আসল পুলিশ না নকল পুলিশ কারা হত্যাকারী তাতে কিস্যু যায় আসে না, আনিস খানের মৃত্যু এটা প্রমাণ করে দিলো যে এই পশ্চিমবাংলাতেও রাষ্ট্রের হাত প্রতিবাদকারীদের রক্তে রঞ্জিত। আঠাশ বছরের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও সমাজকর্মীর মৃত্যু একটি পরিকল্পিত হত্যা। এখন পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রী-সান্ত্রী সবাই এটাকে ধামা চাপা দেওয়ার জন্য নেমে পড়েছে। পুলিশ বলছে এটা অস্বাভাবিক মৃত্যু, অর্থাৎ খুন নয়। অস্বাভাবিক মৃত্যু অনেক কিছুই হতে পারে- আত্মহত্যা হতে পারে, অসাবধানতা বশত পড়ে গিয়ে থাকতে পারে, মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে গিয়েও পড়ে যেতে পারে। শেষের সম্ভাবনাটা এই লেখকের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। ইতিমধ্যেই পুলিশ বলছে তাঁর পাকস্থলীতে অ্যালকোহলের গন্ধ পাওয়া গেছে। গল্প বানানো শুরু হয়ে গেছে।
প্রতিটি পদে পদে পরিষ্কার যে পুলিশ প্রথম থেকেই ঘটনা সম্পর্কে নিঃস্পৃহ ছিল। তাঁর বাবা সালেম খান থানায় ফোন করেন রাত তিনটেয়। পুলিশ এতোটাই অসংবেদনশীল যে তারা সদ্য পুত্রহারা পিতাকে বলে যে তিনি তো আনিসকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি তাহলে কী ভাবে প্রমাণিত হল তিনি মৃত? তারা বলে এক ঘণ্টা বাদে তারা সালেমকে ফোন করবে। ফোন না আসায় সালেম সকাল পাঁচটা নাগাদ আবার ফোন করেন। পুলিশ দেরি হওয়ার জন্য নানা অজুহাত দেখায়। অনেক গড়িমসি করার পর পুলিশ এসে পৌছায় সকাল ন’টায়, ঘটনার প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পরে। সালেম তাদের ঘটনার কী বর্ণনা দিয়েছেন তা ইতিমধ্যেই বহুল প্রচারিত। পুলিশ তাঁর পরিবার বা পাড়াপড়শিদের প্রায় কোনও জিজ্ঞাসাবাদই করেনি। তারা আনিসের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেনি। তারা যে স্থানে আনিসের শরীর আছড়ে পড়েছিল সেটাকে সংরক্ষিত করেনি। তারা মৃতদেহ নিয়ে চলে যায় এবং সালেম ও অন্যান্যদের ময়না-তদন্তের জন্য থানায় যেতে নির্দেশ দেয়। থানায় তাঁরা পৌছিয়ে দেখেন পুলিশ আনিসের পরিবারের জন্য অপেক্ষা না করে মৃতদেহ নিয়ে উলুবেড়িয়া হাসপাতালে চলে গেছে। এতো কী তাড়া ছিল যে পুলিশ তড়িঘড়ি করে নিজেরাই ময়না-তদন্ত করতে চলে গেল? পরিবারের অনুপস্থিতিতে করা এই তদন্ত যে সঠিক ভাবে হবে এর কি নিশ্চয়তা আছে? আনিসের পিতা যথার্থই বলেছেন যে পুলিশ ‘আসল’ ‘নকল’ এর তত্ত্ব আওরাচ্ছে তাদের ময়না-তদন্ত রিপোর্টের ওপর তাঁরা ভরসা রাখতে পারছেন না। প্রায় দেড় দিন কেটে যায়, পুলিশের তদন্ত করতে আসার সময় হয়, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও আসে। পুরো সময়টা যে স্থানে মৃতদেহ পড়েছিল সেটা অরক্ষিত থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে ফরেনসিক পরীক্ষার একটা ‘গোল্ডেন আওয়ার’ থাকে, এতো দেরি করার জন্য সেটা লঙ্ঘিত হয়েছে, ঘটনাস্থল অরক্ষিত রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সূত্র লোপাট হয়ে গেছে। পুলিশ আততায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য সালেমকে দিয়ে কোনও স্কেচ আঁকায়নি। কেন পুলিশ টি আই প্যারেডের ব্যবস্থা করে শুক্রবার রাতের আগন্তুকদের শনাক্তকরণের চেষ্টা করল না সেটাও এক রহস্য। এরপর শুরু হয় ছেলেটির চরিত্র হনন। তাঁর বিরুদ্ধে নাকি বাগনান থানায় পকসো আইনে মামলা আছে, অর্থাৎ আনিস কোনও শিশুকে যৌন নিগ্রহ করেছেন। এই মামলার জন্য আদালতের সমনও আছে। শোনা যাচ্ছে মামলাটি ২০১৮ সালের, তা এতো দিন কি পুলিশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমচ্ছিল? এছাড়া আমতা থানতেও নাকি তাঁর কয়েকটি মামলা আছে! অর্থাৎ পাক্কা ক্রিমিনাল!
ঘটনাটি তুমুল আলোড়ন ফেলার পর শাসক দলের কারবারিরা মাঠে নেমে পড়লেন। তাঁদের মধ্যে দু’চারজন অপরাধ জগত সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে একজন বললেন খাকি উর্দি পরে তারাই খুন করে যারা শাসক দল ও পুলিসকে ভিলেন বানিয়ে নিজেরা আড়ালে থাকতে চায়। পরিকল্পিত ছদ্মবেশ, বাইরের শত্রু, অতি পরিচিত বহিরাগত তত্ত্ব! চক্রান্ত! মাননীয় মেয়র আবার সতর্ক করছেন বিক্ষোভ করে কিছু হবে না, বিক্ষোভ করা সময় নষ্ট। উনি ভুলে যাচ্ছেন ওনার নেত্রী এরকম বিক্ষোভ আন্দোলন করেই বাংলার মসনদ দখল করেছিলেন।
মৃত শহীদ দখলদারিতে এই সব দল সিদ্ধহস্ত। শনিবার সকালে শাসক দলের আঞ্চলিক নেতারা আনিসের বাড়িতে লাইন লাগিয়েছিল, কারণ এতো আমাদেরই ছেলে। তারপর স্থানীয় মানুষ এমন তাড়া লাগিয়েছে যে এখন এলাকা শুনশান, এক পিস তৃনমূলও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আড়াই দিন বাদে জানিয়ে দিলেন, ওঁর সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল, অর্থাৎ জনপ্রিয় এই যুব নেতা শাসক ঘনিষ্ঠ। আনিসের ফেসবুক ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে ৯ই ফেব্রুয়ারি উনি একটা পোস্ট করেছেন যেখানে উনি বিস্ময় প্রকাশ করছেন যে সারা দেশ জুড়ে যখন হিজাব নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তখন বিখ্যাত অমুসলিম হিজাবি এই প্রসঙ্গে নীরব কেন? ২২শে জানুয়ারির একটি পোস্টে তিনি ভাঙ্গরে বিমানবন্দরের বিরোধিতা করছেন, লিখছেন জীবন বাজি রেখেও এটাকে রোখা হবে। তার আগের দিন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্লস হোস্টেলের ছাত্রীদের পক্ষ নিয়ে জল, লিফট ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ভিসি সহ শাসকদের ঘাড় ধরে রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। ১৯ জানুয়ারির পোস্টে দেউচা পাঁচামির আদিবাসীদের লড়াইকে সমর্থন করছেন, লিখছেন ভূমি সন্তানদের কথা মেনে নাও নাহলে “যে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলে ঠিক সেই সিঁড়ি সমেত ধ্বসে যাবে”। ৮ই জানুয়ারি লিখছেন “বাংলার বিপ্লবীদের নতুন পথ দেখাবে দেউচা”। এরপরেও মন্ত্রী সান্ত্রীরা যদি বলেন তিনি তৃণমূলের লোক, তাহলে বলতে হয় কত্তা ঘুরায় হাসব। মতাদর্শ গত ভাবে আনিস ছিলেন সিপিয়েমি বাম আবার একই সঙ্গে নকশালি বাম। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করার জন্য লাল সেলাম জানাচ্ছেন আবার নরেন্দ্রপুরের ঘটনায় আইসা ছাত্র ইউনিয়নের সাতজন জামিন পাওয়ার পর লিখছেন, “সবাইকে লাল সেলাম। লড়াই জারি থাকবে”। তিনি ছিলেন সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের উজ্জ্বল মুখ। ওড়িশার ধিনকিয়াতে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধেও ছিলেন সরব।
তিনি আইএসএফের সদস্য ছিলেন, কিন্তু তাঁর ফেসবুকে অন্তত গত দু’মাসে এই সংগঠন নিয়ে কোনও পোস্ট নজরে আসেনা। তৃণমূল তাঁর ওপর খেপা ছিল কারণ তাঁর জন্য নাকি সারদা গ্রাম থেকে তাদের দল কম ভোট পেয়েছে। তাঁর সামাজিক কাজকর্মের জন্য নানা ঘুঘুর বাসায় নাড়া পড়ে গেছিল। স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণের ওপরে উলুবেড়িয়ায় একটি আলোচনা সভা করেছিলেন যেটির যৌথ উদ্যোক্তা ছিল ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অধিকার মঞ্চ’ ও এপিডিআর। রুগীদের থেকে অতিরিক্ত পয়সা নেওয়া জন্য অঞ্চলের নার্সিং হোমগুলির বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছিলেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁকা জমিতে পিপিপি মডেলে হেলথ কেয়ার ম্যানেজমেন্ট স্থাপিত করার একটি প্রস্তাব হাওয়ায় ভাসছিল। আনিস এই ব্যাপারেও সরব হতে শুরু করেছিলেন। গত ২৪শে মে আমতা থানার ওসিকে লেখা তাঁর চিঠি তো ভাইরাল হয়ে গেছে। নিছক একটা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প তাঁকে করতে দেওয়া হয়নি। পঞ্চায়েত ও শাসক দলের কেষ্টবিষ্টুরা হুমকি দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। তাঁর বাড়ি চড়াও হয়েছে, পরিবারের লোকজনদের নিগৃহীত করেছে, গোয়াল ও রান্নাঘর ভাঙচুর করেছে। পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু আনিস তো চুপ করে বসে থাকার ছেলে নয়। তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে স্বার্থান্বেষী মহল আশঙ্কিত হয়ে পড়ে, অতএব…
মাননীয় মেয়র বলেছেন এই ধরণের ঘটনা ইউপিতে হয়, বাংলায় হয় না! আমরাও তো তাই জানতাম। যেটা উনি বুঝতে পারছেন না সেটা হল তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের শাসক দল এবং পুলিশ-প্রশাসন সপ্তম স্বর্গে পৌঁছে গেছে, এতোটাই যে এখানে কোনও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করা এখন যোগী রাজ্যের মতোই বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। পরপর দমন পীড়নের ঘটনা ঘটে চলেছে। এপিডিআরকে তাদের রাজ্য সম্মেলন করতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে তারা যখনই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে, অতিমারির অজুহাত তুলে তা দমন করা হয়েছে। গত আগস্ট মাসে সোনারপুর থানায় বেনিয়াবাউ গ্রামে পুলিশ কনস্টেবল সুরাফ হোসেনের ওপর কী অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল সেটা স্মরণ করুন। সোনারপুর থানার এস আই সোমনাথ দাস সাদা পোশাকে হাওয়াই চপ্পল পরে সুরাফের ৮৫ বছরের কাকা হোসেন আলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসে। সুরাফের দোষ তিনি প্রশ্ন করেছিলেন অফিসার কেন সাদা পোশাকে ডিউটিতে এসেছেন। তাঁকে বেধড়ক মারধোর করা হয় যার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। সুরাফের ভাই, পড়শিরা যাঁরা তাঁকে বাঁচাতে আসেন তাদেরকেও মারধোর করা হয়। মাল্টিপল ফ্র্যাকচারের কারণে সুরাফ এখনো পুরো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী তানিয়া অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, এস আই প্রিয়া সেন তাঁর ওপর এতো নির্মম ভাবে চড়াও হন যে তাঁর গর্ভস্রাব হয়। এছাড়া তাঁদের ওপর ক্রমাগত মুসলিম-বিদ্বেষী গালি বর্ষিত হয়।
নরেন্দ্রপুর থানায় এই মাসেই যে ঘটনা হয়ে গেছে তা তো আরও নৃশংস। সেখানে পুলিশের লক আপে ছাত্রীদের ওপর যে ধরণের অত্যাচার করা হয়েছে তা সত্তরের দশকে অর্চনা গুহর ওপর অভূতপূর্ব টর্চারকে স্মরণ করায়। তাঁদের বুক যৌনাঙ্গ নিশানা করে পেটান হয়েছে। এক ছাত্রী ইউটিআইয়ের সমস্যা আছে জানানোর পরে তাঁর ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাক্ষণ পুলিশ অর্ধনগ্ন পোশাক পরে মেয়েদের সামনে ঘুরে বেড়িয়েছে, যৌন ইঙ্গিত পূর্ণ মন্তব্য করেছে। সকালবেলায় থানার মধ্যে গীতা ও হনুমান চালিশার পাঠ দেখে বন্দীরা স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। দুটি ঘটনারই তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কিন্তু কে না জানে এসব আশ্বাস ঘটনা চাপা দেওয়ারই প্রয়াস। আরও হাস্যকর নরেন্দ্রপুর থানার একজন অফিসার যিনি ছাত্রীদের নিগৃহীত করায় সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন, তাকেই সুরাফ হোসেনের ঘটনার তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে! এছাড়া আমরা জানি দেউচা পাঁচামি প্রকল্পের যাঁরাই বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ওপর তৃণমূলের বাহিনী ও পুলিশ একত্রে চড়াও হয়েছে। একটি রেসর্টে ঢুকে প্রতিবাদকারীদের লাঠিপেটা করা হয়েছে। ২০ তারিখে সেখানকার একটি সভা থেকে ফেরার পথে নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ২৪ তারিখ অবধি পুলিশ ও জেল হেফাজতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আনিসের বাবা বলেছেন তাঁর ছেলেকে তৃণমূলের এক নেতা সাজান পকসো মামলায় ফাঁসিয়েছে। পুলিশের ওপর তাঁর কোনও আস্থা নেই, তিনি তাদের আনিসের ফোন দিতে অস্বীকার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে নবান্নে ডেকে পাঠিয়েছেন, তিনি যেতে অস্বীকার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন দেউচা বাংলার মুখ, আমরা বলছি আনিস বাংলার প্রতিবাদের মুখ। যে আগুন জ্বালান হয়েছে তা সহজে নেভান যাবে না। আনিসের ঘটনার তদন্তের জন্য সিট গঠন করা হয়েছে যার নেতৃত্বে আছেন এমন একজন অফিসার পনেরো বছর আগে রিজওয়ানুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুতে যাঁর ন্যক্কারজনক ভূমিকা এখনো মানুষের স্মরণে আছে। এগারো বছর আগে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম হয়ে এই রিজওয়ানুরের ঘটনার কারণে একটি দলের পতন হয়েছিল যারা এখন বাংলার মাটিতে খেই খুঁজে পাচ্ছে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আকছার ঘটে। নিজেদের না শুধরলে এই শাসকদেরও আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে বাংলার মানুষ কোনও দ্বিধা করবে না।