ইউকিও মিশিমা একজন বিপজ্জনক লেখক আর একারণেই তিনি জাপানের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের একজন। ব্যক্তিগতভাবে কাওয়াবাতা, তানিজাকি, দাজাইয়ের কিছু কিছু লেখা, যা আমি পড়েছি, পড়ে ভালো লাগলেও শেষপর্যন্ত ফিরে গেছি মিশিমার কাছেই। তাঁর ৪৫ বছরের জীবনের শেষে, তুখোড় লেখক, সফল নাট্যকার, জনপ্রিয় অভিনেতা ও ফিল্ম পরিচালক ইউকিও মিশিমা, একজন দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী হিসেবে একটি প্রাইভেট মিলিশিয়া গঠন করেন এবং টোকিওর একটা মিলিটারি বেস দখল করতে গিয়ে ব্যর্থ হন; তারপর পেট চিরে আত্মহত্যা (সেপুকু) করেন ১৯৭০ সালে। পৃথিবীর অসংখ্য আত্মহত্যাকারীর থেকে মিশিমা আলাদা শুধু এজন্যে যে দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে হত্যার ঘটনাটি তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এটাকেই তিনি বর্ণনা করেছেন 'কনফেশনস অফ আ মাস্ক' উপন্যাসটিতে জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে; বাকি সমস্ত কিছুই তাঁর কাছে গৌণ। এইটুকু বললে অবশ্য মিশিমা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয় মাত্র। মিশিমা ছিলেন একজন নিবিড় শরীরচর্চাকারী, তাঁর 'সান অ্যান্ড স্টিল' শীর্ষক লম্বা স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় হল শরীরচর্চা; প্রচলিত ধারণার বিপ্রতীপে, বৌদ্ধিকচর্চায় মনের তুলনায় শরীরকে তিনি সবসময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবী করে এসেছেন। মানবশরীর, ইউকিও মিশিমার কাছে, একটা উপহার যাকে শেষপর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলতে হবে। 'কনফেশনস অফ আ মাস্ক' উপন্যাসে তাই দেখি কেন্দ্রীয় চরিত্রটি, যে একটি বেড়ে-উঠতে থাকা কিশোর, তরুণ সৈন্যদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে, যারা অচেনা দ্রাঘিমায় যুদ্ধ করতে করতে নিষ্ঠুরভাবে মরে যাবে গোলার আঘাতে। তাদের রক্তাক্ত শরীরের কথা ভেবে ছেলেটি উত্তেজনা বোধ করে; এই উত্তেজনা দুটি উপাংশে ছড়িয়ে থাকে সারা উপন্যাস জুড়ে — প্রথমত সমকামিতা আর দ্বিতীয়ত নৃশংসতা।
একটি অবস্থাপন্ন কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু পরিবারে ছেলেটি জন্মায় ১৯২৫ সালে এবং বেড়ে উঠতে থাকে মূলতঃ তার ঠাকুমার সাহচর্যে। রুগ্ন ঠাকুমার ঘরে অসুখের ঘ্রাণ তার স্মৃতিতে জড়িয়ে যায়; ছোটবেলায় একবার সে পড়ে যায় সিঁড়ি থেকে আর চারবছর বয়েসে বমি করে অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন সকলে ধরে নিয়েছে সে মারা গেছে, ছেলেটি বেঁচে ওঠে। মিশিমার বাক্যগুলি তীক্ষ্ণ এবং মাপা, পরতে পরতে কাব্যিক সুষমা জড়ানো; আলগা বাক্য তিনি লেখেন না। তাঁর লেখার নীচে জমে থাকে মৃত্যুর ছায়া বা বলা ভালো মৃত্যু সম্পর্কে একটা তীব্র অবসেশন। ছেলেটির যৌনস্মৃতি সম্ভবতঃ একজন মেথরের প্রতি আকর্ষণ থেকে শুরু হয়। তারপর একদিন একটি ছবির বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে সে খুঁজে পায় একজন ঘোড়সওয়ার যোদ্ধার চিত্র; যোদ্ধার তলোয়ারটি আকাশের দিকে উঁচানো এবং তার শিরস্ত্রাণের মধ্যে দিয়ে সুন্দর মুখের কিছুটা অংশ দৃশ্যমান। ছবিটার দিকে তাকিয়ে সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দ্যায়। ছেলেটিকে যে পরিচারিকা দেখাশোনা করেন, তিনি বলেন, তুমি জানো ওটা কার ছবি? জোন অফ আর্ক। সেইমুহূর্ত থেকে ছেলেটি তীব্র বিতৃষ্ণা বোধ করতে থাকে ছবিটির প্রতি এবং আরও পূর্ণাঙ্গ অর্থে পুরুষের পোশাকপরা মেয়েদের প্রতি। যুদ্ধের মধ্যে — জাপানের ইতিহাসের টালমাটাল সময়টার মধ্যে — বড়ো হতে থাকে ছেলেটি। বাড়ীর গেটের সামনে দিয়ে ভারী বুট পরে সৈন্যরা যায় মার্চ করতে করতে; তারা ছুঁড়ে দেয় ফাঁকা কার্তুজ। ছেলেটি তাদের ঘেমো ইউনিফর্ম থেকে ভেসে আসা গন্ধে, সমুদ্রতীরের বাতাসের মতো মোহময় গন্ধে, শারীরিক উত্তেজনা বোধ করে। অজানা প্রান্তরে পড়ে থাকা এইসব তরুণের ক্ষতবিক্ষত দেহের কথা সে কল্পনা করতে থাকে। রূপকথার গল্প পড়তে গিয়ে রাজকন্যার প্রতি ছেলেটি কোনো টান অনুভব করে না; রাজপুত্র দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করছে যখন ড্রাগন তার প্রত্যঙ্গগুলি একে একে কামড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে, এটা পড়তে পড়তে সে রোমাঞ্চ অনুভব করে। কিন্তু হঠাৎ সে থমকে যায় যখন জাদুর সাহায্যে রাজপুত্র বেঁচে ফিরে আসে অক্ষত শরীরে; একটি দাগও তার শরীরে আর নেই, এই বর্ণনা পড়ে ছেলেটি ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে, কারণ তার মনে হয় লেখক তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। যা সুন্দর, মিশিমা একটি ধারণা নিখুঁতভাবে গেঁথে দ্যান চরিত্রটির ভেতর, পরিসমাপ্তিতে তা ধ্বংস হয়ে যাবে বলেই সুন্দর।
ধীরে ধীরে ছেলেটি বুঝতে পারে সবাই তার কাছে পুরুষসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করছে এবং সেও শুরু করে প্রতারণা। অন্য ছেলেদের মতো সে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলতে যায়; দৌড়তে দৌড়তে শুয়ে পড়ে মাটির ওপর, সকলে জিগ্যেস করে, তোর কী হলো রে? ছেলেটি জানায় সে মৃত সৈনিকের অভিনয় করছে আর সত্যিই যদি বুলেটের আঘাতে মৃত সৈনিক হত সে, তার মনে হয়, সেইমুহূর্তে, একটা আনন্দের শিহরণ বয়ে যায় তার ভেতর দিয়ে। ঠাকুমার কাছ থেকে তার বাবা-মা তাকে নিজেদের কাছে এনে রাখতে শুরু করে; বাবার আর্টের বইগুলিতে, নগ্ন মেয়েদের ছবি থাকায় যেগুলো লুকিয়ে রাখা হত, সে একদিন খুঁজে পায় গাইদো রেনির সেন্ট সিবাস্টিয়ান চিত্রটি। গাছের সাথে বাঁধা এক যুবকের অর্ধনগ্ন সুঠাম শরীর, তার নিম্নাঙ্গে একটুকরো কাপড় কোনোরকমে ঝুলছে আর দুটি তীর গেঁথে আছে যথাক্রমে দেহের বাঁদিকের বগলে এবং ডানদিকে; কোনো রক্ত নেই। ছেলেটি মুগ্ধ চোখে ছবিটা দেখতে থাকে, তার হাতগুলি অজানা গতিতে সচল হয়ে ওঠে, প্রবল যৌন উত্তেজনায় সে হস্তমৈথুন করে ছবিটা দেখতে দেখতে, বিষণ্ণ পাপবোধে তার মন ভরে ওঠে। ইস্কুলে পড়ার সময় সে ক্রমশ ছেলেদের মতো কর্কশ ভঙ্গিতে কথা বলতে শেখে; ভাষার যৌন ইঙ্গিতগুলি সে খুব দ্রুত রপ্ত করে ফ্যালে, কারণ বাকীরা যখন নিজেদের প্রকাশ করতে করতে পরিণত হয়ে উঠবে, ছেলেটিকে নিজেকে ঢেকে ফেলতে হবে একটা মুখোশের আড়ালে। সবকিছুরই যেন পূর্বনির্ধারিত ইঙ্গিত শৈশবে পাওয়া গিয়েছিল, এমনকি মুখোশটারও; ছোটবেলায় গ্রীষ্মকালীন উৎসবের সময় একদল লোক তাদের বাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকে আসে ভেতরে এবং যিনি পুরোহিত, তাঁর মুখে ছিল একটা শেয়ালের মুখোশ। সেই স্মৃতিটা গেঁথে যায় ছেলেটির মাথায়। পরে তেনকাৎসু নামে জাপানের একজন বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ানের শো দেখে ছেলেটির শখ হয় জাদুকরীর মতো জমকালো পোশাক পরবে এবং সে মায়ের আলমারি থেকে বের করে সবচেয়ে চমৎকার কিমোনোটি। সারা বাড়িময় সে তেনকাৎসু সেজে দৌড়ে বেড়ায় সেই পোশাক পরে যতক্ষণ না একজন পরিচারিকা তাকে ধরে মুরগীর ছাল ছাড়ানোর মতো পোশাকটা টেনে টেনে খুলে দেয়।
ক্লিওপ্যাট্রাকে সে দ্যাখে একটি সিনেমায়, রানীর জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকের নীচে অর্ধনগ্ন পীতাভ-বাদামী শরীর। সেজে থাকা; একটা ছদ্ম পরিচয় যা তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে তার চারপাশের লোকজনের কাছে, এটা থেকে তার একসময় মনে হয় হয়তো সবাই এরকম মুখোশের আড়ালে রয়েছে। আরও পরের দিকে তাকে দেখা যায় মেয়েদের উলঙ্গ ছবির পানে ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থাকতে কিন্তু সেগুলি তার ভেতর কোনো অনুভূতি জাগায় না। বন্ধুর সাহায্যে সে বেশ্যার কাছে যায় এবং ব্যর্থ হয় নিজেকে সঙ্গমে লিপ্ত করাতে। ইস্কুলে থাকতে একটি ফেল-করা ছেলের প্রতি, যার শরীরটা বয়সে বড়ো হওয়ায় অনেকটা পরিণত, তার প্রতি প্রেম জেগেছিল ছেলেটির; প্রেমে পড়েছিল সেই মুহূর্তে, যখন ফেল-করা ছেলেটি তার চোয়ালে একটা সজোরে ঘুঁষি মারে। কলেজে গিয়ে তার বন্ধুত্ব হয় কুসানো নামে এক তরুণের সাথে; কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য প্রেম সে খুঁজে পেতে চায় তার মুখোশের জন্যে, আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে বোঝায় যে সে কুসানোর বোন সোনোকোর প্রেমে পড়েছে। ইতিমধ্যে জাপান জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মিত্রশক্তির বোমার আতঙ্ক। ইউনিভার্সিটি থেকে অন্যান্য সহপাঠীদের সাথে তাকে পাঠানো হয় একটি ফাইটার প্লেন তৈরীর কারখানায়। এখানে তৈরী হত জিরো-মডেল কম্ব্যাট প্লেন, যা ব্যবহার করবে সুইসাইড স্কোয়াড। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্ত আধুনিক উপকরণগুলি মেধাবী মস্তিষ্কের নিখুঁত ও যুক্তিসম্মত চিন্তার সাহায্যে এখানে কাজ করে চলেছে একটিমাত্র পরিণতির উদ্দেশ্যে — মৃত্যু। অন্যান্য জায়গার তুলনায়, এটা সহজবোধ্য যে, এই কারখানায় বোমা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কিছুদিন কারখানায় কাজ করার পর ছেলেটিকে আর্মিতে যোগ দেবার জন্যে ডাকা হয়। ছেলেটির মনে হয় সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চলছে কারণ সে তো এই পরিণতিই চেয়েছিল। কিন্তু কারখানায় থাকাকালীন একটা বিচ্ছিরি সর্দি তাকে পেয়ে বসেছিল এবং যখন আর্মি ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে, সে কিছু কিছু জবাব ভুলভাল দেয়। তার হাঁচিতে কাশিতে নাজেহাল অবস্থা দেখে ডাক্তারের সন্দেহ গাঢ় হয় যে টিউবারকুলোসিস এবং তাকে জানানো হয় আনফিট ফর সার্ভিস।
এইসময় থেকে শুরু হয় গ্লানিবোধ। ট্রেনে ফিরতে ফিরতে ছেলেটি বুঝতে পারে সত্যিটা আসলে কী। সে ভাবে টোকিওতে তার বাবা-মার কাছে ফিরে যাবার কথা, কিন্তু তার মনে হয় যদি বোমার আঘাতে একদিন তারা সপরিবারে মরে যায়; তার গা গুলিয়ে ওঠে কারণ সে তো একা একা মরতে চেয়েছিল অচেনা সহযোদ্ধাদের মাঝে, একটা বেড়ালও মরবার সময় চোখের আড়ালে গিয়ে মরে আর সে কিনা মরবে পরিবারের অন্যদের চোখের সামনে। সে বুঝতে পারে সে আসলে মরতে চায়না, চায়নি কোনোদিন; তাই সে আর্মি ডাক্তারের কাছে উল্টোপাল্টা জবাব দিয়েছে। এইখান থেকে তার জীবনটা হয়ে যায় একটা অপমানের জীবন। তার বন্ধু কুসানো যুদ্ধে যায়; ছেলেটিকে সে বলে যায় তার পরিবারের খোঁজ রাখতে। ছেলেটির সাথে সোনোকোর দেখা হয়; তাদের সম্পর্কটা, সোনোকো ভাবে, বিয়েতে পরিণতি পাবে। ছেলেটি একসময় বুঝতে পারে তার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব, সোনোকোকে কাটিয়ে দেয় সে। দুবছর পরে সোনোকোর সাথে বন্ধু হিসেবে দেখা করে কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারে তারা পরস্পরকে সুখ দিতে পারবে না। ইউকিও মিশিমা যখন এই উপন্যাসটি লেখেন, তখনও তাঁর বয়স বিশের ঘরে। মিশিমার উপন্যাসে, অধিকাংশ ভালো উপন্যাসের মতোই, আত্মজীবনী ও কাহিনী মিলেমিশে থাকে। অসংখ্য জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে উপন্যাসের সমান্তরালে মিশিমার জীবনকে রাখলে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৫ সালে সম্রাট হিরোহিতো যখন আমেরিকান কম্যান্ডারের সামনে নিজের দেবত্ব অস্বীকার করেন, মিশিমা প্রচন্ড সমালোচনা করেছিলেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল হিরোহিতো সেইসব সৈন্যদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাটের জন্যে প্রাণ দিয়েছে। পরে মিশিমা যখন মিলিশিয়ার আয়োজন করেন, সেটাও ছিল সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে। ইউকিও মিশিমা ভয়ংকর সুন্দর একজন লেখক, কারণ মৃত্যু, নৃশংসতা ও যৌনচেতনা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিকোণগুলি বিচিত্র এবং ভাবনা-উদ্রেককারী। সেজন্যেই তাঁকে পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
ভালো লাগলো।
সিএস, ধন্যবাদ।