যতোটা পারি ডাক্তারখানা এড়িয়ে চলি। না পারলে, প্রথম অপসন অবশ্য করেই বিজয়গড় স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। দুই টাকা দিয়ে নাম রেজিস্ট্রেশন করে মেডিক্যাল চেক আপ। চেক আপ শেষে বিনে পয়সার ওষুধ। লাইন দিয়ে নিতে হয়। নিইও। তাইতেই এখনো অব্দি সেরে উঠেছি। বাড়ির বাকিরাও সরকারি হাসপাতালে লাইন দেন। জটিলতা থাকলে যাই ট্রপিক্যাল, পিজি, মেডিক্যাল কলেজ।***
বেসরকারি ব্যবস্থায় খুব একটা ভরসা নেই। - আস্ত মানুষটাকে দেখতে যদি না পান সেই ভয়ে। শরীরটা যে একটা সংসারের - সেটা দেখা বা বোঝার দায় আর কয় জনেরই বা থাকে। তাই দ্যাখার মধ্যে কেবল কিডনি, হার্ট, লাঙ্গস, চোখ, হাঁটুর মতো টুকরো টুকরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কেবল দেখতে পাওয়া যায়। দোষ অবশ্য ডাক্তার বাবুদের নয়। দোষটা সময়ের - স্পেশালাইজেশনের। রোগের সাথে শরীরের, শরীরের সাথে পরিবারের, পরিবারের সাথে দেশ কাল সমাজের এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার যে একটা সম্পর্ক আছে, স্পেশালাইজেশনের চক্করে সেইটেই ভুলিয়ে ছেড়েছে।
***
দুই একজন আত্মীয় এবং একজন ছাত্রের চিকিৎসা বেসরকারি ব্যবস্থায় করতে যাওয়ার সুবাদে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি - তা কহতব্য নয়। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার অভিজ্ঞতা এখানে বলা যেতেই পারে: ফুসফুস বিকল। তাই পড়িমড়ি করে ঘটি বাটি বন্ধক দিয়ে স্বামীকে নিয়ে দক্ষিণের এক বড় হাসপাতালে ছুটলেন এক পরিচিতা। আটদিনের মাথায় প্রায় আঠাশ লাখ ব্যয় হয়ে যাওয়ার পর যখন সেই বিখ্যাত হাসপাতাল পরবর্তী দিনগুলোতে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সুইচ অন রাখার জন্য আরো পঁচিশ লাখের মতো টাকা চান তখন পরিচিতা উপায় না দেখে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেন। বিদেশ বিভুঁয়ে। একক সিদ্ধান্তে। এখন তাঁর আত্মীয় স্বজন সেই ভদ্রমহিলা কি করে সম্মতিপত্রে সই দিতে পারলেন, কেন তাঁর হাত কাঁপলো না - এই নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। অথচ লাইফ সাপোর্টের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য কর্মী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য দফতর এবং আরো অন্যান্য অনেকে যাঁরা পণ্যের-মতো-স্বাস্থ্যের পরিষেবায় নিয়োজিত - তাঁদের দায় কেউই দেখছেন না। এটাও কারুর দোষ নয়। দোষটা সময়ের।
***
দ্বিতীয়টি, সাম্প্রতিক ঘটনা। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। চোখের কিছু অসুবিধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বিজয়গড় স্টেট জেনারেল হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে। ডাক্তারবাবু চোখের ওষুধ লিখে দিয়েছেন। পেয়েও গেছি কাউন্টার থেকে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। তারপর পাওয়ার চেকিংয়ের পালা। আমার সামনে একজন। তিনি বিজয়গড়, পল্লিশ্রী, রাণীকুঠি অঞ্চলে রিক্সা চালান। চোখের পাওয়ার বেড়েছে শুনে চিন্তায় পড়লেন। নতুন চশমা বানাতে হবে। পুজোয় বাড়ি যাওয়াও আছে। বাড়ি সুন্দরবনের দিকে কোনো এক জায়গায়। পাওয়ার চেকিংয়ের দিদিমনি বললেন, “মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যান। চশমা তৈরি হয়ে এলে ফোন যাবে। চশমাটা এসে নিয়ে যাবেন।” কতো লাগবে জিজ্ঞেস করতে বললেন “ফ্রী”। তবে যা ফ্রেম জুটবে সেটাই নিতে হবে। তাড়াহুড়ো থাকলে বাইরে থেকে খরচ করে পছন্দ মতো চশমাও বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ভদ্রলোকের চোখেমুখে অনাবিল প্রশান্তি।
***
ডাক্তারবাবুদের ন্যায্য দাবিগুলো সরকারি স্বীকৃতি পাক। পাশাপাশি, সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকেও নজর দেওয়া হোক। অনলাইন রেফারেল সিস্টেম কাজ করবে কিনা জানি না। শূন্য সীটের সংখ্যা আর অনলাইন পরিষেবাতো এবারের সেন্ট্রালাইজড এডমিশান পোর্টাল বানিয়ে ধুমধাম করে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পুরো বিষয়টাই মুখ থুবড়ে পড়তে সময় লাগে নি বেশি। দোষটা অবশ্য কারুর নয়। দোষটা সময়ের।
***
এখন খালি ভয় হয় সরকারীটা উঠে গেলে যাবো কোথায়? সুস্থ তো ততক্ষণই - যতক্ষণ আস্থাশীল। শ্রদ্ধাশীল। বহু ডাক্তারবাবুর দক্ষতা আসলে সরকারি ব্যবস্থায় আস্থাশীল অসংখ্য মানুষের অসহায় রোগগ্রস্ত শরীর আর সংসার সাপেক্ষ একটা বিষয়। কারণ কেবল বই মুখস্থ করে ডাক্তার হওয়া যায় না। শরীর ঘাঁটতে হয়। মন ঘাঁটতে হয়।
আস্থা, শ্রদ্ধা, নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোকে যতোটা সমগ্রের সাপেক্ষে ভাবা যায় - ততই মঙ্গল। পক্ষ-ভাবনা জুড়ে বসলেই গণ্ডগোল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।