থাপ্পড় সে ডর নেহি লাগতা হ্যায় সাহিব, পেয়ার সে ডর লাগতা হ্যায়।
ব্রিগেডে বাম-কংগ্রেস-ভাইজানের জমায়েতে ওড়া একটি রামধনু পতাকাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলা বাম-সমর্থকদের আদিখ্যেতা দেখে আরেক ভাইজানের সিনেমার এই ডায়লগটা মনে পড়ল।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকে কুকথা শোনা আমাদের, মানে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা সমাজে অপ্রয়োজনীয় থেকে ক্ষতিকর, সবরকমই শোনাও হয়ে গেছে। কান ও মন, দুইই এতদিনে সয়ে যাওয়ারই কথা ছিল। তবু, মানুষের মন তো। তাই কেউ দুটো ভাল কথা বললে হৃদয় গলে যায়। শুধু প্রান্তিক যৌনতার মানুষরাই নন, যাঁরা সমাজে বা পরিবারে গৃহীত হন না, তাঁদের সবার ক্ষেত্রেই এটা হয়। দুটো মিষ্টি কথা, একবেলা বাড়ির মেঝেতে বসে মধ্যাহ্নভোজন, একটু কাঁধে হাত - তাতেই মনে হয় অনেকটা পাওয়া হল। যে রোজ থাপ্পড় খায়, সে একদিন মার না খেলেই তাকে নিজের সৌভাগ্য মনে করে। আর তার সঙ্গে যদি কেউ একটু জিজ্ঞেস করে, "কী রে, জ্বর কমল?" তাহলে তো আর কথাই নেই। মনে হয়, হাতে চাঁদ পেয়ে গেছি। আর সেই একটু পাওয়ার পর লোভ আরও বাড়তে থাকে। সম্মানের লোভ, সম মানের লোভ। সমান আসনের লোভ।
তাই যখন কংগ্রেস বা সিপিএম তাদের ২০১৪-র নির্বাচনী ইস্তেহারে এলজিবিটিকিউ মানুষদের কথা প্রথমবার লেখে, মনে আশা বাড়ে। মনে হয়, যাক এবার হয় তো আমাদের কথা বলার লোক পাওয়া গেল। একথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে যে তারপর থেকে এই দুই পার্টিই কিন্তু বিভিন্ন মঞ্চে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সমানাধিকারের কথা ক্রমান্বয়ে বলে গেছে। শুধু নেতাদের ব্যক্তিগত মতামতই নয়, এই দুই পার্টির অবস্থান এ বিষয়ে খুব পরিষ্কার ও জোরালো। ধারা ৩৭৭ বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ২০১৮-র ঐতিহাসিক রায়ের পর এই দুই দলই প্রকাশ্যে ও সোচ্চারে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এদিক-ওদিক থেকে নয়, রীতিমত কেন্দ্রীয় স্তর থেকে পাশে থাকার, পাশে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এই আবহে বাম-কংগ্রেস যখন আব্বাস সিদ্দিকির মত একজন কট্টর পিতৃতন্ত্রের হোতার সাথে হাত মেলাল, তখন কিছু ভ্রূ-কুঞ্চন স্বাভাবিক। হ্যাঁ, আমি অন্তত এখনও অবধি আব্বাসের মুখে কোনও এলজিবিটি বিরোধী কথা শুনি নি বটে, কিন্তু পিতৃতন্ত্র আর হোমোফোবিয়া যে হাত ধরাধরি করে চলে, এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। যে ভয়ানক পিতৃতান্ত্রিক, সে যৌনতা প্রসঙ্গে মৌলবাদী হবে না, এটা ভাবা কষ্টকর। তা বাদ দিয়েও আব্বাসের আরও কিছু চূড়ান্ত রক্ষণশীল কথাবার্তা চিন্তায় ফেলার জন্য যথেষ্ট।
আমাদের সমস্যা হল, আমাদের যাওয়ার আর কোনও জায়গা নেই। বিজেপি-আরএসএসের চূড়ান্ত গোঁড়ামি ও মৌলবাদের উল্টোদিকে আমাদের আশার জায়গা ছিল সিপিএম-কংগ্রেস। বহু বছরের হতচ্ছেদ্দার পর একটু ভালবাসায়, একটু ভাল কথায় মন দ্রব হয়েছিল। তাই এদের বিচ্যুতি দেখলে কষ্টটা আরও বেশি হয়। আরও বেশি হতাশ লাগে। এবং ভয় লাগে।
ভয় কেন লাগে বুঝতে হলে বাংলাদেশের দিকে তাকাতে হবে। যাঁরা বাংলাদেশের এলজিবিটি সমাজের কিছু মাত্র খবর রাখেন, তাঁরা জানেন গত কয়েক বছরে কীভাবে প্রতিনিয়ত ইসলামিক মৌলবাদীদের হাতে ওদেশের সমকামী ও যুক্তিবাদী মানুষদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়ে চলেছে। এমনই অবস্থা যে প্রাণের ভয়ে অনেকে স্বনামে ফেসবুক পর্যন্ত করতে পারেন না। ঘরপোড়া গরু, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় লাগে। দু-পাঁচ লক্ষের সমাবেশে দুটো রেনবো ফ্ল্যাগ দেখিয়ে সে ভয় কাটবে না।
সিপিএম সমর্থকরা মুখে বলছে বটে যে আব্বাসকে কোনওরকম কট্টর গোঁড়া অবস্থান তারা নিতে দেবে না, কিন্তু বোতলের জিন একবার বেরিয়ে গেলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তো? ঠিক কিসের জোরে তারা বলছে যে অন্য একটি স্বাধীন দলের ওপর তাদের কোনওরকম নিয়ন্ত্রণ থাকবে?
তবে আব্বাস বা অন্য কেউ বাহ্য। তার থেকেও বড় প্রশ্ন একটা মনে ওঠে। এই যে বিভিন্ন দল এলজিবিটিকিউদের নিয়ে কথা বলে, তারা নিজেরা কতটা আন্তরিক? আপনি বলতেই পারেন, খেতে পেলে শুতে চায়। রাজনৈতিক সমাবেশে খান দুই রামধনু পতাকা ওড়াতে দিয়েছি, একজন বক্তা এলজিবিটিকিউদের জন্য একটা বাক্য বলেছেন, এই না কত। এটুকুই বা কে করে? সে আপনি বলতেই পারেন। বলার হক আছে। সত্যিই তো এটুকুই বা কে করে। তবে ওই যে বললাম, সত্তর বছর ধরে লাঠি-ঝাঁটা খেয়ে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। দুটো ভাল কথা বলে প্রত্যাশা আপনারাই বাড়িয়েছেন। তাই ব্রিগেডে মিটিং-এর পর কিছু বাম সমর্থকদের কথা হতাশা জাগাল। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
একজন বললেন, আব্বাস যদি এলজিবিটিকিউ বিরোধী হন তাতে কী অসুবিধে আছে? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তো সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার বিরোধী। তাহলে কি এবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই মান্য বলে ধরতে হবে? তাহলে তো আর কোনও কথাই থাকে না। তাহলে তো আরএসএসের মুসলিম বিদ্বেষ নিয়েও কিছু বলার থাকে না। বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে সিএএ অবধি, কিছুই বলার থাকে না। জয় শ্রী সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে পাশ ফিরে ঘুমোনো যায়।
আরেকজন বাম সমর্থক আবার সেই এক খানা রেনবো ফ্ল্যাগের ছবি দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন বাম-কং-আব্বাস জোট কতটা প্রগতিশীল। তিনিই আবার দেখলাম অন্যত্র লিখেছেন, “আব্বাসের সমকামিতা নিয়ে কী মতামত তাতে কী এসে গেল। আব্বাসের সঙ্গে জোট হবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরির মত ইস্যুতে।” অর্থাৎ, এলজিবিটিকিউদের ইস্যুটা ভোটের বাজারে বিশেষ কিছু সুবিধার নয়। তেমন গুরুত্বপূর্ণ তো নয়ই।
মজাটা এইখানেই। অনেকের চোখেই সাম্য একটা তত্ত্বকথা মাত্র। কোনও মৌলিক ইস্যু নয়। তাই ক্যাটক্যাটে অপরায়ন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করলেও সেটা নজরে পড়ে না। তাই খান কতক রেনবো ফ্ল্যাগ ব্রিগেড জায়গা পেলেও এলজিবিটিকিউ মানুষজনদের জন্য বরাদ্দ একজন বক্তার মাত্র একটি বাক্য। তাতেই প্রগতিশীলতা রক্ষা পেল। অথচ দুদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার সমলিঙ্গে বিয়ের অধিকার প্রসঙ্গে একটি অতি পশ্চাৎমুখী হলফনামা শীর্ষ আদালতে জমা দিয়েছে। সত্যিই যদি কেউ সাম্যের কথা ভাবত, তাহলে এই ইস্যুতেই মোদী সরকারকে ছিঁড়ে খেত। কিন্তু সে প্রসঙ্গে একটি টুঁ শব্দও খরচ হল না।
হবেই বা কেন। এলজিবিটিকিউ গ্রুপ এমনিতেই সংখ্যায় কম। তার ওপর যেমন আরেকজন বাম সমর্থক বললেন, ক্যুইয়ার মানুষজন অনেকেই বিজেপির সমর্থক। তাহলে তারা বামেদের থেকে সাহায্য আশা করে কেন? অর্থাৎ, পিডিপি বিজেপির সাথে সখ্য করেছিল বলে কাশ্মীর ইস্যুতে অ-দক্ষিণপন্থী মানুষরা কথা বলবেন না, বিজেপিতে এক দুজন মুসলিম মন্ত্রী আছেন বলে, জঙ্গি হিন্দু গোষ্ঠীর হাতে আকলাখ খুন হলে কিছু বলা যাবে না। কেন না, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়কে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেতে হলে, আগে মনোলিথিক হয়ে সেই দলকে সমর্থন করতে হবে।
এটাই কি দাবি? নীতি-সাম্য-বোধ সব ভাঁওতা? কুরুসভায় একমাত্র সত্য কার পাশা বেশি অনুগত?
তাই বলছিলাম, থাপ্পড়কে যত না ভয় লাগে, তার থেকে বেশি ভয় লাগে এই হিসেব কষা ভালবাসাকে। থাপ্পড় গালে লাগে, অপমান মনে।
আর কে না জানে, টোকেনিজম কখনও কখনও আরও বেশি অপমানের হয়।
লজ্জিত বোধ করছি, নিজেকে জিজ্ঞেস করি--- যদি আমার একটি সন্তান এলজিবিটি হত, আমি কী করতাম। পিতা হিসেবে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য কতটুকু বা কীভাবে রুখে দাঁড়াতাম?
রঞ্জন রায়ের মন্তব্য কি পিতৃতন্ত্রের প্রতিফলক?
না।
রঞ্জন রায়ের মন্তব্য কি পিতৃতন্ত্রের প্রতিফলক?
রামধনু পতাকাগুলো ব্রিগেডের মাঠেই ছিল, স্টেজে ওঠার কোনো সুযোগ পায়নি। স্টেজটা তার দখলে ছিল যে অভিনয়কে দেহব্যবসা বলে, শিল্পীদের হত্যা সমর্থন করে, আর মেয়েদের গাছে বেঁধে পেটানোর কথা বলে।
কর্ণাটকে অন্ততঃ কংগ্রেস অক্কাই পদ্মশালীকে নেতার সম্মানটুকু দেয়। আর মহারাষ্ট্রে ncpর lgbt cell আছে। উত্তর প্রদেশে একটা টোকেন রেনবো মেট্রো স্টেশনও তৈরি হয়েছে।
যথাযত বিশ্লেষন।
এত ভাবি নি। তবে তৃতীয় লিঙ্গের সন্তান জন্মালে বোধহয় অধিকাংশ বাবা মা হাসপাতালে ছেড়ে আসেন। আমি নিশ্চিত যে সেরকম পরিস্থিতিতে ছেড়ে আসতাম না। ডাউন সিন্ডিকেটের বাচ্চার ও যত্ন ভালোবাসার ত্রুটি করতাম না। কিন্ত ঘরেবাইরে প্রতিনিয়ত লড়াই করা?
ভাবতে গিয়ে ভয় পেলাম, তাই লজ্জিত।
কিন্ত ছোটবাচ্চার সুরক্ষার ও সম্মানের দায়িত্ব কি বাবা মার নয়? এই ভাবনা দুর্বলের। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের কি? একটু ধরিয়ে দিন।
আপনার লেখন শৈলীর অনেক উন্নতি হয়েছে বস্টনযুগের থেকে -অনেক ফোকাসড আর স্ট্রাকচার্ড। এটুকুই বলতে এলাম :)
'এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়কে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেতে হলে, আগে মনোলিথিক হয়ে সেই দলকে সমর্থন করতে হবে'
- এটা সত্যি হলে, খুবই দুঃখের কথা :-(
ব্রিগেডে কিছু রামধনু পতাকা দেখে ভাল লেগেছিল, কিঞ্চিৎ আশারও সঞ্চার হয়েছিল
"আরেকজন বাম সমর্থক আবার সেই এক খানা রেনবো ফ্ল্যাগের ছবি দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন বাম-কং-আব্বাস জোট কতটা প্রগতিশীল। তিনিই আবার দেখলাম অন্যত্র লিখেছেন, “আব্বাসের সমকামিতা নিয়ে কী মতামত তাতে কী এসে গেল। আব্বাসের সঙ্গে জোট হবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরির মত ইস্যুতে।” অর্থাৎ, এলজিবিটিকিউদের ইস্যুটা ভোটের বাজারে বিশেষ কিছু সুবিধার নয়। তেমন গুরুত্বপূর্ণ তো নয়ই।"
এদের কাছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখলই মূল চিন্তা, প্রান্তজনের অধিকার এরা আদৌ বোঝেন না, তাই চানও না। আর মূল কারণ - ভয় (৩), পাছে, (সংখ্যাগুরুর) ভোট নষ্ট হয়!