বোলানিও, যিনি সারা পৃথিবীর পাঠকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন, 'দ্য রিটার্ন' ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর একটি গল্প সংকলন; ২০১০ সালে প্রকাশিত, লেখকের মৃত্যুর সাত বছর পরে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত 'লাস্ট ইভনিংস অন আর্থ' বইটিতে যে গল্পগুলি ছাপা হয়েছিল, তার বাইরেও বোলানিওর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প রয়ে গেছিল; সেগুলি এই বইটিতে স্থান পেয়েছে। মোট তেরোটি গল্প, যার বিষয়বৈচিত্র্য বোলানিওর সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে — দুটো রাশিয়ার গল্প, ভাঙা প্রেমের গল্প, অপরাধের গল্প, পর্নস্টারদের গল্প, আহত ফুটবল প্লেয়ারের গল্প, মৃত কবির সঙ্গে স্বপ্নে আলাপের গল্প এবং অবশ্যই, নামভূমিকায় যে গল্পটি, সেটি একজন নেক্রোফিলিয়াকের। অধিকতর বিচিত্র ও দুর্দান্ত গল্পগুলি সম্বন্ধে কথা বলার আগে 'ডিটেকটিভস' গল্পটিকে সেরে নেওয়া যাক। এই লেখাটিতে দুজন ডিটেকটিভ ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ তাদের এক পুরনো ক্লাসমেটের ব্যাপারে গল্প করতে শুরু করে, যার নাম আর্তুরো বেলানো। বেলানো, যে বোলানিওর বিভিন্ন লেখায় তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি মাত্র, ১৯৭৩ সালে কুড়ি বছর বয়সে চিলিতে ফিরে আসে এবং সেই দুরন্ত সময়ে গ্রেফতার হয়। তাকে যে জেলে রাখা হয়েছিল সেখানে কারারক্ষীর দায়িত্বে ছিল এই দুজন ডিটেকটিভ। তাদের সাহায্যেই বেলানো মুক্তি পায় এবং এই কাহিনীটিকে মনে করা হয় বোলানিওর জীবনের সত্য ঘটনার ছায়াবলম্বনে লিখিত। কিন্তু পরে, যদ্দূর মনে পড়ছে নিউ ইয়র্কারের একটি আর্টিকেল বিতর্ক সৃষ্টি করে এই বলে যে বোলানিও আদৌ ১৯৭৩ সালে চিলিতে যাননি। বোলানিও নিজেও সাক্ষাৎকারগুলিতে যথেষ্ট স্পষ্ট করেননি তাঁর চিলিতে যাওয়ার ঘটনাটি। যাইহোক, চিলির অভ্যুত্থান নিয়ে বোলানিওর আরেকটি লেখা, একটি নভেলা 'বাই নাইট ইন চিলি', অত্যন্ত চমৎকার। সে তুলনায় 'ডিটেকটিভস' আমার ভালো লাগেনি; সংলাপের পর সংলাপ সাজিয়ে লেখা গল্পটা ঠিক অন্য গল্পগুলোর মতো ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠেনি বলে মনে হয়েছে।
যাইহোক, এবার 'স্নো', 'উইলিয়াম বার্নস', 'ক্ল্যারা', 'সেল মেটস', 'দ্য রিটার্ন', 'প্রিফিগারেশন অফ লালো কুরা' প্রভৃতি পছন্দের গল্পগুলোর কথা বলি। শুরু থেকেই যদি শুরু করা হয়, তাহলে 'স্নো' গল্পটিকে ধরা যাক। এটি মূলতঃ রগেলিও এস্ট্রাডার বয়ানে; এস্ট্রাডা এই গল্পটি শোনাচ্ছে লেখককে বার্সেলোনায় বসে। এস্ট্রাডা প্রকৃতপক্ষে চিলির লোক; কিন্তু সে রাশিয়াতে দীর্ঘদিন কাটিয়েছে এবং তার মতে বুলগাকভ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ লেখক। এস্ট্রাডা রাশিয়ায় থাকাকালীন মিশা পাভলভ নামে এক মাফিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমে পাভলভের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। তার মূল কাজ ছিল পাভলভের জন্যে মেয়ে জোগাড় করে আনা। নাটালিয়া চুইকোভা নামে এক অ্যাথলিটের ওপর পাভলভের নজর পড়ে। সমস্যা জটিল হয় যখন এস্ট্রাডা নাটালিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। একদিন রাতে পাভলভের সাথে এস্ট্রাডার একটা কনফ্রন্টেশন হয় এবং সে পাভলভকে খুন করে পালিয়ে যায়। পুলিশ ইত্যাদি ঝামেলা মেটার পর নাটালিয়া ও এস্ট্রাডা প্যারিসে গিয়ে কিছুদিন বসবাস করে এবং তারপর জার্মানী চলে যায়। সেখানে নাটালিয়া এক জার্মানের প্রেমে পড়ে এবং এস্ট্রাডা বার্সেলোনাতে চলে আসে। গল্পের শেষে সে লেখককে জানায় যে রাশিয়াকে সে মিস করে এবং সে একদিন চিলি ফিরে যেতে চায়। এস্ট্রাডা একান্তই বোলানিওর চরিত্র; এইরকম অনেকগুলো দেশ এবং সময়ের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করা চরিত্র আঁকার ব্যাপারে লেখকের দক্ষতা সীমাহীন। 'উইলিয়াম বার্নস' গল্পটিও বার্নসের বয়ানে আমরা পড়ি এবং পটভূমি সান্তা তেরেসা শহর; ২৬৬৬ পড়া থাকলে এই অদ্ভুত শহর আমাদের চেনা। বার্নস দুজন মহিলা ও তাদের দুটি কুকুরের সঙ্গে বাস করে। জানা যায় মহিলা দুজনকে কেউ অজ্ঞাত কারণে খুন করতে আসছে। একসময় সেই খুনী আসে এবং তাকে বার্নস মেরে ফ্যালে। কিন্তু শেষে দেখা যায় মৃত লোকটি আসল খুনী নয়। প্রকৃত খুনী জীবিত আছে এবং বার্নস তার সন্ধানে যায়। গল্পের শেষে পাঠককে জানানো হয় যে কিছুবছর পরে উইলিয়াম বার্নস অপরিচিত লোকের হাতে খুন হয়েছিল। এই অর্থহীন গল্পটি আমার বেশ পছন্দের কারণ বাস্তবের সীমা অতিক্রম না করলেও একটা সাসপেন্স ও অবোধ্য আতঙ্কের শেড গল্পটাকে সাররিয়েল করে তোলে।
'ক্ল্যারা' একটি অতি প্রিয় বিষাদময় গল্প। সুন্দরী ও শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় ক্ল্যারা তার জীবনের একের পর এক সম্পর্কের ভেতর কিছু একটা খুঁজে পায়না; তার প্রেমিকদের মধ্যে নামহীন ন্যারেটর একজন, যে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার পরেও ক্ল্যারার খোঁজখবর রেখে চলে। ক্ল্যারা বিয়ে করে এবং বিয়ে ভাঙে; এভাবেই তার জীবন চলতে থাকে। সম্পর্কগুলি ক্ষেত্রবিশেষে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে। তার কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। একসময় সে যেন একটা স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে বলে মনে হয়। ন্যারেটরের সঙ্গে তার কথোপকথনের মূল বিষয় হয়ে ওঠে তাদের ছেলেমেয়ে। হঠাৎ একদিন ক্ল্যারার ক্যানসার ধরা পড়ে। গল্পের শেষদিকে হাসপাতালে যাবার কয়েকদিন আগে ক্ল্যারা নিখোঁজ হয়ে যায়। এই বিষণ্ণ কাহিনীটি বোলানিওর কলমে আশ্চর্য নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে; একটু অসতর্ক হলেই গল্পটা মেলোড্রামাটিক হতে পারত; হয়না কেননা, আমার মনে হয়, বোলানিওকে সাহায্য করেছে তাঁর গদ্যকবিতা লেখার অভ্যাস। 'ক্ল্যারা'র মতোই 'সেল মেটস' গল্পটিতেও মূল চরিত্র একজন মানসিকভাবে আনস্টেবল মেয়ে। এখানেও আমরা ১৯৭৩ সালে ন্যারেটরের চিলির জেলে বন্দী থাকার রেফারেন্স পাই। মেয়েটি, যার নাম সোফিয়া, সেও একই সময়ে বন্দী ছিল আরাগনের জেলে; সেজন্যেই সেলমেটস নাম। তারা দুজনে খুব দ্রুত যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে; সোফিয়া ঘরের দেয়ালগুলোতে মরুভূমির সূর্যাস্তের দৃশ্য এঁকে রাখে, সে সবসময় একই পজিশনে সেক্স করতে ভালোবাসে। ধীরে ধীরে তার ইকসেন্ট্রিক হ্যাবিটগুলো প্রকাশ পায়; যেমন, মেয়েটা স্রেফ জলে মাখানো ম্যাশড পটেটো খেয়ে দিনের পর দিন কাটায়। সোফিয়ার প্রেমগুলোও একটু বিচিত্র। যাইহোক, একসময় সোফিয়া অন্যত্র বাস করতে যায়। কিন্তু ন্যারেটরের সঙ্গে ঘুরেফিরে ফের সোফিয়ার মোলাকাত হয়। গল্পটাতে সোফিয়ার অদ্ভুত আচরণ ছাড়াও সোফিয়া ও ন্যারেটরের মধ্যে, ঠিক প্রেম নয় অথচ প্রেমহীনতাও নয়, এরকম একটা সম্পর্কের টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়।
'দ্য রিটার্ন' একটা পারফেক্ট ভূতের গল্প। প্যারিসের এক নাইটক্লাবে ন্যারেটর ভোর চারটের সময় মারা যায় এবং সে জানায় এই জীবনের পরেও আরেকটা জীবন আছে। পুরো গল্পটাতেই সে উপস্থিত থাকে সূক্ষ্ম শরীরে; কোথায় যাওয়া উচিত বুঝতে না পেরে সে তার মৃতদেহটাকে অনুসরণ করতে থাকে। তার লাশটাকে মর্গ থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয় জঁ-ক্লদ ভিলেন্যুভ নামে এক বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনারের অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানে ন্যারেটর খুবই অবাক হয়ে দেখে যে ভিলেন্যুভ তার মরদেহের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে। অদৃশ্য অবস্থায় সে ভিলেন্যুভকে তিরস্কার করতে থাকে। এই মজার গল্পটা বোলানিও এমনভাবে লিখেছেন যে সাররিয়েল এলিমেন্টগুলো একধরনের হ্যালুসিনেটরি এফেক্ট তৈরি করে। এটা এই সংকলনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ও চমৎকার গল্প। শেষ করব 'প্রিফিগারেশন অফ লালো কুরা' শীর্ষক গল্পটির কথা বলে। লালো কুরা, যেহেতু বোলানিওর গল্পগুলি একই কল্পজগতের অন্তর্ভুক্ত, তাই লালো কুরাকে ২৬৬৬ উপন্যাসেও আমরা পাব, যাইহোক, সে একজন ভাড়াটে খুনী। তার মা একজন ফিমেল পর্নস্টার ছিল। লালো কুরার বাবা একজন পাদ্রী, যে রেড লাইট এরিয়ায় প্রীচ করতে এসে মার খাবার উপক্রম হয়, কেননা সবাই তাকে পুলিশের চর ভাবে। লালো কুরার মা তাকে বাঁচায় এবং তাদের প্রেম হয়। লালো কুরা যখন তার মায়ের পেটে, তার বাবা, বোলানিওর অসংখ্য গল্পের চরিত্রের বাবাদের মতো লাতিন আমেরিকায় হারিয়ে যায়। লালো কুরার মা প্রেগনেন্ট অবস্থায় একের পর এক পর্ন ফিল্মে অভিনয় করে। লালো কুরার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মায়ের পেটে থাকাকালীন ঘটনাসমূহের পূর্বস্মৃতি সে মনে রাখে। গল্পের শেষদিকে বোঝা যায় সে একজন মেল পর্নস্টারকে খুঁজছে, যে তার মায়ের সহঅভিনেতা ছিল। প্রথমে মনে হয় সে তাকে খুন করতে চায়, কিন্তু শেষপর্যন্ত লালো কুরা পর্নস্টারটির প্রতি সহমর্মিতা দেখায়।
এগুলি ছাড়াও সংকলনের আরও কয়েকটি গল্প উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, 'বুবা' গল্পটি; বার্সেলোনার কোন ক্লাবে খেলতে আসা একজন ফুটবলার সিজনের শুরুর দিকে চোট পায় এবং বুবা নামে একজন আফ্রিকান খেলোয়াড় তার রুমমেট হয়। বুবা নানারকম আফ্রিকান মিউজিকে ডুবে থাকে; ক্রমে তাদের বন্ধুত্ব হয়। একদিন বুবা এই আহত ফুটবলারের খানিকটা রক্ত চায়; স্বভাবতই ফুটবলারটি প্রথমে চমকে ওঠে। অবশেষে রক্ত দেয় এবং বুবা বাথরুমে গিয়ে কিছু একটা করে। পরদিন টিম জিতে যায় এবং এই ফুটবলারটিও দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। 'মার্ডারিং হোরস' গল্পটিতে দেখি একজন বেশ্যা ম্যাক্স নামে একটি ছেলেকে টিভিতে দেখে তার বাড়ীতে এনে টর্চার করে এবং শেষঅব্দি মেরে ফ্যালে। গল্পটি লেখা হয় মনোলোগের আকারে; মাঝে মাঝে ম্যাক্সের অভিব্যাক্তি তুলে ধরা হয় ব্র্যাকেটের ভেতর। 'মিটিং উইথ এনরিকে লিন' গল্পে বোলানিও স্বনামে উপস্থিত; বেলানো নামে নয়। স্বপ্নে বোলানিও কবি এনরিকে লিনের সাথে দেখা করতে যায়, যিনি দীর্ঘদিন আগেই মৃত। একটি লম্বা প্যারাগ্রাফে লেখা এই গল্পটির মধ্যে স্বপ্নের ঘোর তৈরি হয়। বোলানিওর লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আর্বান প্রেক্ষাপট আর প্রায়ই যে জিনিসগুলো কাহিনীতে ঘুরেফিরে আসে, সেগুলো হল সেক্স, ভায়োলেন্স, মেলানকোলি এবং অবশ্যই পোয়েটিক্স; বলা বাহুল্য, এই উপাদানগুলি না থাকলে সেইসব বই পড়ার ইচ্ছে জাগে না। 'দ্য রিটার্ন' গল্প সংকলনটি সেদিক দিয়ে খুবই পছন্দসই; বোলানিওর এই গল্প সংকলনটি তাঁর অন্যান্য বইয়ের তুলনায় মনে হয় সামান্য কম পরিচিত, ফলে এ সম্পর্কে কিছুটা লিখে ফ্যালা গেল।