পণ্ডিতেরা বলেন, এই পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়। বইতেও লেখা থাকে এ কথা। তবে ব্যক্তিগত জীবনে সেই অনুভব আমার প্রথম হয়েছিল খুব আনন্দের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। যখন বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে এমএসসি পড়ি, আমরা ক্লাসের রোল নম্বরে প্রথম কুড়িজন, প্রফেসর সুভাষ রঞ্জন বসুর সঙ্গে ফিল্ড সার্ভেতে গিয়েছিলাম সিকিমের ইউমথাং-এ। কুড়ি কুড়ি করে ছ’টা দল হয়েছিল একশ’ কুড়িজন ছাত্রছাত্রীর জন্য – সঙ্গে একজন করে প্রফেসর। আহা, সেই ঘন নীল আকাশ যেন বেগুনি। ডঙ্কিয়ালা রেঞ্জ, সবুজ ঘাসের গালচে পাতা ঢালু নদীর পাড় – আজ তিরিশ বছর পরেও চোখ বুজলে – সেদিনের মতই স্পষ্ট, জ্বলজ্বলে। যাওয়ার আগে অবশ্য এমকেবি, মানে প্রফেসর মনোতোষ কুমার ব্যানার্জি পাখিপড়া করিয়েছিলেন, ইউমথাং-এ আজ হিমবাহ নেই, তবু একদিন ছিল, তার ফেলে যাওয়া মোরেনের ওপরে আজ ফুটে থাকে রডোডেনড্রন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের কতিপয় গ্লেসিওলজিস্টদের একজন। ডঙ্কিয়ালার উল্লম্ব প্রাচীরের পাশে আমাদের বাস থেমেছিল। সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে দৌড়তে দৌড়তে আমরা পৌঁছলাম লাচুং নদীর ধারে। তার স্লেট রঙা জল, বরফিলি ছোঁয়া, দুরন্ত কলকল আওয়াজ – এতটাই স্পষ্ট, যেন আজও দাঁড়িয়ে আছি ওখানেই। ছোট ছোট কোডাক আর হটশট ক্যামেরায় বন্দি হয়েছিল কিছু মূহূর্ত, যে বন্ধুদের কাছে ছিল সেই মহার্ঘ সম্পদ, তারা অপটু হাতে শাটার টিপেছিল কিছু। এসআরবি আমাদের বললেন, নদীটা যেদিক থেকে আসছে, সেদিকে মুখ করে দাঁড়াও সকলে। কিছু না ভেবেই ঘুরে তাকালাম। কী যে দেখলাম, কী দেখালে দেবতাত্মা হিমালয়! লাচুং নদীর দু’ পাশে সেই উল্লম্ব পাহাড় দুটো আলাদা প্রাচীর নয়, ভারি সমঞ্জস (সিমেট্রিকাল), আসলে একটাই মেঝের দুটো দেওয়াল - বিশালাকায় ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো। আর সেই ইউয়ের মেঝের ঠিক মাঝখানে একটি স্পষ্ট ভি আকৃতির আর একটু নিচু উপত্যকা। স্যারকে আর কিছু বলতে হয়নি, চোখের সামনে খুলে গেছে বইয়ের পাতা। একলক্ষ বছর আগে প্লাইস্টোসিন হিমযুগে মধ্য হিমালয় ছিল বরফে ঢাকা, তখনকার বিশাল হিমবাহগুলি তৈরি করেছে এই দৈত্যাকার ইউ আকৃতির উপত্যকা। তারপর এল অন্তর্বর্তী হিমযুগের গরম। বরফ একটু রয়ে গেল হিমাদ্রির চূড়োয়। মধ্য হিমালয়ে বরফ গলে বইতে লাগল অসংখ্য নদীর ধারা – যারা হেসে খলখল, গেয়ে কলকল, তালে তালে নুড়িগুলো দিয়ে তালি বাজিয়ে কেটে দিল ভি এর মতো দেখতে উপত্যকা। স্যার ডাকছেন, জিজ্ঞেস করছেন বারবার, ‘কী দেখলে? কিছু দেখতে পাচ্ছ?’ – আমরা ভাষাহীন ছিলাম। দেখতে পেয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম হিমালয় দর্শন। এমকেবি বলেছিলেন, আমাদের সকলের কপালে চোখ থাকে। শিব ঠাকুরের আর দুর্গাঠাকুরের ছবিতে আঁকা হয় শুধু। ওটা মনের চোখ। ঐ চোখ খোলাই আমাদের সাধনা। স্যার আরও বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির সামনে দাঁড়াও। শ্রদ্ধা নিয়ে ওর চোখে চোখ রাখো। ও কিছু বলছে, কিছু দেখাতে চায়। তোমরা ওর কথা শোনার চেষ্টা কর’। আমরা সেদিন শুনতে পেয়েছিলাম স্যার, ইয়ুমথাংয়ের পাহাড়ের বলা গল্প।
সেই দিনের পর দীর্ঘ তিন দশক অতিক্রান্ত। আজ আর জলবায়ু পরিবর্তন কথাটা শুনলে সেদিনের মত আনন্দ হয় না। বরং দুঃখ, হতাশা আর আতঙ্ক চেপে ধরে। বসিরহাটে আমাদের পৈতৃক ভিটে। সেখানে ছিল বেশ কয়েকটা আমগাছ। অনেক পুরোনো। কোনোটা আমার জ্যাঠামশাইয়ের লাগানো, কোনোটা বা বাবার নিজের হাতে পোঁতা। রথের মেলায় চারা কিনেছিল। বাকিগুলো হয়তো ঠাকুরদার লাগানো, বা তাঁর বাবার। গাছগুলো ছিল। প্রতিটা গাছের এক একটা পারিবারিক নাম ছিল – লেবুর গন্ধওলা মেজজেঠুর ভাগের গাছটার নাম ছিল লেবুচারা। বড়জেঠুর ভাগের একটা গাছ ছিল ছোট ছোট গোল গোল হলুদ রঙের মিষ্টি আম – নাম ছিল গোল ল্যাংড়া। বাবার ভাগে একটা বিশাল গাছ ছিল হিমসাগরের। ঠাকুরদার আমলে কোনো ঝড়ে তার মগডাল একবার ভাঙা পড়েছিল। তাই ঐ গাছটার নাম ছিল ঘাড়ভাঙা। যে বছর গাছ আমে ভরে যেত, বস্তা করে আম আসত শহরের বাড়িতে। খাটের তলায় আশশ্যাওড়ার পাতা বিছিয়ে বাবা আম সাজিয়ে রাখত। রোজ সকালে বেছে বেছে বার করত, আজ কোনগুলো পেকে খাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। বাবা, বড়জেঠু, মেজজেঠু, ঠাকুরদা, ঠাকুরদার বাবা – কেউ তো আজ নেই, তবু সবার ছোঁয়া বেঁচে ছিল গাছগুলোর গায়ে। আমফান ঝড় এল, এমন কত ঝড়ই তো হয়। তবু এ ঝড়টার মনে কী ছিল? – সব আমগাছগুলোকে নিয়ে গেল। গাছের সঙ্গে চলে গেল বাপ পিতেমোর ছোঁয়া। পন্ডিতেরা বললেন এমন প্রবল ঝড় আসার কারণ হল জলবায়ু পরিবর্তন। এমন নাকি আরও আসবে – কিন্তু আসবে মানে কী? আর কী কী কেড়ে নেবে আমার থেকে? এ পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন হয় – বইয়ের পাতা নয় – এ’কথা আমাদের পৃথিবীর তৃতীয় মেরু হিমালয় পর্বত যেদিন প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, সেদিন সেই দেখাটা ছিল আমার ব্যক্তিগত সুখ। আজ সেই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভয়াল ঝড় যে আমার বুক ভেঙে দিয়ে গেল – সে দুঃখটাও একান্ত আমার একার। বলব কাকে? অন্য লোকে শুনে যদি হাসে? আকাশ পাতাল ভেবে চলি। একটা আনন্দের জিনিস দুঃখ হয়ে গেল কেন? হুম, বুঝেছি - আগের পরিবর্তনটা হয়েছিল লক্ষ বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তাতে মানুষের কোনো হাত ছিল না। আর আজকের পরিবর্তন করছে মানুষ – পাঁচ, দশ, পনের ... পঞ্চাশ বছরে – যেটা পৃথিবীর সময় সারণীতে একটা কণাও নয়। আর এগুলো করছে প্রকৃতির কথা না শুনে, তার টুঁটি টিপে ধরে। সে সুখ চায় না আর, জয়ী হতে চায়। তাই এত দুঃখ ঘিরে ধরে। শুধু কি আর দুঃখ! আমরা ছিলাম আম্রধনী। কোনোদিন আম কিনতে হয়নি। বাবা কিনত বটে, তবে শখে। আমরা রাগ করতাম। আবার আম এনেছ? এক একটা গাছের আমের জেলি, আমসত্ত্ব, মোরব্বার আলাদা আলাদা স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ ছিল। স্বাদ নেবার আগে বোতল দেখেই চেনা যেত, স্বাদ তো চিরকালের চেনা। আজ তারা নেই। তবু মনে করলেই স্বাদ পাই। আহা, আমার মেয়ে তো দেখলে না সেসব দিন। বাঁশঝাড়ের পাশে ছিল মধুগুলগুলির গাছ। ও আম কাটতে লাগে না। হাতে ধরে দু’তিনবার ডলে নিয়ে তলার দিকে ফুটো করে চুষে খেতে হয়। কোথায় লাগে কোম্পানিদের ম্যাঙ্গো ড্রিংক! মেয়ে ঐ ড্রিংক কিনে খেতে চায়, কিনেও দিই। ও বলে, ‘তুমি খাবে না মা?’। ছোট্ট উত্তর দিই ‘না’। কী করেই বা বোঝাই ওকে, আমি যে আম্ররসে সিক্ত, আর ও আম্ররিক্ত। জিনিসটা দূর, তার স্মৃতি তৈরিরও সুযোগ ওর হল না তেমন। আমার তবু তো স্মৃতিটা আছে। আমি ধনী, আমার তুলনায় ও গরীব। এমনি করে সারা পৃথিবীতেই সাধারণ মানুষ হয়তো বুঝতে পারছে, তার থেকে তার সন্তান আরও গরীব হয়ে যাচ্ছে। এই অনুভব বড় হতাশার, ভারি আতঙ্কের। বড্ড মনখারাপ করে আজকাল। কিচ্ছু ভাল লাগে না। সেদিন কাগজে এক অদ্ভুত খবর পড়লাম। আমার দুঃখ শুধু আমার একার নয়, পৃথিবীতে বহু মানুষ গাছপালা, প্রকৃতি, হারিয়ে যাওয়া নদী নালা, পশুপাখি নিয়ে দুঃখে কাতর। আর অনেক লোকের ব্যাপার তো! অভিধানে একটা নামও নাকি ঠিক হয়ে গেছে – ইকোলজিকাল গ্রিফ অর্থাৎ পরিবেশজনিত শোক। আশ্চর্য, বিশ্বব্যাপী এই শোকের কারণ হল মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা আর তার জন্যে ছুটে আসা জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন!
মুখে হাসি বজায় রেখে চলি, কলেজে যাই, লকডাউন কেটে গেছে। আগে কত হাসি মজা হত। এখন সকলেই প্রায়শ গম্ভীর থাকে। সেরকম প্রাণখোলা আড্ডাটা যেন হচ্ছে না, কোথাও বেধে যাচ্ছে। নিজের ভাবনা লুকিয়ে রেখে সবার মতো চলার চেষ্টা করে যাই প্রাণপণ। ছেলেমেয়েদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। জিজ্ঞাসা করি,
- কী হয়েছে তোমাদের – মুখগুলো এত ভার ভার? আগে তো বলতে – ‘বাড়িতে ভাল লাগছেনা ম্যাডাম, কবে কলেজ যাব?’
- ম্যাডাম, ইউনিভার্সিটি কেন আমাদের সঙ্গে এমন করছে?
- কী করেছে?
- এই যে – কেবল ঝুলিয়ে রাখছে। বলছে না কীভাবে পরীক্ষা হবে। বলে দিলেই পারে অনলাইনে পরীক্ষা হবে।
- সে কী? অনলাইনের প্রশ্ন উঠছে কেন?
- অফলাইনে পরীক্ষা কেমন করে দেব ম্যাডাম?
আশ্চর্য, এদের সকলের বয়সই আঠেরোর ওপরে। যদি ধরে নিই অন্তত ছ’বছর বয়স থেকে এরা ফর্মাল পরীক্ষা ফেস করছে, তবে প্রথম বারো বছরের অভ্যেস, স্মৃতি সব কিছু ভুলে ওরা এখন অনলাইনে পরীক্ষা চাইছে? অথচ প্রথম বছর অনলাইন পরীক্ষার আগে কত আশংকা, সঙ্কোচ, কত ট্রেনিং, কত আলোচনা, অনলাইন মিটিং, ফোন কল! তাহলে কি দু’বছর ধরে বাড়িতে বসে বই দেখে, নোট দেখে লেখার সুযোগ পেয়ে, এবং নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খাতা দেখা হয়েছে বলে অস্বাভাবিক বেশি নম্বর পেয়ে ওরা এই অনৈতিক সুযোগ ছাড়তে চাইছে না! কিন্তু আমি নিজে তো জানি, এরা খারাপ মানুষ নয়। করোনার সময়ে কিভাবে চাঁদা তুলে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রোগীর কাছে পৌঁছনো, রান্না করে পৌঁছে দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করা, হসপিটাল বেড খুঁজে দেওয়া, যেসব বন্ধুদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে না, তাদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া, সারা রাত জেগে থাকা, হাজার হাজার ফোন করে ভুয়ো নম্বর কোনটা, ঠিক ফোন নম্বর কোনটা খুঁজে বের করা, কী না করেছে এরা!
- কিন্তু কেন তোমরা অনলাইন চাইছ?
- আপনি বুঝবেন না ম্যাডাম।
- বুঝব। খুলে বললেই বুঝব, তোমরা বল।
- ম্যাডাম আপনি কি বিশ্বাস করবেন?
- হ্যাঁ করব, বল না।
- ম্যাডাম, মনঃসংযোগ ভীষণ কমে গেছে আমাদের, পড়তেই পারছি না। আগে যতটা পড়তাম, এখন তার থেকে পড়ার সময় অনেক কমে গেছে, মন ফেরাতে পারছি না। আসলে লক ডাউনে এত সিনেমা দেখেছি, ঘুমিয়েছি, এখন পড়তে বসলেই খালি মনটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। মুখস্থ করতে বা মনে রাখতে পারছি না। লেখার গতিও কমে গেছে। হাতের লেখা আগের থেকে খারাপ হয়ে গেছে। কম্পিউটারে বা মোবাইলে তাকাতে অসুবিধে হচ্ছে না, কিন্তু বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে চোখে অস্বস্তি হচ্ছে। যার ফলে কীকরে টানা কয়েকঘণ্টা না দেখে মুখস্থ করে হাতে লিখে আসব, সেটা ভেবে ভেবে কোন থৈ পাচ্ছি না ম্যাডাম।
কথাগুলো শুনে ভারি ভাবনায় পড়ে যাই। স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা না করার ফলে আগের সেমেস্টারের সিলেবাস এদের ভালভাবে অধীত হয়নি, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সামনে ইভেন সেমেস্টার পরীক্ষা। সিক্সথ সেমেস্টারের ছাত্রছাত্রীরা লকডাউনের আগে মাত্র ফার্স্ট সেমেস্টারে অফ লাইন ক্লাস করেছিল, রেজাল্ট বেরোনোর আগেই লকডাউন হয়ে যায়। ফোর্থ এবং সেকেন্ড সেমেস্টারের ছাত্রছাত্রীরা অনলাইনেই ভর্তি হয়েছে। কলেজে না আসার ফলে শিক্ষক এবং ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ তৈরি হয়নি। সার্বিক ভাবে চারটি সেমেস্টার অনলাইনে কাটিয়ে তাদের এইসব কমন সমস্যা তৈরি হয়েছে তাহলে!
- এই অবস্থায় অফ লাইন পরীক্ষা হলে তো নম্বর কমে যাবে ম্যাডাম, সবার কাছে অসম্মান হবে, যদি পাশ করতে না পারি! ইউনিভার্সিটি কি কোনোদিন আমাদের কথা বুঝবে না?
চমকে উঠি ওদের কথা শুনে। এই তো কদিন আগে লকডাউন চলাকালীন ওদের কত ভয় ছিল, ‘আমাদের সবাই করোনা ব্যাচ বলবে, আমরা কোথাও চাকরি পাব না’ – সেই দূরের ভয়গুলো তুচ্ছ হয়ে এখন কাছের ভয়গুলো বড় হয়ে উঠেছে! সত্যিই তো, গত দু’বছর প্রাণ খুলে হাসা হয়নি, বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি হয়নি, টিফিন ভাগ হয়নি। বন্ধু, বা শিক্ষক কাউকে মনের কাছাকাছি পায়নি – তাই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাত্মতা হয়নি। এরা নিজেদের খুব একা ভাবছে মনে হচ্ছে। আর সেজন্যই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিপক্ষ ভাবছে। হায় হায়! এতদিন আমি কেবল নিজের দুঃখ নিয়ে বিলাস করছিলাম। এদের দুঃখ, ভয়, টানাপোড়েন আমার চেয়ে শতগুণ বেশি। বরং এই প্রৌঢ়ত্বে এসে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সামলে আমি নিজে যতটা শান্তভাবে এই মনখারাপের মোকাবিলা করছি, এরা তো সেটাও পারছে না। হঠাৎ চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় এক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছাত্রীর কথা শুনে,
- ম্যাডাম দিল্লির দিকে তো বেশ কিছু করোনা কেস হচ্ছিল। পরীক্ষার আগে যদি এদিকে একটু বেড়ে যায়, তাহলে খুব ভাল হয়।
মেয়েটির কথা শুনে হতবাক হয়ে যাই আমি। করোনা বাড়লে তার সঙ্গে আরও অন্য ভয়াবহ কিছু আসতে পারে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা – কোনোটাই আর ওরা গুরুত্ব দিচ্ছে না! তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করি। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট লেভেলের স্টুডেন্টদের একটা বাড়তি সমস্যা তো আছে। আমাদের ভূগোলে যেমন কম্পালসরি ইংরেজিতে উত্তর লিখতে হয়। আমাদের কলেজের পিজি ছাত্রছাত্রীরা তো বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যমেই গ্র্যাজুয়েশন লেভেল অবধি উত্তর লেখে। অন্যান্য সাধারণ বছরে পিজি ফার্স্ট সেমেস্টারে প্রথম ইংরেজিতে উত্তর লিখতে গিয়ে ওদের ভাষার অসুবিধে হয়, নম্বর কমে, কিছু মডিউলে সাপ্লিমেন্টারি হয়। পরবর্তী সেমেস্টারগুলোতে ধীরে ধীরে ইম্প্রুভ করে। এইমূহূর্তে ফোর্থ সেমেস্টারে যারা ফাইনাল পরীক্ষা দেবে, তারা আগের ৩টে পরীক্ষাই অনলাইনে বই দেখে লিখেছে। তাই ভাষার কোনো সমস্যা হয়নি। টিচার হিসেবে আমাদের কাছে স্ক্যান করা খাতা এসেছে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে সঠিক উত্তর লেখা। তাই আমরাও নম্বর কাটতে পারিনি। এর ফলে ওদের নিজেদের যা মান, তার চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে গেছে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে না হয়েছে উত্তর শেখা, ফাঁক পড়ে গেছে ইংরেজি বাক্য শুদ্ধ করে উত্তর লেখাটাও। এবারে ফাইনাল পরীক্ষাতে পড়ে গেছে ফাঁপরে। তাই প্রাণপণে বাঁচার জন্য চাইছে অনলাইন পরীক্ষা হোক।
নিজেদের এই ভয়গুলো ঢাকা দিতে দেখছি ওরা এখন নানা অজুহাত খাড়া করছে। আমাদের তো পুরো সময় অফলাইন ক্লাস হয়নি – ইত্যাদি আরো কিছু। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে রাত জাগা এবং মোবাইলে অস্বাভাবিক আসক্তি। তবে যাই হয়ে থাকে, সবচেয়ে যেটা চিন্তার বিষয় – সেটা হল এদের চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের অভাব। কোভিডে আমরা চেনা অচেনা সব মানুষের কাছে যেতে বারণ করেছি। কাছে গেলে, ছোঁয়া লাগলে জান খোয়াতে হবে, বিশ্বাস করেছি – তার ফল ফলছে আজ। আগে যে ছাত্র নির্ভয়ে দুটো চ্যাপ্টার না পড়ে চলে যেত – বন্ধু বলে দেবে এই ভরসায়, সেও আজ ঘরবন্দি হয়ে পরীক্ষা দিতে চাইছে। কিন্তু ওদের যদি এমন হয়, আমরা বাঁচব কী নিয়ে?
আমি তো ভূগোলের ফিল্ড সার্ভেতে সিকি শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছি, এই তরুণ হাতগুলির ভরসায়। খাদের ধারে, খাড়া ঢালে সবসময় আমাকে ওরা আগলে রেখেছে। ‘অ্যাই, ম্যাডাম কে ধরে নে’। ‘আমার হাতটা ধরে চলে আসুন ম্যাডাম’। ঐ হাতগুলো ধরে সরু বাঁশে পা রেখে মাডফ্ল্যাট পেরিয়ে চড়তে পেরেছি লঞ্চে, বা পেরোতে পেরেছি কত নাম না জানা খরস্রোত। আজ যদি সেই আত্মবিশ্বাসী হাতগুলো নিস্তেজ হয়ে যায়, আমি বাঁচব কী নিয়ে? তোমার মন টুকরো হলে আমি যে গুঁড়িয়ে যাব! না না না, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। এ শুধু ওদের নয়, আমাদেরও অস্তিত্বের প্রশ্ন। ঘুরে দাঁড়াই, বলতে চাই,
- শোন, ভুল কোরো না। ইউনিভার্সিটি আমাদের অভিভাবক, আশ্রয়, বন্ধু। শত্রু মোটেই নয়। হাল ছেড়ো না, ভেঙে পোড়োনা প্লিজ। এসো, শুধু আরও একবার আমরা হাতে হাত রাখি কমরেড। আমরা জেন-এক্স আর জেন-জেড – সবাই মিলে, রুখে দাঁড়াই। অফলাইন থেকে অনলাইনে আমরা যেতে পেরেছিলাম। হেরে যাইনি, জিরো একাডেমিক ইয়ার হতে দিইনি। এবার অনলাইন থেকে অফলাইনে ফেরার লড়াইটাও একসঙ্গে লড়ব। আশা রাখি জিতে যাব। যদি জিততে নাও পারি, আমাদের চেষ্টার সাঁকো বেয়ে পার হবে পরবর্তী প্রজন্ম। মুখে বলি,
- শোনো শোনো, এরকম মনের অবস্থা তোমাদের তো লকডাউনের পরে হল, আগে এমন হয়েছিল কি?
- না ম্যাডাম।
- হুম, তার মানে এই অতিমারীর জন্য আমরা যে ঘরবন্দি হয়ে গেলাম, তার জন্যই সব গোলমাল হল। না হলে তো অনলাইন ব্যবস্থা আমাদের প্রজন্মে হয়তো আসতই না। আচ্ছা বল দেখি অতিমারী কেন হল?
- চীনে ল্যাবরেটরিতে জীবাণুটা তৈরি করেছে ম্যাডাম। সব বড় বড় ধনী দেশ জড়িত।
- দেখ, এটা একরকম তত্ত্ব। প্রমাণিত কিছু নয়। এমন আরও কিছু তত্ত্ব আছে। সেগুলো কে বলতে পারবে?
- আমি একটা বলছি ম্যাডাম। লক্ষ বছরেরও আগে প্লাইস্টোসিন যুগে হিমযুগ এসেছিল। তারপরে অন্তর্বর্তী হিমযুগে আবার নতুন করে নানারকম জীব সৃষ্টি হয়। আগের যুগের জীবাণু আটকে ছিল বরফের নিচে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে কোন স্তর থেকে বেরিয়ে এসেছে এমন ভাইরাস, যার আক্রমণের স্মৃতি মানুষের জিনে নেই।
- হুম হতেও পারে। হয়তো ভবিষ্যৎ বলবে আসল সত্যটা কী। তবে এটা তো ঠিক – পৃথিবী যে থমকে গেল, সেটা অনেকটাই মানুষের করা পরিবেশের ক্ষতির ফল।
- হ্যাঁ ম্যাডাম।
- তাহলে যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখ তো, আমাদের ওপরে গত দু’বছরে যে ঝড় চলে গেছে, তার পিছনের কারণটা পরিবেশ, মানে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। আর সামনের ফলটা হল শারীরিক দুর্বলতা আর মানসিক অ্যাংজাইটি। এই যে ভাবনা – পরীক্ষা দিলেই ফেল করে যাব, জীবন শেষ হয়ে যাবে – এই দুশ্চিন্তা একধরনের সাময়িক পরিবেশগত শোকের ফল, তোমরা একটা মন খারাপের ঘোরের মধ্যে আছ। তলিয়ে ভাব, যুক্তি দিয়ে বিচার কর – এটা কাটিয়ে উঠতে হবে।
- কিন্তু কী করে কাটাবো ম্যাডাম?
- হাতে হাত রেখে, ইস্কুলে পড়নি কবিতাটা? – ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি!’ তারপর ঐ কবিতাটা – ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে এ পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল’।
- মন যে মানছে না ম্যাডাম। কী করে দুশ্চিন্তা কাটাব?
- ভাল কথার চর্চা করে নিজেদের মন ভাল করব সকলে। রাজি তো। আজ বাড়ি গিয়েই বানাব যে যার একটা করে ভালবাসার বাক্স। যেদিন কিছু ভাল ঘটবে, সেদিন সেটা চিরকুটে লিখে বাক্সটায় রেখে দেব, আর তার সঙ্গে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বা দশ টাকার নোট – যে যা পারি রাখব – ঠিক আছে? কয়েক মাস পরে দেখব খুলে কী কী ভাল হল, আর কত মূল্য জমে উঠল ঐ ভালবাসার বাক্সে। সেই টাকা দিয়ে গাছ লাগাব, রাস্তার কুকুর, বিড়ালের চিকিৎসা করব, বা যার যেমন প্রয়োজন মনে হবে খরচ করব। পৃথিবী যা ভাল দিয়েছে আমাদের, সেটা তাকে কিছুটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করব।
- কিন্তু পৃথিবী তো দুঃখকষ্টও দেয় ম্যাডাম।
- দেয় তো। কিন্তু ভেবে দেখ তো, পৃথিবী আমাদের যতটুকু খারাপ দেয়, তার অনেক গুণ বেশি খারাপ কি প্রতিদিন কারণে অকারণে আমরা পৃথিবীকে দিইনা! ও কত সহ্য করে বল তো।
- সেটা ঠিক।
- দেখ, বাঁচার জন্য একটাই পৃথিবী আছে আমাদের। ওকে ভাল রাখতে হবে, আর নিজেরা খারাপ থেকে কি কারোর ভাল করা যায়? যায় না। এসো, একসঙ্গে শপথ নিই –
পৃথিবীর চেয়ে ভাল বাড়ি নেই,
প্রতিকূলতার থেকে বড় শিক্ষক নেই।
বাধার সামনে লড়াই ছাড়ার প্রশ্ন নেই।
“এ পৃথিবীকে আগামীর বাসযোগ্য করে যাব আমরা। পৃথিবী মায়ের কাছে এ আমাদের যৌথ অঙ্গীকার।”
তোদের চোখে বৃষ্টি কত?
রয়েছি বুক পেতে।
আমার রঙিন পাখা নিয়ে
(তোকে) সামনে হবে যেতে।
উড়বে তুমি নীল আকাশে
শানিয়ে মনের জোর।
তোমার কন্ঠে উঠবে বেজে
আমার গানের ভোর।
আগামী বা অতীত যা হোক
রইলে তুমি মাঝে -
এক পৃথিবী ভালবাসার
বাড়ি তোমার আছে।