এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • স্মৃতি ও অন্যান্য ধূসরতার শহর

    সায়ন্তন চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ | ৩৩৮৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • "... হিমাঙ্কের নীচে সবকিছু স্থবির হয়ে আসছে ... নষ্ট নয়, জীবিত নয়, সবকিছু এখন ফ্যাটফ্যাটে শাদা ... এখন সন্ধ্যের আকাশ ঢেকে যাচ্ছে ধোঁয়ায় ... শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে ... বেওয়ারিশ লাশ আর আগুন, এখানে-সেখানে ... চুরমার হয়ে যাওয়া দোকানপাট, ঘরবাড়ি ... জ্বলন্ত বাস, গাড়ির এঞ্জিন ... পোড়া টায়ারের গন্ধ ... রাস্তায় ঢিলের টুকরো, পাথর ... টিয়ার গ্যাসের শেল, লাঠি, বোমা ... কোণাকুণি দৌড়ে আসছে মানুষ ... কোণঠাসা হয়ে পড়া মানুষ ... আমার জানলা থেকে এসব অনেক দূরের দৃশ্য ... আমি শুয়ে আছি ফ্লুরোসেন্ট আলোর নীচে স্থির … নার্সিংহোমের চারতলায় এই নির্জন ঠান্ডা কেবিন … বেডের পাশে বেল টিপলে এক্ষুনি ছুটে আসবে সাদা-পোশাক পরা সিস্টার … টেবিলে কমলালেবু আর আপেলভর্তি ঝুড়ি … বিছানার কোণে স্যালাইনের স্ট্যান্ড …স্বচ্ছ ব্যাগের ভেতর চুঁইয়ে পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা তরল … সময় দেখার জন্যে আমার কাছে কোনো ঘড়ি নেই … তবু আমি সবকিছু টের পাচ্ছি, যা কিছু এই ঘরে সামান্যতম স্থান পরিবর্তন করছে … এমনকি যা কিছু এই নিথর দেয়ালগুলোর বাইরে ঘটছে … কারণ আমি এই শহরে কাটিয়েছি আমার সংগ্রহের সবক'টা বছর … আমি কখনও এই শহর ছেড়ে যাইনি … আমার নাম মঞ্জু … এখন আমার মাথায় শননুড়ি চুল … কুঁকড়ে আসা চামড়া, শিথিল ঠোঁট … দাঁতগুলো পড়ে গ্যাছে সব … এখন সবাই আমার চেয়ে কমবয়েসী … এই শহরের বিভিন্ন ঠিকানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার ছেলেমেয়েরা, নাতিনাতনি … এমনকি যারা চলে গ্যাছে, যেমন আমার বাবা-মা, আমার স্বামী … তারাও আছে এই স্মৃতির শহরজুড়ে … মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি যেন সবসময় এই শহরে ছিলাম … যেন আমি গালিব সাহেবকে দেখেছি … যেন চোখের সামনে দেখেছি মুঘল সম্রাটদের হেরে যেতে … আস্তে আস্তে তামাম হিন্দুস্তান জুড়ে ব্রিটিশরাজের প্রতিষ্ঠা … এসব সত্যি নয়, খোয়াবের কথা … আসলে আমি যা দেখেছি সারাজীবন, তা হলো দাঙ্গা … আর দাঙ্গা-চিহ্নিত বছরগুলো পেরিয়ে আসতে আসতে আমার চুলে বরফ জমেছে … বুড়ো বয়েসে চামড়ার রঙ হয়ে গ্যাছে ফর্সা … এখন আমার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চিন্ত হতেন … মেয়ের চাপা রঙ নিয়ে তাঁর ভারী চিন্তা ছিল … তখন আমি সত্যিই ফর্সা ছিলাম না, ফর্সা ছিল নার্গিস …"

     

    ঝিরঝিরে বৃষ্টি, ভোরের আকাশ ঘোলাটে মেঘে ছেয়ে আছে; যেরকম হয়ে থাকে সচরাচর লন্ডনের আবহাওয়া। রাস্তার পাশে পার্ক-করা গাড়িগুলোর বনেট বিন্দু বিন্দু জলে ভরে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো ফোঁটা জুড়ে বড়ো হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। শহর এখনও পুরোপুরি জাগেনি। রাস্তা, রাস্তার পাশে পেভমেন্ট, বন্ধ ক্যাফে বা পাবের বাইরে বসার জায়গাগুলো — সব আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বৃষ্টির ধূসরতায়। একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে এদিকে আসছে, উইন্ডস্ক্রিনে ব্যস্ত ওয়াইপার, এসে থামল পেভমেন্টের পাশে। পেভমেন্টের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেন ট্রী-টার ভেজা বাদামী গুঁড়ি বরাবর চোখ পিছলে উঁচুতে তাকালে দেখা যাবে, যেখানে গাছটির পাতাগুলো প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে একটি ফ্ল্যাটের জানলা, সেন্ট্রাল লন্ডনের ঐ ফ্ল্যাটটিতে আলো জ্বলছে। ফ্ল্যাটের ভেতরে এক বৃদ্ধা একা-হাতে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর শান্ত ভঙ্গীর মধ্যেও একটা নীরব চাঞ্চল্য মিশে ছিল, কেননা তাঁকে ফ্লাইট ধরতে হবে। নিজের হ্যান্ডব্যাগ খুলে তিনি আরেকবার চেক করলেন পাসপোর্ট ও অন্যান্য দরকারী কাগজপত্রগুলো। ফ্ল্যাটের দরজায় ঠকঠক; গাড়িটা পার্ক করে তাঁর নাতনী রেহানা ওপরে উঠে এসেছে। ঘরে ঢুকে — এই পাগলামিটা না করলে চলত না মাম্মাম? এই বয়েসে কেউ এরকম করে?
    বৃদ্ধা গম্ভীরভাবে বললেন — কেন, এই বয়েসে কেউ কি ট্র্যাভেল করে না? আর আমি দিব্যি শক্ত আছি।
    রেহানা হেসে — শক্ত নেই কবে বললাম? তা বলে ইন্ডিয়া ট্র্যাভেল করবে? আর যাচ্ছই বা কেন? অ্যাকাডেমিক কনফারেন্স না, কিছু না — ঝুঁটি নেড়ে — এখন তোমার ফায়ারপ্লেসের ধারে বসে মেমোয়্যার লেখবার বয়েস।
    বুড়ি নার্গিস জানলার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির দাগ দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলেন — স্মৃতিই তো, —

     

    "... এখন আমার স্মৃতি একটা জিবারিশ বইয়ের ভেতর কয়েকটা আচমকা অর্থপূর্ণ বাক্যের মতো … তবু স্পষ্ট মনে আছে অনেকদূরের ঝলমলে সকালটা ... যেদিন নার্গিসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ... সেই কনভেন্ট স্কুলে প্রার্থনার লাইনগুলো ... আমার পিছন থেকে আচমকা কে যেন চুল ধরে টান মেরেছিল ... 'আঁক' করে চেঁচিয়ে উঠতেই, চারদিকে নানারকম পাপকাজ হয়ে চলেছে এরকম একটা ভয়ে যিনি সবসময় একইসঙ্গে ভীত এবং অতিসতর্ক, সেই সিস্টার রোজালিন অচেনা মেয়েটাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে পিছনে আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন আর মেয়েটা সিস্টারের নজর এড়িয়ে আমাকে একটা ভেঙচি কেটেছিল ... সেদিনই আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল নার্গিসের সাথে ... স্মৃতির ঘ্রাণ যেন এলাচ দেওয়া চায়ের মতন ... মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের মৃত্যুর পর শুধু মনে থাকবে বৃষ্টিঝরা ভোরগুলোর স্মৃতি ..."

     

    জল পড়া থামেনি, তবুও তার মধ্যেই ট্রাফিক; লাল ডবলডেকারগুলো বৃষ্টি ভেঙে চলেছে। নার্গিস গাড়ির ব্যাকসিটে বসে ভাবছিলেন আনমনা কথা। রেহানা চুপচাপ ড্রাইভ করছিল; সে বৃদ্ধার গম্ভীর স্বভাবকে একটু ভয় পায়। শুধু সে নয়, নার্গিস যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন, তখন ছাত্রছাত্রীরাও তাঁকে কিছুটা সমঝে চলত। গ্রেডের ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া এই প্রফেসরের কোর্স তারা অপছন্দ সত্ত্বেও নিতে বাধ্য হত, কারণ আধুনিক ভারতের ইতিহাস বিষয়ে নার্গিস একজন অথরিটি। ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং প্রসার সম্পর্কে তাঁর পঞ্চাশের দশকের ডক্টোরাল থিসিস এখনও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা মনে করেন। ১৯৫৭ সালে লন্ডনের এক তরুণ উকিল ফিরোজ খানের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হয় এবং বছরখানেক পরে তাদের একমাত্র সন্তান জন্মায়: রেহানার মা। পরবর্তী বছরগুলোয় নার্গিস কেম্ব্রিজ স্কুলের একজন অন্যতম প্রধান চর্চাকারী হিসেবে স্বীকৃতি পান। তখন অবশ্য কেম্ব্রিজ স্কুল অফ হিস্টোরিওগ্রাফি মূলতঃ চিহ্নিত ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রতিপক্ষ রূপে এবং এই ধারায় ন্যাশনালিজমের ক্রিটিক হিসেবে নার্গিস বেশ কিছু কংক্রিট অবদান রাখেন। ব্যক্তিগত জীবনে এইসময় নার্গিসের প্রথম বিয়েটা ভেঙে যায়; ১৯৬৭ সালে ফিরোজ খানের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

     

    "... এই যে রাস্তাটা, এটা পেরিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মুরগির কাটলেট ... নার্গিস এত উচ্ছ্বসিতভাবে কথাটা বলেছিল যে আমি হেসে ফেলেছিলাম ... কোনো কারণে একটু আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় সেদিন আমরা চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিলাম স্কুলের বাইরে ... তারপর নার্গিসের মাথায় ভূত চাপল ... তোকে বলছি আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ... দৈববাণীর মতো ঘোষণা করেছিল ... আমার বাবা ইউরোপ অব্দি ঘুরে এসে বলেছে ... শুনে বেজায় মজা লেগেছিল আমার ... এই মেয়েটা যেকোনো গল্পে অন্ততঃ একবার বাবার উল্লেখ করবেই ... কিন্তু নার্গিসের কথাটা সত্যি, আমি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলাম অসম্ভব সুস্বাদু কাটলেটে কামড় বসিয়ে ... সেদিন বাড়ী ফিরে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমরা রাস্তা পেরিয়ে একা একা কাটলেট খেতে গেছিলাম এবং ফের রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে ফিরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম বাধ্য মেয়ের মতন ... আর এইভাবেই আমার জীবনের প্রথম গোপন কথাটার ভেতর আমি ঐ বিচ্ছিরি নোংরা মতো ছোট্টো ঘুপচি রেস্তোরাঁটাকে লুকিয়ে রেখেছিলাম ... ওখানেই তো শেষবার দেখা হয়েছিল নার্গিসের সাথে ... ওর ম্লান মুখটা মনে পড়ে ... কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, যেন সব কথা শেষ হয়ে গেছিল ... অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে মুখোমুখি বসে থাকার পর নিজের হাতদুটোকে কোথায় রাখব বুঝতে না পেরে নার্গিসের হাতদুটো ছুঁতে গেলে নার্গিস আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়েছিল ... তোদেরকে তো দিল্লি ছেড়ে যেতে হবে না ... বলে ধীরে ধীরে উঠে চলে গেছিল ও ..."

     

    এমার্জেন্সির কিছুটা পরে প্রথমবার নার্গিস দিল্লি ফেরেন; ততদিনে তাঁর দ্বিতীয় বিয়েটাও ভেঙে গেছে। পার্টিশনের ওপর একটা ওয়ার্কশপে তাঁর বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। ওয়ার্কশপের মাঝে রেস্তোরাঁটায় গেছিলেন তিনি। রেস্তোরাঁটা প্রায় একইরকম রয়ে গেছে, শুধু দেয়ালে বোম্বের ফিল্মস্টারদের পোষ্টারগুলো বদলে বদলে যায়; সেবার তবু তিনি চিনতে পেরেছিলেন অমিতাভ বচ্চনকে, কিন্তু পরেরবার কার্গিল যুদ্ধের সামান্য আগে একটি আলোচনাচক্রে যোগ দিতে দিল্লি এসে তিনি কিছুতেই চিনতে পারলেন না বুকের দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো সুন্দর চেহারার ছেলেটিকে। দীর্ঘদিন সিনেমা দেখেননি তিনি, কোনো খোঁজ রাখেননি হিন্দি ফিল্মজগতের। আলোচনাচক্রটিতে তাঁর সঙ্গে সাবল্টার্ন স্টাডিজের সদস্যদের প্রচণ্ড বিতর্ক হয়। কেম্ব্রিজ স্কুলের বিরুদ্ধে সাবল্টার্ন স্টাডিজের সমালোচনাকে তিনি তীব্র আক্রমণ করেন। কেম্ব্রিজ স্কুল সম্পর্কে মূল অভিযোগ এই যে, তাদের ইতিহাস রচনার ভিত্তি প্রধানত ব্রিটিশদের সরকারী রেকর্ড ও আর্কাইভ; ভারতীয় ভাষাগুলিতে যেসব উপাদান পাওয়া যায়, সেসব কেম্ব্রিজ বিশেষ গুরুত্ব দেয়না। অর্থাৎ তাদের ইতিহাস আসলে অভিজাতশ্রেণীর ইতিহাস। ইতিহাসের মার্ক্সিস্ট বিবরণটিকেও সাবল্টার্নরা এলিট বলে চিহ্নিত করে, ফলে মার্ক্সবাদীদের সঙ্গেও তাদের ঝগড়া বেঁধে যায়: '… because you have the term subaltern on one side, you don't have the bourgeoisie on the other side, you have elites - and whether they are imperialist elites or nationalist elites, it doesn't apparently matter.' (Habib, Irfan, 1995, Gandhi and the National Movement) যাইহোক, ঐ আলোচনাসভায় বিতর্কের কোনো চরম মুহূর্তে নার্গিস বিরক্ত হয়ে ব্যঙ্গের সুরে বলেন — একটা ক্লিশে জোক মনে পড়ছে। ফরাসী বিপ্লবের সময় যখন এলিটদের ধরে ধরে গিলোটিনে মুণ্ডু কাটা হচ্ছে, তখন কোনো কারণে গিলোটিনের ব্লেড মাঝপথে নেমে আটকে যেতে থাকে আর লোকে ভাবে ঈশ্বর করুণা করছেন। তো, এক এঞ্জিনিয়ারকে আনা হয়েছে, সে দেখেই বলে দিলো কোথায় আটকে যাচ্ছে যন্ত্রটা। অতঃপর এলিট এঞ্জিনিয়ারের গলা কাটা যেতেই সাবল্টার্ন লোকজন সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছিল, এই ব্যাটাই প্রকৃত পাপী। বলা বাহুল্য, এরপর নানারকম আপত্তি ও গন্ডগোলে আলোচনা ভন্ডুল হয়ে যায়। আলোচনার শেষে নার্গিস সেই রেস্তোরাঁটায় গিয়েছিলেন। এমার্জেন্সির পরে যখন দিল্লি এসেছিলেন, সেবার যেমন, এবারও রেস্তোরাঁটায় ঢুকেই তাঁর বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল যদি দেখা হয়ে যায় মঞ্জুর সাথে। মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হয়নি, হবার কথাও ছিলনা। মনে পড়ল, আগেরবার আয়োজকদের পক্ষ থেকে যে অল্পবয়েসী মেয়েটি তাঁকে এয়ারপোর্টে নিতে গিয়েছিল আর দিল্লিতে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী হয়ে ছিল, তার নামটা, অদ্ভুত সমাপতন, প্রিয়দর্শিনী। ওয়ার্কশপের ফাঁকে তিনি যখন সেই রেস্তোরাঁটা একবার দেখতে যেতে চেয়েছিলেন, প্রিয়দর্শিনী জিগ্যেস করেছিল — আরে আপনি বুঝি দিল্লিতে থেকেছেন কখনও? গম্ভীরভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তিনি বলেছিলেন — আই ওয়াজ বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ ইন লান্ডান। প্রিয়দর্শিনী আর কিছু বলেনি, মনে মনে ভেবেছিল এইসব বিদেশী স্কলাররা যতই পার্টিশনের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করুক না কেন, আসলে এরা ব্রিটিশদের মতোই অহংকারী, আর ভারত এদের কাছে স্রেফ একটা ল্যাবরেটরি মাত্র। গম্ভীর এবং অহংকারী নার্গিস বছরের পর বছর শুষ্ক তথ্য আর বিবরণগুলো ঘেঁটে একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে কাজ করে যাবেন কঠিনমুখে, যদিও কাউকে কোনোদিন জানতে দেবেননা পার্টিশনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগ ছিল।

     

    "... উপমহাদেশের রাজনীতি ক্রমশ যে জটিল ভুলভুলাইয়ার ভেতর পাক খেতে খেতে '৪৭ সালের দিকে এগিয়ে চলেছিল, তার একটু পাশে বসে নার্গিস আর আমি জীবনের রঙগুলোকে ছেঁকে-ছেনে নিচ্ছিলাম নিজেদের মতো করে ... নার্গিসের বাবা ওসমান সাহেব ব্যবসা নিয়ে যত না মাথা ঘামাতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ ছিল তাঁর ফরাসী মদ আর উৎকৃষ্ট সাহিত্যের প্রতি ... দিলদরিয়া আড্ডাবাজ মানুষ, মাঝে মাঝে গালিবের কবিতা আউড়ান ... লখনৌয়ের নবাবদের ক্ষেত্রে যেটা ছিল দাবার বোর্ড, ওসমান সাহেব সেটাকে পাল্টে নিয়েছিলেন একটা লাইব্রেরীতে ... আর বাবার সেই লাইব্রেরীর ভেতর দিয়েই নার্গিস একটা বিরাট বড় পৃথিবীর আভাস-আন্দাজ পাচ্ছিল ... সময় দ্রুত পাল্টাচ্ছিল ... বিশ্বযুদ্ধের অস্থির বছরগুলো শেষ হয়ে যাবার পর একদিন রেস্তোরাঁয় পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা পর্দা-ঘেরা কেবিনে বসে নার্গিস বলেছিল, একটা জিনিস দেখবি? ... তারপর দু'আঙুলের ফাঁকে তুলে ধরেছিল একটা সিগারেট ... ওর বাবার টিন থেকে ... প্রথমে ও টেনেছিল, তারপর আমি ... দারুণ কৌতুহলের বশে একবার জোরে টানতেই সঙ্গে সঙ্গে কাশি ... নার্গিস হাসছিল ... সিগারেট হাতে ওকে ঠিক মার্লিন ডিট্রিচের মতো দেখাচ্ছিল ... কখনো কখনো আমরা একসাথে বই পড়তাম ... বিশেষত বিদেশী সাহিত্য ... যৌনবর্ণনার জায়গাগুলো পড়তে পড়তে দুজনে অসম্ভব কৌতুহলে আর উত্তেজনায় ছটফট করতাম যেন ... যেন একটা বন্ধ দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরোনো ঘরের আলোআবছায়াগুলোকে আবিস্কার করে ফেলছিলাম হঠাৎ … তারপর একদিন আমরা পড়ে ফেললাম একটা উর্দু ছোটগল্প যার নাম 'লিহাফ' … প্রথমে আমি গল্পটা বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝে আমার কানদুটো লাল হয়ে গেছিল …"

     

    ১৯৮৩ সালে নার্গিস তৃতীয়বার বিয়ে করেন, আন্দ্রেই জাখারভ নামে এক প্রৌঢ় রাশিয়ান গণিতবিদকে। জাখারভ সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ব্রিটেন এসেছিলেন অধ্যাপনার সূত্রে, এবং ডাইভার্জেন্ট সিরিজের ওপর তাঁর বক্তৃতাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু রাতে লন্ডনের বিভিন্ন পাবে তাঁকে দেখা যেত লোকজনের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়তে, যা কখনও কখনও হাতাহাতি অব্দি গড়াত। এমন নয় যে, সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে তাঁর নিজের কোনো সমালোচনা ছিল না, কিন্তু অন্য কেউ মস্কোর বদনাম করলে, স্তালিনকে গালাগাল দিলে তিনি ঘুষি পাকিয়ে শাসাতে ছাড়তেন না। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মাঝেমাঝে তিনি বলতেন — গন্ডমূর্খের দল, সলঝেনিৎসিন না পড়ে ভার্লাম শালামভের কোলিমা টেলস পড়ে দ্যাখো! নার্গিসের সঙ্গে তাঁর আলাপ হবার কিছুদিন পরে দুজনে বিয়ে করেন। প্রেম কখনও স্নেহ দেয়নি, করুণা করেনি এবং দয়া দেখায়নি নার্গিসকে; নিশ্চিতভাবেই যেকোনো মানবিক ভঙ্গী থেকে অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকেছে প্রেম, লাইটহাউসের মতোই — যদি কেউ এসে পড়ে, সে আসতে চেয়েছিল বলেই — পথভুল করতে পারে এমন সকলকেই সে পথ দেখিয়ে তাড়িয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক এই যে, প্রৌঢ় বয়সের প্রেম নার্গিস ও আন্দ্রেইকে ভীষণ কাছে এনে দিল। তাঁরা মাঝেমধ্যে সন্ধ্যেবেলা সিনেমা বা থিয়েটার দেখতে যেতেন একসাথে, ফেরার সময় নার্গিসের হাতটা নিজের ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে আঁকড়ে থাকতেন আন্দ্রেই; এতগুলো বছর লন্ডনে কাটাবার পর এই প্রথম শহরের রূপ ও সৌন্দর্যের দিকটা নার্গিসের চোখে পড়তে থাকে। বৃষ্টি আর তুষারের ঋতুগুলি পেরিয়ে যেতে যেতে যখন শোনা যাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আসন্ন, সেইসময় একদিন আচমকা আন্দ্রেই মাঝরাতে নার্গিসকে ডেকে তুলে বললেন জরুরী কারণে তাঁকে মস্কো যেতে হবে, একা। যাওয়ার আগে একদিন দুজনে সিনেমা দেখতে গেলেন: ৮৪ চ্যারিং ক্রস রোড। আন্দ্রেই চলে যাবার কয়েকমাস পরে হঠাৎ নার্গিস খবর পেয়েছিলেন মস্কোর শহরতলিতে কোনো পার্কে আন্দ্রেইয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে; পুলিশ জানিয়েছিল প্রচন্ড শীতে হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে, আন্দ্রেই ওখানে কী করছিলেন তা অবশ্য বলতে পারেনি। হয়তো ছোটোবেলার জায়গাগুলোর স্মৃতি আন্দ্রেইকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছিল রাশিয়ায়; নার্গিস জানেন স্মৃতি মানুষকে কীরকম ভূতগ্রস্ত করে দিতে পারে। আন্দ্রেইয়ের মৃত্যুর পর হঠাৎ স্বামীর পদবী ব্যবহার করতে শুরু করলেন নার্গিস জাখারোভা। সম্ভবত এজন্যে যে, আন্দ্রেইয়ের স্মৃতি জেদী আর একগুঁয়ে নার্গিসকে, যিনি জীবনে কোথাও মানিয়ে নিতে পারেননি, তাঁকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছিল আরেকজন পুরুষের স্মৃতির ধূসরতা থেকে — তিনি নার্গিসের বাবা। ১৯৫৯ সালের কোনো বিকেলে যখন লাহোরে ওসমান সাহেব মারা যান গাড়ি চাপা পড়ে, যদিও কেউ কেউ বলেছিল তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল, খবরটা পেয়ে নার্গিসের কোনো দুঃখের অনুভূতি হয়নি; অথচ তার প্রায় বারো-চোদ্দো বছর পরে ভেনিসে কয়েকটি রাত বাবার স্মৃতি নার্গিসকে ভূতের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। মার্সেলো মার্তিনেলির সাথে দ্বিতীয় বিয়ের পর নার্গিস বেড়াতে গেছিলেন ভেনিস শহরে। মার্সেলো প্রথম প্রথম নার্গিসকে বুঝতে চেষ্টা করত, কিন্তু একসময় সে হাল ছেড়ে দেয়। কয়েকবছর বাদে বিয়েটা ভেঙে যাবার পর মার্সেলো তাদের একমাত্র ছেলের ভার নার্গিসকে দিতে চায়নি — আমি একদিন তোমার যন্ত্রণাগুলোর ভাগ নিতে চেয়েছিলাম, তুমি তা দাওনি কেন নার্গিস? 

     

    "… কতরকম উল্টোপাল্টা কথাই যে বলত নার্গিস … কখনো বলত বোম্বে গিয়ে ফিল্মের হিরোইন হবে … কখনো বলত ভেনিসে গিয়ে লেখক হবে … ওসমান সাহেব ব্যবসার কাজে বেশ কয়েকবার ভেনিস গেছিলেন … বাবার কাছে ভেনিসের গল্প শুনতে শুনতে নার্গিসের একটা অদ্ভুত টান তৈরী হয়েছিল সেই না-দেখা শহরটার প্রতি … সরু সরু রাস্তা, খালগুলো আর অজস্র ব্রীজসমেত অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরে সেই মোহময় গোলকধাঁধা … রেস্তোরাঁটায় বসে বাবার কাছে শোনা সেই শহরের গল্পগুলো নার্গিস আমাকে রিলে করত … যেন সেগুলো তার নিজেরই স্মৃতি … যেন বন্দী মার্কো পোলো গল্প বলছে বন্ধু রাস্টিচেলোকে … একটা ক্ল্যাসিক পিস নার্গিসের খুব প্রিয় ছিল … বাবার কাছে সে জেনেছিল শোপাঁর বার্কারোল ভেনিসের নৌকা-চালকদের সুরে বাঁধা … এমন একটা অদৃশ্য শহরে নার্গিস হারিয়ে যেত কল্পনায়, যেখানে সে উপন্যাস লিখতে লিখতে মুখ তুলে তাকাবে ও তার কানে বাজবে শোপাঁর বার্কারোল … আর জানলার বাইরে সেই জলে ডুবতে থাকা বন্দর, যার তলায় ভারবহনকারী কাঠের গুঁড়িগুলো নরম কাদায় গেঁথে যাচ্ছে একটু একটু করে …"      

     

    — কল্পনাতেও মার্কো পোলো ভেনিসের থেকে দূরে যেতে পারেননি — সেন্ট মার্ক'স স্কোয়ারের এক রেস্তোরাঁয় ডিনারের অর্ডার দিয়ে মার্সেলো মার্তিনেলি মন্তব্য করেছিল, পেশায় লেখক ও সাংবাদিক; বেশ কিছুক্ষণ আগে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। সূর্যাস্তের গোলাপি আভা জলের ওপর আকাশে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এখন অন্ধকার; আলোকোজ্জ্বল স্কোয়ারে মানুষের ভিড়। সুদৃশ্য রেস্তোরাঁয় বসে নার্গিস লক্ষ্য করছিল কোণে একপাশে মিউজিশিয়ানদের। এইমাত্র তারা শোপাঁর বার্কারোল পরিবেশন করেছে। মার্সেলো একটু ঝুঁকে বলল — ভেবে দ্যাখো কুবলাই খানকে পঞ্চান্নটা শহরের গল্প শোনাচ্ছে মার্কো পোলো, যার প্রতিটাই আসলে ভেনিসের রকমফের। ক্যালভিনোর বইটার কথা বলছিল। তাহলে কি দূরের শহরগুলো এরকমভাবেই স্মৃতিতে জড়িয়ে যায়? নার্গিস ভাবছিল দিল্লির কথা; দাঙ্গার অদ্ভুত অদ্ভুত খবর আসছিল দিল্লিতে। ওসমান সাহেব তখনও দোনামোনায় ভুগছেন, কেননা দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, এটা যেন অবিশ্বাস্য ঠেকছিল তাঁর কাছে। করলবাগের বাড়িটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা। দলে দলে লোক চলেছে ট্রেনে করে পাকিস্তান, ওদিকে লাহোর থেকে শিখ পরিবাররা আসছে দিল্লি। যে যেখানে পারছে, ফাঁকা বাড়ীতে, বাগানে, রাস্তার পাশে উদ্বাস্তু মানুষেরা আশ্রয় খুঁজছে। কে যেন বলেছিল, নার্গিসের মনে পড়ে না, সীমান্ত পেরিয়ে অমৃতসরে শুধু খুন হওয়া লাশ নিয়ে ঢুকেছে একটা ট্রেন। একদিন বেলার দিকে ওসমান সাহেব বাইরের ঘরে বসে কিছু ব্যবসার কাগজপত্র দেখছিলেন। নার্গিস বাড়ীর ভেতরে ছিল। হঠাৎ রাস্তায় আর্তনাদ ও গোলমালের শব্দ শুনে সে ঘরের জানলার কাছে গিয়ে রাস্তাটা দেখার চেষ্টা করতে করতেই ওসমান সাহেবের চিৎকার তার কানে এল — জানলার কাছে যাস না। ততক্ষণে বাইরের দরজাটার গায়ে লোকগুলো লাথি মারতে শুরু করেছে। নার্গিস শুধু একঝলক দেখতে পেল একটা কনুই অব্দি কাটা হাত রাস্তায় পড়ে আছে, যেটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তখনও। তার বাবা ঘরে ঢুকেই তাকে জানলার কাছ থেকে টেনে এনে একটা থাপ্পড় মারলেন তার গালে। সেদিন তারা কোনোক্রমে বেঁচে যাবার পর দিল্লি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক সহজ হয়ে যায় ওসমান সাহেবের কাছে। তার স্মৃতির জালটা ছিঁড়ে গেল খাবার নিয়ে ওয়েটারের আগমনে: যেন পোরলক থেকে আসা জনৈক ব্যক্তি। মার্সেলো বলছিল কোলরিজের স্বপ্ন সম্পর্কে বোর্হেসের প্রবন্ধের কথা, যেটা তার দাবী ক্যালভিনোকে উপন্যাসটা লিখতে সাহায্য করেছে। হাওয়া দিচ্ছিল গন্ডোলায় চেপে হোটেলে ফেরার সময়; গ্র্যান্ড ক্যানালের দুধারে রাতের ভেনিস। নার্গিস থম মেরে বসেছিল। তার মনে পড়ছিল সেই দিনটা যখন ট্রেনটা দিল্লি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তখন সে মঞ্জুর কথা ভাবছিল। শেষ যখন নার্গিসের সঙ্গে মঞ্জুর দেখা হয়েছিল, তখনও শহরের অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি। কামরা-ভর্তি ভয়ে শিঁটিয়ে থাকা লোকজন; কোলের ছেলেপিলে নিয়ে, পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে জড়ো হয়ে বসে আছে তারা। মাঝে মাঝে বাচ্চাগুলোর কান্না শোনা যাচ্ছে। রোদ যখন পড়ে এল আর দিগন্তের কাছ থেকে লাল সূর্যটা যখন বিকেলের বাতাসের ভেতর নীরব প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন একটা হিম আতঙ্কের ভেতর জমে যেতে যেতে ট্রেনটা ঢুকছিল অমৃতসর। সারি সারি খোলা তলোয়ার নিয়ে ফুঁসতে থাকা মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে। ট্রেনটা ঢুকতেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। বন্ধ জানলা আর দরজাগুলো ভাঙবার জন্যে দুমদুম করে ঘা মারতে লাগল। কামরার ভেতরে বাচ্চাগুলো পরিত্রাহী কান্না জুড়েছে, কেউ একঘেয়ে সুরে আল্লার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে আর নিস্পলক চোখে চেয়ে রয়েছে নার্গিস। সংকীর্ণ খালে হঠাৎ পাশের একটা গন্ডোলার সাথে সামান্য ধাক্কা লাগতেই সে পড়ে গেল জলে।

     

    "… কুড়ি বছর পরে আমাদের দেখা হবার কথা ছিল … তখনও দাঙ্গা-দেশভাগের অন্ধকার দিনগুলো বহুদূরে, ও'হেনরির 'আফটার টোয়েন্টি ইয়ারস' পড়ে নার্গিস আর আমি ঠিক করেছিলাম ঐ রেস্তোরাঁয় দেখা করব কুড়ি বছর পরে … সেই তারিখটা কতদিন আগে পেরিয়ে গ্যাছে … এমনকি আজ আর আমার মনেও পড়েনা সেদিন আমি কোথায় ছিলাম, কী করছিলাম …"

     

    হোটেলের ছোট্টো ব্যালকনিতে নার্গিস একা দাঁড়িয়েছিল। গভীর রাতের আলোয় ভিনিশীয় স্থাপত্যগুলিকে রহস্যময় দেখায়; জলে আলোর প্রতিফলন, জনহীন রাস্তাগুলো, দুএকটা বেড়াল দেখতে দেখতে মনে হয় যেন একটু পরেই নগ্ন মার্কেসা কাসাটি হেঁটে যাবেন সেন্ট মার্ক'স স্কোয়ার ধরে, সঙ্গে তাঁর পোষা চিতাবাঘদুটো, যাদের গলায় হীরকখচিত কলার পরানো রয়েছে। জলে পড়ে হতচকিত হয়ে গেছিল নার্গিস, স্মৃতির ঘোরটা তাকে কাবু করে ফেলেছিল: এখন ঘুম না আসায় তার মনে পড়ছিল বাবার কথা। লাহোরে পৌঁছনোর বছরদেড়েকের মধ্যে তার বাবা বুঝেছিলেন নার্গিস অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অসুখটা কী বোঝা যায় না, অথচ যে মেয়ে অত ছটফটে ছিল, সে কারোর সঙ্গে কথা বলতে চায়না, এমনকি বাবা-মায়ের সঙ্গেও না, ডাকলে সাড়া দেয়না বেশিরভাগ সময়। মাঝে মাঝে জ্বর আসে নার্গিসের, জ্বরের ঘোরে একটা কাটা হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তে দেখে চিৎকার করে ওঠে সে। আর বাবাকে সে সহ্য করতে পারেনা। ওসমান সাহেব ধারেকাছে এলে সে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে যায়, তার মুখ দিয়ে থুতু পড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তাকে লন্ডনে এক আত্মীয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, ওখানেই সে পড়াশোনা করবে, তার চিকিৎসা চলবে। মেয়ে চলে যাবার পর ওসমান সাহেব যেন আরো একা হয়ে পড়লেন, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে আগের মতো আড্ডা বসানোর চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু সুরা বা শায়েরী কিছুই আর জমে না। যত সবকিছু ভেঙে পড়তে থাকে চারপাশে, তত যেন তাঁর রোখ চেপে যায়। দিল্লির কথা ভুলে যাবার জন্যে বেশি বেশি করে লাহোরের সঙ্গে মিশে যাবার চেষ্টা করলেন; ক্রমশ গোঁড়া আর অসম্ভব খিটখিটে হয়ে উঠতে লাগলেন তিনি। তাঁর মদ খাওয়া সীমাহীনভাবে বেড়ে চলল। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেন সবসময়ই আগুনের মতো উত্তপ্ত। '৫১ সালের ব্যর্থ ক্যুয়ের পর '৫৮ সালে পৌঁছে আরম্ভ হল মিলিটারি শাসন। অন্ধকার অবসাদের হাত থেকে রেহাই পেতে ওসমান সাহেব মরিয়াভাবে জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতিতে। একদিন শেষ বিকেলে প্রচন্ড মাতাল হয়ে পুরোনো বই খুলে তিনি গালিবের কবিতার ভেতর কী যেন হাতড়াতে শুরু করলেন; পৃথিবীতে মৃত কবিদের মতো ভয়ংকর প্রেতাত্মা আর কিছু নেই। কালো অক্ষরগুলো ঢেউয়ের মতো দুলতে লাগল তাঁর চোখের সামনে; তাঁর জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার, মাথায় উস্কোখুস্কো ভাবনার স্রোত, মদের গেলাসটা তিনি ছুঁড়ে দেয়ালে আছড়ে ভেঙে ফেললেন। তারপর টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিভে আসা আলোর ভেতর বেরিয়ে গেলেন বাড়ী থেকে। মানুষ পাল্টে যায়; শুধু সাবল্টার্ন স্টাডিজ নয়, যখন নব্বইয়ের দশকে পার্টিশানের ওরাল হিস্ট্রিচর্চা শুরু হয়, নার্গিস ক্রমাগত তার বিরোধীতা করতে থাকেন এবং ক্রমে ক্রমে ঐতিহাসিক মহলে নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফ্যালেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে স্মৃতিকে গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিতে পারেননি। দিল্লিতে ফ্লাইট নামার ঘোষণায় তাঁর ঘোর ভেঙে গেল, ফ্লাইট ল্যান্ড করার সময় তাঁর একটু সমস্যা হয় বাতাসের চাপ ওঠানামা করে বলে, সিটবেল্ট বেঁধে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসেছিলেন। যে তারিখে তাঁদের দেখা করার কথা ছিল কুড়ি বছর পর, সেদিন দুজনের কেউই কথা রাখেননি, কিন্তু তারপর জীবনের বিভিন্ন সময়ে মোট তিনবার মঞ্জু গেছিলেন রেস্তোরাঁটায় আর নার্গিস দুবার। মাঝখানে অনেকগুলো যুদ্ধ হয়ে গেছে, টিটোয়ালের কুকুরটা অনেকবার ঘেউ ঘেউ করে উঠেছে, কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি। আর ঘন্টাখানেক পরে নার্গিস যখন দিল্লির রাস্তায় আটকে পড়বেন ও দেখবেন সামনের গাড়িগুলোর কাঁচ ভাঙতে ভাঙতে দাঙ্গাবাজরা এগিয়ে আসছে তাঁর গাড়িটার দিকে, তখনও তিনি জানবেন না কয়েক কিলোমিটার দূরের রেস্তোরাঁটায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে এবং সেই একইসময়ে শহরের অন্যপ্রান্তে একটি নার্সিংহোমে শয্যাশায়ী মঞ্জুর স্মৃতিতে রেস্তোরাঁটা তখনও টিকে রয়েছে অক্ষত অবস্থায়: বিস্মৃতির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়তে থাকা মঞ্জু এখনই মারা যাবেনা।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ | ৩৩৮৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • গপ্পো | 174.198.***.*** | ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:২২101450
  • বটে 

  • বিপ্লব রহমান | ০৩ জানুয়ারি ২০২১ ১৩:০৭101481
  • কুড়ি বছরে কী লণ্ডভণ্ড হলো নার্গিস আর মঞ্জুতে।  সত্যিই এলাচ দেওয়া চায়ের মতোই স্মৃতির ঘ্রাণ।  ইটালিকের লেখাটাই বেশী টেনেছে, খুব শক্তিশালী স্টাইল 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন