এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • ইয়েলোনাইফে শীতকালীন পর্যটন

    সায়ন্তন চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৪ মার্চ ২০২২ | ১৯৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ওয়াই একজন তরুণ প্রফেসর; মাত্র কয়েকবছর আগে সে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনিওর পেয়েছে। ব্রুকলিনের ক্যাম্পাসে তাকে যে অফিসটা দেওয়া হয়েছে, সেটা ছোটো হলেও তার পছন্দসই। সে প্রকৃতপক্ষে ক্যানেডিয়ান, তার কলেজজীবন কেটেছে টরন্টোতে। আন্ডারগ্র্যাডে সে জেডের ছাত্র ছিল। নিজের রিসার্চ কম্যুনিটিতে জেড একজন নামকরা গবেষক; যদিও তাদের আগ্রহ আলাদা আলাদা বিষয়ে বলে ওয়াই জেডের সাম্প্রতিক কাজগুলো সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল না। গত তিনবছরে জেডের কোনো পেপার সে পড়েনি। কিন্তু তার রিসার্চ গ্রুপের এক ছাত্রী কাজের প্রয়োজনে জেডের একটি সদ্য-প্রকাশিত পেপারের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একদিন সকালে নিজের অফিসে বসে ছাত্রীটির সঙ্গে জেডের পেপারখানা আলোচনা করতে গিয়ে ওয়াই অবাক হয়ে গেল। এত দুর্বল আর ভুলে-ভরা পেপার কী করে রিভিউয়ারদের অনুমোদন পেল, সে বুঝতেই পারল না। ছাত্রীটির মতোই তাকে বিভ্রান্ত দেখাল। সে উঠে গিয়ে কফিমেশিন থেকে মাগে কফি ঢেলে নিয়ে এসে ফের চেয়ারে বসল। যেভাবে গাণিতিক মডেলটা দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা একেবারেই রাবিশ, সে বিড়বিড় করল; আর ছাত্রীটি যখন তাকে অ্যালগোরিদমটা দেখাল, সে রীতিমত হকচকিয়ে গেল। এটা কিভাবে হতে পারে? — সে বিধ্বস্তভাবে ছাত্রীটির দিকে তাকাল। ছাত্রীটি বেশ ইতস্তত করছিল কোনো স্পষ্ট মন্তব্য করতে। তাই দেখে ওয়াই দ্বিধা কাটিয়ে উঠে জোরগলায় বলল, পুরো জিনিসটাই ভুলভাল, কোনো সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা ভুল, তাকে সরাসরি ভুল বলে চিহ্নিত করতে আমাদের দ্বিধা থাকার কথা নয়, সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল। কিন্তু এরকম একটা পেপারে জেড কিভাবে নিজেকে জড়াল ভেবে সে অবাক না হয়ে পারল না। ছাত্রীটি চলে যাবার পরে কফিতে চুমুক দিয়ে সে পেপারটিতে আরেকবার চোখ বোলাল, নিঃসন্দেহে জেডের ছাত্রদের মধ্যে কেউ এটা লিখেছে, কিন্তু জেডের চোখ এড়িয়ে নিশ্চয়ই এটা ছাপা হয়নি। সেক্ষেত্রে জেডের এই অসচেতনতার ব্যাখ্যা কী? সকালের দিকে অনেক কাজ থাকে পরপর। ফলে ভাবনাটা মাথা থেকে সরিয়ে ওয়াইকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হলো পরবর্তী কাজগুলোয়। লাঞ্চের আগে তার একটা লেকচার ছিল। ক্লাস করে অফিসে ফিরে এসে ওয়াই ঠিক করল জেডকে সে পেপারটার ব্যাপারে মেল করবে। আধঘন্টা পরে মেলটা পাঠিয়ে সে লাঞ্চ খেতে গেল। বাকি দিনটা তার আর মেলটার কথা মনে রইল না। সেদিন রাতে মেল চেক করতে গিয়ে হঠাৎ ওয়াইয়ের মনে পড়ল জেডের কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি। সে ভাবল, আরও দু-একদিন দেখা যাক। গোটা সপ্তাহ কেটে যাবার পরেও জেডের কাছ থেকে কোনো উত্তর এলোনা। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে ওয়াই শুধু জানতে পারল জেড আর ওখানে নেই। বছরতিনেক আগে ওয়াই বিয়ে করেছে, ইতিমধ্যে তার মেয়ে হয়েছে। উইকেন্ডে তার মেয়ের জন্মদিন ছিল। ওয়াইয়ের স্ত্রী একটা ছোটো পার্টির ব্যবস্থা করেছিল; তাদের অ্যাপার্টমেন্টে কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন ওয়াইয়ের পুরোনো বন্ধু। সন্ধ্যেবেলা কেক-টেকের পর্ব মিটে যাবার পর বন্ধুটির সাথে ওয়াই ঘর থেকে সংকীর্ণ টেরেসে গিয়ে দাঁড়াল, যাতে তারা একটা সিগারেট ধরাতে পারে। ওয়াই দীর্ঘদিন ধোঁয়াটানা ছেড়ে দিয়েছে। বন্ধুটির সিগারেটে টান দিয়ে তার কাশি পেয়ে গেল। বন্ধুটি হাসল তার অবস্থা দেখে। তারপর তারা কলেজের দিনগুলোর গল্প করতে লাগল। এক্সের কথা উঠল। টেরেসের ধারে কয়েকটা টব রাখা; টব থেকে লতানে গাছ গড়িয়ে নেমেছে। নীচে রাস্তা থেকে ট্রাফিকের কিছু কিছু শব্দ ছিটকে আসছে, নিউ ইয়র্কের সাউন্ডস্কেপ; রাস্তার ওপারে অন্ধকার বিল্ডিঙয়ের গায়ে খোপ-খোপ আলো। একটা এয়ারোপ্লেন লাল-সবুজ নেভিগেশন লাইট জ্বেলে জেনিথ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে দেখতে দেখতে ওয়াই এক্সের কথা ভাবল। হঠাৎ তার মনে হলো এক্সের সাথে যোগাযোগ করলে জেডের খবর জানা যেতে পারে।

    এলোমেলো আরো কিছু আড্ডা হলো টেরেসে দাঁড়িয়ে। তারপর ঘরের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাতেই ওয়াইয়ের চোখে পড়ল তার স্ত্রী পানীয়ের গ্লাস হাতে বন্ধুদের সঙ্গে খুব হাসছে; তার মুখটা আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দৃশ্যটির দিকে, স্ত্রীর প্রতি সে একটা আচমকা টান অনুভব করল। সেদিন রাতে তারা বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ পরস্পরকে আদর করল। স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়ার পর ওয়াই বাথরুমে গেল; বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে টের পেল বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সে জানলার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। কাঁচের শার্সি বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের দানাগুলো লক্ষ্য করল। তারপর বিছানায় ফিরে এসে অতি সন্তর্পণে নিজের ল্যাপটপটা অন করল। আড়চোখে তাকাল ঘুমন্ত স্ত্রীয়ের দিকে। তারপর এক্সকে একটা সংক্ষিপ্ত মেল লিখল। শুধুমাত্র জেডের খবর জানবার জন্যেই আমি এটা করছি, নিজেকে বোঝাল সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কোনো উত্তর না পেয়ে সে ল্যাপটপটা রেখে শুয়ে পড়ল। পরদিন দুপুরের দিকে এক্সের কাছ থেকে উত্তর এলো। এক্স লিখেছে সে জেডের খবর জানে না। এক্সের সঙ্গে ওয়াইয়ের আরো দুয়েকবার ইমেলে কথা হল। তারা পরস্পরের বর্তমান অবস্থার কথা জানতে চাইল। ওয়াই তার মেয়ের খবর দিল, এক্স তাকে অভিনন্দন জানাল। এক্সের স্বামী একটা বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করে, ওয়াই শুনল। তাদের এখনও কোনো বাচ্চা হয়নি। সম্ভবত এক্স খুব একটা উৎসাহী নয় মা হতে, ওয়াই বুঝতে পারল। এক্সের সঙ্গে ওয়াইয়ের যোগাযোগটা রয়ে গেল। তারা একে অপরের ফোন নাম্বার নিল। হোয়াটস্যাপে এক্সের প্রোফাইল ফটোটা দেখে ওয়াই ভাবল এক্স খুব একটা বদলায়নি। মাঝে মাঝে তারা টেক্সট করত। অতি মামুলী কিছু কথাবার্তা; ওয়াই টের পেল প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে সে সহজভাবেই কথা বলতে পারছে। এটা তাকে স্বস্তি দিল। জেডের ব্যাপারে ওয়াই কিন্তু কিছুই জানতে পারেনি। শীতের শুরুতে একটা সেমিনার উপলক্ষে টরন্টো যাবার সুযোগ এল, কিন্তু ওয়াই দোনামোনা করছিল। একদিন সে স্ত্রীর সঙ্গে ডাউনটাউনে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গেল। একটা ছোট কিন্তু সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ, যার জানলার ধারের টেবিলগুলির একটিতে তারা বসল। তারা খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ওয়াইয়ের স্ত্রী তাকে কিছুদিন আগে দেখা একটি জাপানী ফিল্মের কথা বলল, যেখানে মূল চরিত্রটি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত কি লোকটা আত্মহত্যা করেছিল? — ওয়াই জিগ্যেস করল। না, ওয়াইয়ের স্ত্রী জবাব দিল। খাবার এসে পড়লে তারা খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষ করে ওয়াই জানাল সে ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসছে। ওয়াশরুমটা রেস্তোরাঁর বেসমেন্টে। ওয়াই কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে দেখল বেসমেন্টে কেউ নেই। সে ছেলেদের ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকে সে বেসিনে মুখ ধুতে গিয়ে আয়নার দিকে তাকাল এবং লক্ষ্য করল উল্টোদিকের দেয়ালে একটি মেয়ের ফুলসাইজ ন্যুড ছবি। ওয়াই ঘুরে ছবিটাকে ভালো করে দেখল। তারপর সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর কাছে ফিরে এলো। তার স্ত্রী তাকে ওয়েটারের রেখে যাওয়া বিলটা দেখাল। বিল মিটিয়ে তারা যখন বেরিয়ে এল, ওয়াই তার স্ত্রীর কাছে জাপানী ফিল্মটার নাম জানতে চাইল, কেননা সে নামটা ইতিমধ্যে ভুলে গেছে। অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে তারা একসাথে ফিল্মটা দেখলো। সেদিন রাতে ওয়াই স্বপ্নে একটা কাঁচের শহরে গিয়ে পৌঁছল। ঘুমের ভেতরে সে একজন ভাড়াটে খুনি, সে বুঝতে পারল। স্নাইপার রাইফেলের স্কোপে চোখ রেখে সে তাকিয়ে আছে দূরে একটা হাইরাইজের জানলার দিকে। জানলার কাছে কালো স্যুটপরা একটি পুরুষ দাঁড়িয়ে; তার পিঠে কোমর থেকে ঘাড় অব্দি ক্রসহেয়ারটা ওঠানামা করছে। পুরুষটি কারোর সঙ্গে কথা বলছে, সে খানিকটা সরে যেতে দ্বিতীয়জনকে দেখা গেল। একজন মেয়ে, ওয়াই চিনতে পারল এক্সকে। এক্স হাত নেড়ে কিছু বলছে; স্যুটপরা লোকটি ধীরে ধীরে লাইন অফ সাইট ঢেকে দিচ্ছে। ওয়াইয়ের হৃৎস্পন্দন শ্লথ হচ্ছে, ট্রিগারের ওপর তার আঙুলটা চেপে বসল। হঠাৎ লোকটা ঘুরে তাকাল জানলার দিকে আর ক্ষণিকের জন্যে ওয়াই দেখতে পেল অস্পষ্ট মুখটা জেডের। সেই মুহূর্তে কী যেন তাকে বাধ্য করল শটটা নিতে আর সঙ্গে সঙ্গে ওয়াইয়ের ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে সে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল; জেডের কথা ভাবল। সারা সপ্তাহ চিন্তা করে টরন্টো যাবার সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলল। এক্সকে জানাল তার সঙ্গে দেখা করবে। এক্সের প্রতিক্রিয়া সে ঠিক বুঝতে পারলনা। ও কি আদৌ খুশি নয় আমার সঙ্গে দেখা হবে বলে? — ওয়াই অবাক হলো। কিন্তু এটা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন হলো না, জেডের খোঁজ নেওয়াটাই তার মূল লক্ষ্য।

    টরন্টো পৌঁছে সেমিনার মিটে যাবার পরে ওয়াই এক্সকে ফোন করল। তারা পরদিন সকালে কলেজ স্ট্রীটের একটি পিজারিয়ায় দেখা করবে ঠিক হলো। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এইটা ছিল ওয়াইয়ের সবচেয়ে প্রিয় পিৎজার দোকান। একটা বিশেষ পদ্ধতিতে অসম্ভব নরম ক্রাস্ট বানাতো ওরা, ওয়াইয়ের মনে পড়ল। দোকানটায় গিয়ে ওয়াই অবাক হয়ে দেখল বেশ কিছু জিনিস পাল্টে গেছে। বসার জায়গাগুলো আগের তুলনায় অন্যরকম হয়েছে। সিলিঙ থেকে ঝুলন্ত ইতালিয়ান আলোগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। অন্তত পুরনো স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে ওয়াইয়ের তাই মনে হল। জানলার ধারে সে একটা টেবিল দখল করল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, এক্স দেরী করছে। তাকে এক্সের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, এই ভাবনাটা তার মাথার মধ্যে খানিকক্ষণ ঘুরপাক খেল। মিনিটদশেক বাদে টুং করে দরজা-সংলগ্ন ঘন্টিটা বেজে উঠতে ওয়াই চোখ তুলে তাকাল। এক্সকে চিনতে কোনো ভুল হলো না তার। হয়তো এই আদ্যিকালের জায়গাটার বদলে ডাউনটাউনের কোনো রেস্তোরাঁয় আমাদের দেখা হলে ভালো হত, এক্স তার হাতের শপিংব্যাগগুলো রেখে চেয়ারে বসতে বসতে মন্তব্য করল। তারপর যোগ করল, টরন্টো একটা জঘন্য শহর। ওয়াই একমুহূর্তের জন্যে ব্রুকলিনের কথা ভাবল। তারা কাউন্টারে গিয়ে পিৎজা অর্ডার দিল। আমি ভুলে গেছি তুমি অতিরিক্ত চীজ পছন্দ করো কিনা, টেবিলে ফিরে এসে ওয়াই বিড়বিড় করল। না, এক্স বলল। তারপর তারা টরন্টোর আবহাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। এক্স ওয়াইকে বলল সে কোনো বছর চারটে ঋতু নিউ ইয়র্ক শহরে কাটাতে চায়। ওয়াই হাসল। হয়তো আমি কুইনসে আমার মায়ের এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাব, এক্স আনমনে বলল। ওয়াই কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। একসময় দুহাতে চুল ঠিক করতে করতে এক্স স্বাভাবিকগলায় বলল, আমি জানি জেড কোথায় আছে। ওয়াই এক্সের মুখের দিকে তাকাল। তোমাকে জেডের ব্যাপারে আগে বলতে চাইনি। কিছুদিনের জন্যে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম আমরা, এক্স ভাবলেশহীন মুখে জানাল। ওয়াই ঠিক বুঝতে পারল না এক্স কী বলছে। আমি একটা কোক নেব, সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এক্স লক্ষ্য করল কাউন্টারের কাছে গিয়ে ঝুঁকে দোকানের মেয়েটিকে ওয়াই কিছু নির্দেশ দিচ্ছে। মেয়েটা ফ্রিজ থেকে একটা কোক ক্যান বের করে দিল। তারপর ওভেন থেকে পিৎজা বের করে কাউন্টারে রাখল। তারপর, এক্স দেখল, ওয়াই একহাতে পিৎজার বাক্স এবং অন্যহাতে পানীয় নিয়ে তাদের টেবিলের দিকে আসছে। টেবিলে পিৎজা রেখে ওয়াই জিগ্যেস করল, কন্ডিমেন্টস লাগবে? না, এক্স জবাব দিল; তারপর বলল — আমাদের একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল। সেখান থেকে আস্তে আস্তে কয়েকবার ফোনে কথাবার্তা, দু-একবার হোটেলে। আমার স্বামী জানে না। এক্স পিৎজার একটা তেকোনা টুকরো তুলে নিল। বাকি সময়টা সে জেড সম্বন্ধে একটা কথাও বলল না। ওয়াই দু-একবার প্রসঙ্গটা তুলেও কোনো সাড়া পেল না। সে মনে মনে কিছুটা আহত হল। পিজারিয়া থেকে বেরিয়ে এক্স আর ওয়াই কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়ালো। আমার অবাক লাগছে, একসময় ওয়াই এক্সকে জিগ্যেস না করে পারল না, জেডের কথা আমাকে আজ বললে কেন? আমি জানি না, এক্স এই প্রথমবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তসুরে বলল, তুমি আজকের সন্ধ্যেটা আমার সঙ্গে কাটাবে কি? আমার বাড়িতে এসো বরং, হাই পার্কের কাছে। আমরা কফি খাব। ওয়াই এক্সের দিকে তাকিয়ে রইল। তুমি বড় অদ্ভুত, তাই না? সে মনে মনে ভাবল। মুখে বলল, বেশ। শপিংব্যাগগুলো হাতে ঝুলিয়ে এক্স সাবওয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল। ওয়াই তার হোটেলে ফেরার পথ ধরল।

    সেদিন সন্ধ্যেবেলা ওয়াই এক্সের বাড়িতে গেল। বিকেল থেকেই বরফ পড়ছিল; কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল তুমুল বেগে। হাই পার্কের নিকটবর্তী এলাকাটা নির্জন, দিগন্তের কাছে তখনও সূর্যাস্তের ক্ষীণ আভা লেগে আছে। ওয়াই নির্দিষ্ট একটি বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজার মাথায় আলো জ্বলছিল। ওয়াই ডোরবেল বাজাল। তারপর সে একবার পিছন ফিরে রাস্তার দিকে তাকাল। একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে ধীরে ধীরে চলে গেল। এক্স দরজা খুলে ওয়াইকে দেখে হাসল। তারপর তারা ভেতরে গিয়ে কাউচে বসল। এক্স দুটো ওয়াইন গ্লাসে পানীয় ঢেলে এনেছিল। তোমার স্বামী কোথায়? ওয়াই গ্লাসটা নিয়ে জিগ্যেস করল। টোকিওতে, এক্স পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, বিজনেস ট্যুর। ওয়াই কাউচ ছেড়ে উঠে গিয়ে বইয়ের আলমারি দেখছিল। ফ্র্যাঙ্ক ও’হারার লাঞ্চ পোয়েমস, টেড বেরিগ্যানের সনেট, বার্নাডেট মেয়ারের মিডউইন্টার ডে চোখে পড়ল তার। তুমি নিউ ইয়র্ক স্কুলের কবিতা পড়তে পছন্দ করো? ওয়াই একজন গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করল। অ্যাশবেরী বাদে, এক্স উত্তর দিল। তারা ১৯৯০-পরবর্তী আমেরিকান কবিতা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল। একসময় এক্স কফি বানাতে উঠল। আমি হেল্প করছি তোমাকে, ওয়াই বলল। ঘরের একপাশে কফির সরঞ্জাম রাখা; এক্স দুটো চিনেমাটির কাপে কফি আর দুধ মেশাচ্ছিল। ওয়াই একটু দূর থেকে লক্ষ্য করছিল। সে দেখল, একটা তীর্যক আলো কোথাও থেকে এক্সের গ্রীবায় এসে পড়েছে। তুমি সুখে আছ দেখে ভালো লাগল, সে নীচুস্বরে বলল। এক্স মুখ তুলে হাসল, যেন কথাটার কোনো মানেই নেই। তারপর তারা কফি নিয়ে কাউচে ফিরে এসে বসল। একটুখানি চুপচাপ থাকার পরে হঠাৎ এক্স বলল, জেড টরন্টো ছেড়ে চলে গিয়েছে। কোথায়? ওয়াইয়ের কৌতুহল হলেও সে প্রকাশ করল না। আমাদের সম্পর্কটা সে টেনে নিয়ে যেতে চায়নি, এক্স বলল, একদিন সে ফোন করে আমাকে বলেছিল সে চলে যাচ্ছে। জেড এগোতে চায়নি? ওয়াই অবাক হল। এক্স কোলের ওপর হাতদুটো জড়ো করে বলল, হ্যাঁ। তুমি জানো জেড কোথায় আছে? ওয়াই জিগ্যেস করল। এক্স একটা নিঃশ্বাস ফেলল, ইয়েলোনাইফে। সেইরাতে এক্সের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফেরার পথে ওয়াই অনেকক্ষণ ডাউনটাউনের রাস্তাগুলো ধরে এলোমেলো হেঁটেছিল। সে জেডের অদ্ভুত আচরণের কথা ভাবছিল। একমুহূর্তে তার কাছে যেন গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল, আবার পরমুহূর্তেই তার সবকিছু দুর্বোধ্য ঠেকছিল। এক্সের ওখান থেকে চলে আসার আগে এক্স তাকে একটা আশ্চর্য কথা জিগ্যেস করেছিল — তুমি কি ইয়েলোনাইফে যাবে? ওয়াই এতই অবাক হয়ে গেছিল যে সে কোনো উত্তর না দিয়ে দুদিকে ঘাড় নেড়েছিল। এখন তার হাসি পেয়ে গেল। সে কেন ইয়েলোনাইফে যাবে? আগামীকাল সকালে তার নিউ ইয়র্ক ফেরার ফ্লাইট। কোনো প্রশ্নই ওঠে না ইয়েলোনাইফ যাবার। হোটেলে ফিরে এসে ঘর অন্ধকার করে ওয়াই বসেছিল। মাথা থেকে আজেবাজে ভাবনা সরাতে সে তার ল্যাপটপে একটা ফিল্ম চালিয়ে দেখতে শুরু করেছিল। লিঞ্চের ইনল্যান্ড এম্পায়ার। আধঘন্টা পরেই তার ঘুম পেয়ে গেল। তন্দ্রায় তার চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে ওয়াইয়ের তার স্ত্রীকে মনে পড়ল। নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে তার স্ত্রীকে কল্পনা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপরেই সে স্বপ্নে এক্সকে দেখতে পেল। সে বুঝতে পারল অবচেতনে সে তার স্ত্রীর শারীরিক গঠন এক্সের সাথে তুলনা করছে এবং ব্যাপারটার ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। তার মনটা খারাপ হয়ে রইল। একসময় তার চেতনা শূন্য হতে হতে কেবল একটা কালো অন্ধকারে পরিণত হল। কতক্ষণ সে ঘুমিয়েছিল জানা নেই; হঠাৎ জোরালো মিউজিকের আওয়াজে তার চটকা ভেঙে গেল। সে দেখল তার ল্যাপটপে সিনেমাটা তখনও চলছে: ন’জন মেয়ে একটি ঘরে থ্রি-বাই-থ্রি গ্রিডে কোমর দোলাচ্ছে। আচমকা কেউ মিউজিক বন্ধ করে দিল আর মেয়েগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। ওয়াই দেখল স্ক্রিন জুড়ে শুধু আসবাবপত্র-সহ ফাঁকা কার্পেট পাতা। ওয়াই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিল। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে তার আফসোস হল সিগারেট খাওয়ার অভ্যেসটা ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। বাকিরাতটা সে থম মেরে বসে থাকল। ভোররাতের দিকে সে ইউপি এক্সপ্রেস ধরে এয়ারপোর্ট যাবে বলে ইউনিয়ন স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। বেরোনোর আগে এক্সকে একটা মেসেজ লিখে জানিয়ে দিল সে ইয়েলোনাইফে যাচ্ছে।

    ইয়েলোনাইফ পৌঁছে এয়ারপোর্টে নেমে ওয়াই একটা রেন্টাল কার ভাড়া করল। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটি বৈদ্যুতিন বোর্ডে তার চোখে পড়ল মাইনাস বাইশ ডিগ্রি ফারেনহাইট। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ধোঁয়াটে বরফ আর কুয়াশার দরুন দৃশ্যমানতা অবিশ্বাস্য কম। উল্টোদিকের লেনে মাত্র দু-একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে আসছে। অ্যাপোক্যালিপ্টিক ধূসরতার মাঝখান দিয়ে হাইওয়েটা অন্তহীন চলে গেছে। ওয়াই ড্রাইভ করতে করতে একসময় লক্ষ্য করল সে শহরের ডাউনটাউন এলাকায় পৌঁছে গিয়েছে। কুয়াশার ভেতর দুপাশে ভূতুড়ে বিল্ডিংগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ইন্টারসেকশনে থেমে ওয়াই গাড়ি থেকে নামল। রাস্তার পাশে কনভেনিয়েন্স স্টোরটায় ঢুকে সে কিছু চকোলেট আর বিস্কুট কিনল। তারপর বুড়ি দোকানীকে সে জিগ্যেস করল দোকানে বাথরুম আছে কিনা। বুড়ি নিস্পৃহমুখে তাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিল। খুব অপরিস্কার নয়, ওয়াই বাথরুমে ঢুকে টয়লেট সেরে নিল। তারপর বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে ঝাপসা আয়নায় তার নিজেকে চোখে পড়ল। আমার স্ত্রী জানেনা আমি ইয়েলোনাইফ এসেছি, সে মনে মনে চিন্তা করল। তারপর সে ভাবল যদি তাকে কেউ এখানে খুন করে ফ্যালে, লাশটা লোপাট করতে আদৌ কোনো অসুবিধে হবে না। কথাটা ভেবে সে হাসল। স্টোরটা থেকে বেরিয়ে সে গাড়ির দরজা খুলে সীটে বসে জিপিএস দেখতে লাগল। মিনিটপনেরো বাদে সে একটা স্থানীয় মোটেলে চেকইন করল। মোটেলের ঘরে সে রাতটা ঘুমিয়ে নিল। পরের দিন সকালে উঠে সে এক্সের দেওয়া একটা ঠিকানা খুঁজতে বেরোলো। আজকে বরফ খানিকটা কম। আধঘন্টা গাড়ি নিয়ে ঘুরে সে জিপিএস দেখে ঠিক রাস্তায় পৌঁছল। গাড়ি চালাতে চালাতে জানলার কাঁচ নামিয়ে সে বাড়িগুলোর নম্বর দেখার চেষ্টা করতে লাগল। একসময় অসাবধানে তার গাড়িটা রাস্তার পাশে বরফে উঠে গেল আর সে জোরে ব্রেক কষতেই এঁকেবেঁকে স্কিড করতে করতে গিয়ে ধড়াম করে একটা বাড়ির সামনে রাখা গার্বেজ বিনে ধাক্কা খেল। একরাশ বরফ উড়িয়ে গাড়িটা থেমে যেতেই বাড়িটার ভেতর থেকে একটা কুকুরের আওয়াজ শোনা গেল। কুকুরের বকলশ ধরে টানতে টানতে একজন দাড়িওয়ালা লোক দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ওয়াই গাড়ির জানলা থেকে দেখেই জেডকে চিনতে পারল। অবশেষে, সে মনে মনে ভাবল। পুরো ব্যাপারটাই জেডের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছিল। ওয়াই তাকে খুব সংক্ষেপে সবকিছু জানাল। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমাকে খোঁজার জন্যে তোমাকে এত ঝকমারি করতে হয়েছে, জেড হো-হো করে হেসে উঠল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে তারা দুটো বিয়ার ক্যান খুলে পাশাপাশি রাখা বিন ব্যাগ চেয়ারে বসল। জেডের কুকুরটা তাদের সামনে এসে আড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বিয়ারে চুমুক দিয়ে শরীরটাকে খানিকক্ষণ গরম করে নেওয়ার পর ওয়াই জেডকে জিগ্যেস করল সে ইউনিভার্সিটির কাজটা ছেড়ে দিল কেন। কারণ আমার আর ভালো লাগছিল না, জেড কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের প্রতি আমার আর কোনো শ্রদ্ধা নেই। কী বলতে চাইছ? ওয়াই বলল। আমি আমার জীবনে প্রথম যে সিস্টেমটার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলাম, সেটা হল ঈশ্বর আর সেজন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই, জেড হাসল। তারপর সে ফাঁকা বিয়ারক্যানটা মেঝেতে গড়িয়ে দিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কিন্তু ইউনিভার্সিটির ওপর আমার টান অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। হ্যাঁ, এখন আমি বুঝে গেছি ইউনিভার্সিটিগুলো স্রেফ কেরানি যোগান দেওয়ার ফ্যাক্টরি। রিসার্চের প্রতি আমার আর কোনো আগ্রহ নেই। ওয়াইয়ের চকিতে মনে পড়ল জেডের পেপারটার কথা। তুমি দাড়ি রেখেছ দেখছি, সে বলল। জেড দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, কেটে ফেলব। কেটে ফেলব। শীতটা পেরোক। আমি জানিনা তোমাকে কী বলা উচিত, ওয়াই আনমনে বলল, কিন্তু ইয়েলোনাইফে পালিয়ে এলে কেন বুঝতে পারিনি। আর এখানেই থেকে যাবে? আমি বিচ্ছিন্নতা চাই, জেড বলল। এক্সের থেকে? — ওয়াই জিগ্যেস করল। জেড কথাটা শুনেও শুনতে পেল না। এক্স আমায় পাঠায়নি কিন্তু, ওয়াই আবার জোর দিয়ে বলল, আমি নিজেই এসেছি। জেড হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল — চলো, মদ খেয়ে আসা যাক। তুমি গ্রেট স্লেভ লেক দেখেছ? শীতকালে জমে গেলে ওর ওপর দিয়ে ট্রাক যাতায়াত করে।

    ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভেনিউ ধরে জেড ওয়াইয়ের গাড়িটা চালাতে লাগল। কিছুদূর যাবার পরে ওয়াই আচমকা হাসতে শুরু করল। জেড তার দিকে তাকাল। আমি ভাবতে পারছি না কেউ চাকরি ছেড়ে ইয়েলোনাইফে চলে আসতে পারে। আমাকে এখানে থাকতে হলে হয় পাগল হয়ে যাব নয়তো আত্মহত্যা করব, সে বলল, এখানকার গোল্ডমাইনগুলো পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে কেউ আসবে কেন? হয়তো হীরের জন্যে, জেড বলল। তারপর দুজনেই হাসতে লাগল। গ্রেট স্লেভ লেকের কাছে একটা ব্র্যু হাউসে পৌঁছে জেড গাড়িটা থামালো। তুমি মার্গারিটা নেবে? ভেতরে ঢুকে ওয়াইকে জিগ্যেস করল জেড। তারপর তারা দুটো পানীয় অর্ডার দিয়ে একটা টেবিলে বসল। ওয়াই লক্ষ্য করল ব্র্যু হাউসের ভেতরটা ফাঁকা নয়, বরং মোটামুটি ভিড়। ওরা এসেছে মেরুজ্যোতি দেখতে, জেড ওয়াইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল। তুমি দেখেছ কখনো? ওয়াই জিগ্যেস করল। নাহ, জেড হাসল, শহরের আলো থেকে দূরে যেতে হয়। ক্যাম্পে। তাদের মদ এসে পড়লে ওয়াই চুমুক দিয়ে বলল, তোমার ডিপ্রেশন আছে? ক্লিনিক্যালি নেই, জেড বলল, তবে যেকোনো পূর্ণবয়স্ক মানুষেরই কিছুটা থাকে বোধহয়। আমার আছে, ওয়াই বলল, আর সেটা নিয়ন্ত্রণে থাকে কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে। সেরকমটা সম্ভবত সত্যি নয়, জেড বলল, ম্যানহ্যাটান আইল্যান্ডের স্ট্যাটিস্টিকস কী বলে? ওয়ার্ক্যাহোলিকদের মধ্যে ডিপ্রেশন কেমন? আমি জানি না, ওয়াই বলল, কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট করে বলি। তুমি নিরাশাবাদী হয়ে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়েছ, এটা আমার ইরিটেটিং লাগছে। জেড তার লম্বা গেলাসভর্তি বিয়ারে চুমুক দিয়ে খানিকটা থমকে গেল। সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে তুমি আর আমি খুব আলাদা কেউ নই, ওয়াই বলল, বরং গবেষণার ক্ষেত্রে তুমি বেশি সফল। কিন্তু আমি যখন নিউ ইয়র্কে থাকি, আমার একটা মেয়ে আছে, আমি তাকে দেখি, আমি সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারিনা। সেরকম ভাবা তোমার ভুল হবে, জেড বিড়বিড় করল, কেনই বা ভাববে তুমি? কারণ আর কিছুই নয়, তুমি যেন আমার সামনে বসে প্রমাণ করে দিচ্ছ জীবনটা নিরর্থক, ওয়াই বেশ উত্তেজিতভাবে বলল, টরন্টোতে কিছুই কি ছিল না তোমাকে আটকে রাখার মতন? তুমি এক্সের সাথে জড়িয়েছিলে কেন? আমরা জীবনে অনেক কিছু করি যার কোনো মানে নেই, জেড বলল, এক্সকে আমি ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু প্রেম আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। তোমার মনে হয়না এরকম? ওয়াইয়ের হঠাৎ নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়ল। তোমার যুক্তি ভুলভাল, ওয়াই বলল, আর তোমার ধারণাগুলো যদি সত্যি হয়েও থাকে, তুমি কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পাওনি। না, আমি কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি, জেড জবাব দিল। তারপর তারা কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপচাপ মদ খেতে লাগল। ব্র্যু হাউসের ভেতরে ফ্ল্যাটস্ক্রিনে শব্দহীন বাস্কেটবল ম্যাচ চলছিল। কেউ খুব একটা দেখছিল না। রাতগুলো এখানে দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর, জেড স্বগতোক্তির মতো বলল, বিশেষত শীতকালে। আমি রেডিও শুনে অনেকটা সময় কাটাই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের স্টেশন আমার প্রিয়। তখন আমি ততটা বিচ্ছিন্ন বোধ করিনা। টরন্টোতে থাকতে একদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল, বুঝলে? আমার জীবনের সবচেয়ে ডিস্টার্বিং অভিজ্ঞতা। আমি রাতের এক্সপ্রেসওয়ে ধরে একা ড্রাইভ করছিলাম। হঠাৎ দৃশ্যটা আমার চোখে পড়েছিল। এক্সপ্রেসওয়ের দুদিকে ধূসর অরণ্য চলে গিয়েছে আর সামনের আকাশ জুড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের বিস্ফোরণ। ছায়াপথ কি আগেও দেখিনি? কিন্তু সেই রাতে সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে কী যেন একটা পাল্টে গেছিল। সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়েছিল আমার। হয়তো আমার নির্বাসনের সিদ্ধান্ত ভুল। হয়তো এজন্যে আমাকে অনুশোচনা করতে হবে। তবুও এটাই ভাল। একেবারে আশাহীন আমি নই। আশাকে পুরোপুরি মেরে ফেলা যেকোনো জীবিত মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। মাঝে মাঝে এক্সের কথা আমার মনে পড়ে, যদিও আমি জানি আমাদের পক্ষে একসঙ্গে থাকা সম্ভব ছিলনা। সবকিছু ভেঙে যাওয়াই ভালো। তুমি কি এক্সকে এখনও ভালোবাসো? ওয়াই প্রশ্ন করল। জেড হেসে উঠল। বিল মিটিয়ে ব্র্যু হাউসটা থেকে বেরিয়ে ওরা কিছুক্ষণ গ্রেট স্লেভ লেকের ওপর ড্রাইভ করে বেড়ালো। শীতকালীন ইয়েলোনাইফে ইতস্তত পর্যটক নজরে পড়ে। তবুও ধু-ধু বরফের প্রান্তরের ওদিকে ফ্যাকাশে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ওয়াইয়ের মনে হল, সে যেন পৃথিবীর শেষপ্রান্তে চলে এসেছে। আমার এক শিকারী বন্ধু আছে, জেড মজা করে বলেছিল, কোনো একবছর আমরা আর্কটিকে তিমি শিকার করতে যাব। স্লেভ লেক থেকে চলে আসার পথে জেডকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়েছিল ওয়াই। তুমি কি ফিরে যাবে? জেড তাকে জিগ্যেস করল। হ্যাঁ, ওয়াই অন্যমনস্কভাবে বলল, আমার স্ত্রীকে একবার ফোন করতে হবে। বেশ, জেড বলল। তারপর সে বাড়ির দরজা খুলতেই কুকুরটা বেরিয়ে এসে তার পায়ে ঢুঁসো মারতে লাগল। ওয়াই গাড়িটা ব্যাকগিয়ারে রেখে পিছনদিকে গিয়ে তারপর ঘুরিয়ে নিল। সাইড মিররে সে দেখল জেড কুকুরটার বকলশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াই হাত নাড়ল জেডের উদ্দেশ্যে। তারপর ঘুরন্ত চাকায় অনেকখানি বরফ উড়িয়ে সে বেরিয়ে গেল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১৪ মার্চ ২০২২ | ১৯৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২০ মার্চ ২০২২ ০৫:৪৫505052
  • স্বীকার করি, সম্পর্কগুলো এইরকমই জটিল, যান্ত্রিকও। ভেংগে যায়, আবার ঠিক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয় না। 
     
    এমনকি হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এই পোড়া দেশেও। 
     
    এক্স ওয়াই জেড চরিত্রের নামকরণ কিছুটা একঘেয়ে লেগেছে, একে বিদেশ বিভুই, তায় সম্পর্কের টানা- হেঁচড়ার গল্প, সবগুলো চরিত্রের মানানসই নাম, সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় দৃশ্যপট আরও পাঠ বান্ধব হতে পারতো। 
     
    গ্রাহক হলাম। আরও লিখুন। শুভ yes
  • প্রদীপ কুমার বিশ্বাস | 116.193.***.*** | ২২ মার্চ ২০২২ ১৪:০১505176
  • নি:সন্দেহে  খুব ভালো গল্প তবুও আমার  মনে হয় এতো সুন্দর প্রাণবন্ত ন্যারেটিভ একটু ইন্টারেকটিভ হলে বা সংলাপ থাকলেএবংগ সেই সাথে যে পেপারটা নিয়ে গল্পতা তার সাথে পাঠককে  জড়িয়ে দিলে    গল্পের টান মজবুত থাকতো । গল্পের ঈর্ষনীয় সম্পদ এর ন্যারেটিভ যেমন "এক্সের কথা উঠল। টেরেসের ধারে কয়েকটা টব রাখা; টব থেকে লতানে গাছ গড়িয়ে নেমেছে। নীচে রাস্তা থেকে ট্রাফিকের কিছু কিছু শব্দ ছিটকে আসছে, নিউ ইয়র্কের সাউন্ডস্কেপ; রাস্তার ওপারে অন্ধকার বিল্ডিঙয়ের গায়ে খোপ-খোপ আলো। একটা এয়ারোপ্লেন লাল-সবুজ নেভিগেশন লাইট জ্বেলে জেনিথ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে দেখতে দেখতে ওয়াই এক্সের কথা ভাবল। হঠাৎ তার মনে হলো এক্সের সাথে যোগাযোগ করলে জেডের খবর জানা যেতে পারে।"সত্যিই  দারুণ ,  এইরকম বর্ণনা আর ভাষা কেন যে আমি দিতে পারি না? শিখলাম এই গল্প থেকে অনেক কিছু ।  
     
     
     
     
     
  • dc | 2a02:26f7:d6c0:680d:0:cba6:15e7:***:*** | ২২ মার্চ ২০২২ ১৪:৪৬505177
  • পেপারটা ম্যাকগাফিন। গল্পের প্লটটা ভালো, তবে আরেকটু সময় নিয়ে লিখলে ভালো হতো। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন