১
নীলাভ আলোর ঝলকে প্রস্তরীভূত শরীরের ভেতর আদিম অন্ধকারের স্বাদ থেকে জেগে উঠে দেখলাম কোনো ব্যথা নেই, কোনো স্মৃতি পর্যন্ত নেই যে কবে শরীরের অনুভূতিসম্পন্ন স্নায়ুকোষগুলি একে একে নষ্ট হয়ে ঝরে গেছে। মৃত্যুর পরে সময়ের কোনো চেতনা অনুভব করিনি আর। তাই জানিনা কতদিন শুয়ে আছি এই গ্রহের মাটিতে প্রায় জীবাশ্ম হয়ে, পাথরের দৃঢ় শরীরে গেঁথে আছে আমার কঙ্কাল, তবু জেগে ওঠবার প্রেরণা সংগ্রহ করে নিতে হলো নীল আলোর বৃত্তটায় করোটির কোটরদুটো ধাঁধিয়ে যাবার ফলে। ঠিক তখনই একটা চলমান বস্তু দুর্বল অভিকর্ষের সাহচর্যে বিশাল লাফ মেরে এসে পড়ল আমার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম কোনো প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যে শুকিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যহীন এক জলপ্রপাতের খাতে জমতে শুরু করা বৃষ্টির দানাগুলোর মতো আমার বোধের ভেতর ফিরে আসছে দুর্বল স্মৃতি। একটা লম্বা টানেল পেরোতে থাকা ট্রেনের গায়ে আছড়ে পড়া প্রতিধ্বনির মধ্যে থেকে যেন আমি শুনতে পেলাম হাজার হাজার নামহীন কন্ঠস্বর। মোমবাতির নিভে আসা হলদে শিখার মতন কাঁপতে কাঁপতে মনে পড়ে গেল আমার নিকটবর্তী জিনিসটার নাম — প্রাণ! সাদা ধাতব পোশাক ও শিরস্ত্রাণ পরা একটা নভোচারী কুকুর ও তার পিছনে স্পেসস্যুট পরিহিত দুটো দ্বিপদ প্রাণী হাতে নীল আলোর টর্চ জ্বেলে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কাছে এসে আমার অবয়ব পরীক্ষা করতে করতে যখন ওদের কাঁচের হেলমেটে ঢাকা মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল, আমি চিনতে পারলাম দুজন মানুষকে। দুজন মানুষ! আঃ! আমরাও তো মানুষই ছিলাম সেই বীভৎস বিস্ফোরণের আগে। অনেকদিন আগে এইখানে ঘটেছিল বিস্ফোরণটা। আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাবগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছিল। ধাতুপোড়া গন্ধ আর জ্বলন্ত মাংসের থকথকে ঘ্রাণের ভেতর শুয়ে আমরা অনেকক্ষণ কাতরাচ্ছিলাম, জোরে জোরে চিৎকার করেছিলাম, কারোর আঙুলসমেত হাত, কারোর চুলসুদ্ধু মাথা ছিটকে ধোঁয়ার ভেতর গলে যাচ্ছিল; আমার কোমরের নীচের অংশটা উড়ে যায়। কান থেকে চ্যাটচ্যাটে রক্ত গাল বেয়ে গড়াচ্ছিল, যতক্ষণ আমি জেগেছিলাম। তারপর পোড়া চুলের গন্ধ মুখে নিয়ে আমরা মরে যাই। এখন সবকিছুর ওপর লাল ধুলোর পুরু স্তর জমে আছে। ধ্বংসের পর শব্দহীন হয়ে গেছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভূগর্ভস্থ গবেষণাগার ও কৃত্রিম আবহাওয়া বেষ্টিত সারফেস ডোমগুলো-সমেত এই পরিত্যক্ত টেস্ট ফেসিলিটি; শুধু বছরের পর বছর দৈত্যাকার ধুলোর টর্নেডো ঠান্ডা পাতলা কার্বন-ডাই-অক্সাইড-ভর্তি বায়ুমন্ডলের ভেতর থেকে ধেয়ে এসে সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে যায় অক্সিডাইজড আয়রন ডাস্ট। খানিকদূরে কোনো অর্ধসমাপ্ত কথোপকথনের শেষ সিগন্যালটুকু ধরবে বলে হিম ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধুলো গিলছে হাঁ-করা বিশাল রেডিও অ্যান্টেনা। হোয়াট ডু ইউ রীড, মাই লর্ড? ওয়ার্ডস, ওয়ার্ডস, ওয়ার্ডস! ভুলে যাওয়া এই মহাকাশের কবরখানায় দুজন জ্যান্ত মানুষ এসে পৌঁছেছিলো বহু বছর পর। সঙ্গে একটা কুকুর। বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে ওরা যখন ফিরে যাচ্ছিল কবরখানা থেকে, ওদের স্পেসশিপটা ক্রমে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল নক্ষত্রের সমুদ্রে; আর নেগেটিভ ফারেনহাইটে সমস্ত দৃশ্যপট ঝাপসা হয়ে আসছিল কার্বন-ডাই-অক্সাইডের শুকনো কুয়াশায়।
২
টেক্সাস ছাড়বার অনেক পরেও মার্শা আমাকে ভোলেনি। মার্শা আমার দিদি, যে যোগ দিয়েছিল টেররিস্ট দলে। বললে বিশ্বাস হবে না কিন্তু আমাদের পরিবার ছিল খাঁটি রিপাবলিকান। নেভার ভোটেড ব্ল্যু! আমাদের বাড়িটা ছিল অফহোয়াইট রঙের, সামনে ঘাসের লন, সাদা বেড়া। ঘাসের মধ্যে টাঙানো দোলনায় দুপুরবেলা রোদ এসে পড়ত। মার্শা দোলনায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ত। আমায় গল্প পড়ে শোনাত। অত ছোটবেলায় আমি কিছুই বুঝতাম না। আমি ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম। আমাদের একটা আকাশ ছিল। উজ্জ্বল নীল। একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে দোতলার ঘরে আমি মার্শাকে আবিস্কার করি ওর বান্ধবীর সঙ্গে। বুককেসের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা দুজন দুজনের কোমর জড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল আর জানলা দিয়ে দুপুরের ছায়াহীন আলো ঢুকে ওদের গায়ে লেপ্টে গেছিল। মার্শা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন ওর বয়েস বাইশ বছর। সে রাতটায় বেশ ভালো শীত পড়েছিল। বাবা ফায়ারপ্লেসের সামনে আরামকেদারায় বসে পাইপ টানতে টানতে হঠাৎ আমাকে ডাকলেন — শোনো, ও যখন চলেই গেছে, আমি ওকে আর মনে রাখব না — মেয়ের দুঃসাহসিকতায় ফুলে ওঠা ক্রোধ চেপে বলেছিলেন — মার্শা মারা গিয়েছে। এটাই সকলে সত্যি হিসেবে জেনেছিল যে মার্শা মারা গেছে। অনেকদিন পর যখন মার্শা আমাকে পীড়াপিড়ি করেছিল একবার দেখা করবার জন্যে আর শেষপর্যন্ত সেই অনুরোধ এড়াতে না পেরে আমি রাজী হয়েছিলাম দেখা করতে, তখনই জেনেছিলাম মার্শা শুধু মারাই যায়নি, তার নামও পালটে গেছে। কোনো এক বিকেলের শেষে নিউইয়র্কের নোংরাতম ম্যাকডোনাল্ডসে আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ মুখোমুখি বসেছিলাম। আমি রাস্তার উল্টোপিঠে গ্যাস স্টেশনটার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম বছরের প্রথম তুষারপাত শুরু হয়েছে আর তখনই মার্শা আমার হাতে হাত রেখেছিল।
— আমি ভেবেছিলাম তুই না বুঝলেও ভুল বুঝবি না অন্ততঃ! — আবেগহীন গলায় বলেছিল।
আমি দেখছিলাম টেবিলটায় চলকে পড়া কফির না-মোছা দাগে কয়েকটা মাছি ঘুরে ঘুরে বসছে। হাতটা সরিয়ে নিয়ে আমার হঠাৎ মার্শার সঙ্গে খুব শীতল ব্যবহার করতে ইচ্ছে হলো — আমার ওপর ভরসা করে তুই নিশ্চয় বসে নেই, অতএব —
এইসময় কাউন্টারের দিক থেকে আমি সেই ভবঘুরে লোকটাকে আসতে দেখলাম; অর্ডার দেবার সময়ই খেয়াল করেছিলাম হোমলেস লোকটা হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে বিড়বিড় করে চলেছে অর্থহীনভাবে, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। এখন আমাদের টেবিলটার পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলাম গভর্নমেন্টকে গালাগাল দিতে দিতে গেল। মার্শা আড়চোখে তাকিয়ে আমায় বলল — তুই তো এখন লিবারাল হয়েছিস, তাই না?
যদি পৃথিবীতে একটা লোকের কাছে এই প্রশ্নের জবাব সরাসরি দিতে আপত্তি থাকে সে হচ্ছে মার্শা। মনে মনে ভাবলাম, ও কি আমায় দোষারোপ করতে চায় যখন ও লেসবিয়ান জেনে বাবা অস্বস্তিতে ভুগছিলেন, আমি সেসময় চুপ করে ছিলাম বলে? আমি কোন উত্তর না দিয়ে মাথাটা স্থির রাখলাম। মার্শা হাসল। একটু ঝুঁকে বলল — ডু ইউ গিভ আ ফাক অ্যাবাউট দ্য ওয়ার্ল্ড বার্নিং আউটসাইড আমেরিকা?
আমি জানি ও কি বলছে। একুশ শতকের শেষদিক থেকেই পৃথিবী পাল্টে গেছে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর ইমিগ্রেশন পলিসি ভয়াবহরকম স্ট্রীক্ট হয়েছে। জনসংখ্যা, যুদ্ধ আর মহামারী পৃথিবীর ইকোনোমিকে মুমূর্ষু করে ফেলেছে। মাঝে মাঝে খবর আসে এশিয়া আর আফ্রিকার গরীব দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। সেদিন ব্রুকলিনে আমার ফ্ল্যাটের সামনে একটা বিরাট বড় পোষ্টার দেখলাম মনে আছে — ক্যাপিটালিজম অ্যাট ইটস ডেথবেড। আমি মার্শাকে আর কিছু না বলে উঠে পড়েছিলাম। বাইরে বেরোতেই চোখে পড়েছিল গ্যাস স্টেশনটায় নিয়নের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে।
৩
— প্রথমে তিনি দেখেছিলেন একজন বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধকে, তারপর তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল অসুখে জীর্ণ এক ব্যক্তির সাথে, এরপর তাঁর চোখে পড়েছিল একটি মৃতদেহ আর সবশেষে একজন অনশনরত যোগীর তপস্যার দৃশ্য তাঁকে নাড়িয়ে দেয়। সিদ্ধার্থ ছিলেন একজন রাজকুমার। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ করে একরাতে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন দুঃখের কারণ খুঁজতে। — প্রফেসর নাটকীয়ভাবে থামলো। প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি লোক উপচে পড়ছে।
— বুদ্ধিজম ইজ নট অ্যাবাউট মেডিটেশন অ্যান্ড ফিলিং গুড। লেট মি রিমাইন্ড ইউ অ্যাবাউট দ্য রাইটিং অফ সুজুকি। নাৎসী জার্মানীতে হিমলারের পকেটে থাকত একটা গীতা। আর জাপান যখন চীন আক্রমণ করে, তখন সুজুকি বুদ্ধিজমকে ব্যবহার করেছিলেন জাপানকে ডিফেন্ড করতে। ইটস মাচ মোর সিরিয়াস স্টাফ দ্যান ইউ থিংক।
তিনঘন্টার বক্তৃতা একটানা শুনে বেরোনোর সময় আমার পাশের সিটের ছেলেটি তার বন্ধুকে বলল — লোকটা জাদু জানে। তার বন্ধু জবাব দিল — বিকজ হি ইজ আ ফ্যাসিস্ট। এভরি ফ্যাসিস্ট নোজ হাউ টু ইমপ্রেস।
আমি ব্রুকলিনে ফিরছিলাম। চলন্ত গাড়ির জানলা থেকে আমার চোখে পড়ছিল অবিন্যস্ত নিউইয়র্ক শহর। রাস্তার ধারে সস্তা হটডগের স্টল, বাস টার্মিনাসে শুয়ে থাকা গৃহহীন উলিঝুলি পোশাক পরা মানুষ, ভাঙাচোরা গলির দেয়ালে এবড়োখেবড়ো রঙের গ্রাফিতি, ফুটপাতে দাঁড়ানো একলা গাছ থেকে ঝরে পড়া মরা পাতার স্তূপ। সবকিছুর ওপর একটা মলিনতার ছ্যাৎলা পড়ে রয়েছে। সবকিছু যেন নষ্ট হয়ে গেছে অথবা নষ্ট হবার অপেক্ষায়।
— সুজুকি খুব স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন যে নির্বাণপ্রাপ্তির পরে আর একজন মানুষ তার কৃতকর্মের জন্যে কোনো অনুশোচনা বোধ করে না। ফলে সে ভয়ানক হয়ে উঠতেই পারে কেননা সে যদি ছুরি মেরে কাউকে খুন করে, এ ঘটনা তার কাছে প্রতীয়মান হবে এইভাবে যে ভিক্টিম নিজেই এসে ছুরিটা গেঁথে নিলো বুকে।
— যদি নিজের ফলস সেলফ থেকে একজন নিজেকে ডিটাচ করে নিতে পারে, তাহলেই দুঃখময় জগত থেকে তার মুক্তি ঘটে।
টেক্সাসে আমাদের বাড়ির সামনে একটা গ্যাস স্টেশন ছিল এইরকম। ছোটবেলায় আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে একটা খেলনা বাইনোকুলারের সাহায্যে লক্ষ্য করতাম গ্যাস স্টেশনের লোকেদের। যেন আমি একজন স্নাইপার আর এদের মধ্যে কাউকে আমি খুন করতে চাই, এইভাবে আমি টার্গেট স্থির করতাম। তখন আমি অল্পসল্প ভিডিওগেম খেলতে শুরু করেছি। বাড়ি থেকে খানিকদূরে একটা ভিডিও গেমের দোকান ছিল। দোকানটায় ক্রমে ক্রমে আমি একজন নিয়মিত খদ্দের হয়ে উঠলাম আর আমার পনেরো বছরের জন্মদিনে আমি উপহার পেলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর একটা ওয়র গেম। নর্ম্যান্ডি বীচে নামছে আমেরিকান প্যারাট্রুপার্স। গভীর হাওয়ার রাত। আমাদের হাতে উদ্যত এম ওয়ান কার্বাইন। ফ্রান্সকে মুক্ত করতে এগিয়ে চলেছি আমরা। কিংবা স্ট্যালিনগ্রাডের ভয়ংকর যুদ্ধ। অথবা বার্লিনে ঢুকে পড়ছে মিত্রশক্তি। রাইখস্ট্যাগের দখল নিতে নিতে আমি টের পেলাম আমি ন্যায়পরায়ণতার সুখ অনুভব করছি। কলেজের শুরুর দিকে আমি খেলেছিলাম উপসাগরীয় যুদ্ধের ওপর বানানো আরেকটা গেম। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম। ততদিনে আমি কিছুটা লিবারাল হয়ে উঠেছি। বাবার প্রভাব ক্রমে দুর্বল হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। ট্যার ট্যার করে গুলি চালিয়ে শত্রুপক্ষকে মারতে একটু অস্বস্তি লাগছিল এই যুদ্ধটায়। যেন ঠিক নাৎসীদের মারার সুখ পাচ্ছিলাম না। একারণেই ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে যাবার পরেও আমি সংগ্রহে থাকা তৃতীয় গেমটা খেলিনি। সেটা ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের ওপর। প্রফেসরের বক্তৃতা শুনতে শুনতে সেদিন আমার মনে পড়ছিল এই গেমটার কথা।
— আমি মনে করি ভার্চুয়ালাইজেশন অনেকখানি সহজ করে দিয়েছে নিজের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে নেবার কাজটাকে। যেরকম আচরণ খুব কম মানুষই বাস্তবে করবে, ভিডিও গেম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় প্রতিটা লোক সেরকম আচরণ কীভাবে করে? রক্ত, অশ্রু ও বেদনা আমাদের মধ্যে কোনো সাড়া জাগায় না আর। বিকজ দ্যাট রিয়েলিটি ডাজন্ট এক্সিস্ট ইজ ট্রু মোর দ্যান এভার।
— পৃথিবীটা মৃত। নষ্ট হয়ে গেছে। নো এক্সিট। আর কিচ্ছু করবার নেই। এ সত্যকে আমরা কী করে গ্রহণ করব? এই দুঃখ ও যন্ত্রণাময় জগত আমাদের ভেতর থেকে পিষে মেরে ফেলছে। এসো, আমরা নিজেদের দূরত্বে রাখি। মঙ্গলময় বুদ্ধকে আমরা অনুধাবন করি।
৪
আর্কটিকের কাছে মিডউইন্টার সান দিগন্তের ওপরে ওঠে না। এখন মাইনাস ফর্টি ডিগ্রী। পাণ্ডুরবর্ণ রোদ ছড়িয়ে আছে আকাশের চামড়ায়। নীচে মাইলের পর মাইল ঠান্ডা নিথর জঙ্গলে নীলচে-শাদা বরফে আপাদমস্তক ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্প্রুস, ফার, পাইনের মতো লম্বা লম্বা সরলবর্গীয় গাছেরা। তাদের ডাল থেকে ঝুলন্ত শুকনো পাতার গুটিতে ঘুমিয়ে আছে শুঁয়োপোকার দল। পাইন নাট সংগ্রহ করে মাটির অনেক নীচে গর্তের ভেতর শীতঘুমে চলে গেছে মারমট আর চিপমাঙ্ক প্রজাতির কাঠবেড়ালি। সমস্ত এলাকাটা যেন পৃথিবীর শেষপ্রান্তে একটা নির্জন সমাধিক্ষেত্র যেখান দিয়ে মাঝে মাঝে হাওয়ার আর্তনাদ বয়ে যায় টুপটুপ বরফের গুঁড়ো ঝরিয়ে। এত শব্দহীন যে দিনের পর দিন এখানে থাকতে থাকতে আমাদের ডিপ্রেশন হয়। উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার গোপন উপত্যকায় বানানো এই গ্রাউন্ড স্টেশনটায় আপাতত আমরা পাঁচজন আছি। সামনের বছর আমাদের পাঠানো হবে মার্সের টেস্ট ফেসিলিটিতে। স্পেস কলোনি তৈরির প্রথম ধাপ। লালগ্রহ লক্ষ্য নয়, কিন্তু কোনো আর্থ অ্যানালগ এক্সোপ্ল্যানেটে পাড়ি জমানোর আগে মঙ্গলকে ব্যবহার করা হচ্ছে টেস্টবেড হিসেবে যেখানে হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে কলোনি স্থাপনের সমস্যাগুলোকে। শীতল সাইবেরিয়ায় কয়েকমাস আইসোলেশনে বাস করাটা ট্রেনিংয়ের পার্ট। অ্যাস্ট্রোনটদের ফিজিক্যাল স্ট্যামিনা, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি অনেককিছু এখানে খুঁটিয়ে দেখা হয়। মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর জন্যে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে নানারকম বই বা ভিডিও লেকচার দেওয়া হয়েছে আমাদের। অবসরে একলা একলা বসে বই পড়তে পড়তে কখনও কখনও আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। টেক্সাসে আমাদের বাড়ির সামনে গ্যাস স্টেশনটার লাগোয়া একটা ক্যাফে ছিল। আন্টিজ অ্যান্ড আঙ্কেলস। এক বুড়ো কৃষ্ণাঙ্গ দম্পতি চালাতেন দোকানটা। খুব ভাল ব্রেকফাস্ট পাওয়া যেত, বিশেষ করে বেকন আর হ্যাম দিয়ে বানানো থ্রি-এগ অমলেট আর মুচমুচে ফ্রেঞ্চ টোস্টগুলো সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল। বুড়ি আমাকে দেখলেই একটা ফ্রি ডোনাট খেতে দিতেন, দিয়ে জিগ্যেস করতেন স্কুলে কী পড়ানো হচ্ছে ইত্যাদি। মাঝেমাঝেই আফশোস করতেন আজকাল স্কুলের শিক্ষা কত ঈশ্বরহীন হয়ে গেছে তাই নিয়ে আর বারবার বলতেন চার্চে যাওয়া যেন না ছাড়ি। তারপর বাইবেল থেকে যীশুর অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে কয়েকটা গল্প শোনাতেন।
— সবসময় মনে রাখবে তাঁর করুণা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না। একটা পাকাফলও মাটিতে পড়ে না।
আমি আপত্তি জানিয়ে বলতাম — গাছ থেকে ফল পড়ে গ্র্যাভিটির জন্যে। ওতে যীশুর কোনো হাত নেই। নিউটন আর আপেলের গল্পটা জানোনা?
তিনি একটু হতাশ হয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন — গাছ থেকে ফল পড়ে যাতে লোকে খেতে পায়। সবকিছুর পিছনেই একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে জেনো।
সেদিন ম্যাকডোনাল্ডসে বসে মার্শা আমাকে ঠিক এই কথাটাই বলেছিল — সবকিছুর একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে। আমি উত্তরে ঘাড় নেড়েছিলাম — দেশের ভেতর যারা সশস্ত্র অন্তর্ঘাত চালানোর চেষ্টা করছে, যারা ডেমোক্র্যাটিক সিস্টেমকে ধ্বংস করে দেবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে, তাদের সঙ্গে তুই যোগ দিয়েছিস। অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমি তোর সঙ্গে দেখা করলাম, কিন্তু এই প্রথম আর এই শেষ। মার্শা তীব্রস্বরে ফুঁসে উঠেছিল — আর তুই? তুই স্টেটের অনুগত একটা হৃষ্টপুষ্ট শুয়োরে পরিণত হসনি? আজ স্পেস কলোনি তৈরির ব্যাপারে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। কাদের জন্যে? বড়লোকদের জন্যে। আর এই পৃথিবীটার কি হবে? যারা কাতরাতে কাতরাতে মরে যাচ্ছে, যাদের প্রথম বিশ্বে ঢুকতে দেওয়া হয়না, সেই লোকগুলোর কি হবে?
আমি শান্তভাবে কফিতে চুমুক দিয়ে বলেছিলাম — আই অ্যাম নট আ ব্লাডি কমিউনিষ্ট। কর্তৃপক্ষ সবরকম চেষ্টা করছে যাতে রেস, জেন্ডার বা রিলিজিয়নের বেসিসে ডিসক্রিমিনেশন মিনিমাল করা যায়। তোরা যেটা করছিস সেটা পাগলের মত কাজ। তখনই মার্শা হেসে বলেছিল — ও, আমি ভুলেই গেছিলাম। তুই তো এখন লিবারাল হয়েছিস, তাই না?
৫
এই নতুন পৃথিবীর নাম শ্রাবস্তী। এখানে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন। তিনি এই ছেলেটির প্রপিতামহ যে আমার সামনে বসে কিছু একটা লিখছে ঘাড় গুঁজে। ওর পায়ের কাছে মেঝেতে প্রিয় কুকুরটা গোল হয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার খুলিটাকে ও রেখেছে ওর গাঢ় সবুজ শ্বেতপাথরের পড়ার টেবিলটার বাঁদিকে। স্কুলের প্রোজেক্টের পার্ট হিসেবে ওকে আর ওর একজন সহপাঠীকে কোনো গ্রহাণু থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করে আনতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ওরা চুপিচুপি কৌতুহলবশতঃ স্পেসশিপ নিয়ে ঢুকে পড়েছিল সৌরজগতে। পৃথিবী পর্যন্ত যেতে ওদের সাহস হয়নি, কারণ সেটা মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ। এমনকি সৌরজগতে ঢোকাও কঠোরভাবে নিষেধ, ধরা পড়লে জেল হতে পারে; কিন্তু ওরা লুকিয়ে নেমেছিল সেই লালগ্রহটায়। ওরা খুঁজে পেয়েছিল সেই পরিত্যক্ত টেস্ট ফেসিলিটি, যেখানে আমাদের কঙ্কালগুলো মাটির নীচে চাপা পড়েছিল। ছেলেটার মুমূর্ষু প্রপিতামহ আসলে সেই মানুষদের একজন যাঁরা পৃথিবী ছেড়ে চলে এসেছিলেন। ততদিনে পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে; জনসংখ্যার চাপে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গভর্নমেন্ট ভেঙে পড়েছিল, জল আর বাতাস বিষাক্ত হয়ে গেছিলো চিরকালের মত। অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলিতে সরকার হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল রেফিউজিদের রুখতে। নানারকম অদ্ভুত খবর পাওয়া যেত, কেউ বলত অজানা অসুখে কোটি কোটি লোক মারা যাচ্ছে ওসব দেশে, কেউ বলত ওদের মধ্যে কেউ কেউ না খেতে পেয়ে ক্যানিবল হয়ে গেছে। কোনো কোনো সাংবাদিক লুকিয়ে ছবি তুলে আনলেও সেসব কড়াভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এই নোংরা, বাসের অযোগ্য পৃথিবীকে পিছনে ফেলে রেখে সদ্য নির্মিত কলোনিতে চলে আসেন ছেলেটার প্রপিতামহের মত আরো কিছু মানুষ। সৌরজগতের বাইরে নতুন পৃথিবীতে কোনো দুঃখ নেই। সমৃদ্ধি উপচে পড়ছে। ঝকঝকে কাঁচের বিল্ডিং আর স্বয়ংক্রিয় পাবলিক ট্রানজিট দেখতে দেখতে আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম হয়তো এটাই ঠিক হয়েছে। শেষপর্যন্ত কিছু মানুষ তো সুখে রয়েছে। প্রজাতিটাকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে তারা। তবু কোথাও একটা অনুশোচনা অনুভব করার আশঙ্কা হয়তো ছিল। তাই প্রথমেই পৃথিবীর সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। খুব সংক্ষিপ্তভাবে স্কুলে পড়ানো হয় পুরনো পৃথিবীর লোকেদের স্পেস কলোনি তৈরির ইতিহাস, যেখানে একটা ফুটনোটে ছেলেটা খুঁজে পেয়েছিল লালগ্রহে মানুষ-নির্মিত সেই প্রথম এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল আর্কিটেকচারের উল্লেখ। লেখা থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা কী যেন ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিল। ওর পড়ার টেবিলে আমার ডানদিকে একটা ভগবান বুদ্ধের পেতলের মূর্তি রাখা। বুদ্ধের স্বপ্নসম চোখদুটি নতুন পৃথিবীর মানুষদের ভরসা যোগায়। বাইরে ঝিমঝিম করে বৃষ্টি নেমেছে। এই গ্রহে বৃষ্টির রঙ হালকা নীল। দেখতে দেখতে আমার প্রফেসরের কথা মনে পড়ল। বৌদ্ধ দর্শনের ওপর সেই শরতকালে অনেকগুলো পাবলিক লেকচার দিয়ে হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। কেউ কেউ লোকটাকে বলত ফ্যাসিস্ট, কিন্তু আমার মনে হয় প্রচুর প্রচুর মানুষ রাতারাতি লোকটার ভক্ত হয়ে যায় শুধু এই কারণে যে বুদ্ধের দর্শন তাদের একটা পথ দেখিয়েছিল যুদ্ধ ও জরা, মারী ও মৃত্যু-আকীর্ণ পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে নিজেকে রেহাই দিতে। আমিও আকৃষ্ট হয়েছিলাম বুদ্ধের প্রতি। ব্রুকলিনের ফ্ল্যাটে আলো নিভিয়ে অনেক রাত্রে আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রঙবেরঙের আলোয় উজ্জ্বল শহরের স্কাইলাইন দেখতে দেখতে ভাবতাম কেন একজন রাজকুমার প্রাসাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন একরাতে। আমার ভাবনার মাঝে দূর থেকে পুলিশের সাইরেনের শব্দ টেনে আনত হিমেল বাতাস। হঠাৎ আমার মনে পড়ত মার্শার কথা। কে জানে মার্শা এখন কোথায় আছে! সেই ম্যাকডোনাল্ডসে একবার দেখা করার পর আর তো ওর সাথে কথা বলিনি। উপায়ও নেই। মার্শা আমাকে বলেছিল ও কিছুদিনের জন্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে। সরকার ক্রমশ কড়াভাবে নজর রাখছে ওদের দলের কার্যকলাপের ওপর। ওরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শুনেছি ইউরোপেও এরকম কয়েকটা বিপ্লবী দল তৈরী হয়েছে। কী করে সম্ভব সব মানুষকে ভালো রাখা? অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়া? শেষবার যারা এরকম চেষ্টা করেছিল, তাদের চোখের সামনেই কি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েনি তাসের ঘরের মত?
৬
সাইবেরিয়ার বিকেলগুলো আমরা পাঁচজন গল্প করে কাটাতাম। আমাদের সঙ্গে গ্রাউন্ড স্টেশনটার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মি অফিসাররা এসেও যোগ দিত। ওরা থাকত পাশেই একটা বেস ক্যাম্পে। প্রচন্ড শীতল জায়গায় কমব্যাটের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও ওয়েপন আছে ওদের। তাছাড়া রাডারের সজাগ দৃষ্টি গোটা এলাকাটাকে ঘিরে রেখেছে সবসময়। তবুও আচমকা একদিন হামলা হল। গুলির শব্দে সচকিত হয়ে উঠল পুরো উপত্যকা। আমাদের মুহূর্তের মধ্যে বাঙ্কারে ঢুকতে বলা হল। বাইরে তীব্র লড়াই চলছে গেরিলাদের সঙ্গে মিলিটারির। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাপারটা ফুরিয়ে গেল। চারজন গেরিলার প্রত্যেকেই ডেড। পাশাপাশি রাখা চারটে বডির মধ্যে সবচেয়ে ডানদিকে শুয়েছিল মার্শা। চোখ বোজা, মেশিনগানের গুলিতে ওর শরীরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছিল। বরফের ওপর রক্তমাখা লাশেদের সেই দৃশ্যটা আমার মনে পড়েছিল অনেকদিন পরে, যখন বোমায় উড়ে গেছিল আমাদের টেস্ট ফেসিলিটিটা আর আমি মারা যেতে যেতে শুনছিলাম যে কেউ কাতরাতে কাতরাতে চিৎকার করছে, আমাদের পাঁচজনের মধ্যে কোনো একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেদিন ম্যাকডোনাল্ডসে বসে মার্শা আমাকে হঠাৎ বলেছিল — তুই ভাবিস আমি তোকে ঈর্ষা করি তাই না? কারণ ছোটবেলা থেকে তুই সবার বেশি প্রিয় ছিলি আর আমি ছিলাম অবাধ্য মেয়ে! আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চুল পাকাতে পাকাতে অন্যমনস্কভাবে মার্শা নিজের ভেতরে একটা দ্বিধাকে খুঁজে নিতে নিতে যোগ করেছিল — হয়তো করি। বাড়িতে থাকাটা আমার জন্যে যখন অসম্ভব হয়ে উঠছিলো, তুইও তখন চুপ করে ছিলি। বাবার বিরুদ্ধে যেতে, বাড়ি ছাড়তে আমি বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু তোকে এসব কিছুই করতে হয়নি। কিন্তু আমি লড়ে যাব, আমরা লড়ে যাব কারণ তুই দেখিসনি লোকে কিভাবে বেঁচে আছে। পৃথিবীটা নরক হয়ে গেছে তাদের জন্যে আর পালাবার কোনো জায়গাও নেই। এই লোকগুলোকে একটা ফাঁদে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মার্শার মুখচোখে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠেছিল আর গলায় জেদী সুর — আমি শেষপর্যন্ত সকলের বিরুদ্ধে যেতে রাজী আছি, এমনকি তোরও। একদিন হয়তো তোকে মারবার জন্যে আমাকেই পাঠানো হবে — ফ্যাকাশে হেসেছিল। সত্যিই মার্শা অনেককিছু দেখেছিল যা আমি দেখিনি। ওরা গোপনে গেছিল এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে; নীলনদের জল ততদিনে সীসার বিষে অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়েছে, কিলিমাঞ্জারোর বরফ গলে গেছে সম্পূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের অয়েল ফিল্ডগুলো ফোঁপরা হয়ে পড়েছিল। নিউক্লীয় অ্যাশে ধূসর হয়ে গেছিল মিশরীয়, সুমেরীয় কিংবা হরপ্পা সভ্যতার আকাশ। অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছিল মাঝখানে আর বোমারু বিমান ও সাইরেনের আওয়াজে কেঁপে উঠেছিল বারবার পুরনো পৃথিবীর উদ্বাস্তু শহরগুলো। কিন্তু আমি জানতাম শেষঅব্দি মার্শা হেরে যাবে; মার্শার মতো সকলেই হেরে গেছিল। একদিন হঠাৎ খবরে পড়েছিলাম প্রফেসর আত্মহত্যা করেছে, পুলিশ তার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ভেঙে ঢুকে মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল। হালকা হাওয়ায় জানলার পর্দাগুলো উড়ছিল। আমি দেখছিলাম শ্রাবস্তীর আকাশে দুটো চাঁদ। এলোমেলো জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে জানলার বাইরের সমস্ত জায়গা। জানলা দিয়ে আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে বিছানার ওপর। রাতচরা পাখিরা কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে কোনদিকে চলে গেল। ছেলেটা পাশ ফিরে শুলো। পেতলের বুদ্ধমূর্তিটা চকচক করছে আধো-অন্ধকারের ভেতর। ছেলেটা ফের চিত হলো। ঠোঁট নড়ছে, কি যেন বিড়বিড় করছে। কপালে সামান্য ঘাম। বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখছে। আমি জানি ও এখন চলে গেছে সেই পুরনো পৃথিবীতে, ঘুরে বেড়াচ্ছে সেইসব ফুটপাতে যেখানে হাজার হাজার মানুষ ডেকচিতে শাকপাতা ফোটাতে ফোটাতে মরে গেছে না খেতে পেয়ে, পরখ করছে সেইসব পেটফোলা রুগ্ন শিশু আর অন্ধ বেড়ালদের, বোমার আঘাতে যাদের রগে বা কোমরে গেঁথে গেছে সজোরে স্প্লিন্টার, উড়ছে সেইসব সমুদ্রের ওপর দিয়ে যেখানে জলের ওপর ভেসে উঠেছে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রাণীদের লক্ষ লক্ষ গলাপচা শবদেহ। ঘুম ভেঙে অন্ধকারে বিছানায় একা চুপ করে বসে রইল ছেলেটা। একটা ব্যাখ্যাতীত বোধের ভেতর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে নড়ে উঠল। সামান্য মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে কিছুটা জ্যোৎস্না। একটু আগে শ্রাবস্তীতে মারা গেছেন বৃদ্ধ প্রপিতামহ।