অ-যাত্রা (পর্ব ১)
কাকভোরে ঘুম ভেঙে গেল।
সাধারণত আমার ঘুম একটু বেলা করে ভাঙে। ফোনে টাইম দেখলাম - চারটে চুয়ান্ন।
আজ ভোরে আমার বাগডোগরার ফ্লাইট ছিল। য়ুকসামের গাড়ি, ওখানকার কাঞ্চনজঙ্ঘা লজ্, গাইড-পোর্টার - সব ঠিক করা ছিল।
এখন পুরোটাই ক্যানসেল।
আমার তিনতলার জানলার গ্রিলে ছাঁকা হয়ে নিচের বাংলো বাড়ির বাগানের আলো ঘরের সিলিং-য়ে এসে পড়ত। টিউবলাইট বন্ধ করে দেওয়ার পরেও ঘরটা একটা আবছা আলোয় ভরে থাকত। দু'দিন হল আলোটা খারাপ হয়ে গেছে।
ভাল করে আলো হয়নি এখনো। জানলা দিয়ে একটা বাইকের আওয়াজ পেলাম। একবার চলে, আবার একটু গিয়ে খানিক থামে। নাইটগার্ড ডিউটি শেষ করে একে-একে বাগানের আলো নিভিয়ে বাড়ি যাবে।
আমার জানলার নিচে বাইকটা থামল না।
ঘরের কোণে একটা ব্রাউন পেপারের ব্যাগে একজোড়া গরম মোজা আর একজোড়া গ্লাভস রাখা। গরম টুপিও আছে। একজোড়া নতুন জুতো রাখা আছে পাশেই।
এবারের জন্যেই কিনেছিলাম ওগুলো। এখন ধুলো পড়বে - কতদিন, কে জানে!
অন্ধকারে চোখ সয়ে আসছিল।
দু'বছর হল পাহাড়ে যাইনা।
ফিরে আসা, ফিরে যাওয়া (পর্ব ২)
এইট-বি থেকে বাসে উঠেছি। দেখি, ইউনিভার্সিটির একদল ছেলেমেয়ে গিটার-কাহন নিয়ে আমার পিছুপিছু বাসে উঠল।
সুকান্ত সেতু, সন্তোষপুর পেরিয়ে বাসটা বাইপাসে এসে পড়ল। পেছনের লম্বা সিটে বসে ওরা এতক্ষণ নানারকম চেঁচামেচি করছিল, এখন একজোট হয়ে গান গাওয়া শুরু করল। ঈগলস্, গানস্ অ্যান' রোজেস্, সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল - এইসব।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওদের সঙ্গে গান গাইতে। লিরিক্স-জানা গান সামনে বসে কাউকে গাইতে দেখলেই আমার গাইতে ইচ্ছে করে। আমার ইচ্ছে করছিল, ওদের সঙ্গে বাস থেকে নেমে ওরা যেখানে যায় যেতে, ওরা যে রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খায় - সেখানে বসে ওদের সঙ্গে চাইনিজ খেতে।
আমার কাছে খরচ করার মতন টাকা বিশেষ নেই। ওদের মতন নামী কলেজ-ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি, তাও নেই। আমার নেই ঝকঝকে চেহারা, এককথায় ইমপ্রেস করার মতন ব্লু-ব্লাড। সবচেয়ে বড় সমস্যা - আমি ওদের কাউকেই চিনি না। ওরা আমায় পাত্তা দেবে কেন?
পৃথিবীতে, প্রতিমুহূর্তে, নানারকম ঘটনা ঘটে চলেছে। এইসব ঘটনার ফ্লো বদলে দেওয়ার কোন উপায়ই কি নেই?
বাসে বসেই ঠিক করলাম - যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, একজন চিত্রপরিচালক হতে হবে। একটা সিনেমা করব, তাতে এমনই একটা সিন থাকবে। তফাৎ এই, যে আমার চরিত্রে যে অভিনেতা অভিনয় করবেন, তাকে হতে হবে লম্বা-চওড়া, ফর্সা-সুন্দর। আমার ক্যারেক্টরটা হবে একজন দুরন্ত ক্লাইম্বারের, কিংবা একজন বিশ্বখ্যাত ফটো আর্টিস্ট, বা একজন ইসেন্ট্রিক ট্রাভেল রাইটারের। ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে চুপচাপ, কানে ইয়ারফোন গোঁজা জানলার-ধারে-বসে-রাস্তার-গাড়ি-দেখা মেয়েটা; সে আমার ক্যারেক্টরের দিকে গানবাজনা-হৈ-হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে তাকাবে, তাকিয়েই থাকবে।
পরক্ষণেই মনে হল - এরকম একটা সিনেমা হতেই পারে, কিন্তু সেটা আমার বায়োপিক হবে কি?
--
জায়গাটা সকলেরই পছন্দ হয়ে গেছিল। জায়গার চেয়েও বেশি, হোটেলটা।
ঝকঝকে কালো পিচের রাস্তা থেকে একটু ওপরে উঠে গিয়ে হোটেল। হোটেল থেকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি নেমে এসে রাস্তাটায় পড়েছে। রাস্তা পেরিয়ে, পাইনের পাতাঝরা আরেকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে আশ্রমের কম্পাউন্ড। প্রশস্ত কোর্টইয়ার্ড। রেলিঙের ধারে ধারে লোহার বেঞ্চ। রেলিঙের ওপারে - জীবনবীমা কম্পানির ক্যালেন্ডারের ছবির মতন হিমালয়ের প্যানোরামা। সূর্যোদয়ের সময় ভিড়ে টেকা দায়। বেলা বাড়লে ভিড় হাল্কা হয়। এক-দু'জন বসে বই পড়েন, কেউ স্কেচ করেন, কেউ কেউ ভ্যালি থেকে উঠে আসা মেঘের ফাঁকে বিখ্যাত হিমালয়ান পিকের পরিচিত শেপ খুঁজে পান।
সানরাইজ দেখে ফেরার পথে অনেকে পাইন নীডল্ কুড়োন। আমিও একসময় অনেক কুড়িয়েছি, বুকশেল্ফ সাজাবো বলে। ধুলো পড়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। পাইনবনে পড়ে থাকা পাইন নিডল্-গুলোয় কখনো ধুলো পড়ে না।
হোটেলটাও বড় সুন্দর। ঘরে কাঠের ফ্লোর, চিমনি দেওয়া ফায়ারপ্লেস। এই আমার প্রথমবার নিজের চোখে ফায়ারপ্লেস দেখা। বিট্টুদার মতন লোক, যে হোটেলে ঢুকে ব্যালকনির আগে বাথরুম চেক করে - সেও একনজরে ওক্কে করে দিয়েছিল।
আমাদের অবশ্য একদিনের থাকা। এই হোটেলেই আমাদের লম্বা ফ্যামিলি ট্যুরের শেষ পাহাড়ি রাত। কাল সকাল সকাল বেরিয়ে এখানকার একসময়ের রাজাদের তৈরি প্রাচীন মন্দির কমপ্লেক্স দেখে ফেরা।
হোটেলের একতলায় বড় বড় কাঁচের জানলাওয়ালা ডাইনিং হল। পোর্সেলিনের প্লেট, ঝকঝকে পরিষ্কার স্টিলের চামচ। অপূর্ব রুটি খেলাম। মোটা, অথচ নরম - একটু-আধটু ছাইয়ের দাগ লাগা হাতরুটি। বাড়ির বেলাদির কথা মনে পড়ল। বেলাদি লোক খুব ভাল, কিন্তু বেলাদির রুটি একদম সুবিধের নয়।
আর তো মোটে একদিন। তারপর, ফেরা।
ভোর ভোর উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। মাল গোছানোই ছিল। ব্রাশ, গরম জলে চান, ব্রেকফাস্ট করে হোটেলের বিল মিটিয়ে বাসে উঠে বসলাম। হোটেল ছাড়ার দিনের সবচেয়ে কঠিন কাজ হল বেয়ারা এড়ানো। মুখোমুখি হলেই বিশ-পঁচিশ-তিরিশ-পঞ্চাশ টাকার খরচা।
পরিষ্কার আকাশ; পরিচ্ছন্ন রোদ পাহাড়ি গাছের পরিষ্কার পাতায় পড়ে পিছলে যাচ্ছে। হু-হু করে বাস চলছিল।
দূরে পাথরের মন্দিরগুলোর চূড়ো দেখা যাচ্ছে, বাস থেকে নামবে বলে অনেকে বাসের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে কোমর ছাড়িয়ে নিচ্ছে - এমন সময় বাঁহাতের কব্জিতে হাত পড়ল। আমার ঘড়িটা!
ঘড়িটা আমার এমন কিছু প্রিয় নয়। অনেকের ঘড়ি-সংক্রান্ত নানারকম স্মৃতি থাকে। আমার সেসব নেই। মুশকিল একটাই - ঘড়িটা বেশ দামি।
বিট্টুদাকে ব্যাপারটা বলতে ও গম্ভীর হয়ে গেল। খানিক বকাঝকা, তারপর পার্সের ভেতর থেকে হোটেলের একটা কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল - বাস তো ওপথেই ফিরবে। হোটেলে একটা ফোন করে খবর নে। ঘরে ফেলে আসলে পেয়ে যাবি, হয়তো।
বাস থেকে নেমেই একটা বুথ খুঁজে ফোন লাগালাম। একটা রিং হতেই একজন ফোন তুললেন।
- হ্যাল্লো, পাইন হোটেল!
ব্যাপারটা বললাম। ম্যানেজার ঘটনা শুনে বললেন, রুম ছাড়া মাত্রই রুম ক্লিনিংয়ে চলে যায়। কোনো বেয়ারা যদি দেখতে পেয়ে তুলে রাখে, ভালো কথা। কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। ফেরার পথে যেন একবার রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে নিই।
বাসের ড্রাইভার পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড়াতে নিমরাজি হলেন।
আবার ফিরে চলা। সেই রাস্তা, সেই পাইনবন, রাস্তার ধারে সেই ছোট্ট ধাবাটা - যেখানে বাথরুম করতে নেমেছিলাম। সেই নীল আকাশ। আকাশী নীল রং বোঝাতে অনেকে স্কাই কালার শব্দটা ব্যবহার করেন। এ নিয়ে আমার একটু আপত্তি আছে। আকাশের কি একটাই রং?
মনের মধ্যে একটা চাপা উসখুশ। মনে হচ্ছিল, কতদিনের পুরোনো জায়গায় ফিরছি যেন।
বাস তখনও হোটেল পর্যন্ত পৌঁছয়নি। জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম হোটেল থেকে নেমে আসা সিঁড়ির মুখে একটা বুড়ো দাঁড়িয়ে। খুব পুরোনো, নড়বড়ে একটা বুড়ো। গায়ে রোঁয়া-ওঠা গরম কোট। মাথায় পাহাড়ি টুপি।
বুড়োকে দেখেই চিনেছি। গত রাতে ও-ই আমাদের রুটি এনে দিচ্ছিল।
বাস থামতেই নেমে বুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কথা ছিল হোটেলের রিসেপশনে খোঁজ নেওয়ার। সেটার আর দরকার পড়ল না, কারণ - বুড়ো নিজের ডানহাতটা সামনে বাড়িয়ে রেখেছে, আর সেই হাতে ধরা আমার ঘড়িটা।
বুড়োও দেখি, আমায় দেখেই চিনেছে। বিনা বাক্যব্যয়ে আমার হাতে ঘড়িটা সঁপে দিয়ে ফেরার সিঁড়ি ধরল।
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বুড়োকে দাঁড়াতে বলে পার্স বের করলাম।
চার ধাপ সিঁড়ি ওপরে দাঁড়ানো চার ফুটিয়া বুড়ো মুহূর্তের মধ্যে আমার চেয়ে অনেকটা লম্বা হয়ে গেল। বার বার মাথা নেড়ে বলতে লাগল - নহি নহি, য়ে তো মেরা ফর্জ হ্যায়...
ড্রাইভার বাসের স্টার্ট বন্ধ করেনি। আমার জন্য চারপাশটা ডিজেলের গন্ধে ভরে উঠছে, ভাবতে খারাপ লাগছিল। বুড়োর হাতে ঘড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বাসে চেপে পড়লাম। বাস ছেড়ে দিল।
জানলা দিয়ে পাইনবনের ফাঁকে আশ্রমের একচিলতে কোর্টইয়ার্ড দেখা যাচ্ছিল। পাইনের পাতাঝরা সিঁড়িটা, সেটাও একঝলক দেখতে পেলাম।
--
গল্পটা এভাবেও শেষ হতে পারত।
আসলে, তা হয়নি। এই গল্পটা তাই আমার গল্প নয়।
ঘড়িটা আমি ওই বুড়োকে দিয়ে আসিনি। ঘড়িটা এখনো আমিই পড়ি। ওই ঘড়িতে শহরের সময় দেখায়, এখনো।
তফাৎ এই, যে আমারও এখন ঘড়ি-সংক্রান্ত একটা স্মৃতি আছে।
ভাল লেগেছে।
অনেক ধন্যবাদ।