিজের বক্তব্যকে  পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করছি। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মানবসম্পদের নষ্ট হবার একটা প্রধান কারণ দারিদ্র্য। যদিও সেটা কিভাবে ঘটে তা সব সময় আমাদের চোখে পড়ে না। লেখাটা শেষ করছি এই সম্পর্কিত একটা উদাহরণ দিয়ে। 

    এটাও বেশ কিছুদিন আগেকার কথা। অন্তত বছর ছয়েক তো হবেই। একদিন ক্লাস করাতে করাতে লক্ষ্য করলাম একটা ছেলে আমার পড়া না শুনে অন্য একটা কিছু করছে। আমার ক্লাসে এই জিনিসটিকে আমি একেবারেই এলাও করি না! তাই পড়ানো না থামিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ছেলেটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম, এবং একেবারে ক্যাঁক করে ওকে চেপে ধরলাম। দেখা গেল যে, ইংরেজি ক্লাসে তিনি শিল্পচর্চা করছেন। পাতা জোড়া ছবি আঁকা প্রায় শেষ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, সে ছবি কিন্তু আর পাঁচটা বাচ্চার মতো করে আঁকা যে সে ছবি নয়! সে এঁকেছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা কয়েকটি আর্টিফিশিয়াল স্যাটেলাইটের ছবি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এই ছবিটা তুমি কোথায় দেখেছো?' হঠাৎ ধরা পড়ে যাওয়ায় সে একটু থতমতো খেয়ে গিয়েছিল, তবু কয়েকবার আমতা আমতা করে জানালো যে সেটি নাকি ডিসকভারিতে হওয়া একটি অনুষ্ঠানে দেখেছে। ঘটনাচক্রে এই জাতীয় অনুষ্ঠান আমি নিজেও দেখে থাকি। আর সেই জন্যই বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কতটা এক্সট্রাঅরডিনারি! শুধুমাত্র স্মৃতি থেকে যে ছবিটা সে এঁকেছে সেটা বলতে গেলে প্রায় নিখুঁত! মানে, ছেলেটার একটা প্রায় ফটোগ্রাফিক মেমোরি রয়েছে! 

    এখনো মনে আছে যে ওর নাম ছিল সৌমেন। সৌমেন ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিল, বয়ঃসন্ধির সময় থেকে সেটা ক্রমশই বিষাক্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। ওর বাবা-মা ছেলেকে পড়াতে অনিচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু সৌমেন নিজেই অধিকাংশ দিন স্কুলে আসতো না, বা এলে পরে অন্যদের বিরক্ত করতো। একটু bullying-এর প্রবণতাও পরবর্তীকালে ওর মধ্যে তৈরি হতে দেখেছি। 

    আমার ঠিক মনে নেই সৌমেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল কিনা। যতদূর মনে পড়ছে করেনি। তবে মাধ্যমিকের গন্ডি যে পেরিয়েছিল সেটা মনে আছে। যাইহোক, স্কুলে আসা বন্ধ করার কিছুদিন পর আমার সাথে একবার দেখা হয়েছিল ওর। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল একটা মিস্ত্রি মজুরের দলের সাথে। আমাকে দেখে নিজেই এগিয়ে এসেছিল কথা বলার জন্য। 

    আমি এখনো ঠিক জানিনা সৌমেনের মধ্যে ঠিক কোন দিকে বিকশিত হওয়ার সম্ভবনা ছিল। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মালে সম্ভবত ওর পরিণতি এমন হতো না। বেশ কিছু মানুষের ক্ষেত্রে তার প্রতিভার বিকাশের জায়গাটা বোঝা যায় বয়স একটু বাড়ার পর। আমার ধারণা সৌমেনও ছিল তাদেরই মতো একজন। কিন্তু শুধুমাত্র একটা ভুল শ্রেণীতে জন্মানোর জন্য ওর ভেতরের সম্ভাবনাগুলো আদৌ কোন রূপ পাবার আগেই অযত্নে নষ্ট হয়ে গেল!

    [পুনশ্চঃ পাঠক আমাকে ভুল বুঝতে পারেন মনে করে নিজের ডিফেন্সে কিছু কথা আগ বাড়িয়ে বলে রাখি। 
     
    প্রথমতঃ লেখাপড়াটাকে দরকারের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা কিন্তু এই লেখাটিতে আমি আদৌ বলিনি। যে মানুষগুলো সবজি বিক্রি করে, রিকশা চালায়, দেওয়াল গাঁথে বা ভ্যান টানে তাদের লিখতে পড়তে এবং গুনতে জানা আবশ্যিক নিশ্চয়ই, কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরনোর পর উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়াটা একেবারেই নয়। কিন্তু, যাদের মধ্যে আরও বড় কিছু করার সম্ভাবনা আছে তাদের শুধুমাত্র বিশেষ শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করার জন্য সেটা করতে না পারাটা মানবসম্পদের অপচয় অবশ্যই।
     
     
    দ্বিতীয়তঃ আশা করি এত দূর পর্যন্ত পড়ে এটা বুঝে ফেলেছেন যে বর্তমান লেখক স্কুলে ভালো ফল করাটাকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মাপকাঠি বলে মোটেও মনে করেন না - তবু শিক্ষকদের হাতে ছাত্র-ছাত্রীদের পোটেনশিয়াল মাপার আর খুব বেশি টুলস থাকে না বলে সেটিকেই মোটামুটি কষ্টিপাথর ধরে নিয়ে তিনি একদা শুধুমাত্র ক্লাস টেনের লেখাপড়ায় ভালো এবং টিউটোরিয়াল ক্লাস করতে ইচ্ছুক বালক বালিকাদের তিনদিন করে এক্সট্রা পড়াতেন। কিন্তু বোর্ডের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল যে ফল হয়েছে লবডঙ্কা।
     
    তৃতীয়তঃ লেখাটা লিখতে গিয়ে বারবার একটা ব্যাপারে নিজেকে সচেতন করেছি - আমি যেন লেখক হিসেবে কখনোই আমার ছাত্রদের দারিদ্রকে বিক্রি করে পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা না করি। ওই যে একটা কথা আছে না - সাহিত্যের মা যখন কাঁদে তখন একটু বেশি করেই কাঁদে - আমি খেয়াল রেখেছি এই লেখাটা যেন সেরকম একটা কিছু হয়ে না দাঁড়ায়। আমি যাদের কথা লিখছি দারিদ্র কিন্তু তাদের মুখের হাসি ম্লান করে দিতে পারেনি। তারা গরিব হতে পারে, কিন্তু কোনমতেই আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা নয়। তাদের আচার-আচরণ দেখে মনেও হয় না দারিদ্র্যের কারণে তারা আলাদা করে খুব দুঃখে আছে। উপরন্তু, পড়াশোনার ব্যাপারে বাড়ির অত্যধিক প্রেসার না থাকায় তারা বরং ইমোশনালি অনেক বেশি ব্যালেন্সড হয়। তাছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাবামায়েরা ছেলেমেয়েদের অনেক বেশি করে পুশ করতে থাকেন নিজেদের মধ্যে একটা অস্বাস্থ্যকর কম্পিটিশন করার জন্য। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কখনো এই জিনিসটা দেখিনি। আসলে দুঃখটা বোধহয় তাদের নয়, দুঃখটা আমাদের। আমরা যারা চোখের সামনে অজস্র সম্ভাবনাকে দারিদ্র্যের কারণে নষ্ট হয়ে যেতে দেখি, তাদের। যারা নষ্ট হয়ে যায় তারা জানেও না তাদের মধ্যে কি ছিল। তাই তাদের নিজেদের কোনো দুঃখ নেই।
     
    চতুর্থতঃ অনেকেই হয়তো এটা লক্ষ্য করে অস্বস্তি বোধ করেছেন যে 'মধ্যবিত্ত' এবং 'নিম্নবিত্ত' জাতীয় 'অর্থনৈতিক শ্রেণী'বাচক শব্দগুলিকে আমি মোটেই সবসময় শুধুমাত্র বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে ব্যবহার করিনি। এক্ষেত্রে বিষয়টাকে ডিফাইন করা আমার নিজের পক্ষেও যথেষ্ট কঠিন। তবু, যদি ধরে নেন যে 'মিডলক্লাস আউটলুক' বলে কিছু একটা জিনিস বাস্তবেও অস্তিত্ব রাখে এমন পূর্ব সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমার এই শ্রেণী সম্পর্কিত উক্তিগুলি করেছি, তাহলে হয়তো বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে।]
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • আলোচনা | ২২ মার্চ ২০২৩ | ৮১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন