এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপর বাংলা

  • চা শ্রমিকদের রক্ত ঘামের দাম! 

    কিংবদন্তি লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১৩১৫ বার পঠিত
  • চা শ্রমিকদের লেখব লেখব ভাবছি বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু আমি এত কম জানি এই বিষয়ে যে ভয় হয় লিখতে। তবে কম জানলেও সাধারণ জ্ঞানে বুঝা যায় যা হচ্ছে তা কোনমতেই স্বাভাবিক না। বর্তমান সময়ে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে কীভাবে কেউ কাজ করবে এমন আশা কেউ করে? অমানবিক না? তারপরেও কাজ করছে, কেন করছে? কতটা অসহায় হলে কেউ এরপরেও এই কাজ করে? মালিক পক্ষ জেনে গেছে এদের আসলে যাওয়ার আর জায়গা নেই, তাই আমি যা দিব তাই নিয়েই সে কাজ করে যাবে দিনের পড় দিন। কতটা অমানবিক হলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়!
    দিন মজুর বিষয়টা সভ্য সমাজের চোখে ধরা পরে না। সভ্য সমাজ যখন ঘুম থেকে উঠে তখন অফিসে যেতে যেতে, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে যেতে দেখে কিছু মানুষ কাজ করছে নানা জায়গায়। কেউ মাটি কাটছে, কেউ বালু টানছে, কেউ জমিতে কাজ করছে। এরা কোথা থেকে এসে কোথায় কাজ করছে তা জানে কয়জন? 

    প্রতিটা শহরে কিছু জায়গা আছে যেখানে ভোরে গেলে দেখবেন সারি সারি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোদাল হাতে, কেউ দাঁ হাতে, কেউ মাটি টানার টুকরি আর কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই জায়গা মত উপস্থিত থাকতে হবে। অল্প সময়ের মধ্যেই যাদের দরকার তারাও এসে হাজির হবে। দুই জন, পাঁচ জন, দশ জন এমন করে মানুষ বাছাই করে নিয়ে চলে যাবে কাজে। যারা কাজ পেল তাঁরা কাজে গেল, তাঁরা বেঁচেই গেল। আর যারা কাজ পেল না? তাদের আর কিচ্ছু করার নাই, আজ আর হল না। ফিরতে হবে খালি হাতে বাড়িতে। 
    কেউ দেরি করে ফেলেছে আসতে, সাই সাই সাইকেল চালাচ্ছে, সাইকেলে কোদাল ঝুলান, ছুটে যাচ্ছে সময় মত পৌঁছানোর জন্য। এমন দৃশ্য আমি অনেক দেখেছি। আবার ফিরতি পথে ফিরে যেতেও দেখেছি। আবার কেউ কেউ এই জায়গায় হয়নি সে দৌড় দিচ্ছে অন্য জায়গায় পৌঁছানোর জন্য। যদি সেখানে মিলে যায় কোন কাজ। এরা দিন মজুর। এরাই দিন আনি দিন খাই শ্রেণীর সবচেয়ে নিচের শ্রেণীর মানুষ। যাদেরকে সভ্য সমাজ ঠিকমত চিনেই উঠতে পারে না। 

    এঁদের প্রসঙ্গ কেন আনলাম বলছি। চা শ্রমিকরা এঁদের থেকেও নিচে বাস করে। দিন মজুরেরা নিজের ইচ্ছা মত পারিশ্রমিক হাঁকাতে পারে। আজকে বৃষ্টি নেমেছে, শরীরটা ভাল না, কোনমতে কাটিয়ে দেই আজকের দিন বলে বাড়িতেই বসে যেতে পারে। চা শ্রমিকদের সেই সুযোগ নাই। অসহায়ত্ব বুঝা যাচ্ছে? দিন মজুরদের কোন ইউনিয়ন নাই, সমিতি নাই, তবুও তাঁরা মজুরি নিজেদের মত করে নির্ধারণ করে নিতে পারছে। কারণ তাঁরা স্বাধীন। এই জায়গায়ই চা শ্রমিকেরা ধরা। দাস প্রথার মত করে তাঁরা মালিকের নিকট বিক্রি হয়ে গেছে এমন যেন জীবন। এতটাই দুর্বল তাঁদের অবস্থা যে বেতন বাড়াতে বলছে, ২০২২ সালে এসে, যখন মোটা চাল পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলছে, ভোজ্য তেল ডাবল সেঞ্চুরি মেরে সগৌরবে ব্যাট উঁচু করে দাঁড়িয়ে, যখন কাঁচা মরিচ ট্রিপল সেঞ্চুরি মেরে আনবিটেন এখন পর্যন্ত তখন তাঁরা দাবী করছে তিনশ টাকা মজুরি দিতে হবে! পাঁচশ চাওয়ার সাহসও নাই? দৈনিক হিসেবে কেন বেতন এইটাও আমার বোধগম্য না। দৈনিক মানে হচ্ছে শুক্রবার বেতন নাই, যে কোন বন্ধের দিন বেতন নাই! তিনশ করে হলে মাসে বেতন কত আসে? আলিমুল গায়েব নিজে হাতে চলাচ্ছে এঁদের? না হলে তাঁরা বেঁচে আছে কি করে? 

    বাংলাদেশে আমার হিসাবে দুইটা শ্রমিক ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী। এক মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন আরেক হচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন। এঁরা শক্ত করে দাবী আদায় করে বলে এঁদের নাম আমরা জানি। বাকিরা শ্রমিক না ধইঞ্চা তাও আমরা জানি না। আমার জীবনের খুব অল্প কিছুদিন স্পিনিং মিলে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি দেখছি এঁদের কোন সারা শব্দ পুরো দেশে কোথাও নেই। আওয়ামীলীগ সরকার যখন প্রথম দফায় গার্মেন্টসদের বেতন বৃদ্ধি করল সেই সময় আমি নারায়ণগঞ্জে একটা স্পিনিং মিলে চাকরি করি। আমি দেখলাম সেই বেতন বৃদ্ধি এঁদের জীবনে কোন প্রভাব ফেলল না। তখন সম্ভবত সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ছয় হাজার টাকা। আমি আমার ফ্লোরে অদক্ষ শ্রমিককে বেতন নিতে দেখছি দুই হাজার টাকা, দেড় হাজার টাকা করে! এবং গার্মেন্টস যখন শিশু শ্রম থেকে মুক্ত হয়ে গেছে প্রায় তখন আমি দেখছি স্পিনিং মিলে দশ বারো বছরের শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে, বেতন মাসে এক হাজার টাকা! শিশুদের রাতের শিফটে কাজ করানো আমার পক্ষে সম্ভব না, শুধু মাত্র এই কারণে আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসছিলাম। আমি জানি না এখন স্পিনিং মিলের পরিবেশ ক্যামন। খুব একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে বলে মনে হয় না আমার। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি কোনদিন কোথাও শুনি নাই স্পিনিং মিলের শ্রমিকেরা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নেমেছে। আর নামে নাই বলেই হয়ত আজও অন্ধ কুঠিরে সারাদিন কাজ করে বেতন পাচ্ছে তিন চার হাজার টাকা! কোনদিন এঁরা যদি রাস্তায় নামে আমি আশ্চর্য হব না। তবে আমি যেমন চা শ্রমিকদের কথা জেনে শিউরে উঠেছি, তেমনই তখনও অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যাবে এঁদের জীবন কাহিনী শুনে। 

    চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী মেনে নেওয়া হোক। এমন যদি হত চা শিল্প বাংলাদেশে খুব অসহায় একটা ক্ষেত্র, সরকারের দয়ায় টিকে আছে তবুও মনটা মানত। যদিও ঢাকা ওয়াসা সেই চিন্তার পথও বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারে কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়ে এমডি সাহেব বেতন নেন পাঁচ লাখ টাকা, কাজেই লসের গল্প বলে লাভ নাই। আর চায়ের ক্ষেত্রে লসের গল্প বলার সুযোগও নাই। তাহলে কেন গড়িমসি? 
    গার্মেন্টসে মারচেন্ডাইজিং করার সময় কারখানার এক কর্মকর্তা আমাকে শ্রমিকদের আচারন সম্পর্কে অদ্ভুত এক জ্ঞান দিয়েছিল। তার মতে সারা দুনিয়ায় না কি এই নিয়মেই চলে। তিনি বলেছিলেন শ্রমিকদের কখনও পেট ভরে খেতে দেওয়া যাবে না! কেন? আজকে পেট ভরে খেলে ও কালকে কাজে আসবে না! পেট খালি থাকলে ও দৈনিক কাজে আসবে, উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তখন বয়স অল্প ছিল, গা রি রি করলেও কিছু বলতে পারি নাই। আজকে এতদিন পরে মনে হচ্ছে চা শ্রমিকদের মজুরি যারা নির্ধারণ করছে তারা সম্ভবত আমার ওই বসের লোক। তারা কোনদিন পেট ভরে খেতে দিবে না শ্রমিকদের। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপর বাংলা | ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১৩১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২৫ আগস্ট ২০২২ ১২:৪০511335
  • ইউনিয়ন এইজন্যই দরকার হয়।  আমার এক বন্ধু একটা কথা বলে যে মৌমাচির ঝাঁককে বাঘও ভয় পায়। জোট বাঁধা ছাড়া উপায় নেই। 
  • কিংবদন্তি | ২৫ আগস্ট ২০২২ ২২:৩৩511349
  • দ, এখানে পরিস্থিতি খুব করুণ। ইউনিয়ন হচ্ছে সরকার সমর্থিত। যার কারণে প্রকৃত শ্রমিকদের কথা সরকার পর্যন্ত যাচ্ছে না। শ্রমিকেরা রাস্তায় আন্দোলন করে রাতে বাসায় ফিরছে আর নেতারা রাতের বেলায় গিয়ে ১৪৫ টাকায় রাজি হয়ে চলে আসছে! ভাল দিক হচ্ছে শ্রমিকেরা সময় মত বুঝে গেছে কে তাঁদের সাথে আছে আর কে ধোঁকা দিচ্ছে। যার কারণে এখন ওরা এক জোট, তিনশ টাকার নিচে কেউ কাজ করবে না। আশু এই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও একটু জল ঘোলা হবে তারপরে হয়ত একটা উপায় হবে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন