তিস্তাপারে নয়, বাঘারুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সুন্দরবনের উত্তাল রায়মঙ্গল নদীতে, কুমিরমারি যাওয়ার নৌকায়।
ধামাখালি থেকে একের পর এক নদী পেরিয়ে নদীর ঘাটে এসে বোট লাগাতে ঘন্টা তিন। সোদরবনের সেই লম্বা জলসফরে দেখা – বলিষ্ঠ, খালি গা, মেঘকালো বাঘারুর সঙ্গে। বাবাকে বাঘে নিয়েছিল। সেই থেকে বাঘের ওপর ভারি আক্রোশ বাঘারুর। “সামনে পেলি পিটাই মারি ফালাব।” বলেই বোটের স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ত্রস্ত চোখে সামনের যাত্রীদের দিকে তাকাল। ফরেস্টের কোনো বাবু, কোনো চেনা মানুষ শুনে ফেলল না তো!
ভাল নাম পরিতোষ বাইন। ওই নামে কেউ চিনবে না। সবাই চেনে বাঘের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া বাঘারুকে। আম্পান চলে গিয়ে তখন ইয়াসে বানভাসি সুন্দরবন। আমরা যাচ্ছি মেডিকেল ক্যাম্প করতে কুমিরমারি। আম্পানে উড়ে যাওয়া ঘর ঠিক করতে না করতেই কয়েকমাস বাদে কোটাল আর ইয়াসের ধাক্কা। বাঘারুর পিয়ারাফুলির টালির ঘরে তখন ঘোলা জল। কোমরসমান।
- এত রাগ কেন বাঘের ওপর?
- আপনেরা কলকেতার লুক, ছবির বাঘরে দেখতি আসেন। আসল বাঘ ওইন্য।
বাঘারু গম্ভীর।
কেঁপে উঠলাম। কী বলছে মাধ্যমিক বিদ্যার বাঘারু!
- আসল বাঘ কেমন?
- বারবার আসেন সোদরবন, খুলা রাখেন চোখ-কান, বুঝি যাবেন। জনাব রয়্যাল ব্যঙ্গলরে চেনতে সময় লাগে।
জঙ্গলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে খাঁড়িতে চোখ রাখছে বাঘারু।
বাঘারুর বউ, বাচ্চা এখন দোতলা ইস্কুলবাড়ির ক্যাম্পে। ঘাটের দরমার ঘরে রাত কাটায় বাঘারু, খায় – যা পায় তা-ই। ভ্যানরিক্সা চালাত আগে। মালিকের খিদে দিনদিন বাড়ছিল। রেগে একদিনে ভ্যান চালানো ছেড়ে ধামাখালির সোহম মোল্লার ভটভটি চালাচ্ছে এখন। লম্বা ট্রিপ হলে দুশ’। ছোট হলে এক-দেড়শ’। মোল্লার কাজটা করত নাজিবুল। ইয়াসে গোসাবার চিকনখালি গ্রামে বাড়ির হাল দেখতে গেছে নাজিব। ফিরলেই বাঘারুর ছুটি।
- ছেড়ে দিলে কেন আগের কাজটা?
- খিদা।
- কীসের খিদে?
- খিদার কুনো কুল নাই। বাঘের খিদা মিটে। মালিকের খিদা মিটবো না কুনোদিন! অস্ফুটে বলে বাঘারু।
- কোন মালিক?
- ছুটো মালিক, মেজো মালিক, বড় মালিক, মালিকের মালিক... দ্যাশ জুইড়ে, দরিয়া জুইড়ে শুধু মালিক আর মালিক!
চমকে উঠলাম। কী বলছে বাঘারু!
- রাজাও মালিক, গজাও মালিক! জলে মালিক, ডাঙ্গায় মালিক! কুথায় পালাইবেন! হো হো করে হাসছে বাঘারু।
- ওরে, ওই বাঘরু, পাগল কাহাকার, ঘাট আসি গ্যাছে, হ্যান্ডেল ঘুরা। বোটের উল্টোদিক থেকে চিৎকার করছে বোটের আর এক কর্মী।
কুমিরমারিতে নামতেই সঙ্গী অরুণদা।
- কী এত কথা হচ্ছিল ছেলেটার সঙ্গে?
- বাঘারুকে কাল্টিভেট করতে হবে দাদা।
-ওর নামটা ভুলবেন না। যত মিশবেন, তত চিনবেন সুন্দরবনকে। পা চালান, মেডিকেল ক্যাম্পে অনেক রোগী অপেক্ষা করছে।
- সমস্যাটা কী বাঘারু?
- সমইস্যা কাগজ, সমইস্যা পেলাস্টিক।
- কাগজ মানে? টাকা?
- ছিলভার টনিক! ওই দ্যাখেন। মাটির সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় ভেড়ির দিকে আঙুল তুলল বাঘারু।
- ওটা তো একটা ভেড়ি।
- একখান না, দুইখান। মইধ্যে বিশাল নালা আছিল। মালিক জমি গিলি নেছে। নালা নাই। অখন নালাও ভেড়ি।
- মালিক কে?
- মালিক আকবর। ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বলল বাঘারু।
- আকবরটা কে?
- ছুটো রাজা! আর কইতে পারি না। এহানে জলেও শুনতি পায়। জাইনতে পারলে খুপরিতে দানা পুইরে দিবে বাদশা।
-এমন কত নিকাশি নালা গায়েব হয়ে গেছে বাঘারু? জানতে চাইলাম গলা নামিয়ে।
- দুই-চাইরখান অখনও আছে। বাকি সব হাওয়া। কোটালের জল, বানের জল, বিষ্টির জল – একবার জইমলে নামবো ক্যামনে! ধূসর চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বাঘারু।
- সরকারি অফিসার কিছু বলে না?
- বইলবো ক্যান! বাদশার টনিক, ভেড়ির মাছ! ইয়া বড় ঘিয়ে ভরা কাঁকড়া পাইলে আপনে বইলতেন? চোখ জ্বলছে বহেরুর। অস্বস্তি হচ্ছে আমার।
- কাগজ তাহলে কথা বলে! আর প্লাস্টিক?
- পেলাসটিক বড় নালার নাকমুখ ‘ছিল’ করি দেয়। জমা নুনা জল আমগো চক্ষের পানি! কী বোঝলেন!
মনে পড়ে যায়, রবি একদিন বলেছিল গল্পটা। বড় নিকাশি নালা গায়েব, যেটুকু বেঁচে, পরিষ্কার হয় না। একবার জনপদের, এমনকি স্কুলের মাঠের জল কিছুতেই নামে না। পাবলিকের হল্লায় নালা পরিষ্কার করতে লোক লাগাল পঞ্চায়েত। একদিনের কাজ শেষ হয় তিনদিনে। নালা সিল হয়ে ছিল কোটি কোটি প্লাস্টিকের চিকচিকি, ব্যাগ, মোড়ক, গ্লাস আর থার্মোকলের ট্যুরিস্ট বাটি-থালায়।
আটাত্তর, দু’ হাজার, আয়লা, আম্পান, ইয়াস। একের পর এক বন্যা। সন্দেশখালির নালার হাজার মেগাটন প্লাস্টিক তুলে নিয়ে যেতে লরি লেগেছিল গোটা কুড়ি।
-বানে বানে প্লাস্টিক নোনাজল আটকে দিয়ে বন্ধ্যা করেছে কতশত একর উর্বর জমিকে। ঠিক বললাম বাঘারু।
- হুধু ধান কেন, কুটি কুটি মাছ মারে নুন! পেলাস্টিক শক্তিমান। পেলাস্টিক ভগমান।
- ভগবান না, ভগবানের শত্রু বল।
- ভূত-ভগমান, শত্রু-বন্ধু, দুর্বল-সবল অখন সব গুলায়ে যায় বাবু। খেমতা ফেলাড ক্যাম্পে খিচুড়ি খাওয়ায়, খেমতাই নীচু মাথা উচাইলে চাবকাইয়া মাটিতে ফালাইয়া দেয়।
বাঘারু দার্শনিক যখন-তখন।
- প্লাস্টিককে ভগবান বলছিলে না! প্লাস্টিক আসলে হিন্দুদের ‘আত্মা’ – অজর, অমর, অক্ষয়।
- নাশ নাই, ত্রাস নাই, জন্মায় খালি, মরে না পেলাস্টিক।
- সুন্দরবনে যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় প্লাস্টিক...
- বন্ধ কইরবে! হো হো...
অট্টহাসি হাসছে বাঘারু।
- হাসছো কেন? আইন করে সব হয়।
- আর হাসাইবেন না বাবু! আইন! আইন মালিকের দারোগা! পেলাসটিকের মালিক কে কন তো?
- আবার মালিক!
- মালিক দুকানদার, তার মালিক ছাপলায়ার, তার মালিক কারখানা, তার মালিক কে কন।
- রাঘব বোয়াল।
- এইবার ঠিক হইছে। বড় মালিক তুয়াজ করে খেমতারে। খেমতা মাপে, মালিকের চাকায় পাম্প দেয়। মাল বানায় ছমিক, তার মালিক ম্যাঞ্জার, তার মালিক বাবু, তার উপরে বড় মালিক। খেমতা বড় মালিকের বাপ। মালিকে মালিকে, খেমতায় খেমতায় দুনিয়া জুইড়া দইচিড়া! খইদই!
বাঘারুর গলায় তেজ ।
-তুমি এত জানলে কী করে বাঘারু?
- কামকাজ না থাইকলে মাথায় গিজগিজ করে পুকা। বইসা বইসা ভাবি। লুকে পাগল কয়।
বাঘারুর সঙ্গে আবার দেখা হল পুজোর আগে। এমএলএ এসেছেন বিদ্যাধরী নদীর নতুন বাঁধের উদ্বোধন করতে। আগেরদিন বৃষ্টি হয়ে গেছে। দুটো ভেড়ির মাঝের সরু রাস্তা কাদা-জলে মাখামাখি। এমএলএ-র পেছনে অনেকে, ভিড়ের মধ্যে হাফপ্যান্ট খালি–গা বাঘারু।
দাঁড়িয়ে গেছেন এমএলএ সাহেব। এই রাস্তায় হাঁটতে গেলে পিঠ চাই।
- তোল, বাঘারু তোল, স্যাররে পিঠে তোল। পেছন থেকে বলে উঠছে প্রধান বাদশা।
বসে পড়ছে বাঘারু। ধবধবে ধুতি হাঁটুর নীচে তুলে, ঘিয়ে পাঞ্জাবি বেঁটেখাটো চওড়া এমএলএ একলাফে চড়ে পড়লেন বাঘারুর বলিষ্ঠ কাঁধে। উঠে দাঁড়াচ্ছে বাঘারু। দৌড়ে সামনে গিয়ে দু’পাশে দু’পা ঝুলিয়ে বাঘারুর কাঁধে চড়া এমএলএ সাহেবের ছবি তুলছেন প্রধান। পেছন থেকে দৌড়ে প্রধানের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন বিডিও সাহেব।
- পথ ছাড়েন, আমারে স্যারের সঙ্গে যেতি হবে। নতুন বান্ধ উই অনেকটা দূর। বাঘারু স্যাররে ফালায়ে দিলে আপনে বাঁচাবেন? আমারেই ধরতি হবে। বাদশার গলায় আঁচ।
- প্রোটোকল, সরকারি অফিসার মন্ত্রীর সঙ্গে যাবে। মিনিমিন করছেন বিডিও।
- কী বুঝলি বাঘারু? বাঘারুর গলা জড়িয়ে বলছেন মন্ত্রী।
- মুখ্যু মানুষ, কিছুই বোঝলাম না।
- বুঝলি না! অফিসার ন্যাতা হইতে চায়, ন্যাতায় অফিসার! দেখিস ফেলে দিস না যেন।
- আপনে ভগমান ছার। ফালায় কার সাইধ্য।
দূর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রী-বাঘারুর সংলাপ।
- নামাবি না? বলিস কী!
- ঠিকই কই ছার। বাঘারু পিঠে তুলে, নামায় না।
তিস্তার নীল জল মিশে যাচ্ছে বিদ্যাধরীর ঘোলা জলে। মন্ত্রী বাঘারুর পিঠে চড়ে এগোচ্ছেন নদীর দিকে। জঙ্গলের দিকে।
দূরে নদীর পাড়ে জঙ্গলে আবছা, ছায়াছায়া এক চতুস্পদ। ডোরাকাটা।