এমন হয় না যে অংক হয়েছে কিন্তু এক নাম্বার কেটে দিছে? কাহিনী কী? সমীকরণ মেলানোর পরে প্রমাণিত লেখা হয় নাই! কিন্ডারগার্টেনে লেখার শেষে ফুলস্টপ দেয় নাই বলে দিল অর্ধেক নাম্বার কেটে! ওই রকমই প্রায়, মেসি সেরা এইটা কালকে কাপ না পেলেও সত্যই থাকত। কিন্তু ওই যে একটু ক্যামন যেন হয়ে যেত। ক্যামন ক্যামন হয়ে যাওয়াটাই কালকে উড়ে গেল। আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা এত বছর কাপের জন্য খেলি না বা কাপের জন্য সমর্থন করি না যতই বলুক, সবাই কাপের জন্যই খেলে এইটাই শেষ কথা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আর্জেন্টিনাকে ধর্মের মত করে সমর্থন দিয়ে গেছে? কেন সমর্থন করে তাও জানে না। এক মডেল না অভিনেতাকে দেখলাম সাক্ষাৎকারে বলতেছে ও না কি ম্যারাডোনার খেলা দেখে আর্জেন্টিনা সমর্থন করে! কবে দেখল খেলা? বলে ৯৮ বিশ্বকাপে! অনেকের অবস্থাই এমন। মেসির জন্য আর্জেন্টিনা সমর্থন করাও যায় এইটাও জানে না। কারণ মেসির খেলাও দেখে নাই। যে মেসির উত্থানের সময়কার খেলা দেখে নাই তার পক্ষে আসলেই বুঝা সম্ভব না মেসি আসলে কী জিনিস, কেন সেরাদের সেরার কাতারে চলে গেল সে। মেসি গারদিওলার রসায়ন যে না দেখছে তার জন্য একটু অনুশোচনা। জাতীয় দলে মেসি যে কত নিষ্প্রভ ছিল এত বছর তা আগের ওই মেসিকে যে না দেখেছে তাকে বুঝানো সম্ভব না। সেই সময়ের মেসির অনেকটাই গতকাল দেখা গেছে, এই বিশ্বকাপে নানা সময়েই দেখা গেছে। মেসির সেই ক্ষুধা, অমরত্বের হাতছানিই যেন এবার উজাড় করে দিয়েছে।
কালকের জয় শুধু মেসির শ্রেষ্ঠত্বের জন্য না, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের জন্যও জরুরি ছিল। ৩৬ বছর কাপ পায় নাই একটা দল। এমন না যে দলটা উরুগুয়ের মত হারিয়ে যাওয়া দল। ভাল দল কিন্তু কই জানি গড়বড় করে ফেলে কাপ নেওয়া হয়। বিপক্ষের তীব্র বিদ্রূপের জবাবে গলার জোর ছিল প্রধান অস্ত্র। জন্মের পরে কাপ নিতে দেখছস? এই কথার উত্তর কী? আমার নিজের ৯৪ সালের খেলার কথা তেমন মনে নাই, ফাইনালে ব্যাজিও পোস্টের অনেক উঁচু দিয় মেরে ইতালিকে হারিয়ে দিছিল, এইটা ঠিক মনে আছে না পরবর্তীতে সিনেমা ডকুমেন্টারি, ভিডিও দেখে জানি তাও ঠিক মনে নাই। ৯৮ বিশ্বকাপের কথা হালকা পাতালা মনে আছে। পরিষ্কার মনে আছে ২০০২ সালের কথা। পরিবার থেকে বিদ্রোহ করে আমি তখন ইংল্যান্ডের সমর্থক, আমাদের বাড়ির চৌদ্দ গোষ্ঠী ব্রাজিলের সমর্থক! আমি তখনই সবাই যা করে তার থেকে বের হতে চাচ্ছিলাম। আর ছিল ব্যাকহাম নামের এক খেলোয়াড়, যে কারণেই হোক আমি তার মুগ্ধ ভক্ত হয়ে গেলাম। ব্রাজিল সমর্থকেরা সেবারও কাপ জিতার স্বাদ পেয়ে গেল! স্বভাবতই অন্তত আমাদের বয়সই আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা জন্মের পরে কাপ দেখছস প্রশ্নের সম্মুখীন হতে থাকল নিয়ম করে! এখন অবশ্য জন্মের পরে কাপ দেখছস কথা ব্রাজিল সমর্থকদেরও শুনতে হচ্ছে! তবুও আর্জেন্টিনার কষ্টের কাছে কিছুই না। আরও যন্ত্রণা ৩৬ বছর আগের যে কাপ তাও ম্যারাডোনার হাত দিয়ে দেওয়া গোলের কলঙ্ক লেগে আছে। সমর্থকদের জন্য, এমন অন্ধ ভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য একটা কাপ জেতা খুব জরুরি ছিল। কালকে সমর্থকদের শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়ে দিয়েছে মেসি ইতিহাসের সেরা ফাইনাল জিতে।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে বলি। ৩৬ বছর কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরে কাপ জেতা না, এর আগে ৪৪ বছর অপেক্ষা করে কাপ জিতেছিল ইতালি। কাপ না জিতলেও সমর্থকরা সমর্থন দেওয়া বাদ দিয়েছে এমন না। ইতালির সমর্থক তখনও ছিল, দুইবার টানা বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়ার পরে এখনও আছে। এইটাই সম্ভবত ফুটবলের সৌন্দর্য। মানুষ ফুটবলকে ধর্মের মত মানে। কোন প্রশ্ন নাই, কোন যুক্তি নাই, কোন প্রাপ্তি নাই, শুধুই দিয়ে যাওয়া, মেনে যাওয়া। ধর্ম মরলে পরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখায়, ফুটবল তাও করে না, তবুও অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাওয়া। ধার্মিকদের মতই ফুটবল সমর্থকেরা আচারন করে যখন আমি বলি প্রচলিত দল গুলার বাহিরে কোন একটা দলকে সমর্থন করি! কিংবা আমি ফুটবলের সৌন্দর্যকেই উপভোগ করি, কোন নির্দিষ্ট দলের প্রতি আলাদা সমর্থন নাই! যদি বলি আমি অংক মুখস্ত করি নাই, সূত্রটা জানা, তাই সব অংকই করতে পারি। আমার কোন একটা দলকে সমর্থন করার প্রয়োজন নাই, আমি খেলাটাকেই ভালবাসি, তাই যে ভাল খেলে, এমন কী যে খারাপ খেলে তাকেও সমর্থন দিতে পারি, আমার খেয়ালে, আমার মর্জিতে। হয়ত একটা খেলোয়াড়ের জন্য, হয়ত কোচের জন্য, হয়ত গরিব দেশ বলে, হয়ত আমার মনে হয়েছে আমি সমর্থন দিলেই এই দলটা একদিন ভাল করবে, ওরা বসেই আছে আমার সমর্থনের জন্য। আমি পারি, ব্রাজিলের খেলার দিন অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিতে। কালকে আক্ষরিক অর্থেই মেসির জন্য কান্না এসে যাচ্ছিল যখন তিন তিন গোলে সমান হয়ে গেল খেলা শেষের কয়েক মিনিট আগে। আমি পারি, অনেকেই পারে না, বেশির ভাগই পারে না। ধার্মিকরা যেমন ক্ষেপে যায়, অভিশাপ দেয়, মরলে পরে নরক বাসের হুমকি দেয় কিংবা মেরে পাঠিয়ে দিতে চায় নরকে, অনেকটা তেমনই করে ফুটবল ধর্মের অনুসারীরা। তবে পরলৌকিক প্রত্যাশা নাই বলে মনে হয় এরা অত খ্যাপা না, অন্তত মারধর করে না। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে ছাড়ে না, এই আর কী!
সূত্রটা শেখা জরুরি। ফুটবল খেলটাকে যদি ঠিকঠাক ভালবাসতে পারেন তাহলেই হবে, সব দলের সৌন্দর্যই চোখে পড়বে। আমরা দল কানা হতে না করি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে। বা অন্য যে কোন ব্যাপারেই বলি এক পক্ষের যেন না হয়ে যাই আমরা, বলি সত্যটা জানা জরুরি, বলি জেনে বুঝে পক্ষ নিন। আর আমরাই এক দলের পক্ষে গলাবাজি করে যাই, তখন কেউ বলে না দল কানা হইও না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে দল কানা রোগ বাসা বাঁধে, কে জানে তার শুরু এখান থেকেই হয় কি না।
মেসির জন্য শুভ কামনা। আর্জেন্টিনার জন্য শুভ কামনা। ল্যাটিন ফুটবলের জন্য শুভ কামনা। আগামীর সুপার স্টার এমবাপ্পের জন্য শুভ কামনা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।