দ্বিতীয় কবিতার বই - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের 'আলির কবিতা' তুলনায় মিতায়তনিক। বইটা অধিকাংশ চতুর্দশপদী সনেট এবং দুটো ভিলানেল নিয়ে তৈরি। চতুর্দশপদীগুলো নানারকম গঠনের - ৪ + ৪ + ৪ + ২ , ৩ + ৩ + ৩ + ৩ + ২ , ৮ + ৬ ইত্যাদি। কিন্তু এই বইয়েরও পাতায় পাতায় ছন্দের আড়ালে আলির মত অনেক বিপজ্জনক কিন্তু অনিবার্য চরিত্রদের গল্প ছড়ানো ছিটোনো। সেইসব গল্প বলার ক্ষেত্রে বিশ্বজিৎ বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন তারিখ, বার অথবা ঘড়ির কাঁটার ওপর -
[১]
পিজির বারান্দা থেকে দেখা যায় বৈশাখের রোদ
ধীরে ধীরে সরে যায় উডবার্ন ওয়ার্ডের দিকে
তারপর একদিন এপ্রিলের একুশ তারিখে
শোনা গেল তুমি নেই , কেউ যেন বাজায় সরোদ
ভুল সুরে, মনে হয়, মন দিয়ে বাজাতে শেখেনি
[২]
১২ আগস্ট মানে জন্মদিন ! দাতা বা গ্রহীতা
কেউ কি জানেন, কেন ভেঙে গেল গোপনে গিটার ?
[৩]
বর্ষাকাল বৃষ্টি কম পুরনো পাঁচিল
তোমার দুহাত ছেড়ে নতুন শহরে
সোমবার অন্ধকার তিনটের পরে
ময়ূরী অসুখ নিয়ে ঘরে একা ছিল।
এসব কবিতার লাইনে বিশ্বজিৎ আসলে পরতে পরতে রহস্য তৈরী করেন , কোনও সদুত্তর দেন না। তুমি মানে কে ? বারই আগস্ট কার জন্মদিন ?
এক কবিতায় দেখি -
ক্লাসরুম ছিল গুঞ্জনে ভরা, রৌদ্রকরোজ্জ্বল
দীনেশ বাবুর ভর্ৎসনা ভুলে কবিতা লেখার ক্লাস
ডায়রিতে টোকা আল মাহমুদ, রবিশংকর বল
তারপর সেখান থেকে দৌড়ে ঢুকে পড়ি আরেকটা রহস্যময় কবিতায় -
পুলকার থেকে নেমে ডানদিকে রেহানার বাসা
সরলরেখাও নাকি বক্র হয় .. বাকিটা কুয়াশা।
সেখান থেকে 'শালিনীর পাখি' কবিতায় লাফিয়ে যাই -
মা গেছেন শুক্লপক্ষে, ফাঁকা বাড়ি ফোটো থেকে বাবা
নিঃশব্দে সংকেত দিচ্ছে, কেউ নেই; বারান্দায় ঝুঁকে
শালিনীও উড়ে যাবে, সিঁদুরের গুঁড়ো লেগে মুখে
খোলা পিঠে রক্তছাপ, বাঘ নয় -স্বপনের থাবা।
ভিলানেল উনিশ লাইনের - ৩ + ৩ +৩ +৩ +৩+ ৪। একটা ভিলানেলে আছে কবি গৌতম বসুর প্রসঙ্গ।
এছাড়া আরেকটা কবিতা [চতুর্দশপদী] লেখা হয়েছে কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর স্মৃতিতে, যার শেষ দুটো লাইন -
একটি যাপন , কবিতা লেখার বাড়ি
কবিতারা আছে , তুমি মহাকাশচারী।
বিশ্বজিৎের কবিতাদের আরেকটি মূল অনুষঙ্গ মৃত্যু -
[১]
ডেকেছ বলেই যাচ্ছি, জানি তুমি মৃত
মৃত্যুর মতন আসে, পিছু পিছু শীতও
[২]
মৃত্যু এসে তাগাদা দেয় এবার বাড়ি চলো
বাড়ি কোথায় খোলা আকাশ পাথর ধুলো বালি
একটি লেখা দাঁড়ায় পথে বারণ করে খালি
পাথর শুধু পাথর নেই একটি কণা জল ও
[৩]
শান্ত মাছ লাল সাপ সিঁড়ি ও অতল
বন্ধ ঘরে ড্রপ খাচ্ছে মৃত্যু আর বল।
কবিতার বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখা সবসময়ই কঠিন , কারণ যতগুলো কবিতার অংশ এখানে তোলবার চেষ্টা করলাম , তার থেকে অনেক বেশি আসলে বাকি থেকে গেল। এককের বন্ধু ফ্যাচার ভাষায় - "নিজের লেখা কবিতা দুভাবে বাতিল করা যায়। এক হল গোল্লা পাকিয়ে ডাস্টবিনে। আরেক - সাজিয়ে গুছিয়ে ছেপে ফেলে।" এই দুটো বইয়ের পান্ডুলিপি যে গোল্লা পাকিয়ে ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি, তার জন্য আবহমান বাংলা কবিতাই লাভবান হয়েছে। কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়াই রোজকার কাজের ফাঁকে লিখে রাখা টুকরো টুকরো ব্যক্তিগত অনুভূতিমালা যেন নিয়ন আলোয় দুটো সুন্দর সাজানো গোছানো কবিতার বই হয়ে উঠেছে।