১
ছোটবেলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাসে প্রথমবার কামঠ-এর কথা পড়ি। সে এক অদ্ভুত জিনিস। সুন্দরবনের সরু খাঁড়ির ঘোলাটে জল। জলের তলায় চরে বেড়াচ্ছে কামঠেরা। জলে হাত দিয়ে পোজ্ দিয়ে ছবি তোলার জো নেই। কাদা শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে যাওয়া পা যে ধুয়ে নেব - সর্বনাশ! একজোড়া ধারাল দাঁত দিয়ে কুচ্ করে জলের তলায় হয়ে যাবে অপারেশন। সে এমনি শিল্পী সার্জেন, হাত-পা জল থেকে না তোলা অবধি নাকি বোঝাই দায়, যে আদৌ কিচ্ছু হয়েছে কিনা। হুঁ হুঁ বাবা, সোঁদরবনের কামঠ।
মকর সংক্রান্তির রাত। সেই কামঠ-মার্কা ঠান্ডাটা আজ হঠাৎ করে অনেকটা কমেছে। সস্তার উলের গ্লাভসের ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকে আজ অতটাও জ্বালাচ্ছে না। তবে আরতি শেষ হতেই কেউ যেন রাজঘাটের মালব্য ব্রিজের ওপর থেকে বালতি করে কুয়াশা ঢেলে দিল নদীর ওপর। সাদায় ঢেকে যাচ্ছে কালো জল। পায়ের তলা থেকে নেমে যাওয়া বেলেপাথরের সিঁড়ির শেষে বাঁধা নৌকাগুলো ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।
তিনজন লোক একটা নৌকার খোলে আগুন জ্বেলেছে। হলদে আগুনের মিহি আলোয় দেখা যাচ্ছে - নদীর ওপর পিছলে যাচ্ছে কুয়াশা। চারদিকে একটা হলদেটে ভাব। ঘাটের ল্যাম্প-পোস্টের হলুদ আলোয় মিশে যাচ্ছে আগুনের আভা, দু'জনে মিলে বাঁচিয়ে রাখছে আমাদের সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া থেকে।
সাতটা নাগাদ যে চৌকি গুলোয় চড়ে পুরোহিতেরা আরতি করেন, আটটা নাগাদ তার একটায় একটা ইডলির দোকান বসে। সাম্বরের কৌটোর ঢাকনা খুলতেই স্টিম ইঞ্জিনের মত গলগল করে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। চৌকিগুলোর ওপরের গেরুয়া পতাকা অবধি উঠতে না উঠতেই হলুদ সাম্বরের ধোঁয়া মিশে গেল হলদে আগুনের ধোঁয়ায়।
মানমন্দিরের ডিজাইনার বেগুনি-গোলাপি আলো প্রত্যেক তিরিশ সেকেন্ডে রং বদলায়। পরিষ্কার কাছা পরা, মুণ্ডিত মস্তক এক ভদ্রলোক সেই আলোয় বেগুনি-গোলাপি হয়ে হেঁটে গেলেন। পেছনে আরো কয়েকজন। ওঁরা মণিকর্ণিকা থেকে আসছেন।
ওঁরা মণিকর্ণিকা থেকে আসছেন। আমরা সবাই মণিকর্ণিকার দিকে যাচ্ছি। যে যেখানে থাকি, সবাই।
৮৮-খানা ঘাট। তার মধ্যমণি মণিকর্ণিকা। মণিকর্ণিকায় কখনো চিতা নেভে না। নিভবে কেন? বেনারসের কোনো হাসপাতালে কোনোদিন ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ড খালি থেকেছে?
সকালে উঠে ব্রাশ্ করে কচৌরি গলিতে কচুরি খেতে যাওয়ার সময় মনটা লুচি-লুচি হয়ে থাকে। আলতো করে ফুলে ওঠা লুচি। কিন্তু আঙুল দিয়ে টোকা মেরে ফুটো করে গরম বাষ্প বের করে দিলে লুচির যেমন অবস্থা হয়, হঠাৎ মনেরও তাই।
কিছুদূর যেতেই তিনজনের সঙ্গে দেখা। ম্যাটাডোরে পাশাপাশি শুয়ে আছেন ওঁরা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কমলা-হলুদ কাপড়ে মোড়া। জ্বলছে ধুপ। ইতস্তত গাঁদার পাপড়ি। সবাই এক আঙুলে প্রণাম সারছে। পথচারী কেউই খুব একটা বিচলিত নয়। তিনজনেরই গন্তব্য মণিকর্ণিকা।
মুখ হাঁ হয়ে যায়। এ কি সিস্টেম? আমাদের শ্মশান হয় গ্রামের প্রান্তে, শহরের উপকণ্ঠে। শহরের মধ্যিখানে শ্মশান?
না হওয়ার হাজার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, জানি। দর্শন বলে, মণিকর্ণিকা মহাতীর্থ। শ্রীরামকৃষ্ণ দেখেছেন, এখানে শিব প্রত্যেকের কানে তারকব্রহ্ম নাম দেন। অত জানি না। তবে মণিকর্ণিকা কান ধরে শিখিয়ে দেয় - আজ যারা জিলিপি খেতে খেতে প্রণাম ঠুকলে, কাল এই জিলিপি প্রণাম যে তাদেরই প্রাপ্য হবে না - এই গ্যারান্টি খোদ মহাদেবও দিতে পারবেন না।
শুধু মণিকর্ণিকা নয়। হরিশচন্দ্রও আছেন। বাকি ৮৬-টা ঘাটের প্রত্যেকটার এক কোণায় শান্ত হয়ে বসে বাতাসে নাক পাতলেই শুনতে পাওয়া যায় এই দু'জনকে। ঘাটে ঢুকতেই নৌকাওয়ালারা হাঁক পাড়ে - বোলিয়ে, বোট রাইড করা দেঁ? হরিশচন্দ্র সে মণিকর্ণিকা?
২
চিন্তা-ভাবনা সব অবনীন্দ্রনাথের জীবনের একটা ঘটনাকে ফোকাল পয়েন্ট করে ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশ কিছুদিন অসুস্থতার পর যখন তিনি একটু সুস্থ, ঠিক হল - খানিক জপ-ধ্যান করে পরলোকের পাথেয় রোজগার করবেন। পরিণত বয়সে আধ্যাত্মিক লাইনে যাওয়া আর কি! পাহাড়ি বারান্দায় সানরাইজের সময় চোখ বন্ধ করে বসে থাকার জোর চেষ্টা। সূর্য উঠবে উঠবে করছে, এমন সময় কে একজন তাঁর মনে চটাস করে একটা চড় মেরে চোখ খুলে দিল। সূর্যোদয় হল, অবনীন্দ্রনাথ দেখলেন। অবনীন্দ্রনাথ বুঝলেন, তাঁর ধ্যান চোখ বন্ধের ধ্যান নয়। ধ্যানেরও রকমফের হয়।
দশাশ্বমেধে আজ চোখ-বন্ধের সাধুর ভিড় বেশি। আর যাঁদের আধবোজা, তাঁদের নজর বাটির দিকে। অপার্থিবের সন্ধানের পার্থিব পাথেয়। হর হর ব্যোম ব্যোম।
দশাশ্বমেধ ঘাটে ঢোকার সিঁড়ির রেলিংটার ওপরে একটা ধাতব ঘোড়া বানানো। আইডিয়া মন্দ নয় নিঃসন্দেহে। তবে ইতিহাস বলে, অশ্ব-মেধের ওপরেও একটা ইতিহাস আছে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে খানিকটা ডানদিকে হাঁটলে ঘাটের ওপরেই একটা ছোট্ট মন্দির। ঘাটের প্ল্যাটফর্মের বেশ কিছুটা নিচে, গর্তের মধ্যে মাইলস্টোনের মত দেখতে একটা লাল সিঁদুর লেপা পাথর। খুব অস্পষ্ট - তবু মনে হয়, একটা পুরুষ ও একটা মহিলার আকৃতি। ওপরে লেখা, সতী স্থল।
বেনারসের ঘাটে-গলিতে, আনাচে-কানাচে নাকি আকছার দেখা যায় এরকম "সতী স্টোন"। এরকম প্রত্যেকটা জায়গায় একজন মহিলা উঠে বসেছিলেন তাঁর স্বামীর চিতায়। রাতারাতি দেবীত্বে প্রমোশন।
দেবীত্বে প্রমোশন এখনো হচ্ছে। একটা বাচ্চা মেয়ে, মাথায় মুকুট, গালে রং মেখে দেবী সেজে ভিক্ষে করছে। লোকে যত্ন করে দু'টাকার কয়েনের মধ্যে থেকে এক টাকার কয়েন বেছে, দেবীর থালায় দিয়ে ছবি তুলছে। দেবী হাত তুলে ক্যামেরার চোঙকে আশীর্বাদ করছেন।
৩
শুনেছি, কোন এক দার্শনিক বলেছেন - Philosophy is a dead subject। সে হতেই পারে। আর পাঁচটা বুড়োর মতন স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত মৃত্যু। শোনা কথার বিদ্যের ওপর ভরসা অফুরান। জানি, কিছু দর্শন প্রশ্নের উত্তর দেয়। কিছু, জন্ম দেয় প্রশ্নের।
এই দর্শনটা ঠিক কোন টাইপের হতে চলেছে, লাইনে দাঁড়িয়ে সেটাই ভাবি। বাঁ পাশের জাম্বো কুলুঙ্গির মধ্যে কমলা-রঙা ঢুন্ডিরাজ গণেশ। তাঁকে সাক্ষী রেখে ফুল্ বডি সার্চ করাই। তারপর মাথা হেঁট করে মেটাল ডিটেক্টরের তোরণ পার করেই -
বিশ্বনাথের গলি! ডানদিকে মা অন্নপূর্ণার মন্দিরের বিশাল দরজা। বিশাল দরজার পাশে একটা ছোট্ট শ্বেতপাথরের ফলক। লেখাটা অস্পষ্ট। কাছে গিয়ে জোর করে পড়ার চেষ্টা করি। এই তো, পড়া যাচ্ছে! লেখা - Persons who do not belong to the Hindu community are requested not to proceed beyond this point।
পায়ে লেপ্টে যাচ্ছে বিচ্ছিরি কাদা। এই কাদার ধর্ম একটাই, জাত অনেক। স্যাম্পেল নিয়ে টেস্ট করে দেখা যেতে পারে, হুঁকোয় মুখ দিলে জাত যায় কিনা।
একদা সবুজ, এখন গাঢ় বাদামি কার্পেটের ওপর দিয়ে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলল রক্ত-মাংসের স্রোত। বর্ষার রাতে ওল্ড দিঘার কংক্রিটের সৈকতে যেমন করে আছড়ে পড়ে ঢেউ, মানুষ আছড়ে পড়ছে চারপাশে। নানা সাইজের মানুষের জন্য নানা সাইজের ঘণ্টার নানা ফ্রিকোয়েন্সির ঘণ্টাধ্বনি। পাশের ভদ্রলোক শিবাষ্টকম পাঠ করতে করতে চোখ বন্ধ করে ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে এগিয়ে গেলেন। মানুষের মাথা আর মন্দিরের নিচু সিলিংয়ের মাঝের স্বল্প atmosphere-কে অল্প করে দিয়ে উঠল সারি সারি হাত, সঙ্গে সিলিং-ভেদী নাদ -
হর হর মহাদেব!
পঞ্চাশ টাকার প্রসাদের কাগজের প্লেট্ আর প্রাপ্তবয়স্ক কিছু প্রশ্নকে বাঁচিয়ে চলি। বিশ্বনাথের নন্দীর মুখ বিশ্বনাথের দিকে নয় কেন? কি আছে জ্ঞানবাপি কুয়োর তলায়? আর জ্ঞানবাপি মসজিদের পেছনে? মসজিদের পেছনটা কি আজও জেমস প্রিন্সেপের লিথোগ্রাফ-এর মতন দেখতে? প্রশ্নগুলোর মৃত্যু এই অবিমুক্তক্ষেত্রে হলে তাদের স্বর্গলাভে বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
মশারির মতন জালি-কাটা কোমর-উঁচু দেওয়াল। ভেতরে উঁকি মেরে দেখি, চাল-কলা অর্পণের থেকে বাঁচতে কুয়োর ওপরেও মশারির আচ্ছাদন। কড়া চোখে তাকিয়ে আছেন পূজারী।
আমি সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত যতবার পাহাড়ে গেছি, প্রত্যেকবার - সে প্রত্যেকটা জায়গা আলাদা আলাদা হলেও - ড্রাইভার রাস্তার একটা তীব্র বাঁকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, নিচে নেমে ঠিক একই স্টাইলে গুটকার থুতু ফেলে বলেছে - উতর-কে দেখিয়ে, সুইসাইড পয়েন্ট!
ঘাড় বেঁকিয়ে দেখেছি। হুড়হুড় করে নিচে নেমে যাওয়া খাদ। আমার সুইসাইড করার সেরকম কোন ইচ্ছে ছিল না। শুধু ওই পা শিরশিরানিটুকুর জন্য নিচে উঁকি মেরে দেখেছি। হাত-ঘাড়ের লোম খানিক দাঁড়িয়েই আবার বসে পড়েছে।
আমার কি এখন আবার সুইসাইড্ পয়েন্ট-সুইসাইড্ পয়েন্ট লাগছে? লাগছে নিশ্চয়ই, নাহলে হঠাৎ করে সুইসাইড্ পয়েন্টের কথা মনে পড়ল কেন? খানিক দাঁড়াই তো এখানটায়। উঁকি মেরে দেখব? ঔরঙ্গজেব বেনারস আক্রমণ করছেন শুনতে পেয়ে বিশ্বনাথের প্রধান পুরোহিত বিশ্বনাথের লিঙ্গমূর্তি সমেত ঝাঁপ দেন জ্ঞানবাপিতে। "বিধর্মী" আঙুলের ছোঁয়া লাগেনি বিশ্বনাথের গায়ে।
তারপর? পুরোহিত আর বাঁচেননি নিশ্চয়ই। কিন্তু তারপর কি তোলা হয়েছিল বিশ্বনাথকে? ইতিহাসবিদেরা মাথা নাড়েন। কোন গ্যারান্টি নেই। হতেই পারে, প্রিয় সেবকের হাড্ডিসার কোলের মায়া আজও ছাড়তে পারেননি বিশ্বেশ্বর, জ্ঞানবাপির কালো জলের তলায়...
৪
দু'খানা ঘেয়ো বাঁদরের সাহস দেখে সবাই অবাক। পঞ্চাশ, একশো - এমনকি পাঁচশো একের প্রসাদকেও ছেড়ে কথা বলছে না। সিমেন্টের মেঝেতে একটা নোংরা প্লাস্টিকের পাইপ। ভকভক শব্দ করে বেরোচ্ছে জল। বজরঙবলীরা লাফ দিয়ে সেটা পার করে একটা অশ্বত্থর তলায় বসে দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে।
জ্ঞানবাপির ঠিক সামনে কমলা রঙের সুপ্রাচীন প্রকাণ্ড নন্দী। সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য, নন্দীর নিতান্ত অনিচ্ছুক মুখগহ্বরের থকথকে কালাকাঁদ। তটস্থ পাণ্ডা। নন্দী নির্বিকার। ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন সামনের লোহার জালির পেছনে তিন মানুষ উঁচু অমানবিক করোগেটেড শিটের দিকে।
আচ্ছা, আজ থেকে তিনশো বছর আগে একটা খুব সাধারণ, জাঁকজমকহীন কবর তৈরির খরচ কত হতে পারে? কোন আন্দাজ আছে? না থাকলেও অসুবিধে নেই। চোদ্দ টাকা বারো আনা। পাক্কা হিসেব।
যে সময়ের কথা, সে সময় পুরোনো দিল্লির বাজারে হেন অদ্ভুত চিজ ছিল না, যা মিলত না। এহেন অদ্ভুতের বাজারে সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস দুটো। অপটু হাতে বোনা কিছু মুসলমানি টুপি। আর, বেনামে কপি করা কয়েকটা সস্তার পকেট কোরান।
শেখ জৈনুদ্দিন সিরাজির দরগা মহারাষ্ট্রের ছোট্ট শহর খুলদাবাদের এক প্রান্তে। দরগার অনেক কবরের এক কবরের খবর জানাই। কবর তৈরির খরচের কথা আগেই বলেছি। চোদ্দ টাকা বারো আনা। ছাদ খোলা কবর তৈরির প্রত্যেকটা পয়সা রোজগার করা হয়েছে দিল্লির বাজারে টুপি-কোরান বেচে।
মেঘলা আকাশের নিচে ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা সেই কবর। মাঝখানটা খানিক খোলা। মাটি ছুঁয়ে সেখান থেকে বেরিয়েছে একটা ছোট্ট গাছ।
কাচার বালতিতে বেশি উজালা পড়লে স্কুলের সাদা জামা কেমন একটা মনমরা নীলচে হয়ে যেত। কবরের চারপাশের মার্বেলের দেয়ালে বর্ষার বিকেলে আজ সেই রঙ।
করোগেটেড শিটের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, ঔরঙ্গজেবের তৈরি জ্ঞানবাপি মসজিদ আর ঔরঙ্গজেবের নিজের কবরের মার্বেলের দেয়ালের রঙ-মিলান্তি।
নন্দীর চোখ শিটের ওপারে যায় না।
লোহার জালির পাশের হাত তিনেক চওড়া রাস্তাটা শেষপর্যন্ত চওড়া হতে হতে - দু'বার ডানে, একবার বাঁয়ে বাঁক খেয়ে - মেইন রাস্তায় পড়েছে।
সেটা ধরে এগোই। সামনে বেশ বড় খোলা চত্বর। এক কোণে একটা জংলা রঙের তাঁবু। ভেতর থেকে ভেসে আসছে আর্মি ম্যানদের হাসির শব্দ। চত্বর ঘিরে নরকঙ্কালের মত মৃত্যুপথযাত্রী বাড়ির দল। প্রত্যেকটা জানলা কাঠের ফ্রেম এঁটে যত্ন করে সিল করা।
সবার মাথা ছাড়িয়ে, বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে সেনার ওয়াচ-টাওয়ার।
তাঁবুটা পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরলাম।
করোগেটেড্ শিটে একটা বড় ফাঁক। এটা মসজিদের পশ্চিম দেওয়াল। লোহার জালির লাইন-অফ্-কন্ট্রোলের ওপারের মেঝে বাঁধানো নয়। পাতলা হয়ে যাওয়া চুলের মতন, হলদে হয়ে যাওয়া শুকনো ঘেসো ঢেউ খেলানো জমি গিয়ে ঠেকেছে মসজিদের দেওয়ালে। কয়েকটা থার্মোকলের প্লেট্, চিপসের প্যাকেট্ আর প্লাস্টিকের গ্লাস্ পড়ে আছে।
এখানটায় দুটো ছোট্ট সাদা বেনামা কবর ছিল। এখন নেই।
এটুকুই যা অমিল।
বাকিটা হুবহু প্রিন্সেপের Benares Illustrated-এর লিথোগ্রাফ। মসজিদের ম্লান নীলচে-সাদা রঙ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। ইট দিয়ে অযত্নে বন্ধ করে দেওয়া বিশাল দরজার দু'পাশে থাকে-থাকে সোনালি-বাদামি কলাম। তাদের ওপরদিকে অদ্ভুত নকশিকাঁথার কাজ। জাফরিকাটা আর্চ। সুপ্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
মসজিদের স্থাপত্য খুবই সাদামাটা। মোগলাই গন্ধ নেই বললেই চলে।
প্রিন্সেপের করা জ্ঞানবাপি মসজিদের লিথোগ্রাফ-টার নাম - Temple of Vishveshwur, Benares।
বিশ্বনাথের আদি মন্দির তৈরি করেন রাজা মান সিং, সম্রাট আকবরের আমলে। আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীরের নাতি তা দিলেন গুঁড়িয়ে। মন্দিরের ইঁটে রাতারাতি গাঁথা হল মসজিদের ভিত।
আজও, নন্দী নিরুপায় হয়ে চেয়ে আছেন মনিবের পুরোনো বাড়ির দিকে।
একটা মারাঠি পরিবার গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটার পায়ে রূপোর নূপুর।
এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি। পায়ের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি।
সূর্যাস্ত হতে বেশি দেরি নেই। বেরিয়ে এক ভাঁড় রাবড়ি খেলে হয়।
মেশিনগানের বুলেটের মত পাখার শব্দ করে এক ঝাঁক পায়রা বিশ্বনাথ মন্দিরের সোনার চুড়ো থেকে উড়ে গিয়ে মসজিদের মিনারে বসল।
নমাজের সময় হয়েছে।