ফেসবুকে যেমন হয়ে থাকে, সেদিন কথাপ্রসঙ্গে লেগে গেল তর্ক। বিপক্ষের ভদ্রলোক বেশ বিদ্বান ব্যক্তি, একসময়ে আমাকে বললেন 'আপনি তো মার্কস পড়েছেন, এটা জানেন না'? এবারে 'সেটা' আমি সত্যিই জানতাম না ফলে বলতে বাধ্য হলাম যে আমি মার্কস পড়েছি ইনডিরেক্টলি। তাই আমি 'এটা' জানিনা। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন 'ইনডিরেক্ট পড়া'টা কী বস্তু? তাতে আমি তেনার অজ্ঞতা নিয়ে একটু খিল্লি করায় (করব না বলুন? ছাড়া যায়?) তিনি রেগে গিয়ে তর্ক ছেড়ে চলে গেলেন। আমিও মান বাঁচিয়ে সংগৃহিত ব্রাউনি পয়েন্টের ঝোলা দোলাতে দোলাতে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপাবার প্রস্তুতি নিলাম। একজন ফেবু বীর এবং অক্লান্ত যোদ্ধা হিসাবে এ আমার কর্তব্য।
এখন প্রশ্ন হল আপনারা কি জানেন এই ইনডিরেক্ট পড়া ব্যপারটা ঠিক কি? জানেন হয়তো, কিন্তু কলম যেহেতু আমার হাতে, নেট আমার, গিগাবাইট আমার, অতএব আমার ধরে নেওয়া কর্তব্য যে আপনারা কিসুই জানেন না। আমি না জানালে জানবেনও না। কারণ আমিই সে - সো অহম। অহম ব্রহ্মাস্মি। অতএব হে অর্জুন, শ্রবণ করো -
পড়াশুনা যারা টুকটাক করেছেন, তারা অনুভব করেছেন যে ইহা মূলতঃ দুই প্রকার - ডিরেক্ট রিডিং এবং ইনডিরেক্ট রিডিং। ডিরেক্ট রিডিং অর্থাৎ যে বই আমি নিজে পড়েছি এবং তা থেকে জ্ঞান আহরণ করেছি। যেমন শার্লক হোমস অমনিবাস, দা ভিঞ্চি কোড ইত্যাদি। ইনডিরেক্ট রিডিং অর্থাৎ যা আমি নিজে পড়িনি কিন্তু আমার বন্ধুরা পড়েছে বা পড়েছেন, তা থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং সেই লব্ধ জ্ঞান ইতিউতি বিতরণ করেছেন এবং আমি সেই বিতরিত জ্ঞান আহরণ করে বইটির মূল বিষয়বস্তু এবং বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্বন্ধে জেনেছি। যেমন বোদলেয়ারের দর্শন, দান্তের কাব্য ইত্যাদি। জ্ঞান আহরণের এই দুটি সর্বজনমান্য পদ্ধতিকে আদি যুগে স্মৃতি ও শ্রুতি নামে অভিহিত করা হত।
এখন এই দুই পদ্ধতির তুলনামূলক আলোচনায় ঢোকার আগে একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। ধরুন সেদিন যা নিয়ে তর্ক হচ্ছিল - মার্কস। আমার অনেক বন্ধু ডাইরেক্ট মার্কস পড়ে জেনেছেন মার্কস কী বলেছেন। আমি তাদের কাছ থেকে ইনডাইরেক্ট পড়ে জেনেছি মার্কস কী বলেছেন। এই দুইএর মধ্যে তফাৎ অবশ্যই আছে, তা পরে আলোচিত হবে, কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে এফেক্টিভলি তেমন কোন তফাৎ নেই। যেমন ধরুন আমার বন্ধুবর্গ এবং আমি উভয়েই জানি মার্কস কিভাবে শিল্প বিপ্লব কালীন এবং তার পূর্ববর্তী সময়ের অর্থনীতিকে একজন শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিয়েছেন, অর্থনীতির বৈষম্য দেখাতে গিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন, শ্রেণী বৈষম্য থেকে শ্রেণী সংগ্রামএর প্রসঙ্গে এসেছেন। বুর্জোয়া কারা, প্রলেতারিয়েত কারা, দ্বন্দ্ব কী ইত্যাদি ব্যখ্যা করেছেন, দ্বন্দ্ব থেকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন, বস্তুবাদের তত্ত্ব দিয়েছেন। আবার এগুলি সবই যে মার্কস সাহেবের মৌলিক চিন্তা নয়, হেগেল, এঙ্গেলস ইত্যাদিদেরও ধর্তব্যে রাখতে হবে এ ও আমরা (অর্থাৎ ডিরেক্ট ও ইনডিরেক্ট রিডারেরা) জানি। ফলে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হব তখন বিপক্ষ বুঝতেই পারবে না আমার বিমান রাফাল বানিয়েছে নাকি হ্যাল।
কিন্তু তাই বলে কি কোনই ফারাক নেই? আছে তো অবশ্যই। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা এই দুই ধরণের পাঠের সুবিধা এবং অসুবিধাগুলি নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করব। মনে রাখবেন আমরা জাজমেন্টাল হতে চাই না কারণ আমরা নীতিপুলিশ নই - কাজেই এদের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠতর তা নির্ধারণ করা আমাদের স্কোপের মধ্যে পড়ে না। আমরা শুধু নির্মোহ ভাবে সুবিধা এবং অসুবিধাগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করব। আপনার পাঠাভ্যাস আপনার চয়েস - তাকে প্রভাবিত করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।
যেহেতু ডাবল খাটুনির কোন মানে হয়না, আমরা চর্বিতচর্বন বাদ দিয়ে দেখাতে পারি যে ডিরেক্ট রিডিং এর যা সুবিধা তা-ই ইনডিরেক্ট রিডিং এর অসুবিধা - এবং ভাইসি ভার্সা। অতএব শুরু করা যাক ডিরেক্ট রিডিং এর সুবিধা এবং ইনডিরেক্ট রিডিং এর অসুবিধা নিয়ে। ডিরেক্ট রিডারের সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে তার আহরিত জ্ঞানটি ফার্স্ট হ্যান্ড এবং অন্তত তার নিজস্ব চেতনার নিরীখে সম্পূর্ণ। ফলে এই জ্ঞানের সম্পূর্ণ বা আংশিক গ্রহন এবং বর্জনের চয়েস পাঠকের থাকে। উল্টোদিকে ইনডিরেক্ট রিডারের ক্ষেত্রে আহরিত জ্ঞানটি সেকেন্ড হ্যান্ড এবং স্বাভাবিকভাবেই তার মিডিয়াম, অর্থাৎ যার ডিরেক্ট রিডিং এর ফল তিনি নিচ্ছেন তার ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে তার গ্রহন বা বর্জনের চয়েস কমে যাবার আশঙ্কা প্রবল। কারণ আমাদের উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক, মার্কস সাহেব তাঁর লেখায় মোট পঞ্চাশটি তত্ত্বের অবতারণা বা আলোচনা করেছেন (হাইপোথিসিস)। এখন আমাদের ডিরেক্ট রিডার এই পঞ্চাশটি তত্ত্বই পড়েছেন, কিন্তু তিনি এর মধ্যে পনেরোটিকে মনে করেছেন বর্তমান সময়ের নিরীখে বা তাঁর আঞ্চলিক বাস্তবতার নিরীখে অচল অথবা ত্যাজ্য। ফলতঃ তাঁর বিতরিত জ্ঞানে পঁয়ত্রিশটি তত্ত্বের অবতারণা থাকলেও বাকি পনেরোটি সম্বন্ধে তিনি নীরব। অতএব ইনডিরেক্ট পাঠকের হাতে পড়ে থাকল মাত্র পঁয়ত্রিশটি তত্ত্ব - বাকি পনেরোটি তত্ত্বের অস্তিত্ত্বই তাঁর জ্ঞানের পরিধির বাইরে থেকে গেল (যেমনটা আমার সাথে হয়েছিল আর কি)।
তবে ইনডিরেক্ট পাঠকের পক্ষে এই অসুবিধা দূর করার একটি উপায় অবশ্যই আছে - সেটি হল একই বিষয়ে মিডিয়ামের সংখ্যা বাড়ানো। মার্কস পড়েছেন এমন একজনকেই মুরুব্বি না ধরে আপনি যদি একাধিক, অন্তত তিন থেকে চারজন ডিরেক্ট পাঠককে ফলো করেন, তাহলে প্রোব্যাবিলিটি বলে আপনি পঞ্চাশটি তত্ত্বই জেনে যাবেন কোন না কোন সূত্রে। "বাহির হইতে পরিকল্পিত কাঠি না করিলে মিডিয়ামের সংখ্যা এবং আপনার চয়েসের সংখ্যা সমানুপাতিক হারে বাড়ে" (রৌহিনের প্রথম সূত্র)। যদিও এইভাবে চয়েস বাড়ানো গেলেও একটি অসুবিধা থেকেই যায় - তাকে "৫১ নম্বর চয়েস কনফিউশন" সূত্র বলা হয়। অনেকে একে শ্রয়ডিঙ্গারের বেড়ালও বলে থাকেন। এই সূত্র অনুযায়ী কার্যত ইনডিরেক্ট পাঠক চয়েস বাড়াতে বাড়াতে পঞ্চাশটি তত্ত্ব জেনে গেলেও তিনি কোনদিনই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন না একান্ন নম্বর তত্ত্বটির অস্তিত্ব বিষয়ে। ডিরেক্ট পাঠকের এই কনফিউশন নেই। তিনি জানেন একান্ন নম্বর তত্ত্ব বলে কিছু নেই। কিন্তু ইনডিরেক্ট পাঠক সর্বদাই অস্বস্তিতে ভোগেন কারণ একান্ন নম্বর তত্ত্ব আছে না নেই তিনি জানেন না।
এবারে আসা যাক ইনডিরেক্ট পাঠের সুবিধা তথা ডিরেক্ট পাঠের অসুবিধায়। ধরুন ডাস ক্যাপিটাল। অত্যন্ত খটোমটো একটি বই যা জার্মান ভাষায় লেখা। অর্থাৎ আপনি ভাষাটি না জানলে আপনাকে অনুবাদ পড়তে হবে (সত্যি বলতে কি "সহজে জার্মান শিখুন" কোর্স করে থাকলেও আপনাকে অনুবাদই পড়তে হবে) - অর্থাৎ খটোমটো ইনটু টু। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে এই ধরণের বই খুব ভাল ঘুমের ওষুধ - অধিকাংশ ক্ষেত্রে আধপাতা বা এক পাতাই যথেষ্ট। ক্রণিক ইনসমনিয়ার রোগীদের তাই ডিরেক্ট রিডিং এর পরামর্শ দিয়ে থাকেন বহু মনোবিদ। এবারে এই রেটে এগোলে ডাস ক্যাপিটাল শেষ করতে কতদিন লাগতে পারে তা নির্ণয় করার জন্য নিশ্চই আইনস্টাইনকে লাগবে না। জীবন সীমিত, জ্ঞান অসীম। এখানে নুড়ি কুড়ানোর প্রশ্নে ইনডিরেক্ট পাঠকের হাতে চয়েস অনেক বেশী। সবচেয়ে বড় কথা ডিরেক্ট পাঠকের কাছে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার মত কোন সর্বজনগ্রাহ্য বিকল্প পথ নেই। বামফ্রন্টের বিকল্প যেমন উন্নততর বামফ্রন্ট তেমনি হার্ড ওয়ার্কের বিকল্প হার্ডার ওয়ার্ক। ৩৪ বছর পরে কেউই টেঁকে না।
বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং লেখার চলন অত্যন্ত সুন্দর। জটিল বিষয়কে বেশ হাস্যরস দিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে যাতে গিলতে সুবিধে হয়। আমি গিলতে শব্দটাই ব্যবাহার করলাম, কারন যুক্তি যেসব লেহার বা কথার সাথে যুক্ত থাকে, তাকে সাধারণত গিলতে হয়।
কিন্তু কোথাও কোথাও লেখাটা খেই হারিয়ে ফেলেছে। বিষয়বস্তু থেকে সরে গিয়ে অন্য বিষয়ের অবতারনা একটু বেশি দেখা গেলো। শ্রী রৌহিন ব্যানার্জী উচ্চমানের লেখক। আশা রাখছি, আরো ভালো লেখা পাবো।
ভালো লাগলো।
অনেক সত্যি কথা সহজ করে বলা ভালো লাগলো
দারুন লাগলো লেখাটা।
আরেকটু বিস্তারিত হলে ভালো লাগত।
ভালো বিষয় ত! মদ্যিখেনে এসে এরম, যাহ সব বাদাম ফুরিয়ে গ্যালো, ক্যানো? না কী পরের কিস্তি আসচে..
@একক পরের কিস্তি আসবে কি না জানিনা - এটা একটা ইম্পালসিভ লেখা। সেই মুডটা আবার পেলে আরেক কিস্তি লিখব হয়তো, নাহলে নয় - এটা এখনো আমি জানিনা।
@ রৌহিন, বেশ তাই হোক। লেখার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটার আরো ভেতরে ঢুকলে, আদউ ডিরেক্ট রিডিং বলে কিচু হয় কী না, সেই সংশয় ও তুলে ফেলা যায়। টেক্সট কীভাবে ক্যারিয়ার কে ধরে ধরে পাল্টায় সে ত মজার জগত। আর, আমরা যারা এব্রাহামিক মন্ত্র দরশনের উল্টো দিক্টাও দেক্তে চাই , তাদের কাছে, এ অতি জরুরি পোশনো ।
স্মৃতি ও শ্রুতির তফাতটা তরল করে পরিবেশনের যে উদ্যোগ লেখাটায় আচে তাকে খন্ডন করার দরকার দেকচি না, বাট ওই আর কী, লেখকের কাচে আব্দার ঃ আরও এগিয়ে খোঁজা চলুক। ☺
শেষ দিকে এসে রাস্তা গুলিয়ে গেল যেন । তবে এমন রসকষহীন বিষয়কে এমন উপাদেয় ও সহজপাচ্য করে তোলার জন্য শ্রী রৌহিনকে ধন্যবাদ ।
@একক - লোভ দেখাচ্ছেন। উৎসাহিত হচ্ছি। ভবিষ্যতে এটা আমার একার প্রোজেক্ট না হয়ে যৌথ হলেই বা আপত্তি কী?
@টিম - এই লেখাটায় হোয়া ইউনিভার্সিটি আসতেই পারত - আরো অনেক কিছুই। আসলে এখন নিজেরই মনে হচ্ছে শেষাংশটুকু কেমন হুট করে শেষ হয়ে গেছে, অনেক বিষয়ে ঢোকাই হয়নি। কৈফিয়ৎ একটাই - এই লেখাটা প্রায় এক দমে লেখা, একটা বিশেষ মানসিক অবস্থায়, ফলে সেই ফ্লো যতক্ষণ ছিল ততক্ষণই লিখেছি। কিন্তু ওপরের সব মন্তব্যগুলি পড়ে এবং নিজের লেখাটাও আবার পড়ে মবে হয়েছে এই লেখাটায় আরো কিছু স্কোপ আনএক্সপ্লোরড থেকে গেছে - এমনকি আলোচিত বিষয়গুলিও আরো মনোযোগ দাবী করে। পারব কিনা জানিনা কিন্তু এটার ওপর ভিত্তি করে একটা বড় লেখা নামানোর ইচ্ছে রইল। সেটা যৌথ লেখা হলেও আপত্তি নেই।
@সাহানা দি, দীপালোক বাবু, সঞ্জয় (দেবা) এবং বাকি সকলকে - তোমাদেরও একই কথা বলি - চেষ্টা করছি আরো বড় করে গুছিয়ে লেখার - কোন সময়সীমা দিচ্ছি না