কয়েকটা নিঃসঙ্গ রেখা, যারা তার অবয়বটুকুকে ফুটিয়ে তুলেছে, তাদের সাথে সংলগ্ন হয়ে একমনে সেলাই করছিল জানলার পাশে বসে; হাতের বইটা মুড়ে আমি বললাম — এত কম আলোয় চোখ ঠেরে ঠেরে সেলাই কোরোনা অনু, চোখ খারাপ হয়ে যাবে। সে তাকাল না আমার দিকে, যেন শুনতে পায়নি, এত বেশি দূরত্বে রয়েছে; তারপর চোখ তুলে হাসল। বলল — বিকেল ফুরিয়ে এল, তুমি হাঁটতে গেলে না?
শীতের বিকেল ঢের তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে এসেছে বটে, হাঁটতে যাওয়া হল না; বেরোতে ইচ্ছে করল না আজ আর। মুখে বললাম — এই বইটা পড়তে পড়তে — অনু আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করেনি; ওর চোখ জানলার ওপারে বাগানের করবী গাছটার দিকে। ওইদিকে মানুষের সমাচ্ছন্ন অতীতের পানে চেয়ে দুর্বল আলোটুকুর ভেতর দৃষ্টি ফেলে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইল সে। তারপর একটা নিঃশ্বাস চেপে আবার সেলাই করতে শুরু করল। তার রেখাচিত্রটির পিছনে জানলার গরাদের গায়ে অতি সূক্ষ্ম মাকড়সার জাল সামান্য হাওয়ায় কেঁপে উঠল। আমি কড়িকাঠের দিকে তাকালাম; দেখি সেখানেও বিস্তর ঝুল জমে, বিশেষত ঘরের কোণে ধূসর জটিল পিন্ড মানুষের অবহেলার মতো, অনাদরে। বাড়িটা পুরোনো, কিন্তু বড়; বেশ সস্তায় ভাড়া পেয়েছিলাম। তখন সামনের বাগানটা মরা আগাছায় ছেয়ে ছিল। বিয়ের প্রথম প্রথম অনুর শখ ছিল বাগান করার; আস্তে আস্তে আমারও। ক্রমশ বেশ সবুজ সতেজ গাছে ভরে উঠল সামনেটা; ধুতরো গাছগুলো আগে থেকেই ছিল আর একটা করবী গাছ, দুটোই যত্ন পেয়ে সাদা ফুলে ঢেকে গেল; সঙ্গে আরও নানারকম ফুল, ফল ও সবজির চারা। বাড়িটাও নতুন হয়ে উঠছিল; ভাড়া নেবার সময় শুনেছিলাম একটু বদনাম আছে (ভূত-টূত ইত্যাদি)। সেসব মিথ্যে করে মানুষের সংস্পর্শে বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল। বাড়িওলা এখানে থাকেনা; সেও একটা মস্ত সুবিধের জিনিস। ফলে এখানকার ইস্কুলে চাকরিটা হবার পর এই বাড়িটা পেয়ে আর দেরী করিনি। স্যাঁতসেতে দেয়ালগুলোয় ঘেরা বাড়িটায় ঢুকে প্রথমদিন, আমার মনে আছে, একটা ধেড়ে ইঁদুর অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আমার পায়ের ওপর দিয়ে কোনো অজানা গর্তের দিকে চলে যায়। আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠেছিলাম, দেখে অনু হেসেছিল। পোকামাকড় বা জন্তু-জানোয়ার নিয়ে আমার ভয় সবসময়ই ওর কাছে ভারী মজার বস্তু। কিন্তু সেদিন রাত্রে নিজেই আমাকে ঠেলে তুলে দিয়েছিল ঘুম থেকে, কেননা ওর মনে হচ্ছিল ইঁদুরগুলো ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের কামড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতে পারে। সেদিন বাকী রাতটা আর আমাদের ঘুম হয়নি; ইঁদুরের ভয়ে নয়, প্রচুর প্রচুর জ্যোৎস্নায় বাড়ির সামনের বাগান, বাগানের ওপারে রাস্তা ও রাস্তার ওদিকে মাটি অবনত হয়ে যে পুকুরের ভেতর নেমে গেছে, সেই পুকুরটির জল ও জলাশয়লগ্ন কলাবনের সমস্তটায় ছড়িয়ে থাকা মায়া দেখতে দেখতে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। স্মৃতি মাঝেমাঝে এইসব পুরাতন জলবিভাজিকাগুলির সামনে এনে আমায় দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখান থেকে নদীর জন্ম হয়। তবু এইখানে শীতের অন্ধকারে হৃদয় নীরব হয়ে গেল; অনু কখন জানলার পাশ থেকে ছুঁচসুতোসহ সেলাইয়ের সরঞ্জাম গুটিয়ে উঠে গেছে খেয়াল করিনি।
মাঝে মাঝে মনে হয় যেন এই নির্জন স্বপ্নময় জীবনের ভেতর বেঁচে থাকতে ভালোবাসি। বিকেলের রোদ পড়ে এলে হাঁটতে যাই; পুকুরের পাড় বেয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে বাজারের দিকে, অনেক একলা একা ভাবনার শ্লথতায় পাক খেতে খেতে সেটা ধরে হাঁটি। সবুজ কচুরিপানার ভেতর, ঘাসের ভেতর, চোরকাঁটার ভেতর ম্লান আলো মরে যায় ক্রমে; বকের মতন ঘাড় বেঁকিয়ে ঠান্ডা কুয়াশার মতো অর্থহীন যন্ত্রণা আমাদের নিরন্তর ছিঁড়ে খায়। একটি পাটকিলে ভাম আড়াআড়ি রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে গেল ঝোপের মধ্যে; ধুলো-ধুলো পাড়াগাঁর পথঘাট যেন, কোথাও বিভিন্ন গর্তে হয়তো সাপেরা, সাপেদের পরিবার নিরালায় ঘুমে ডুবে আছে। শালিখ পাখির ডিম পাতার আড়ালে হয়তো বা, বিকেলের শবদেহ ঘিরে কাকেদের বিপন্ন চিৎকার আমাকে অসুখ দেয়। কিছু কিছু সাইকেল আরোহী নাকমুখ ঢেকে চলে যায়, তাদের চিনতে পারা যায় না। দূরত্বে অনেক এসেছি একথা মনে হয় একাকী বাজারে গিয়ে; দেখি সামান্য বিক্রিবাটা সেরে মরুঞ্চে ডিমেশাক নিয়ে কোনো হাড়গিলে বুড়ি পা টেনে টেনে আশ্চর্য দীনতায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ইঁদুরের বিষ কিনব বলে দাঁড়াই মুদির দোকানে; সে আমার দিকে আড়চোখে চায়, গভীর সন্দেহের চোখে, ভয়ে নিথর হয়ে যাওয়া মণিটাকে সহসা নাড়িয়ে গলাখাঁকারি দিয়ে ওঠে — হিম পড়ছে মাস্টারমশাই। একটি উপকারী স্বরে কথোপকথনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে। দুএকটা বয়ামের ঢাকনা খুলে অনর্থক প্যাঁচ দিয়ে বন্ধ করে অন্ধকার দোকানের কোণে যায়, ফিরে আসে অস্থিরভাবে। আমি দেখি পথে সত্যিই হিম পড়ছে; একটা মেটে রঙের কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুলো যেন আর উঠবে না; যেন সরীসৃপের কাছ থেকে শীতঘুম ধার নিয়ে মরে যাবে। ক্লাবে যারা তাস খেলে, আমি ওদের চিনি; আমিও খেলি গিয়ে মাঝে মাঝে, ব্রিজ বা অন্য কিছু। একটা হলদে ঝুলন্ত বাল্বকে ঘিরে আমরা বসে থাকি নিজেদের পরিত্যক্ত ছায়ায়। অনেক নিশুতি রাতে আমি উঠি তাসের আড্ডা ছেড়ে, ওরা আড়চোখে দ্যাখে। আমি ভাবি আমি আর আসব না। কী লাভ এখানে এসে? সত্যিই একদিন আর যাই না। রাস্তার মোড়ে দেখি লাল-নীল টর্চের আলো জ্বেলে ওরা সব ফিসফাস করছে। আমায় দেখে ওরা থেমে যায়; স্বপ্নহীন নক্ষত্রের তলায় সহসা একটি মোটরগাড়ির আলো ওদের থুতনিতে আছড়ে পড়ে। শীত; শীত করতে থাকে আমার। মাফলারটা জড়িয়ে নিই কানে, মনে পড়ে নিউমোনিয়ায় আজকাল নাকি আর কেউ মরে না। নিউমোনিয়ার কথা, হিম অসুখদের কথা ভাবতে ভাবতে আমি বাড়ি ফিরি; পুকুরের পাড়ে জংলার ভেতর ঝিঁঝিঁর মগ্ন ডাক চিরে কী যেন চিৎকার করে ওঠে। শুকনো পাতা মাড়িয়ে একটা হিংস্র গিরগিটি সরসর করে পুকুরের জলে নেবে গেল। নৈঃশব্দ্যের ভেতর ওদের অদ্ভুত ফিসফিসানি শুনতে পাই আমি। উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে নিউমোনিয়ায় আর কেউ মারা যায় না আজকাল। ঘাড় নেড়ে খেয়াল করি অনেক দেরী হয়ে গেছে, শুধু পেঁচার বিশ্রী ডাক ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই শূন্যতার ভেতর। দেখি অনু হ্যারিকেনের আলোয় মাথা হেলিয়ে বসে আছে জানলার ধারে। আমি ওকে ডাকব বলে কাছাকাছি এগোই। তবু এক অনিয়তাকার অন্ধকারের ভেতর আমি দাঁড়িয়ে থাকি; করবী গাছের গোড়ায় জোনাকির খেলা দেখতে দেখতে এইকথা ভাবি যে একদিন হয়তো অনুর কাছে পৌঁছনো যাবে। কে জানে সত্যিই হয়তো নিউমোনিয়ায় আজকাল আর কেউ মরে না।
অনেক গভীর রাতে জেগে উঠে আমি কিছুক্ষণের জন্যে জানলা খুলে দিই, দমবন্ধ ঘরে হ্যারিকেন; দেখি অনু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি তার পাশে বসি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিই; শুনতে পাই ইঁদুরগুলোর অবাধ হুটোপাটি। ইঁদুরগুলো ফিরে এসেছে আবার; মেঝেয় এককোণে রাখা নিভু-নিভু হ্যারিকেনটা উসকে দেব কিনা ভাবতে ভাবতে যেন হঠাৎ অন্যঘরে ঠক করে কিছু একটা আওয়াজ হয়। আমি বুঝতে পারি ওরা লক্ষ্য রাখছে। আলোটা তুলে এঘর থেকে বেরিয়ে ওঘরে যাই; ইতিউতি দেখেও শব্দের কোনো উৎস খুঁজে পাইনা। আস্তে আস্তে ফিরে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখি অনু উঠে বসেছে বিছানার ওপর, অন্ধকারে অল্প চাঁদের আলো তার চুলে লেগে। আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সে জিগ্যেস করে — কিসের আওয়াজ হলো? আমি হ্যারিকেনটা যথাস্থানে রেখে কমিয়ে নিরাসক্তভাবে বলি — ও কিছু না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অনু বিড়বিড় করে — ওরা আমাদের একজোড়া পিশাচ ভাবে। জানলা বন্ধ করে আমি ক্রমে বিছানায় গিয়ে ওর পাশে বসি — ভাবুক গে। ওর বাহুতে আঙুল ঘষি, চুমু খাই, ওর চুলে, কাঁধে। আমি ওকে; ও আমায়। আস্তে আস্তে ওর বুকে হাত দিই; কত নরম ওর স্তনদুটো, ও আলগা করে দেয় ব্লাউজের হুক। ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো ও আমার শরীরে থাবা বসায়। ওর গরম লালা আমি টের পাই ঘাড়ে, গলায়, বুকে; হলদে বাঘনখ গেঁথে দেয় শিরদাঁড়ায়, দুই ঠোঁটের ফাঁকে মাংসসুদ্ধু চামড়া টেনে তুলে চুষতে থাকে, রক্ত জমাট বেঁধে যায় জায়গায় জায়গায়। আচমকা অসাবধানে চামড়া ছিঁড়ে রক্তের লবণাক্ত স্বাদ পেয়ে অনু মুখ তোলে। আমি অন্ধকারে দেখি ওর দীর্ঘ কেশরাশি বটের ঝুড়ির মতো নেমে ঘিরে ধরেছে মুখটাকে; চুলের সুগন্ধ ছুঁয়ে আমি নেকড়ের মতো নিঃশব্দে হাসি, উঠে বসে জড়িয়ে ধরি ওকে। কালো ঝাড়লন্ঠন ভেঙে বের করে আনি ওর মুখ, ওর উন্মুক্ত গ্রীবা কামড়ে ধরি; ছটফট করে ওঠে অনু। সুডৌল বুকে ঠোঁট নামাই, জিভ দিয়ে স্পর্শ করি ওর স্তনের নরম; সাপের ফণার মতো মাথা তোলে তীক্ষ্ণ বোঁটাটি। আমার দু'সারি দাঁতের ফাঁকে রাখি তাকে; ওপর ও নীচের ধারালো কৃন্তক এগোতে থাকে পরস্পরের দিকে। ঠিক সেইমুহূর্তে অনুর গলা থেকে অস্ফুটে একটি 'আহ্' ছিটকে বেরোয় এবং আমি ওর স্তন থেকে মুখ সরিয়ে নিই। রাতের চতুর্থ প্রহরে শোঁ-শোঁ হাওয়ার শব্দ ওঠে, বাইরে হয়তো চাঁদ ঢেকে গ্যাছে মেঘে। একচোখো দৈত্যের মতো ঘোলাটে হ্যারিকেনটা ঘরের সীমানায় ক্ষীণ। নারীটি ঘুমিয়ে পড়েছে আমার বাঁদিকে, ঘুম আসেনা আমার: জেগে থাকি। অযৌক্তিক বস্তুসমূহের কথা চিন্তা করি। অন্ধকারে বুকের ওপর চেপে বসা শূন্যতার কাঁকড়া নিরবিচ্ছিন্ন যন্ত্রণায় আমাকে অবশ করে ফ্যালে। ঘোরের ভেতর একটি শিশুর মিঠেগলায় আমি শুনতে পাই অর্থহীন টুকরো টুকরো ধ্বনি। বেখেয়ালে বালিশের মাথার দিকে হাত ছড়ালে হঠাৎ আমার আঙুলে কী যেন ফুটে যায়, সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে আসে হাতখানা। ফের সতর্কভাবে হাত বাড়াই। ছুঁয়ে ছুঁয়ে বুঝতে পারি অনুর অসমাপ্ত সেলাইয়ের সরঞ্জাম। ছুঁচ-গাঁথা কাপড়ের খন্ডটা শোওয়ার আগে মাথার কাছে রেখে সে ঘুমিয়েছিল। আঙুলটা মুখে ঢুকিয়ে চুষে অল্প ফুঁ দিলাম; অনুর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। এইটা খুকির পুরোনো জামা, রিফু করছে অনু। ক'দিন আগে আমি বেলার দিকে খাটের তলা থেকে টিনের ট্রাঙ্কটা টেনে বের করেছিলাম ভেতরের জিনিসগুলো রোদে দেব বলে। ফিকে ন্যাপথালিনের গন্ধ; আর দেখি খুকির কিছু নতুন উলের সোয়েটার বুনে রেখেছে অনু। ভোররাতের দিকে বেশ হিম হয়ে আসে ঘরের ভেতরটা। আমি অনুর কোঁকড়ানো শরীর থেকে খসে-পড়া কাঁথাটা টেনে ঠিক করে দিলাম।
দুঃখ মানুষকে বড় স্থির করে দেয়; ঘরবাড়ি নষ্ট করে। আমাদের বাগানটা আস্তে আস্তে আগাছায় ঢেকে যাচ্ছে, করবী গাছটা শুকিয়ে আসছে ক্রমে। কোথা থেকে পার্থেনিয়ামের ঝাড় লকলকিয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমি কেরোসিন ছিটিয়ে দিই, অথবা ছুটির দুপুরে কেটে-রাখা গাছগুলো বিকেলের দিকে মাটির গর্তে ফেলে আগুন ধরিয়ে দিই। অনু এসে দূরে দাঁড়ায়, আগুনের উত্তাপে ওর মুখটা লালচে দেখায়; ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে আমাদের ঘরেদোরে। সূর্য নেমে আসে; প্রেতাত্মার ছায়া সমস্ত নিভে-আসা শকুন-দ্রাঘিমার গায়ে। আমি খেয়াল করি অনু যেখানে ছিল, সেখানে এখন আর কেউ নেই। তারা-ফোটা আকাশ থেকে একজোড়া কর্কশ ডানা পাখসাট মেরে হাওয়ায় শিরশিরানি মিশিয়ে উড়ে গেল। আমি বাড়ি ঢুকে এদিকওদিক অনুকে খুঁজি। ঘরগুলোয় সামান্য পোড়াগন্ধ, নিস্প্রভ আলোয় দৃষ্টিগোচর হয় দেয়ালের ডেডোয় রঙপেনসিলের আঁকিবুঁকি: অনুকে দেখতে পাই আমি একটা জানলার সামনে বাঁহাতে গরাদ ধরে নিশ্চল চুপ, তার চোখ আমার চোখে পড়েনা। তার চুল ঘিরে অজানা উৎস থেকে কী এক আলোর জ্যামিতিক নির্মাণ; পুরোনো প্রস্তরযুগের নারীদের মতো, লক্ষ্য করি, ওর ল্যাংটো মাংসল পাছা ও অন্যান্য শরীর — হেমজ্যোৎস্না, তুমি আমাকে খাও — নীচুগলায় ফিসফিস করে বলে অনু ছোট্ট কিশোরীর মতন, সাপিনীর মতো আচমকা হিসহিসিয়ে ওঠে আমার দিকে ফিরে। ডানহাতে একটা ধারালো ছুরি। আমি একপা পিছু হঠি, দু-পা; ঘরের কোণ থেকে একটা ধেড়ে ইঁদুর দৌড়ে এসে আমার গোড়ালিতে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায়, কমলা বাতি ভেঙে খণ্ডখণ্ড পড়ে থাকে আমার মাথার ভেতরে, কালো জলে। অবোধ্য অন্ধকার ছাড়া কি চাই আর মানুষের, যেখানে নিজেকে নগ্ন করা যায়? প্রেম আসলে প্রয়োজন নেই মানুষের; একটা খুব জোরালো নেশার দরকার জীবনের অবর্ণনীয় বৈচিত্র্যহীনতার ভেতর বেঁচে থাকার জন্যে। ঘৃণা এক আশ্চর্য করুণ সান্ত্বনা দিয়ে গ্যাছে আমাদের পরস্পরে; এই অপরূপ অন্ধকারে আমাদের হৃদয়ের ঘরবাড়ি। বিষের মতো বৈদ্যুতিক নেশা প্রেমে নেই, প্রেমের সে ক্ষমতাও নেই। রঙ পাল্টাতে পাল্টাতে বিকেলের আলো এসে স্থির হয় যেইরঙের পরে অন্ধকার, সেইরঙে; সেই ফিকে বিকেলের মতো প্রেম, তার আয়ুক্ষয় আমাদের হৃদয়ের চারপাশে — মুছে গ্যাছে। খিলখিল করে, আমি শুনতে পাই, অসংলগ্নভাবে অনু হাসছে; যেন সে ও আমি খুব দূরের ছায়াপথ থেকে এখানে এসেছি আর পার্থিব প্রজাতি, তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ কখনও হয়নি। দিনেরবেলা রান্নাঘর থেকে আমি দেখি দূরে অনুর আংশিক দেহ, তার মসৃণ চুল, যা আমার প্রিয়; তার দুহাতে কাঁটা চলছে সমান ছন্দে, নানারঙের উলের গোলাগুলি চতুর্দিকে ছড়ানো। চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি, দেয়ালঘেরা চৌকো মেঝের কোণে নিষ্কৃতির দরজা, তবু মাথার ভেতর ঘরগুলোকে বৃত্তাকার ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা এবং এজন্যেই যেন আমাদের আজন্ম আটকা পড়ে থাকতে হবে এই বাড়িটার ভেতর। যেকোনো প্রান্ত থেকে দৃশ্যের কেন্দ্রে হঠাৎ খুকি টলোমলো পায়ে ছুটে এসে দাঁড়াবে, এইরকম আচ্ছন্নতায় আমি নিবিষ্ট হয়ে থেকে চমকে উঠলাম আমার বুড়ো আঙুলটা কড়াইয়ের গরম কিনারায় ঠেকে যাওয়ার ফলে; ঘুরে শেলফ থেকে আমি ইঁদুরের বিষের প্যাকেটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। লেবেলহীন স্বচ্ছ প্যাকেট; কেমিস্ট্রি পড়াই, এতে মানুষ মরেনা আমি জানি। উনুনে ফুটতে-থাকা সুস্বাদু ঝোল; বাষ্প উড়ে উড়ে যায় জানলার দিকে, রাঙতাময় রোদে চিকচিক করে। একরাতে অন্ধকারে চটকা ঘুমটা ভেঙে যেতে আমি চোখ খুলে দেখলাম ভুষো-পড়া হ্যারিকেনের ঝাপসা আলোয় সে মাটিতে থেবড়ে বসে আছে, তার একহাতে কাঁচি, অন্যহাতে চুলগুলো টেনে ধরে কেটে ফেলছে কচকচ শব্দে। পিছনে দেয়ালের ওপর তার ভয়ংকর চওড়া ছায়া পড়েছে। আমি ঘুমজড়ানো গলায় বললাম — চুলগুলো কেটে ফেললে অনু? মাদুরটা টেনে নিয়ে বোসো, নইলে জোলো মেঝেতে ঠান্ডা লাগবে।
ক্রমশ আমি হেরে যেতে থাকি পার্থেনিয়ামের ঝাড়গুলোর কাছে, দক্ষ আর্মির মতো বাড়ির চারদিক দখল করে ফ্যালে ওরা। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারাবাড়িতে। প্রথমে আমার কাশি শুরু হয়। তারপর সর্দির ধাতটা অনুকে পেয়ে বসল; সঙ্গে হাঁপানি আর ঘনঘন জ্বর। চাদর ঢাকা দিয়ে অনু চুপ করে শুয়ে থাকে মরামানুষের মতন। পার্থেনিয়ামের বিষাক্ত রেণু বাড়ির সর্বত্র; আমার গায়ে লাল-লাল ঘা ফুটে উঠতে শুরু করে, জ্বালা করতে থাকে সর্বক্ষণ। আমি অনুর পাশে বসে বালিশে ওর মাথাটা ঠিক করে দিই; ও অঘোরে ঘুমোচ্ছে, লক্ষ্য করি। একদিন সন্ধ্যের দিকে আমি থার্মোমিটার আনতে অন্যঘরে গেছি; হঠাৎ ফিরে এসে দেখলাম অনু মেঝেতে উবু হয়ে অকাতরে বমি করছে আর তার বমির সাথে ভলকে ভলকে উঠে আসছে রক্ত। হামাগুড়ি দিয়ে একটা অসুস্থ গিরগিটির মতো সে কোনোরকমে বিছানায় উঠে শুলো। আমি জলের বালতি আর ঝাঁটা এনে মেঝেটা পরিস্কার করতে লাগলাম। সবকিছু ধুয়েমুছে যখন বাথরুম থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম, যেন চৌকাঠে চিতাবাঘের লোমগুলো ইতস্তত ছড়ানো, ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম; একটা খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, মনে হলো, জন্তুর গন্ধ পেলাম নাকে। অনুর রুগ্ন পালকঝরা শরীর বিছানায়, শুধু ঘাড়টুকু তুলে সে অমানুষিক চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমি আস্তে আস্তে তার দিকে এগোলাম এবং শুনতে পেলাম সে অদ্ভুত ঘর্ঘরে গলায় বলছে — যদি আমি মরে যাই, তুমি আমাকে খুন করবে না বলো? সেইরাতে সংবিগ্ন ইঁদুরগুলি পার্থেনিয়াম-অধ্যুষিত বাড়িটাকে তোলপাড় করতে লাগল। আমি অনুর নিরালা হাতটা আমার হাতের ভেতর ধরে নির্বাক বসে রইলাম আর মাঝে মাঝে বালিশে মুখ চেপে কাশতে লাগলাম। রাত আড়াইটের সময় অনু হঠাৎ চোখ খুলে এদিকওদিক চেয়ে খুকিকে খুঁজতে লাগল। জোরে ডেকে উঠল সে — খুকি! এখন রাতের সেই প্রহর যখন মানুষ দুঃস্বপ্ন-দেখে-ঘুম-ভেঙে-যাওয়া সন্তানের শরীর জড়িয়ে নিশ্চিন্তি দেয়। এখন আমার মনে হল, ইঁদুরের উপদ্রবে ভরা এই ভুতুড়ে বাড়িটায় বসে আমি অনুর মৃত্যুকামনা করছি। এই কথা ভাবতে ভাবতে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমার ঠোঁটজোড়া নিঃশব্দে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে এবং শীতল হিম ঠান্ডার ভেতর ভলকে ভলকে হাসি বেরিয়ে আসবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ এও তো ঠিক, যে, আমি তাকে ভালোবাসি। ফাঁকা দরজার পাল্লার দিকে চেয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম: কেউ এসে দাঁড়াবে। কেউ কি এসে দাঁড়াবে? কয়েকসপ্তাহ বাদে ইস্কুলে থার্ড পিরিয়ডের ঘন্টা পড়েছে, এমনসময় হেডমাস্টারের ঘরে আমার ডাক পড়ল। গেলাম; আমাকে দেখেই তিনি ভ্রূ কুঁচকে — কী ব্যাপার? আপনি অসুস্থ নাকি? — না-না, বলুন — কাশি সামলাতে সামলাতে বললাম। ভাগ্যিস আজকাল ফুলহাতা জামা পরে আসি।
— আপনার নামে অনেক অভিযোগ। আপনি ক্লাসে ছেলেদের নানারকম বিষের গল্প বলেন?
— বিষ?
— হ্যাঁ, মানুষমারা বিষ; সায়ানাইড, স্ট্রীকনিন, সারিন গ্যাস, যা নাকি হিটলারও ব্যবহার করতে চায়নি?
— (নিরুত্তর)
— দেখুন সুপর্ণবাবু, আপনাকে শোকজ করা হবে; হয়তো ম্যানেজিং কমিটি শেষপর্যন্ত সাসপেন্ড করবে —
বিকেলের দিকে হঠাৎ ইস্পাতরঙা মেঘ ঘনিয়ে এলো; ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তায় মধ্যিখানে একটা কালভার্ট পড়ে, নির্জন জায়গাটায় আমি কিছুক্ষণ দাঁড়াই। আজকেও দাঁড়ালাম; ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটোটা বের করে রাখলাম কংক্রিটের মাথায়। ঢাকনাটা খুললাম। রুটি আর সামান্য তরকারি। অনেকদিন পর টিফিন এনেছিলাম; অনু এখন খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। সকালে আমায় টিফিন বানিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টিটা তেড়ে নামল; আমি কৌটোটা উপুড় করে দিলাম কংক্রিটের স্ল্যাবে। একটু দূরে যেতেই কয়েকটা কাক ডানা মুড়ে দ্রুত নেমে এলো; হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম বৃষ্টির ভেতর কাতর যন্ত্রণায় কাকগুলো মরে যাচ্ছে। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম অনু আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, অনু তুমি মরে যেওনা একা একা।