মণিভূষণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন উথাল পাথাল করে দেওয়া কয়েকটি লাইন – আমাদের চালু হিসেবে কবিতা বলে গ্রহণ করি। কিন্তু হৃদয়ের অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণ এবং উপচে পড়া মমতা যখন শব্দের চেহারা নেয় তখন কি সে কবিতা? কিংবা, পশ্চিমী তাত্ত্বিকদের ভাষায় emobodied experience? মণিভূষণ লিখেছিলেন –
“অধ্যাপক বলেছিল, ‘দ্যাট’স র-ঙ, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?’
মাস্টারের কাশি ওঠে, ‘কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!’
চটকলের ছকুমিঞা, ‘এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ও. সি-কে।’
…..
উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সে ডানপিটের তেজী রক্তধারা,
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।”
এখানে মণিভূষণ যখন এই সৃষ্টি করছেন তখন পৃথিবীর আরেকপ্রান্তে সময়ের কিছু ব্যবধানে লুই আরাগঁ সৃষ্টি করেন –
It’s already too late to learn how to live,
Let our hearts mourn together at night.
For the least little song we pay with sadness
For each thrill we pay with regret
Even a sweet melody we pay with weeping.
There is no happy love.
১৯৭০-৮০-র দশকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হবার আগে বহু যৌবন পাঠ করেছে তাঁর কলম-কালির জরায়ু ছিঁড়ে জন্ম নেওয়া গায়ে কাঁটা-দেওয়া কবিতার সেই লাইনগুলো –
“পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ –একা – নরক দর্শন করে
তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হতে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার;
মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।”
প্রসঙ্গান্তরে, প্রতিবছর আমরা ১৫-ই আগস্ট তথা স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতে যথেষ্ট পরিমাণ বেলপাতা-ফুল-পাঁজি-বাতাসা নিয়ে স্বাধীনতার গল্প শুনি। ২০১৭ সালে দুই দিনাজপুর এবং মালদার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়ঙ্কর বন্যা শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্ট। এক হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে গ্রামের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদের জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন, সাথে কয়েকজন বাচ্চা শিক্ষার্থী ছিল। পরের দিন সংবাদপত্রের খবর হয়েছিল এ ঘটনা। সমস্ত বঞ্চনা, অনাদর, অবহেলা, অবান্তর মৃত্যু, বুভুক্ষা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাজারো ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও মানুষের স্মৃতিতে নির্মিত হয় স্বাধীনতা দিবসের বর্ণময় চিত্রকাব্য – এমনকি জীবনে কোন বর্ণ না থাকা সত্ত্বেও। এখানে এসে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা – হবসবম, হানা আরেন্ট, নর্বার্ট এলিয়াস, স্পিভাক, লাকাঁ আদি সমস্ত বিশ্ব তত্ত্বসাম্রাজ্যের শাসক সম্রাটেরা – ভেঙ্গে পড়তে থাকে মানুষের শরীরী অভিজ্ঞতা বা emobodied experience-এর কাছে। অদ্ভুতভাবে অনেকেরই সেদিন মনটাও হয়তো বা একটু উড়ুক্কু থাকে।
আমরা সেই ঘোরের মাঝে স্বাধীনতার লগ্নের বড়ো বড়ো নায়কদের – গান্ধী-নেহরু-জিন্না-প্যাটেল-নেতাজীর - গল্প শুনতে থাকি। স্বাধীনতার গল্প শোনার ফাঁকে স্বাধীনতার লগ্ন কিভাবে জন্ম নিল, কিভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ স্রেফ অসমান দু-টুকরো হয়ে ধরাধামে আত্মপ্রকাশ করলো, কীভাবে স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য সমস্ত মানুষের ভোটের যন্ত্র, মন্ত্র এবং অধিকার তৈরি হল – এসবকিছুও শুনি আমরা, শুনতেই থাকি। বিভিন্ন রস, স্বাদ এবং রঙের যৌগপদ্যে নতুন নতুন ধারায় এবং বিভঙ্গে জমে উঠতে থাকে দেশ, জীবন, স্বাধীনতা আর আমাদের অস্তিত্বের যাত্রাপালা। আমরা স্বাভাবিক জাগতিক নিয়মে এর সাথে মানসিকভাবে একাত্ম হয়ে পড়ি প্রায় সবসময়েই, অবশ্য কখনো distant observer হয়েও থাকতে পারি। সবমিলিয়ে গণতন্ত্রের এক জমাটি “জনতা” হিসেবে আমরা, বাখতিনের ভাষায়, carnivalesque / carnivalized literature-এর পাঠ নিতে অভ্যস্ত হতে থাকি। কিন্তু বাখতিন যে “সাবভার্সন” দেখেছিলেন জনতার এই আনন্দমুখর সৃজনে সে সৃজন বাখতিনের প্রায় ১০০ বছর পরে লুঠ হয়ে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছে, রাষ্ট্রের হাতে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের আধুনিক চেহারায় এবং চলনে কার্নিভালের পরিবর্তে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের “নির্মিত” জনতার উৎসব। ভারত ভাগের ৭৩ বছর পার করে এসে রাষ্ট্রও তো বড়ো আকাঙ্ক্ষা করে এমনটাই যেন থাকি আমরা।
শঙ্খ ঘোষ কি এরকম কোন সম্ভাবনা, এরকম কোন মুহূর্তের কথা ভেবেই আমাদের সচকিত করেন –
“আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
…..
আমাদের এই তীর্থে আজ ভেঙে পড়ার উৎসব
তাকিয়ে আছে হাজার মাঠ গহ্বর
বিনাশ আনন্দের উৎসারের প্রতীক্ষায়
ঝলসে ওঠে আকাশমুখী চিমনি
…..
আমাদের এই তীর্থে ঘোর উৎসব
আমাদের এই তীর্থে শেষ উৎসব”
একজন সার্বভৌম নাগরিক, একজন ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে শিখলেই গৌরি লঙ্কেশ বা পানেসার বা কালবুর্গি হয়ে ওঠার বিপজ্জনক সম্ভাবনা ক্রমশ খুলতে থাকে। এমনকি “হিট লিস্ট”-এ থাকেন গিরীশ কার্নাডের মতো ব্যক্তিত্ব। আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান পরিধির মধ্যে এতটা জায়গা আমরা দিই কী করে? প্রত্যাশা করাও বড্ডো অনুচিত। যখন আনন্দমুখর উৎসবের প্রকাশকে সাফদার হাসমির মতো কেউ রাস্তায় সমস্ত মানুষের সাথে মিশিয়ে দিতে চান, ভাগ করে নিতে চান প্রতিজ্ঞাঋদ্ধ প্রত্যয়ে তখন তাঁর দোজখ যাত্রা ছাড়া আর কোন রাস্তাই বা খোলা থাকে? কারণ, ব্যক্তি কথা বলছে, সমষ্টিও কথা বলছে। কথা বলছে মানুষের নিজের জীবন-জগৎ-যাপন নিয়ে। এ এক সর্বনেশে পরিস্থিতি। তাই আমরা জনতাই থাকি, কার্নিভালের সুখে মাখামখি হয়ে থাকি। শঙ্খ ঘোষ তো কবেই নিজেকে এবং আমাদেরকে বলেছিলেন –
“তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
যে-কথাটাই বলাতে চাই বলি
সত্য এবার হয়েছে জমকালো।
গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর
হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর
তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে –
…….
এ-দুই চোখে দেখতে দিন বা না দিন
আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন
আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে।”
স্বাধীনতার ঠাসবুনট গল্পের কী কেবল একটিই আখ্যান? শুধুমাত্র একটি বয়ান? একটিই শরীর? যাত্রাপালা কী একভাবেই অভিনীত হয়? প্রতিটি অভিনয়ের সাথে সাথে তো নতুন উপাদান, নতুন ভঙ্গিমা তৈরি হয়। এভাবেই আমাদের রুধির-স্নাত স্বাধীনতার চলমান জীবনপ্রবাহ বেঁচে থাকে।
গল্পের ওপরে গল্প। আখ্যানের পরে আখ্যান, অসংখ্য চরিত্র, অগণন মৃত্যু, সংখ্যাতীত নারীর শরীর (তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া), টুকরো হয়ে যাওয়া জমি-জিরেত-পরিবার-আত্ম-দেশের ভূমি, হাজারো হাজারো নামগোত্রহীন শববাহী ট্রেনের যাত্রা, ক্ষমতার স্তরে স্তরে আরো বৈভব আরো মাৎসর্য – এসব নিয়েই তো স্বাধীনতার নির্লজ্জ বা অবগুণ্ঠিত কাহিনী।
“তুমি তো জানো,
জন্মভূমি আজ ছিন্নমস্তা; তার উলঙ্গ অভুক্ত দেহের ওপর
হাজার নরমাংস লোলুপ শ্বাপদেরা
তোমার শপথ, স্বপ্ন, ভালোবাসা, সবকিছুকে আড়াল করছে।
এমনকি তার হাতের মুঠোয় যে লাল পতাকাটা শক্ত ক’রে ধরা আছে
সেখানেও ভয়াবহ কুয়াশা, কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।” (বীরেন্দ্র চট্টোপাধায়)
এই ছিন্নমস্তা জন্মভূমির কাহিনী, আখ্যান, রক্ত-স্নাত কসাইখানা, যার নাম হতে পারে রাষ্ট্র, মানুষের ওপরে মানুষের ঢিবি করে রাখা লাশ – এসবকিছুর সালতামামি নেবার মাহেন্দ্রক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ছে। তখনই তো আবার শুনবো উদার সুরে “সারে জঁহাসে অচ্ছা”, মন ভরিয়ে দেবে “ऐ मेरे वतन् के लोगों / ज़रा आँख् में भर् लो पानी / जो शहीद् हु हैं उनकी ज़रा याद् करो क़ुरबानी।”
তখন আরেক কবি মাতৃভূমির স্বপ্ন নিয়ে একটি অন্য চিত্র আঁকবেন –
“এখন আমি বলিষ্ঠ তুলির টানে
একটা নতুন শিশুর মুখ আঁকবো
আর ঘুমন্তদের ডেকে বলবো
শহীদদের সেই উজ্জ্বল স্বপ্নের কথা –
যে স্বপ্ন দেখতে কোনোদিন ঘুমোতে হয় না।”
সেসময়েই কোন একজন কবি হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উঠে আসা আগ্নেয় প্রক্ষোভ নিয়ে রচনা করবেন –
“রক্তমাখা দ্রোণফুল পড়ে আছে ঘাতকের থাবার তলায়
ওই ফুল একদিন ফুটেছিল জ্যোৎস্নায়, কবিতায়
তাহার মায়ের স্নেহের ছায়ায়।” (সনৎ দাশগুপ্ত)
এও তো আরেক “কুরবানি”-র কাহিনী, তবে এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়। দেশের মানুষের শোণিত-সিক্ত জীবন বনাম রাষ্ট্রের খতম-যুদ্ধের কাহিনী।
গায়ত্রী স্পিভাকের লেখা, ১৯০০০-এর বেশি রেফারড, প্রবন্ধ (পরে পুস্তক হয়ে প্রকাশিত) “Can the Subaltern Speak”-এ স্পিভাক মন্তব্য করছেন – “The subaltern cannot speak. There is no virtue in global laundry lists with ‘woman’ as a pious item.” তিনি তাঁর আত্মীয় ভুবনেশ্বরী দেবীর আখ্যান চিরে চিরে দেখিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পথে তিনি ফরাসী দার্শনিক ফুকো এবং দেলুজের “epistemic violence” তথা জ্ঞানতাত্ত্বিক হিংসা, উপনিবেশিক ভারতের মতো ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমিতে জন্ম নেওয়া জ্ঞান ও সত্যের নির্মাণ কী করে “universal” জ্ঞানের কাঠামোর মধ্যে নৈতিকভাবে আত্মসাৎ করে নেওয়া যায় ইত্যাদি প্রসঙ্গকে মার্ক্সীয় এবং দেরিদীয় প্রেক্ষিত থেকে সমালোচনা করেছেন। নতুন ভাবনার যাত্রাপথ নির্মাণ করেছেন।
দুটি প্রসঙ্গ এসেছে ওপরের উদ্ধৃতিতে – প্রথম, সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গের মানুষ তাদের নিজেদের কথা বলতে পারেনা; দ্বিতীয়, “global laundry lists”-এ নারীরা কোন পবিত্র সামগ্রী নয়। আপাতত সাবঅল্টার্নদের স্বর আদৌ আছে বা রেপ্রেসেন্ট করা সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে একটুখানি কথা বলবো। পরে আমাদের স্বাধীনতা ও নারী নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা যাবে।
সত্যিই কি সাবল্টার্নরা নিজেদের রিপ্রেসেন্ট করতে বা কথা বলতে পারেনা (এখানে নারীর প্রসঙ্গ ঊহ্য রাখলাম)? “আনন্দমঠ” পড়লে এরকম মনে হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। নামগোত্রহীন সন্তান সেনাদের (সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের মাঝে শুধু ভবানন্দ, ধীরানন্দ, জীবনানন্দ, মহেন্দ্র কিংবা সত্যানন্দের মতো অগ্রণী পুরুষদের কন্ঠনিঃসৃত সংলাপ শোনা যায়। যে অসংখ্য বিদ্রোহী – শান্তির বক্তব্য অনুযায়ী গড়ে “বিশ পঞ্চাশ হাজার” সন্তান সেনা থাকে – তারা ভাষ্যহীন, কণ্ঠহীন, স্বরহীন। সন্তান সেনাদের নেতৃত্ব ভবানন্দ বলেন – “আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কী হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?”
এরপরে মহেন্দ্রের সাথে ভবানন্দের কথোপকথনে আসে ইংরেজ এবং মুসলমানদের প্রতিতুলনা –
“ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায় – শরবৎ খুঁজিয়া বেড়ায় – ধর, তার পর, ইংরেজদের জিদ্ আছে – যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলাকারই। টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহীরা মাহিয়ানা পায় না। তার পর শেষ কথা সাহস – কামানের গোলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না – সুতরাং একটা গোলা দেখে দুই শ জন পলাইবার দরকার নাই। কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায় – আর গোষ্ঠীশুদ্ধ গোলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।” এত প্রাঞ্জল এ বিবরণ যে পাঠক নিরপেক্ষভাবে এর আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু ইতিহাসও কি এমনটাই বলে? সুপ্রকাশ রায়ের অসীম পরিশ্রমধন্য ১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত বই “ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম”-এর পাতায় পাতায় এ বক্তব্যের অর্থাৎ “আনন্দমঠ”-এর বিপরীত ভাষ্য বিধৃত আছে। সন্ন্যাসী, ফকির, নিপীড়িত হিন্দু-মুসলমান ভূমিহারা, সহায়সম্বলহীন কৃষক সম্প্রদায় ইংরেজ শাসন, কেবলমাত্র ইংরেজ কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে লড়াই করেছে। ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাচারী হিন্দু বা মুসলিম জমিদার বা কুসিদজীবীও বাদ যায়নি। বিদ্রোহীদের একটি পর্যায়ের নেতা ধর্মগতভাবে মুসলমান – মজনু শাহ। পরবর্তীতে নেতৃত্বে এসেছিলেন ইশা শাহ এবং অন্যান্যরা।
ইংরেজের সাথে চুক্তিবদ্ধ জমিদারদের “রেভেনিউ কাউন্সিল” ১৭৭২ সালের ১৬ মার্চ জমিদারদের সরকারিভাবে জানিয়েছিল – “ফকিরদের উৎপাতের ফলে রাজস্বের যে ক্ষতি হইয়াছে, আমাদের হিসাবে রাজশাহী জেলায় তাহার পরিমাণ ৮,৯৬৯ টাকা। আমরা মনে করি, চুক্তিবদ্ধ জমিদারগণ যে সকল দায়িত্ব বহন করিতে বাধ্য, এই ক্ষতি পূরণ তাহার মধ্যে একটি। কাজেই সরকার এই ক্ষতি সহ্য করুক – এই প্রস্তাবে আমরা সম্মতি দিতে পারি না।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃঃ ৩০) ১৭৮৭ সালের ২২শে জুন দিনাজপুরের কলেক্টর মুর্শিদাবাদের কলেক্টরকে চিঠি লিখছেন – “এই যুদ্ধে গ্রামবাসীরা ফকিরদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছে এবং বিপদের সময় ফকিরেরা যে ফেলে গিয়েছে তা সযত্নে রক্ষা করে পরে ফকিরগণ নিরাপদ স্থানে উপস্থিত হলে ফিরিয়ে দেবে।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃঃ ৩৯) এসময়কার গ্রাম উত্তাল হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন না মেনে। অবশ্য মানুষের চলমান জীবন স্রোতে এ বিভাজন কোনদিনই ছিলোনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় বড়ো জোর দিয়ে এ সত্যের উল্লেখ করেছেন।
আমরা এর সাথে “আনন্দমঠ”-এর স্বকপোলকল্পিত কাহিনীকে মেলানোর চেষ্টা করতে পারি। “আনন্দমঠ”-এ শেষ অবধি ইংরেজকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রীয় প্লট হিসেবে প্রকারান্তরে কাজ করেছে। ইতিহাসের ওপরে আরেক ইতিহাসের, কাহিনীর ওপরে আরো অনেক কাহিনীর স্তরায়ন হয়েছে। কিন্তু সাবঅল্টার্নদের স্বর রয়ে গেছে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে, লোকগাথায়। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সাবঅল্টার্নরা “কথা” বলতে পারে – উপনিবেশিক দেশেও – কখনো বিদ্রোহের ভাষায়, কখনো ভিন্ন স্বরে। সেসময়ের লোকগান বা কাহিনী আমার জানা সূত্রের মধ্যে নেই। কিন্তু সামাজিক উথাল-পাথাল অবস্থায় গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এবং প্রকাশে পরিবর্তন তো আসবেই। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষ যখন একে রেপ্রসেন্ট করেন তখন সমগ্র চিত্রনাট্যই নতুন করে লেখা হয় রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ঢঙে। তখন আর নিম্নবর্গের কোন কণ্ঠ, স্বর, ভাষ্য শোনা যাবেনা। ১৯৪৭-এর নান্দীমুখ হিসেবে এরকম আখ্যান একের পরে নির্মিত হতে থাকে, যার একঅর্থে চূড়ান্ত পরিণতি মর্মন্তুদ স্বাধীনতার অভিনব চিত্রনাট্যে। আমরা পরতে পরতে সে ঘটনা দেখবো এ প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে।
তখনো স্বাধীনতা হাতে এসে পৌঁছেনি ভারতীয় জনতার হাতে। জোর কদমে প্রস্তুতি চলছে। সেরকম এক সময়ে ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট নিয়ে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা আবুল কালাম আজাদ তাঁর India Wins Freedom গ্রন্থে লিখলেন – 16th August was a black day in the history of India. Mob violence unprecedented in the history of India plunged the great city of Calcutta into an orgy of bloodshed, murder and terror …. The streets were deserted and the city had the appearance of death.
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ” হয়ে উঠলো শেষ অবধি। শুধু এটুকু নয়। "স্বাধীনতা” এই শব্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল সাম্প্রদায়িক হত্যা, নারীদের ক্ষত-বিক্ষত ধর্ষিত দেহ, এমনকি পণবন্দীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। আজাদ বলছেন – It implied that partition was being accepted on the basis that in both India and Pakistan, there would be hostages who would be held responsible for the security of the minority community in the other state.
ভারতভূমির রাষ্ট্র হয়ে ওঠা
বাইরে থেকে রোপণ করা বা এনগ্র্যাফটেড আধুনিকতার যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষণীয় যে যেখানে ইউরোপের একটি বড়ো অংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, ভারতে তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েকটি দশকে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে যেভাবে ব্যক্তির অভ্যুদয়, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি-নাগরিকের সহাবস্থান, সমাজ বা কৌমের অবস্থান বিলুপ্ত হওয়া এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (সেক্যুলারিজম) পরিসর তৈরি হয়েছে ভারতে তা হয়নি। ভারতে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের রাজনৈতিক ক্ষমতা-চিহ্ন, নীচের স্তরের সামাজিক ক্ষমতা নয়। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, রয়েছে নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। সামাজিক পরিসরের জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার রাষ্ট্রিক ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর এবং কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক Occupy Wall Street” বা “Another World is Possible” কিংবা, বিশেষ করে, একেবারে হালের “#Black Lives Matter” আন্দোলনের কথা মনে পড়বে। এরকম একটি পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার, অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিক পরিসর অর্জন করে।
কিন্তু ভারতের মতো দেশে যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় ভিন্ন প্রেক্ষিতে এবং ভিন্ন উপাদান নিয়ে? রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি হয়ে ওঠে কেন্দ্রাভিমুখী। ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেলো অন্তর্লীন গঠনগত বিরোধ। অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে আধুনিক ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য আখ্যান সতীনাথ ভাদুড়ীর “ঢোঁড়াই চরিত-মানস”।
“অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জৎ বাড়ে, বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জৎ বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” “বোটের” সুতোয় রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনো নাগরিক হয়ে উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার এক আখ্যান। “বলান্টিয়ারদের” দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” ঢোঁড়াইয়ের মননে বা সাইকি-তে যোগসূত্র তৈরি হল “মহাৎমাজীর” সাথে – ইমাজিনড কমিউনিটিজ। এর অবস্থান আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে। ঢোঁড়াইয়ের ভিন্ন যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক ভারতের “পাক্কী” রাস্তার বাঁকে ঢোঁড়াই। কিন্তু তার নাগরিকতার মধ্যে রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান।
১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে অনুসৃত ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্যের উপাদানের মাঝে নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্রে নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer (পূর্ণসংখ্যা) হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশ অনুমোদিত নয়। মণিপুরী বা কাশ্মীরী বলে আলাদা কিছু হয়না। ওগুলো ভগ্নাংশ, পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়। এরকম এক সামাজিক মানসিকতা তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা। আবার পূর্ণসংখ্যা পজিটিভ হতে পারে। পূর্ণ সংখ্যা নেতিবাচকও হতে পারে। গোরখপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ কাফিল খান – সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ না থাকার ফলে কতগুলো বাচ্চা স্রেফ মরে গেলো, বাইরে থেকে অক্সিজেন জোগাড় করে ডাক্তারবাবু বাঁচালেন অনেকগুলো প্রাণ, তারপরে ৮ মাস জেল খাটলেন। এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে – আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা আর ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। কিন্তু নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা কখনো গৌরি লঙ্কেশ, কখনো কালবুর্গী, কখনো আখলাক, কখনো আসিফা, কখনো পানেসার নামে নিঃশেষ হয়ে যায়।
এসবের মাঝে অলক্ষ্যে নাগরিক পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে তার সঙ্কোচন ঘটেছে, রাজনৈতিক চরিত্রের পৌরুষীকরণ হচ্ছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলো বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে আপনমনে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম পাড়িয়েও দেওয়া হয়, যাকে বলে এথিকাল ট্র্যানকুইলাইজেশন (ethical tranquilization)।
কতসব অ-পূর্ণ রাশি! নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দি-অহিন্দি, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড-ডে মিলের ভারত! সবাইকে প্রকাশ করতে হবে পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? কিংবা চিহ্ন-জ্ঞাপক কোন শ্লোগান দিয়ে? শ্লোগান এবং নির্মিত কিছু শব্দসমষ্টি শুষে নেয় চিন্তাকে – যে চিন্তাহীনতাশূণ্য আনুগত্য দাবী করে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার অধীশ্বরের। যেমনটা “হীরক রাজার দেশে”-তে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। রাষ্ট্র তো বারেবারে একটি কথাই বলে, শেখায় আমাদের - হয় তুমি ভারতীয়, নয় তুমি ভারতীয় নও। আসাম আজ শিখছে সেকথা, অন্য প্রদেশগুলোও শিখে ফেলবে ভবিষ্যতের সময়ে। এর মাঝে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার নানা রকমের কৃৎ-কৌশল রয়েছে, আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী (spectcularization) করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে এগুলো নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়ে উঠবে।
শিক্ষকেরা হয়ে যাবে educational managers, শিক্ষাদান সংক্রান্ত নানারকমের টেকনিক্যাল কাজকর্ম সামলাবেন। ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোন জ্ঞানভিক্ষু হিসেবে অবস্থান তৈরি হবেনা। সিলেবাসও সেভাবে তৈরি হবে, যেমন সাম্প্রতিক দিল্লি বা জওহারলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। নতুন সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে যার ভিত্তিতে রয়েছে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকতা-নির্ভরতা, শুধুমাত্র বর্তমানকে যাপন করা। অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের লুম্পেনরা আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে। স্পষ্ট ভাষায় ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করবে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেবে “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যায়। আমাদের এতদিনের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছেনা। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে এমন নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীদের প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তাদেরকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
রবীন্দ্রনাথও এখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন। কর্পোরেট পুঁজির জগতে তিনি বেমানান। তাঁর সবাইকে নিয়ে সমাজ জীবন গড়ে থাকার চিন্তা অনুমোদন পাবেনা – হয় তুমি সুবোধ, সুশীল নাগরিক কিংবা সুবিশাল পণ্যবাজারের একরঙ্গা ভোক্তা। এভাবেই তো ইতিহাসের পুনর্লিখন হয়। ইতিহাসের পুনর্লিখন চলছে। ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করেছিলেন – “কুৎসিত বেশে সজ্জিত বর্বরতাপূর্ণ এই বৈষয়িকতা মানবিকতার বিরুদ্ধে এক প্রবল অভিশাপ, কারণ পূর্ণতার শক্তির উপরে ক্ষমতার প্রমত্ত আদর্শ চেপে বসেছে। … শক্তিমানের কাছে এই প্রলোভন যতটা সর্বনেশে, দুর্বলের কাছে তা আরও বেশি ভয়ঙ্কর। … আমাদের জীবন হয়ে উঠুক বহিরঙ্গে সহজ আর অন্তরঙ্গে মহীয়ান। আর্থিক শোষণ ও বিরোধের উপরে নয়, সামাজিক সহযোগের ভূমিতে আমাদের সভ্যতা দৃঢ়ভিত্তি লাভ করুক।” (ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ)
স্বাধীনতার অন্যতম প্রস্তুতি ছিল গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভোটকে ঘিরে। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে ঢোঁড়াই বুঝতে পারে – “অদ্ভুত জিনিষ এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জত বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে আগে হয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” (সতীনাথ ভাদুড়ি, ঢোঁড়াই চরিত-মানস) এখানে অব্যর্থভাবে মনে পড়বে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের Imagined Communities-এর কথা – “anonymous performance of citizenship”. কোন ভগ্নাংশে একে দেখা যাবেনা – হয় শূন্য কিংবা ১, এরকম পূর্ণ রাশিতে তোমার পরিচয়। তুমি একইসাথে ভারতীয় এবং বাংলাদেশী হতে পার না।
“গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থা তো একটি শক্তপোক্ত secularizing process – এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু জাতের সমস্যা, বিভাজন, পারস্পরিক হিংস্রতা রয়েই গেলো। আবার ঢোঁড়াইয়ে ফিরি – “আমাদের সাহায্যেই ভোটে কংগ্রেসি জিতেছিল আগেরবার। এবার তাই আমরা ঠিক করেছি কুর্মছত্রি, কুশবাহাছত্রি, আর যদুবংশছত্রি এই তিন জাত মিলে রাজপুত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব।” এর উত্তর ৬১ বছরেও মিললোনা। The answer my friend is blowing in the wind!
ঢোঁড়াই দেখেছিল – “পূবের দিকের টুরমেনের ফারমের সিধা রেল লাইনের কাছে কাঠের ইস্টিশন করেছে ফৌজের সাহেবরা। বড় বড় চালা তুলেছে সেখানে। গোরু, ঘোড়া, ছাগল, খচ্চর, ভেড়ায় ভরা। সব বেলুচি ফৌজ মুসলমান নইলে এত কসাই আর কে হবে। অথচ মুসলমানরা চটবে বলে উট আর শুয়োর রাখেনি সরকার।” সেনাবাহিনীতে সাম্প্রদায়িকীকরণের এই বিপদ পরে আবুল কালাম আজাদও অনুভব করেছিলেন – “This injected communal poison in the army which till then had been free from it.” আজাদ একথা বলছেন ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের অব্যবহিত আগে। ঢোঁড়াই আরো আগে একই বিষয় নিজের বাস্তবতা দিয়ে অনুভব করছে!
কিভাবে অখণ্ড ভারতবর্ষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের ক্ষমতার লোভে টুকরো টুকরো হল সে নিদারুণ ঘটনা বিস্তৃত জানার জন্য অন্তত তিনটি বইয়ের কথা উল্লেখ করবো – (১) জয়া চ্যাটার্জীর Bengal Divided এবং The Spoils of Partition, (২) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পলাশী থেকে পার্টিশন” এবং (৩) সুমিত সরকারের Modern India: 1885-1947।
কী হল তারপরে? উর্বশী বুটালিয়ার The Other Side of Silence-এ oral history, personal narrative, government documents ইত্যাদি সব নথিভুক্ত হয়েছে। তাঁর হিসেবে – “Twelve million people were displaced. Nearly one million died. Some 75,000 women were raped, kidnapped, abducted, forcibly impregnated by men of the ‘other’ religion, thousands of families were split apart, homes burnt down and destroyed, villages abandoned.” (p. 35) আরো মর্মান্তিক হল – “while abducted women then entered the realm of silence, women who were killed by families, or who took their own lives, entered the realm of martyrdom.” (p. 158) একদল নারীর যাত্রা পরম নৈঃশব্দে এবং বিস্মৃতিতে যাদের কোথাও কোন চিহ্ন নেই (স্রেফ মুছে গেলো), আরেকদল অর্জন করলো শহীদের মর্যাদা। স্বাধীনতার কী অট্টহাস্যময় পরিহাস!
বীণা দাস তাঁর “Transactions in the Construction of Pain” প্রবন্ধে জানাচ্ছেন – “The bodies of the women were surfaces on which texts were to be written and read – icons of the new nations.” কিন্তু বিপরীত ঘটনাও ঘটলো – “But women converted this passivity into agency by using metaphors of pregnancy…” নারী হবার কারণে তাকে ধর্ষিতা হতে হয়। আবার জারজ সন্তান গর্ভে ধারণ করার মধ্য দিয়ে তার মাতৃত্ব তথা সত্তা/identity তথা agency অর্জিত হয়। এ ছিল এক অদ্ভুত সন্ধিকাল। আজও আছে, শক্তভূমির ওপরেই আছে – ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন আখ্যানে, ভিন্ন version-এ।
পরিবার, নারীত্ব, চিরকালীন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, দেশহারা-ভূমিহারা-আশ্রয়হারা-নির্বান্ধব হবার তীক্ষ্ণ বর্ণনা ধরা আছে An Epic Unwritten: The Penguin Book of Partition Stories-এ। সাদাত হাসান মান্টোর “সাহে” গল্পে হিন্দুদের সাথে একসাথে সারাজীবন, বংশ পরম্পরায় বেড়ে ওঠা বন্ধু মুমতাজ শেষ অবধি লাহোর যাবার জাহাজে উঠে পড়লো। সেসময় “After his bags had all been taken to the cabin, he took us out onto the deck. For a long time he gazed out of the place where sky and sea came together. He then took Juggal’s hand in his and said, ‘How perfectly deceptive … this meeting of the sky and the sea, and yet so incredibly delightful too!’”
মান্টোর আরেকটি বিখ্যাত গল্প “টোবা টেক সিং”-এ পাগলা গারদের এক পাগল জিজ্ঞেস করে – If they were in India, where on earth was Pakistan? And if they were in Pakistan, then how come that until only the other day it was India?” অন্য একজন পাগল গাছের ওপরে উঠে পড়ে জানায় সে ভারত বা ভিন্ন কোন ভূমিখণ্ডে নেই – এক নিরালম্ব অবস্থা। গল্পের প্রধান চরিত্র বিষান সিং ১৫ বছর ধরে শুধু দাঁড়িয়েই ছিল। তারপরে তাকে যখন জোর করে ভারতে পাঠানো হবে তখন এই চূড়ান্ত মানসিক আর শারীরিক ধকল সে নিতে পারেনা, পড়ে থাকে তার প্রাণহীন দেহ – There behind the barbed wire, on one side, lay India and behind more barbed wire, on the other side, lay Pakistan. In between, on a bit of earth which had no name, lay Toba Tek Singh.” “নো ম্যান’স ল্যান্ডে” পড়ে রইলো মানুষটি যার কোন দেশ নেই। মান্টো তাঁর “সহায়” গল্পের (মূল উর্দু থেকে অনুবাদ সঞ্চারী সেন) শুরু করছেন এভাবে – “এমন কথা বলোনা যে এক লাখ হিন্দু আর এক লাখ মুসলমান মারা গেছে। দু লাখ মানুষ যে মারা গেছে সেটাও আসল ট্র্যাজেডি নয়। আসল ট্র্যাজেডি হল মৃত্যুগুলো খুব বেহিসেবি হয়েছে। এক লাখ হিন্দু মেরে মুসলমানরা ভেবেছিল হিন্দুধর্ম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা হয়নি, হিন্দুধর্ম রয়ে গেছে, রয়ে যাবে। তেমনি এক লাখ মুসলমান মেরে হিন্দুরাও আনন্দে বগল বাজিয়েছিল যে ইসলাম খতম হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব আপনাদের সামনে হাজির, ইসলামের গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি। তারা নির্বোধ, যারা মনে করে বন্দুক দিয়ে ধর্ম শিকার করা যায়। ধর্ম, ন্যায়, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এ সবকিছুই আমাদের শরীরে নয়, আত্মায় অবস্থান করে। ছুরি, কৃপাণ, গুলিতে এদের ধ্বংস করা যাবে কী করে?”
“রাইত কতো হইলো? উত্তর মেলে না!”
কৃষণ চন্দরের “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” গল্পটি একবার স্মরণ করি। পেশোয়ার এক্সপ্রেস এখানে নিজের মনে কাহিনী শোনায়। এক ট্রেন ভর্তি জবাই হওয়া হিন্দু ভারতে আসছে, ফিরতি ট্রেনে ট্রেনভর্তি হিন্দুদের হাতে কাটা মুসলিম দেহ নজরানা হিসেবে ফেরত যাচ্ছে। ট্রেনটি গোঙায়। অবশেষে সেই মেয়েটিকে পেয়ে গেলো দাঙ্গাবাজেরা – “মেয়েটি ওদের হাতে নিহত হল। জঙ্গলের শুকনো ঘাসের ওপর মেয়েটি ছটফট করতে করতে মারা গেল। আর তার হাতের বইখানা রঞ্জিত হল তারই দেহের রক্তে। বইটা ছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা।” জন স্ট্র্যাচির Why One Should Be A Socialist। “সে তো নারী ছিল। হতো কারও প্রিয়তমা অথবা জননী। আর এখন সে এই জঙ্গলে পড়ে আছে লাশ হয়ে। শকুন আর শেয়ালেরা তার লাশ ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা বইটা জানোয়ারেরা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। বিপ্লবের দরজা আর কেউ খুলছে না। কেউ কিছু বলছে না।”
আমাদের স্বাধীনতা পরিক্রমা আপাতত “শান্তি কল্যাণ” নিয়ে শেষ হল বেশ জবরভাবে বুঝতেই পারছেন। ৭৩ বছর পরেও বিস্মৃতির অতলান্ত গহ্বর থেকে উঠে আসা স্কন্ধ কাটা মানুষগুলো বারেবারে বেসামাল করে দেয়। শিকাগোর হে মার্কেটের শহীদ অগাস্ট স্পাইসের গলায় ফাঁসীর দড়িতে টান পড়ার আগে শেষ কথা ছিল – “The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.” (History As It Happened, p. 199)
আর আমাদের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের কানে মন্ত্রোচ্চারণ করেন –
“কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।”
ভারতরাষ্ট্রের বাকী ইতিহাসের ভগ্নাংশ
Engrafted (বা বাইরে থেকে রোপণ করা) মডার্নিটির যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সবাই মানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্রিটিশ জাত প্রায় ৩৫০ বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে ভারত সেসমস্ত ধাপ অতিক্রম করার জন্য পেয়েছে কয়েক দশক মাত্র। ফলে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (secularism) যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা ভারতে হয়নি। যেভাবে শ্রমিক তথা মার্ক্সের ধারণানুযায়ী সর্বাহারা শ্রেণীর এবং পুঁজির সাথে শ্রমের টানাপড়েন থেকেছে বিভিন্ন স্তরে, যেভাবে দেশগত ভিন্নতা থাকা সত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও শ্রেণী সম্পর্কের মানুষের একটি পাব্লিক ডিসকোর্সের পরিসর তৈরি হয়েছে, যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে সমাজ জীবন থেকে অপসৃত হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে সেসব তো এখানে হয়নি। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগলিক ভূখণ্ডে সামন্ত রাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতি শ্রেণী, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করেছে ১৯৪৭ পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষ।
এধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতা চিহ্ন। এরকম এক ঐতিহাসিকতায় প্রধানত কৃষি সম্পর্কে আবদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রে মডার্নিটি বা আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে engrafted হয়ে যায়, ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক পরিবর্তন ও গতিশীলতার (social and historical dynamics) নিয়মে জন্ম নেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার যে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষে তা প্রায়-সম্পূর্ণ ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংবিধানের ধারায় তৈরি হওয়া। বিশেষ করে আমরা যদি দুটি বিষয় একবার স্মরণ করে নিতে পারি – (১) ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ স্বয়ং গান্ধী তাঁর নিজের জীবনের ক্ষেত্রে একাধিকবার দুটি passion-এর কথা বলেছেন। প্রথমটি হল ব্রিটিশ সংবিধান (Pax Britannica-ও বটে) এবং দ্বিতীয়টি নার্সিং বা শুশ্রূষা। (২) প্রধানত শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে সমাজ এবং কৌমের ধারণা খসে গেছে প্রায় ৩০০ বছর জুড়ে। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক – অধিকার এবং কর্তব্যের বাঁধনে, cash nexus-এর প্রবল উপস্থিতিতে। এখানে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, যা আছে তা নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। ডেমোক্রাসির স্বর্ণযুগে কিংবা সামাজিক পরিসরের সবল, জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে – indiscernible থেকে discernible হয়ে ওঠে, invisibility থেকে visibility-র স্তরে উঠে আসে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলনের কথা কিংবা হালে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে সাদা-কালো-পীত নির্বিশেষে আন্দোলনে উত্তাল করে দেওয়া আমেরিকার কথা। মাথায় রাখি কিশোরী গ্রেটা থুর্নবার্গের ঢেউ তোলা – ট্রাম্পের দরজায় বসে।
এরকম একটা পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার কিংবা অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিকভাবে মান্যতা, গ্রাহ্যতা পায়। বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে।
কিন্তু সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাই যদি ভিন্নধর্মী হয়? যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্ত রাজা ও এর উপযোগী পরিব্যাপ্ত মানসিকতা, কৃষি শ্রম, শিল্পীয় শ্রম, শিক্ষিত জায়মান নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পর্বে গড়ে ওঠা ছোট বা স্বাধীন পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে জাতিসত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে? রাষ্ট্রের তৈরি করা আধুনিকতার একটি এবং একমাত্র ভাষ্যেই এদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি সবসময়েই কেন্দ্রাভিমুখী। প্রান্ত এখানে প্রান্তিক, কখনো ব্রাত্যও বটে। অসংখ্য দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত রেখে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য চলমান চরিত্র (দলিলও বলা যেতে পারে) সতীনাথ ভাদুড়ীর সৃষ্টি ঢোঁড়াই – এ কথা আগে আলোচনা করেছি। এরকম দলেই পড়বে আমার মতো সুশীল, সুবোধ, গোপাল-বালক গোছের মানুষজন।
সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Truths and Lies about Nationalism, as narrated by Carvak (২০২১) গ্রন্থে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন – “The first truth is that the states came into the Indian federation in ways that were often very different ... In a few cases, such as Jungadh, a plebiscite was held, although for Jammu and Kasmir it was not ... I keep reminding you, the state (rājya) is not identical to the nation (raṣṭra).” (পৃঃ ২২৩-২২৪)
যাহোক, ঢোঁড়াই বড়ো মুশকিলে পড়ছিল ওর জীবনটাকে নিয়ে। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই ধীরে ধীরে বুঝেছে, আত্মস্থ করেছে অজানা সব অভিজ্ঞতা – “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জৎ বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে হয়ে গিয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জৎ বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” ঢোঁড়াইয়ের ইজ্জৎ সারা গাঁয়ের ইজ্জৎ হয়ে যায়। “বোটের” সুতোয় রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনো নাগরিক হয়ে উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার এক আখ্যান। আরেক আখ্যান তৈরি হচ্ছে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে চলা নতুন ভারতবর্ষের মধ্যে।
“বলান্টিয়ারদের” দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” আধুনিকতার নতুন কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক ডিসকোর্সে ঢুকে পড়ছে ঢোঁড়াইয়ের মতো প্রান্তিক মানুষ ও অঞ্চল – নিজস্ব সমাজ ও কৌম বোধ নিয়ে। এটা ব্রিটিশের জগতে জন্ম নেওয়া ইউরোপীয় আধুনিকতার চেহারা নয়, এর অবস্থান ইউরোপীয় আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে।
পরবর্তীতে ঢোঁড়াইয়ের অন্য এক যাত্রা শুরু হয়। “এই নিঃসীম রিক্ত জগৎটার মধ্যে ‘পাক্কী’ না কী নামের যেন একটা অপরিচিত রাস্তা দিয়ে সে চলছে।” আধুনিক ভারতের “পাক্কী” রাস্তার বাঁকে ঢোঁড়াই – ভারতের উন্নয়নের কুল চিহ্ন (insignia)। কিন্তু তার নাগরিকতার মধ্যে রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান, যদিও রাষ্ট্র তাকে গ্রহণ করবে একক integer হিসেবেই। রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেলো অন্তর্লীন বিরোধ। ইটি আব্রাহাম অল্প কথায় সমস্যাটাকে এভাবে বুঝেছেন – “Within these new spaces, a logic different from the representation of India as ‘traditional’ was meant to operate. These new spaces would be rationalized, scientifically ordered spaces filled with individuals who, having shed personal religious or sectarian loyalties would identify primarily as a modern man – in a word, ‘Indian’.” (The Making of the Indian Atomic Bomb, p. 21) নিজের সত্তা, অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, ভগ্নাংশকে অন্তর্লীন রেখে ঢোঁড়াইয়ের মতো অগণন মানুষের আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী integer হয়ে ওঠার সংকট প্রসারিত হতে থাকবে সামাজিক বিভিন্ন স্তরে।
ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্য, যা আমাদের দেশে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে অনুসৃত হচ্ছিল, তার উপাদানের মাঝে (matrix) নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের মতো নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer বা পূর্ণ সংখ্যা হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশের কোন জায়গা নেই। উদো-বুধোর ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, এসব ভাবার কোন অবকাশই নেই। মণিপুরী বা কাশ্মীরী বলে আবার আলাদা কিছু হয় নাকি? এগুলো তো ভগ্নাংশ। পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়।
এরকম এক social psyche তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা এবং disciplinary time তথা শৃঙ্খলাবদ্ধ সময়। আবার পূর্ণ সংখ্যা পজিটিভ বা ইতিবাচক হতে পারে, যেমন স্থিতধী, প্রজ্ঞাবতী-প্রজ্ঞাবান সব নাগরিক। পূর্ণ সংখ্যা নেগেটিভও (নেতিবাচক) হতে পারে।
এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে numbing of collective consciousness – বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা, যাকে বলে historical and social amnesia – ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। এই বিস্মরণের জোরেই কিনা ডঃ কাফিল খানের ভাই যে “অজ্ঞাত পরিচয়” দুষ্কৃতির হাতে মারা গেলো সে কথা বোধ করি আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। পূর্ণ সংখ্যা মানে পজিটিভ পূর্ণসংখ্যা – একখানা গোটা, আস্ত নাগরিক। কিন্তু নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা কেমন অদ্ভুতভাবে পৃথিবী থেকে, মনুষ্য সমাজ থেকে একে একে খসে পড়তে থাকে। কী লম্বা মিছিল দেখুন। আমিও দেখি। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী? কী আর হবে! আমাদের যাপিত সময়ের জাগ্রত বিবেক শঙ্খ ঘোষ স্মরণ করিয়ে দেন –
“আর সব উন্নয়ন পরিত্রাণ ঘূর্ণমান অগণ্য বিপণি দেশ জুড়ে
যা দেয় তা নেবার যোগ্য নয়
আমাদের চেতনাই ক্রমে অস্পষ্ট করে সাহায্যের হাত …..
লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।”
স্মরণ করিয়ে দেন –
“বেঁধেছ বেশ করেছ
কী এমন মস্ত ক্ষতি
গারদে বয়েস গেল
তাছাড়া গতরখানাও
বাবুদের কব্জা হল
হল তো বেশ, তাতে কি
বাবুদের লজ্জা হল?”
হল কী সত্যিই? এসবের মাঝে নিঃসাড়ে গণ পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে, তার রাজনৈতিক চরিত্রের masculinization তথা পৌরুষীকরণ ঘটেছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলোকে অল্প অল্প করে দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে (ethical tranquilization)।
কি বিচিত্র বিষয় ভেবে দেখি একবার! নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দি-অহিন্দি, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, আলোর ভারত-আলো-আঁধারির ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড ডে মিলের ভারত! উফ, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এত্তো এত্তো ভারতকে মনে রাখতে হবে? সবাইকে প্রকাশ করতে হবে “তোমারই প্রকাশ হোক”-এর মতো পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? আমার পরিচালক রাষ্ট্র তো সে কথাই বলছে।
“আমরা তো অল্পে খুশি
কি হবে দুঃখ করে
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাত কাপড়ে!”
আবার এক ডিসকোর্স তৈরি হয়ে চলেছে – হ্যাঁ-ভোটার আর না-ভোটার-এর দ্বিত্বতায়। অস্যার্থ, তুমি আধুনিক, থুড়ি, বিদ্যমান রাষ্ট্রের নিয়ম-টিয়ম মানো তো? প্রমাণপত্র আছেতো? আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রথম যুগে মানে ইউরোপে যখন এলায়িত সামন্ত রাজ্য/রাষ্ট্রগুলো নতুন করে জুড়ে এবং বিন্যস্ত হয়ে ধীরে ধীরে আধুনিক শিল্পনির্ভর জাতীয় রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সেসময় থেকেই তো অস্তিত্বের অন্যসব স্তর তলিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নাগরিক সত্তার মাঝে। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে, তার নিজস্ব আইনকানুন নিয়ে একটি রাষ্ট্র – বহুলাংশেই জনমতের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (যাকে এখন অ্যাকাডেমিক জগতের ভাষায় বলে “manufacturing consent”)।
আরো একধাপ এগিয়ে আবার আমার আপনার মতো কোন অর্বাচীন, অকালপক্ব, অর্ধশিক্ষিত দেখে এর মাঝে hegemony তথা মান্যতা নিয়ে টিকে থাকবার নানা রকমের কৃৎ-কৌশল রয়েছে। কৃৎ-কৌশল রয়েছে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্রের হয়ে ওঠার চারিত্র্য-লক্ষণের মধ্যে, আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার মাঝে – শব্দে, চিত্রকল্পে, প্রাত্যহিক সংলাপে। এমনকি অসহিষ্ণুতার সন্ত্রাস গড়ে তোলার মাঝে। হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী করে তুলতে হবে (spectacularized violence)। ধীরে ধীরে এগুলোকে সহনীয় হয়ে যাবে। নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়েও যায়। আমরা desensitized হয়ে যাই – নিঃসাড়ে।
যাকে পছন্দ করিনা তাকে ‘দানব’ বানিয়ে দাও (demonization), শিক্ষা থেকে থেকে সরিয়ে দাও প্রশ্ন করার সাহস, উৎসাহ এবং পরিসর। শিক্ষকেরা হয়ে যাক educational managers, ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার লক্ষ্যে কোন জ্ঞানভিক্ষু নয়।
একটি সংস্কৃতির জন্ম হবে যার ভিত্তি হবে কেবল তাৎক্ষণিকতা-নির্ভর, শুধুমাত্র বর্তমানকে চিনি বুঝি যাপন করি, অন্য কিছু নয়। অতীতের এবং ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ হবে। সমাজের অন্ধকার জগৎ (যাদেরকে চালু ভাষায় লুম্পেন বলা হয়) আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে।
ভিন্ন প্রেক্ষিতে সমধর্মী এক পরিস্থিতি দেখেছিলেন ফ্রানজ ফ্যানঁ (Frantz Fanon) তাঁর The Wretched of the Earth পুস্তকে। তিনি দেখেছিলেন – “The very same people who had it constantly drummed into them that the only language they understood was that of force, now decide to express themselves with force.”
এরকম এক বিশেষ সময়ে নবারুণের সৃষ্টি আমাদের চেনা “ফ্যাতাড়ু”রা আর অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারেনা। এরা নিজেরাই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার (assimilation) অংশীদার হয়ে যায়। এরা হিংসা আর শক্তি প্রদর্শনের extra-judiciary, extra-state হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এরা “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”-র সৌম্যকান্তি পাগল চরিত্রটির মতো দুর্বোধ্য “গ্যাৎচরেৎশালা” উচ্চারণ করেনা। এরা স্পষ্ট ভাষায় হিংসা-ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেয় “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যেতে থাকে। আমাদের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে আধুনিকতার এই গল্পগুলো ঠিক তৈরি হচ্ছেনা। ঘটনাচক্রে অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত “কালো” শক্তির হাতে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বেচারা বিদ্যাসাগর। তিনি এই চলমান ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে গেছেন – এতদিন বাদে, হয়তো বা রূপকার্থে।
আমরা বিলক্ষণ জানি, রাজনৈতিক লুম্পেনিকরণ বহুদিন ধরেই চলছে। আমাদের বিবেক, মনন, চেতনা বিদ্ধ হলেও, রক্তাক্ত হলেও আমরা মেনে নিয়েছি বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের আচরণ করছে তাই নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীর প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তাকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই বিচার যদি পার্টি বা দলের বিচার হয়? কিংবা যদি বিচারের আঙ্গিনায় প্রধান পুরুষ হয়ে দেখা দেয় রাষ্ট্রের প্রসারিত রাজশক্তির পৌরুষ – invisible এবং indiscernible বহুদূরের প্রান্তজন মানুষটির পরিবর্তে? তখন তো ঔপনিবেশিক কালের মতোই বিচারের বাণী নীরবে চোখের জল ফেলতেই পারে। অথচ আমরা কথা বলছি আধুনিকতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে। গণতন্ত্রের এমনই দ্বৈত সত্তা!
বর্তমানের যাপিত সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত স্তম্ভগুলোকে যদি স্মারকচিহ্নের স্তরে নামিয়ে আনা যায় তাহলে পার্টি এবং বকলমে রাষ্ট্র লালিত extra-judiciary এবং extra-democratic institutions-এর ধারণা জনমানসে নিঃসাড়ে চারিয়ে যায়। লুম্পেনরাজ ঘোষিতভাবে সমাজের চলন, নীতি, নৈতিকতা, ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি পরিসর - সবকিছু নির্ধারণ করবে। আমরা তো জানিই “শীতলকুচি করে দেবো” বা “রগড়ে দেবো” বা “অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড” গড়ে তোলার মতো প্রবল প্রত্যয় এবং অমৃত তথা স্বস্তিবচন। আমরা ধীরে ধীরে সইয়ে নিচ্ছি নিজেদের? এরকম এক সুবোধ, সুশীল “ফ্যাতাড়ু”বাহিনী পেলে আর কারা অন্তর্ঘাত ঘটাবে? এদেরকেইতো নবনির্মিত রাষ্ট্রের প্রয়োজন বা এভাবেই গড়ে নেবে। কিছু নির্মিত চিহ্ন বা শ্লোগানের প্রতি বশ্যতা ও আনুগত্য বোঝাবে পছন্দমতো-গড়ে-নেওয়া দেশ নামক ভূখণ্ডের নাগরিক বা না-নাগরিক।
এখানেই রাষ্ট্র, পার্টি ও প্রচলিত আখ্যানের বাইরে গিয়ে জরুরী হয়ে পড়ে একটি তৃতীয় পরিসর গড়ে তোলা। জরুরী অবস্থার সময়ে ভারত জুড়ে পার্টি অস্তিত্বকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপী তৃতীয় পরিসর জন্ম নিয়েছিল। এই তৃতীয় বা নাগরিক পরিসর নতুন চিন্তন, সৃষ্টিতরঙ্গ, নতুন কমরেডশিপকে বাস্তবের মাটিতে জীবন্ত চেহারা দিয়েছিল। এই তৃতীয় তথা নাগরিক পরিসরের সজীব উপস্থিতি জেলে অবরুদ্ধ কংসারী হালদারকে নির্বাচনী লড়াই জিতিয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ বা ১৯৮৮-৮৯-এর পশ্চিমবঙ্গে বন্দীমুক্তি আন্দোলনকে সফল করেছে। নন্দীগ্রামের নরহত্যার পরে লাখো লোকের দৃপ্ত পদচারণা পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে। নাগরিক পরিসর না থাকা বা ক্রম-সংকুচিত হবার জন্য আজ দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের চিত্র ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গের চিত্র এখনো খানিকটা ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে।
ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর ফ্যান্টম পাবলিক গ্রন্থে বলেছিলেন - “Since the general opinions of large numbers of persons are almost certain to be a vague and confusing medley, action cannot be taken until these opinions have been factored down, canalized, compressed and made uniform. The making of one general will out of multitude of general wishes is not an Hegelian mystery, as so many social philosophers have imagined, but an art well known to leaders, politicians and steering committees. It consists essentially in the use of symbols which assemble emotions after they have been detached from their ideas.”
আমাদের ভারতে তৃতীয় পরিসর বা নাগরিক পরিসর (কিংবা অন্য অর্থে বাম পরিসরও বটে) আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে, হবে – নতুন রাজনীতির নিয়মে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা “চোখে আঙ্গুল দাদা!” বেচারা ধর্ম-নির্লিপ্ত, মানুষকে নিয়ে বেঁচে থাকা বিদ্যাসাগর। তুমি কে? ইতিহাসের তো পুনর্লিখন চলছে। অনেক নতুন বীর আর শহীদ গড়ে উঠবে। তোমার সামনে নেচে-কুঁদে বেড়াবে। বাঙ্গালী, বাংলা তথা ভারত বর্তমানের প্রয়োজনেই তোমাকে ভুলে যাবে। নতুন ইতিহাস গড়ে উঠছে!
তবে এই "নতুন" ইতিহাসের মাঝে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে “নো ভোট টু বিজেপি”, কৃষকদের জেদি একমুখী আন্দোলন বা “রেড ভলান্টিয়ার”দের প্রচেষ্টা তৃতীয় পরিসরের বাস্তব দিগন্ত উন্মোচিত করছে। একে বাঁচাতে হবে। ফ্যান্টম পাবলিক নয়, রক্তমাংসের বারেবারে হেরে যাওয়া, সর্বস্ব খুইয়ে সাধারণ মানুষ একে বাঁচাবে – ভোটের রাজনীতির জনপিণ্ড নয়।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত পুস্তকে নাস্তিক চার্বাকের (মুনি) মুখ দিয়ে লেখক আমাদের জানাচ্ছেন – “I am asking you to speak against this attempt to impose on the whole country a single, thoroughly politicized, Hindu religion as the life national culture … I believe writers and artists working in the various regional languages prepared the ground on which politicians and lawyers constructed the Indian republic.” (পৃঃ ৩১৭-৩১৯)
এ চাহিদা বর্তমান সময়ের চাহিদা। এ দাবী বর্তমান সময়ের দাবী!