সত্যজিতের ভূতের নেত্য
পাঁচশো বছর আগেকার ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গের তেতে ওঠা রাস্তায় হঠাৎ ত্রোফিয়া নাম্নী এক তরুণী নাচতে শুরু করে দিলেন। সে নাচ শুরু হল তো হল; থামাথামির নাম নেই। তাকে ঘিরে ক্রমাগত জমতে থাকা ভীড়ের প্রতি বিন্দুমাত্র দৃকপাত না করেই তিনি বল্গাহারা নেচে যেতে লাগলেন যেমন ‘নাচে জন্ম; নাচে মৃত্যু’… এবারে হল কি, ত্রোফিয়ার এই আত্মহারা উন্মত্ততায় প্রাণিত হয়ে ভীড়ের মধ্যে থেকেই বেশ কয়েকজন , বিশেষত তরুণী নাচতে শুরু করে দিলেন। নাচতে নাচতে রক্তাক্ত পা নিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া, আবার সংজ্ঞা ফিরলেই উন্মত্ত হয়ে নব উদ্দীপনায় নাচতে শুরু করা…’ডান্সিং প্লেগের’ এই ছোঁয়াচ - দৌরাত্ম্যে গড়ে দশ জন মারা গিয়েছিল সে সময়ে। অবশ্য তারো আগে সপ্তম শতকে প্রথম ডান্সিং প্লেগের খবর পাওয়া যায় যখন এক ব্যক্তি হঠাৎ কবর খানায় নাচতে শুরু করেন। ১৩৭৪ সালের জার্মানিতে ডান্সিং প্লেগে পাঁচশো থেকে এগারোশো মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। কারণ হিসেবে ট্যারান্টুলা মাকড়সার কামড় বা ছত্রাক জনিত সংক্রমণকে পাত্তা না দিয়ে দায়ী করা হয় অবসাদকে। তদানীন্তন ব্ল্যাক ডেথের মতো মহামারীতে মানুষের কীটোচিত মৃত্যু, নাটকীয় অর্থনৈতিক অবক্ষয় , সামাজিক সংঘাত ইত্যাদি কারণে প্রবল মানসিক চাপে একরকমের ‘গণ হিস্টিরিয়া’ বা সাইকোসিসের ফলে দেখা দেয় ‘ডান্সিং প্লেগ’।
কি ? উপসর্গগুলো চেনা চেনা লাগছে? লাগছে না? আজ যখন উপরিউক্ত কারণে আজকের ফ্রান্সের কোন ত্রোফিয়া, ইউ.কে’ র কোন ভিক্টোরিয়া , ভারতের কোন ত্রমি তেতে ওঠা রাস্তায় মাস্ক খুলে অকস্মাৎ মাদনে মথিত হয়ে হাত পা ছুঁড়ে নৃত্য করে লোক জড়ো করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন মনে পড়ল আরেক নেত্য’র কথা - সত্যজিতের ভূতের নেত্য।
সেই কমলা হেম হাসের টেপফ্রকবেলা থেকে এই ছয় মিনিট আঠেরো সেকেণ্ডের ভূতের নেত্য আমার ভূতে পাওয়া মনকে টেনে রেখেছে, যেমন লোহাকে টান মারে অয়স্কান্ত’র ম্যাগ্নেটিয় চুমু-প্রভা। ভূত মানেই নঞর্থক । ভয়াবহ । ছমছমে। অথচ তাদের সঙ্গতে এমন ভারত-সঙ্গীত-রত্নাকর ছেঁচা অপূর্ব নৃত্য ও বাদ্য যন্ত্রের অমর্ত্য সমাবেশ! ভাবা যায় না। এ অমর্ত্য, এ অলৌকিক কিন্তু ভৌতিক তো নয়! সেই শিশুমনের সদাশ্চর্য প্রেক্ষাপটে এ যেন পাঁচমুড়া পাহাড় বা শ্যামলী নদীর তীর নচেৎ ঠাকুরদাদার ক্রৌঞ্চ দ্বীপের রাজার ডাকহরকরার হাতছানি!
ক্রমে ক্রমে সেই হাসবেলা গেল। টেপফ্রক ঠেলে সন্তরিত সেই মরালের দুটি ঠোঁট উঠল। লকারে থাকা আখরোটি ব্রেনের তখন প্রবল ইচ্ছে জগতের উপর যত পর্দা আছে , তা এক ঘ্যাঁচে টেনে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলার। সেইসময় যখন ভূতের নেত্য দেখলুম, মনে হল একটা গোটা রাষ্ট্রের ইতিহাস ঐ ছয় মিনিট আঠেরো সেকেণ্ডের পেটে পোরা আছে। তাবৎ যুদ্ধ হানাহানি রাহাজানি শোষণ শাসন প্রতিরোধ হাসি কান্না হীরা পান্নাকে নৃত্যখাতে বইয়ে দিয়ে মৃত্যুর মোহনায় প্রোথিত করার অমোঘ সে রক্তমাংসরহিত জলজ্যান্ত ইতিহাস।
সে ইতিহাসে ঢুঁ মারার আগে গুপী বাঘা’র চিত্রনাট্যে ভূতের নেত্য কীভাবে বর্ণিত হয়েছে তাতে চোখ বোলানো যাক।
‘ভূতের রাজা হাত তুলে ওপরে নির্দেশ দেবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যে নাচের বাজনা ভেসে আসে। গুপী-বাঘাও পেছন ফিরে ওপরে তাকায়। সব ভূতেরা এগিয়ে এসে নাচতে শুরু করে। প্রথমে রাজা ভূতের দল, পরে চাষা বা প্রজার দল, এর পর সাহেব ভূত এবং শেষে বানিয়া, বামুন আর পাদ্রি মিলে মোটা ভূতের দল। নাচতে নাচতেই এদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগে এবং নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু করে, সেই লড়াইতে প্রত্যেক দলের ভূতই মারা পড়ে। শেষে চারটি ভূতের দলকেই চার সারিতে একসঙ্গে নাচতে দেখা যায়। নাচের দৃশ্য অদৃশ্য হওয়া মাত্র ভূতের রাজা দুই হাত নেড়ে গুপী-বাঘাকে কাছে ডাকেন।‘
সুতরাং রাজনীতি ধর্মনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির এক একটা মধুকলস নিয়ে ক্ষমতাধারীদের প্রলয় নৃত্য করতে করতে বিধুরেণ সমাপয়েত হয়ে একটি ঐতিহাসিক বিন্দুতে মিলিয়ে যাওয়ার ঋকমন্ত্র যেন উদ্গীত হল এই সিনেমার মধ্যে আরেকটি সিনেমার অবতারণায়। সবচেয়ে মজা লাগে চিত্রনাট্যের এই কথায় যে ‘সেই লড়াইতে প্রত্যেক দলের ভুতই মারা পড়ে।‘ মারা কারা পড়ে? ভূতেরা। গীতার শ্রীকৃষ্ণ যেন এ কথায় একটু মুচকি হাসেন। সবাই আগে থেকেই মরে ভূত হয়ে রয়েছেন। সত্যজিৎ নিমিত্ত মাত্র।
তা যাই হোক, আমরা যখন নাচের গভীরে প্রবেশ করি, দেখি নৃত্যরত প্রত্যেক ভূতই পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মতো টলটলে যেন এইমুহুর্তে গড়িয়ে পড়বে বুঝি এক আঙ্গিক থেকে আরেক আঙ্গিকে । রাজা আর সাহেবদের পোষাক সাদা,প্রেক্ষাপট কালো, বাকি দুই ক্ষেত্রে বিপরীত। কেউ কেউ বলেন ভারতীয় ইতিহাসের দিকপাল যেমন মহাত্মা গান্ধী, লর্ড মাউন্টব্যাটেন , জিন্নাহ বা প্যাটেলের রহস্যময় উপস্থিতি আছে নাকি এই পরিসরে। সে থাক। কিন্তু আমার মনভোমরার বৈশিষ্ট্য হল বারে বারে ঘুরে ফিরে প্রিয় কুসুমিত’র মুখচুম্বন করে মধু নিঃসরণ করা। তা সেদিনও মন-ভোমরা ভূতের নেত্যজাত সৌরভ ( শুধু ভূতের নেত্যই মাঝেমাঝে দেখার শখ হয়) আস্বাদন করতে করতে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল, চাষা ও শ্রমিক দলের একজন একতারা হাতে ধরে রয়েছেন! (উপরের ছবি দ্রষ্টব্য) তুলতে তীর ধনুক, বর্শা’র মাঝে একতারাধারী কে ও? লালন ! মহিষাসুরমর্দিনীকে সব দেবতা সব রকমের অস্ত্র দিয়েছিলেন অসুর মারবার জন্য অথচ ওই খুনে মেয়েমানুষের হাতে ব্রহ্মা দিয়েছিলেন কমণ্ডলু ও অক্ষমালা। কে জানে এই ভূতের নেত্যলীলাতে ভাবের ঘরের কমণ্ডলুধারী সন্ত সাধক-যোদ্ধাটি কে? আর একটা লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল নিজেদের মধ্যে লড়াই করেই সকলের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটছে। এক দলের সঙ্গে অপর দলের শ্রেণীশত্রুতা দেখানোর বদলে কোন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর অন্তর্ঘাতের উপরেই যেন পরাজয় ও মৃত্যুর হাস্যকর ট্র্যাজেডিটা দাঁড়িয়ে আছে। সেই অন্তর্ঘাত বিশ্বাসভঙ্গ, ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহত্তর প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা (খুব খুব চেনা না শব্দগুলো এবং তাদের অভিঘাত?) ইত্যাদি এবম্বিধ দড়ি টানাটানি খেলায় যে অবশ্যম্ভাবী বিনষ্টি আর অধঃপতন , সেই নির্মম সত্যটাকেই শিশুহৃদয়ের নরম মাটিতে কুঁদে কুঁদে তাদের শিখিয়ে দেওয়া, যে যুদ্ধ বস্তুটা মোটেও ভালো নয়, তাতে ধ্বংস ও মৃত্যু অনিবার্য।
ফরাসি শব্দ ‘দন্স ম্যাকাবের ( Danse Macabre) এর ইংরেজী হল ‘Dance of Death’ বা ‘মৃত্যু নৃত্য’।
ইউরোপে মধ্যযুগের শেষদিকে গির্জার দেওয়াল চিত্রণের ক্ষেত্রে এই ‘প্রেত নৃত্য’র ভাবনা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেই দেওয়াল চিত্রগুলোয় দেখা যেত, সাধারণত সমাজের নানা স্তরের মানুষ হাতে হাত ধরে নাচের ছন্দে কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।নানা স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে এই ধরণের ছবিতে চিত্রিত হতেন একজন পোপ, একজন রাজা, একজন শিশু ও একজন শ্রমিক। সমাজে তোমার যে অবস্থানই হোক না কেন; অন্তিমে মৃত্যুর কপালে লকলক করছে জয়তিলক। সুতরাং জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান কর আর অর্জনের পেছনে বৃথা দৌড়িও না- এইরকম একটা দর্শনের প্রতিভাস আমরা পাই ‘প্রেত নৃত্যের চিত্রে’। সত্যজিতের ভূতের নেত্যতেও কী ‘দন্স ম্যাকাবের’র ‘ছায়া পড়িয়াছে’?
আজ যখন ছাতার মতো গোল পাতাটির নীচে ভোরের দোয়েল পাখি টুপটাপ করোনা আপডেট শোনে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর আকাশের বুক কাঁচিডানায় কেটে কেটে উড়ে যায়…’চুপ কর অবিশ্বাসী’ বলে ধমকে ঠাকুরদাদা অমলের শিয়রে বসে রাজার প্রতীক্ষা করেন, তখন মনে হয় , সে রাজা বুঝি ভূতের রাজা, তার দুই বরাভয়ে জবর জবর তিন বর- ওষুধ, বেড আর অক্সিজেন…
তামিমৌ ত্রমি
তথ্যসূত্রঃ অফবিট ; হুঁশহীন নাচ, নাচতে নাচতেই মৃত্যু! ‘ডান্সিং প্লেগ’ আজও ইতিহাসের পরম বিস্ময়-প্রতিদিন ১৪ই এপ্রিল , ২০২১
বাংলা ট্রিবিউনঃ বার্গম্যান ও সত্যজিতের ‘মৃত্যুর সাথে নৃত্য’
রে’ভার্স উইকি
ডান্সিং প্লেগ সম্পর্কে এই প্রথম জানলাম। লেখাটি ভাল লাগলো, খুবই সাবলীল। তবে কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলে আরও ভাল হতো। চলুক
অসংখ্য ধন্যবাদ। আচ্ছা দৈর্ঘ্য' র ব্যাপারটা মাথায় রাখলাম।
আমার তো মনে হলো বড্ডো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল... তামিমৌর গদ্য এবং তার অন্তর্লীন উইট আমার খুব পছন্দ হয়েছে... আরো লিখুন
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।