আপনার জানার খিদে কতটুকু আছে সেই প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু খানিকক্ষণ হেঁটে আসার পরে আপনার পাতে টিরিং টিরিং ধ্বনি-সহ যে তথ্যগুলো উগরে আসবে তা হল—কতটা দূরত্ব হাঁটা হল, হাঁটার সময় হৃদযন্ত্রের ধুকপুকুনি কেমন ছিল, কত মিনিট আর কত সেকেন্ড হাঁটলেন, এই হাঁটার ফলে কত কিলো ক্যালরি পোড়ালেন, যতটা ক্যালরি পোড়ালেন তা কত বাটি ভাত কিংবা ক’বোতল ঠাণ্ডা পানীয়র সমান, যে পথ দিয়ে হাঁটলেন তার চড়াই উতরাই কেমন ছিল, হাঁটার গতিবেগ কত ছিল, সব মিলিয়ে কত স্টেপ হাঁটা হল, আজকে যতটা হাঁটবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সেই কথাটা কত শতাংশ রাখতে পারা গেল, সপ্তাহে যতটা হাঁটবেন বলে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিলেন তার কত শতাংশ এ পর্যন্ত পূরণ করতে পারলেন, এই হন্টনকালের মধ্যে শরীরের অক্সিজেন মাত্রার কেমন পরিবর্তন হল, এতটা হাঁটার মধ্যে কতটা অ্যাক্টিভ হাঁটা অর্থাৎ হাঁটার মতো হাঁটা হল আর কতটা এমনি এমনি অপরিণত হাঁটা হল, আপনার বন্ধুরা হাঁটার দৌড়ে আজকে আপনাকে কতটা দুয়ো দিলেন কিংবা বেশি হাঁটার ফলে আপনি তাঁদের ক’জনকে কলার তুলে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে পারলেন ইত্যাদি। তালিকা অন্তহীন, অসীম। সারাদিনের কাজের পর বিধ্বস্ত হয়ে সামান্য জিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কব্জিতে ফের স্পন্দন। তাকিয়ে দেখা গেল, স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে, বসে আছেন অনেকক্ষণ, এক্ষুনি যান, আড়াইশ স্টেপ হেঁটে আসুন। রাত্রে ঘুমলেন। সকালে উঠে দেখলেন সেই ঘুমের স্ট্যাটিসটিক্স। উল্টোপাল্টা, অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর শরীরের ময়নাতদন্ত হয়। কিন্তু একজন জ্যান্ত, সুস্থ মানুষের ঘুমের কাঁটা-ছেঁড়া নিয়ে যন্ত্রের উৎসাহ দেখলে চোখ কপালে ওঠে। সকালে স্ক্রিন গলগল করে বলে দেবে, কাত রাতে ঘুমিয়েছেন মোট এত ঘণ্টা এত মিনিট। হাল্কা ঘুমলেন ৪ ঘণ্টা ৩২ মিনিট। গভীর ঘুমলেন ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। তন্দ্রায় এপাশ ওপাশ করেছেন ৫৮ মিনিট। সুতরাং, আপনার ঘুমের পয়েন্ট হল এত। ভাল ঘুমের টার্গেটটা মিস করে গেলেন এই একটুর জন্য। সকালে ওঠার পরেই যন্ত্র হুমকি দেবে, ভোর হল দোর খোল খোকাবাবু হাঁটো রে। ভাবলেন এক কাপ চা খেয়ে বেরবেন। কিন্তু প্রতি মিনিটে বাহু কাঁপিয়ে সেই ভাইব্রেশন আপনাকে চটজলদি স্পোর্টস শ্যু পরে বাইরে বেরোতে বাধ্য করবে। আপনি কেমন আছেন তা জানান দেওয়ার জন্য যন্ত্রের যে বড় চিন্তা হয়। দুশ্চিন্তা। প্রিয়জনকেও হার মানাতে পারে এমন চিন্তার খতিয়ান।
বিয়েবাড়িতে এক বন্ধুর সঙ্গে একসাথে খেতে বসেছিলাম। বুফে নয়, পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন ছিল। আমার প্লেটের পাশে যত্নে রাখা ছিল মেনু কার্ড। আর ওর প্লেটের ডানদিকে মেলে রাখা টিস্যু পেপারের উপরে জায়গা করে নিয়েছিল মোবাইল। বেগুনি দিল। ভাজাটা হাতে তুলে খানিক এদিক ওদিক করার পর বন্ধুর প্রশ্ন ছিল, কত গ্রাম হবে রে এটা? নিজেই কিছু একটা অনুমান করে মোবাইলের পর্দায় বাঁহাত দিয়েই টাইপ করল খুটখুট করে। প্রতিটা আইটেম আসার পরে ওজনের অনুমান ও আঙুলের এই খুট-খুট চলতে থাকে। চার পাঁচটা আইটেমের পরে যখন কেটারিংয়ের ছেলেটি হাতায় আদর মাখিয়ে রাজকীয় পোলাও দিতে যায়, মোবাইল থেকে বেরোতে শুরু করল অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ধ্বনি। হেলিকপ্টারের ডানার মতো থালার উপরে প্রবলভাবে হাত নাড়তে শুরু করে দিয়েছিল আমার বন্ধু। মধ্যের যাবতীয় আইটেম ‘স্কিপ’ করে হাত ধোয়ার জন্য বাটি ভর্তি সাবান জলের অপেক্ষায় ছিল ও। গুমরে গুমরে বলছিল, আজকের ক্যালরি ইনটেক কমপ্লিট রে। অ্যাপটা আমাকে মনোমতো খেতেও দিল না। ওর কথায় দুঃখ ছিল, আফসোসও। তবে রাগ ছিল না মোটে। নিজের শখ আহ্লাদের উপরে যান্ত্রিক আম্পায়ারিং মেনে নেওয়ার ফলে ওর চোখে মুখে কোনও দ্বিধা ফুটে উঠতে দেখিনি।
কয়েকবছর হল, জীবনের দুটো নিয়ন্ত্রককে আমরা বরণ করে নিয়েছি বেশ। প্রথমটা ছোট্ট একটা স্ক্রিন বসানো রবারের ব্যান্ড। কব্জিতে তা এঁটে রাখতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা। হ্যাঁ, স্নান করার সময়ও খোলা নিষ্প্রয়োজন। পোশাকি নাম ফিটনেস ট্র্যাকার। আপনার চলন, শয়ন, স্বপন-বপন সব কিছু সেই ১৫ গ্রামের ছোট্ট ডিভাইস মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে। স্মার্ট ফোনের লেজুড় হয়ে কল, এসএমএস, হোয়্যাটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন তো পাঠাবেই, ডায়ালের তলায় রাখা ইনফ্রারেড আলো আপনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপবে, হৃৎস্পন্দন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে। আর, সবচেয়ে বড় কথা হল, প্রভুভক্ত সারমেয়র মতো তার আশ্রয়দাতাকে ডেটা দিয়ে ভরিয়ে দেবে। হাঁটা মানে যে শুধু হাঁটা নয়, দিনের প্রতিটা স্টেপ দিয়ে যে গড়ে তোলা যেতে পারে গ্রাফের আশ্চর্য আলপনা, তা এই ডিভাইস দেখাবে। ছোটবেলায় যেভাবে দৌড়, সাইক্লিং ও সাঁতারে পারদর্শী হয়েছিলেন, তার মধ্যে বাস্তবে যে কত খুঁত পুরে রাখা আছে তা নিপুণভাবে বাতলে দেবে এই ফিটনেস ট্র্যাকার। বলা ভাল, আপনাকে মাপবে। ডায়ালের ছোট স্ক্রিনে সাধ পূরণ হয় না। তাই ব্লুটুথের মাধ্যমে মোবাইলের সঙ্গে সিঙ্ক করতে থাকবে এই বাইনারি সম্পদ। সাত ইঞ্চির মোবাইল স্ক্রিন কোনোদিন করতালি দেবে, আবার কোনোদিন বলবে আপনার দ্বারা কিস্যু হবে না।
এই ফিটনেস ট্র্যাকার বা ব্যান্ডের বিক্রির ধুম লেগেছে বিশ্বজুড়ে। করোনাকালে বহু সামগ্রীর ব্যবসা ধরাশায়ী হলেও ফিটনেস ট্র্যাকারের ঊর্ধ্বগতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ফরচুন বিজনেস ইনসাইটস-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে দুনিয়াজুড়ে এই ফিটনেস ব্যান্ডের ব্যবসার পরিধি ছিল ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনুমান করা হচ্ছে প্রতি বছর ব্যবসার পরিমাণ বাড়বে ১৫.৪ শতাংশ হারে। গেরুয়া পাতার খবর কাগজের ভাষায়, সিএজিআর। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৮ সাল নাগাদ ব্যবসার বেলুন ফুলে ফেঁপে ১১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়ে ফেলবে। স্বাস্থ্যের গুচ্ছ গুচ্ছ জাঙ্ক ডাটা নিয়ে লোকজনের ছুঁকছুঁকানি বাড়বে যত, ফিটনেস ব্যান্ড কর্তাদের মুখের হাসিও তত চওড়া হবে। অনুমান করা যায়, ফিটনেস ও ক্যালরি সম্পর্কিত যত অ্যাপ আছে, ডাউনলোডের দৌড়ে অন্যান্য অ্যাপকে তারা চোখ বুজে দশ গোল দেবে। ব্যবহারের ট্রেন্ড এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কোভিড অতিমারী নিয়ে সাবধান হওয়ার জন্য চিকিৎসকদের একাংশ বাড়িতে অক্সিমিটার কিনে রাখার উপদেশ দিয়েছিলেন। এই মৃদু উপদেশের থেকে অনেক জোর গলায় তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন কোভিড বিধি মেনে চলা ও মাস্ক পরে রাস্তায় বেরনোর কথা। আম-আদমি দ্বিতীয় উপদেশ না মেনে প্রথমটি মেনে চলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মুড়ি মুড়কির মতো বিক্রি হতে শুরু করল অক্সিমিটার। ফিটনেস ব্যান্ড কর্তারা বুঝলেন, জলের তলায় লুকিয়ে থাকা হিমবাহের মতো এক বিরাট সম্ভাবনা অপেক্ষা করে রয়েছে দু'হাত বাড়িয়ে। এক রোগগ্রস্ত, হ্যাংলা বাজার। অধিকাংশ ফিটনেস ব্যান্ডেই আগে অক্সিজেন স্যাচুরেশন অর্থাৎ এসপিওটু মাপার ব্যবস্থা ছিল না। এমন অ্যালগোরিদম ঢুকিয়ে তৈরি করা হল নয়া যন্ত্র-সার্কিট। বিক্রির যে গাঙে জোয়ার এসেছিল আগেই, তা এবার দেখতে শুরু করল পাহাড়প্রমাণ ঢেউ। প্রতি সন্ধ্যায় সিইও সাহেবরা হয়তো একটার জায়গায় দুটো চিলড বিয়ারের ক্যান খুলতে শুরু করলেন, সানন্দে।
কয়েকটি তাবড় কর্পোরেট সংস্থা সুসময়ের আনন্দ-দোলনায় দোল খাওয়া শুরু করলেও অনেকেই কিন্তু এই ঘটনায় কপাল কুঁচকেছেন। জনস্বাস্থ্য নিয়ে মাথা ঘামান যাঁরা, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁরা বলতে শুরু করেছেন, স্বাস্থ্য সচেতনতা ভাল, কিন্তু তাই বলে এই অতি সচেতনতা? তাঁরা বলছেন, বেশি সচেতন হতে গিয়ে মানুষ আখেরে নিজের ক্ষতি করছেন। প্রশ্ন তুলছেন এই রাশি রাশি ডেটার উপর। হাজার দুয়েক টাকার সার্কিট বোর্ড তা মেপে ফেলার ক্ষমতা রাখে বলেই দিবারাত্রি সমস্ত তথ্য স্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলার ঘোর বিরোধী তাঁরা। তাঁদের মতে, এই ইনফরমেশন ওভারলোড মানুষকে ঠিক পথ দেখানোর বদলে টর্চের আলো ফেলতে শুরু করেছে ভুল পথের অন্ধ গলিতে। যন্ত্র দাসে পরিণত হওয়ার পরে মানুষ যখন তাঁর ভুল বুঝে উঠতে পারবেন শেষ পর্যন্ত, বলা যায় না, অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে যাবে।
অসুস্থ হয়ে ডাক্তারখানায় গেলে চিকিৎসকেরা আমার-আপনার হৃৎস্পন্দন পরখ করে নেন। মনের মধ্যে এক উহ্য প্রশ্নচিহ্ন আঁকড়ে ধরে আমরা চুপ করে ডাক্তারবাবুদের মুখ খোলার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। এই ‘কি হয়, কি হয়’ ভাবের পণ্যায়ন দেখি সিনেমার পর্দায়। মাল্টিপ্লেক্সের ডলবি ডিজিটালে উপচে পড়ে বিপ বিপ ধ্বনি। পর্দায় আইসিইউ-এর কোনও দৃশ্য। রোগীর পাশে বসানো মেশিনের পর্দা প্রতি মুহূর্তে মেপে চলেছে হার্টবিট। সঙ্গে সেই একঘেয়ে বিপ বিপ। রোগীর মৃত্যু বোঝাতে বহু দৃশ্যে ওয়াকম্যানের শেষ হয়ে যাওয়া ব্যাটারির মতো বিপ ধ্বনি কিছুটা প্রলম্বিত হয়ে পুরোপুরি থেমে যেতে শুনেছি। তারপরেই হাহাকার। চিকিৎসকেরা বলছেন, নিজের হৃদযন্ত্রের লাব-ডাবের পরিসংখ্যান জানা ভাল, তবে অবশ্যই দরকার পড়লে। দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই যদি কব্জিতে এঁটে থাকা যন্ত্রের পর্দা ক্রমাগত দেখিয়ে যেতে থাকে হৃৎস্পন্দনের পরিসংখ্যান, তা তথ্য দেয় যত, সেই তথ্য অনুধাবনের বিকৃতি ঘটায় তার চেয়ে বেশি। কোনও ফিটনেস ব্যান্ড আবার হার্ট বিট স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেলে সাইরেন বাজিয়ে, ভাইব্রেট করে প্রতিকূল অবস্থা জানান দেওয়ার ষোলকলা পূর্ণ করে। এমন নোটিফিকেশনের বহর দেখে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। আমার এক ফিটনেস পাগল বন্ধুর কথা বলতে পারি। স্মার্টব্যান্ড বলছিল, হার্টের বিপিএম ৮২, অর্থাৎ মিনিটে ৮২টি বিট। বিপিএম মিনিটে ৬০ থেকে ১০০-র মধ্যে হলে চিকিৎসাশাস্ত্র মতে বলা চলে—দিব্যি। আড্ডা চলাকালীন টিরিং করে বন্ধুর স্মার্টব্যান্ডে হোয়্যাটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন এলো। বস্ লিখেছেন, আধঘণ্টা সময় দিলাম শার্প। এই অ্যাসাইনমেন্টটা করে পাঠাও উইদাউট এনি ডিলে। আর কি আশ্চর্য। বন্ধুটি ঘামতে শুরু করল। স্মার্টব্যান্ড বলল, তোমার আপডেটেড বিপিএম ১১৯। বিপিএম-এর সবুজ ফন্ট পলকে রক্ত-লাল। তা দেখে ঘাম বাড়ল আরও। পরিচিত এক চিকিৎসককে ফোন করল দ্রুত। ডাক্তারবাবু সব শুনে বললেন, ‘চিন্তার আসল কারণটা কি একটু বলবেন? বসের হোয়্যাটসঅ্যাপ না বেড়ে যাওয়া বিপিএম? অ্যাসাইনমেন্টের মেসেজটা কব্জির পর্দায় না দেখে যদি মোবাইলে দেখতেন, তা হলেও কি এমন চিন্তা হত? হ্যাঁ, সেলফোনে শুধু মেসেজটাই দেখতেন, বিপিএম নয়।’ এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার বন্ধু দিতে পারেনি।
মনোবিদরা বলছেন, ফিটনেস প্রেমীদের ক্রমশ ফিটনেস ফ্রিক বানিয়ে দিচ্ছে এই বাহারি ব্যান্ড। ফিট-উন্মাদ। নিজেকে মাপার জন্য, শরীরচর্চায় নিজেকে আরও বেশি বাধ্য করার জন্য শখ করে কেনা হয়েছিল যে ফিটনেস ব্যান্ড, কিছুদিন পরে তার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত অবিশ্বাসের সম্পর্ক। বহু ব্যবহারকারী ভাবছেন, ৫৭ মিনিট হাঁটলাম, ঝরল মাত্র ১৪২ কিলো ক্যালরি? ভাবছেন, এতটা পথ পেরিয়ে যে ঝরঝরে বোধ হচ্ছে শরীরে, তা হলে কি সেই ভাবনায় ভুল? এত ঘামের মূল্য মাত্র দেড় বাটি ভাত? ব্যান্ডের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। খুব ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও দৌড়তে শুরু করছেন আবার। শারীরিক সমীকরণ মেলানোর জন্য খেতে বসে দেড় বাটি ভাতকে এক বাটি করছেন। ক্যালরি পোড়াতে না পারার ব্যর্থতা চাপছেন শরীরে আরও কম ক্যালরি যুগিয়ে। দিনের পর দিন এমন অভ্যাসের দাস হয়ে কার্যত তাঁরা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছেন ক্রমশ। মনের অলিগলি নিয়ে চর্চা করেন যারা, তাঁদের মতে, এমন ট্রেন্ড ভয়ঙ্কর। দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে তাঁরা বলছেন, শুধু স্যাটেলাইট আর কেবল-এর চোটে নয়, এই স্মার্টব্যান্ডের জন্যেও পারস্পরিক সম্পর্কে ভাঙন ধরছে। সামান্য কয়েকটা স্টেপের জন্য সেদিনের হাঁটার ‘গোল’ মিস করার ভয়ে ব্যান্ডধারীরা তাঁদের দিনের প্রায়োরিটি বদলে দিতেও দুবার ভাবছেন না। আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখা ডিনারের প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র সেদিনের জন্য সেট করে রাখা ক্যালরি পোড়েনি বলে। যে অনুষ্ঠানে সময়ে পৌঁছবেন বলে কথা দেওয়া হয়েছিল, ফিট থাকার টার্গেট তাতে দেরি করিয়ে দিতে বাধ্য করছে। ফলে কথার পিঠে কথা উঠছে। সম্পর্কে মিশছে কাদাজল।
এমন ফিটনেস ব্যান্ডের চাহিদা বাড়ছে যত, চিকিৎসকদের মুখের ত্রিকোণমিতি তত প্রকট হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, ছোট পর্দায় দেখানো এমন ডেটাকে জীবনের সার সত্য মানার কোনও মানেই হয় না। প্রথমে তাঁরা ভুরু কুঁচকেছেন এমন ডেটার সততা অর্থাৎ ক্রেডিবিলিটি নিয়ে। বহু পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, হার্ট বিট মাপতে ডাহা ফেল করেছে এমন ফিটব্যান্ড। মিনিটে কুড়ি তিরিশটি বিটেরও বেশি এদিক ওদিক করে দেখিয়েছে স্ক্রিনে। হাঁটার সময় দূরত্ব মাপতে ভুল করেছে। ফলে কত কিলো ক্যালরি পুড়েছে তা দেখাতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে মুখ পুড়েছে ফিটনেস ব্যান্ডের। মন ভরে যাওয়া, তৃপ্ত ঘুমের বদনাম করেছে ‘ও তো তন্দ্রা ছিল’ বলে। কোনও ডায়েটিশিয়ানের অ্যাপ-অবতার নিরীহ কোনও খাবারের মধ্যে মনগড়া ক্যালরি ভরে দিয়ে সেই খাবারের উপরে মুহূর্তে এনে দিয়েছে অরুচি। আর জাঙ্ক ফুডকে দেখিয়েছে নির্বিষ। চিকিৎসকরা বলছেন, ফিটনেস ব্যান্ড অথবা অ্যাপ এবং তার ব্যবহারকারীদের মধ্যে সম্পর্কটা যেন খাদ্য-খাদকের মতো না হয়ে যায় কোনোদিন। আমাদের স্বাধীন সত্ত্বা, শখ-আহ্লাদের উপরে তা যেন নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে থাবা না বসায়। তাঁরা ক্রমাগত মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গাঁটের কড়ি খরচা করে যে যন্ত্রটি কিনে এনেছেন, তাঁরা নিয়ন্ত্রক যেন আপনিই থাকেন। কাঁধে হাত দিয়ে তাঁদের উপদেশ, সংযমী হতে হবে, কিন্তু বাঁচতে হবে নিজের ইচ্ছেমত। সংযমের ব্যাকরণ শেখাবে আমাদের মনের অ্যলগোরিদম, কোনও সার্কিট বোর্ড নয়।
ফিটনেস ব্যান্ডের সিএজিআর বাড়ছে। তবে একইসঙ্গে হয়তো ওজনদার হচ্ছে বিরক্তির মাত্রাও। বহু ফিটনেস ফ্রিক তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ফলাও করে লিখছেন অন্তর্জালে, তাঁদের ব্লগে। বলছেন, ওই যে আমার সাধের ব্যান্ড। ড্রয়ারের এক কোণায় পড়ে ধুলো খাচ্ছে অনেক দিন। খাক। বলছেন, ছেড়ে বেঁচেছি। আর হ্যাঁ, অনেক ভাল আছি আগের থেকে।