গাঙ পার হইয়া আর হাঁটে না লক্ষ্মণ; সীতা জিগায়- থামলা ক্যান?
কথার উত্তর এড়ায়া লক্ষ্মণ হাত উঠায়- ওই যে গরুগুলা চরতেছে; তার পিছনেই বাল্মিকীর গ্রাম; গ্রামের উত্তর সীমানা বরাবর ঋষির আশ্রম…
পানিনামা পায়ে নদীর পাড় বাইয়া উঠতে পোয়াতি সীতার বহুত হয়রানি গেছে। বাম হাতে মাজা ঠেকায়া বাম পায়ে শইলের ভর ঢাইলা ডান পা টানায়া ফোলা তলপেটের উপর ডান হাত বিছায়া ক্লান্তি আর বিরক্তি একলগে ঝাড়ে সীতা- এই রইদের মইদ্যে খাড়ায়া ভূগোল পড়াইতেছ ক্যান?
লক্ষ্মণ হাত-চোখ নামায়া ডানে-বামে ডান পা ঘুরায়া নির্ঘাস মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকে। সীতা কপাল কুচকায়- পোয়াতি আমি আর অবস্থা দেইখা মনে হইতেছে পা ভারি হইছে তোমার…
লক্ষ্মণ হাঁটেও না; দেখেও না; কথাও কয় না। কারিগরি বদলায়া এইবার সে উপর-নিচ পা ঘইসা আগে আঁকা মাটির দাগটা মোছায় মনযোগ দেয়। সীতা চিল্লায়- এইখানে খাড়ায়া থাকার মানেটা একটু বুঝায়া বলবা?
লক্ষ্মণ এক ঝটকায় সীতার দিকে তাকায়া আবার মুখ নামায়। এইবার সে ছোট ছোট লাত্থি দিয়া শুকনা মাটিতে একটা নালা বানাইতে থাকে…
সীতার বিরক্তি বিস্ময়ে বদলায়। সে লক্ষ্মণের মুখ দেখার চেষ্টা করে; পেটানো তামার মতো কালো মুখটা গভীর গম্ভীর। চোখগুলা প্রায় বন্ধ করার মতো নিচের দিকে নামানো। লক্ষ্মণরে খুঁটায়া দেইখা সীতা প্রায় আর্তনাদ করে- তুমি কানতেছ ক্যান?
লক্ষ্মণরে সীতা চিনে। মালবাহী মুটে থাইকা মন্ত্রীর কাম পর্যন্ত করতে দেখছে তারে। যখন তার ভিতরে অল্প কথা থাকে তখন তার সবই সে অন্যরে শোনায়া দেয়। কিন্তু যখন বলার মতো বেশি কথা জমে তখন সব কথাই বন্ধ রাখে লক্ষ্মণ…
লক্ষ্মণরে তার মাটিকাম করতে দিয়া এইবার ডান হাতে মাজা ঠেকায়া ডান পায়ে শইলের ভার নিয়া বাম পায়েরে বিশ্রাম দিয়া বাম হাতে কপালের ঘাম মুইছা কিছু হিসাব সীতা নিজেই মিলায়া নেয়…
নদী পার হইতে নৌকায় উঠার আগেও তাইলে নিশ্চিত কানতেছিল লক্ষ্মণ। চোখে কী জানি কী পড়ছে কইয়া মুখ ধুইয়া চোখের পানি লুকাইয়া ফেলায় আর সীতার চোখে পড়ে নাই…
লক্ষ্মণের লগে অযোধ্যা থাইকা সে বাইর হইছে গত কাইল ভোরে। লক্ষ্মণরে একবারো স্বাভাবিক দেখা যায় নাই। পুরাটাই আছিল গম্ভীর। নিজেই নিজের পোয়াতি যন্ত্রণায় অস্থির সীতা সেইটা নিয়া ভাবেও নাই। ভাবছে হঠাৎ কইরা পাওয়া রাজকীয় দায়িত্বের চাপে চ্যাপ্টায়া যাইতে যাইতে গোমড়াভাবের অধিকারী হইছে লক্ষ্মণ…
রাজা হইবার কালে লক্ষ্মণ ছাড়া অযোধ্যায় রামের নিজের পক্ষের মানুষ বলতে আর আছিল না কেউ। এখনো কারা পক্ষে আর কারা বিপক্ষে সেই সমীকরণ মিলাইতে পারে নাই রাম। ফলে লক্ষ্মণের উপর চাপের পরিমাণটা আসলেই বেশি। রাম তারে দিয়া মন্ত্রী-সেনাপতির কাম যেমন করায়; তেমনি দেহরক্ষী আর গৃহসহকারীর পুরানা কাম থাইকাও তারে মুক্তিও দেয় নাই…
রইদ বাঁচাইতে সীতা একটা গাছের তলায় গিয়া দুই হাতে পিছন থাইকা মাজা ঠেস দিয়া দুই পায়ে সমান ভর দিয়া খাড়ায়। লক্ষ্মণ একবার তার দিকে তাকাইলেও জায়গা থাইকা নড়ে না। কোমারে দুই হাত রাইখা একমনে বাল্মিকীর গ্রামের পশে গুরুর ঘাস খাওয়া দেখে। সীতার দাঁড়াইতে কষ্ট হয়। পিঠ বাইর করা একটা মোটা শিকড়ের উপর বইসা সে পা দুইটা সামনে ছড়ায়া দেয়…
এইবার লক্ষ্মণ নড়ে; শরীর টাইনা খাড়ায় গাছতলায়। কিন্তু ছায়ার ভিতর ঢোকে না সে। রইদে দাঁড়ায়া সীতার দিকে একবার তাকায়া আবার মুখ নিচা করে। সীতা লক্ষ্মণের দিকে তাকায়- রইদে খাড়াইলে কি দুঃখ শুকাইব? ছায়ায় আসো…
লক্ষ্মণ নড়ে না। কয়- এইটা বাল্মিকীর গ্রাম বৌদি…
- হ। সেই ভূগোল তো আগেই পড়াইছ। এখন কি ইতিহাস বলবা?
লক্ষ্মণ আবার মুখ ঘুরায়া গরুচরা দেখে। তারপর আধমরা চোখ তুইলা সীতার দিকে তাকায়- আমারে ফিরতে হবে বৌদি…
- আমি কি থাকার লাইগা আসছি?
লক্ষ্মণ চোখ নামায়- না মানে… আমি আশ্রমে যাব না…
- আশ্রমে যাবা না। ক্যান? ঋষির লগে তোমার কোনো গ্যাঞ্জাম আছে নাকি?
- না না না। উনার লগে আমার আবার কীসের গ্যাঞ্জাম? উনি আমারে খুবই স্নেহ করেন…
- তাইলে আশ্রমে যাবা না ক্যান? রাজায় না তোমারে দায়িত্ব দিলেন আমারে আশ্রম দেখায়া নিতে?
লক্ষ্মণ আমতা আমতা করে- রাজায়ই আমারে বলছেন গাঙপাড় থাইকা ফিরতে…
সীতা অবাক হয়- কী আবোল তাবোল কথা কও। আইলাম বাল্মিকীর আশ্রমে। এখন দূর থাইকা তিনার গ্রাম দেইখা ফিরব? এইটা কেমন কথা?
লক্ষ্মণ মাটির লগে কথা কয়- তুমি আশ্রমেই যাবে। আমারে ফিরতে হবে অযোধ্যায়…
- এইটা কী জাতের ফাইজলামি? আমি কি একলা একলা ফিরব?
- না বৌদি। তুমি আর ফিরবা না। রাজার আদেশে তোমারে এইখানে ফালায়া যাইতেছি আমি….
সীতা পা গুটায়া ভাঁজ করা হাঁটু দুইটার মাঝখানে থুতনি নামায়া লক্ষ্মণরে দেখে। লক্ষ্মণ আর কিছু কয় না। সে ঘাড় ঘুরায়া গরুগুলার পাশে দুইটা রাখাল বাচ্চার মারামারি দেখে…
পরশু রাত্তিরে সীতা রামরে বলছিল বাচ্চা জন্মের আগে সে ঋষিদের আশ্রমে গিয়া কিছু দানদক্ষিণা কইরা শিশুর লাইগা আশীর্বাদ নিয়া আসতে চায়। একবাক্যে রাজি হইয়া রাম বলছিল- লক্ষ্মণ তোমারে নিয়া যাবে। সেই হিসাবে গতকাইল ভোরে শ্বশুরের সারথি সুমন্ত্রর রথে লক্ষ্মণরে নিয়া সে অযোধ্যা ছাড়ছিল…
পথে ছোটখাটো কিছু আশ্রম দেখার পর গোমতী তিরের এক আশ্রমে গত রাইত কাটানোর পর বাল্মিকীর আশ্রমের উদ্দেশ্যে আইজ দুপুরে তাগোরে গঙ্গার এই জংলি ধারে আইনা নামাইছে সুমন্ত্র। নদীর এই পাশে রথ পার করার মতো বড়ো নৌকা নাই। তাই সুমন্ত্র ওইপাশে থাইকা গেছে। নিষাদগো ছোট একটা নৌকায় পার হইয়া এই তীরে আইসা উঠছে লক্ষ্মণ আর সীতা…
এইপাশে ঋষি বাল্মিকীর গ্রাম। আজকের রাইত বাল্মিকীর আশ্রমে থাইকা আগামী কাইল ফিরার কথা ছিল অযোধ্যায়…
লক্ষ্মণ খাড়ায়া আছে। সীতার গলায় মমতা- কী হইতেছে আমারে একটু খুইলা বলবা লক্ষ্মণ?
লক্ষ্মণ এইবারও কথা কয় মাটির লগে- রাজা রাম তোমারে ত্যাগ করছেন বৌদি। আমারে বলছেন তোমারে রাজ্যের বাইরে ফালায়া আসতে…
ঠাঠা কইরা হাইসা উঠে সীতা। হাসতে গিয়া তার পিঠের পেশীতে টান খায়। কষ্টে মুখটা কিঞ্চিত বিকৃত কইরা দুই হাত পিছনে নিয়া সে টানখাওয়া পেশী মালিশ দিয়া আরাম পায়। তারপর হাত দুইটা দিয়া পিছন দিকে মাজার উপরে মালিশ দিতে দিতে সে শব্দ ছাড়া হাসে- এই জিনিসের লাইগা তুমি মুখ ভার কইরা আছ? তোমার ভাই এই নিয়া কয়বার আমারে ত্যাগ করার কথা বলছে খেয়াল আছে তোমার? এইগুলা এখন তার অভ্যাসের অংশ…
পিছনের মাটিতে হাতের ভর দিয়া সীতা উইঠা খাড়ায়- লও যাই। ঋষিরে প্রণাম কইরা কাইল বাড়ি গিয়া তোমার ভাইর লগে কথা বলা যাবে। এইসব নিয়া তোমার কিছু ভাবা লাগবে না…
লক্ষ্মণ নড়ে না- এইবারেরটা কিন্তু আগেরগুলার মতো না। এইটা গুরুতর…
সীতা হাত দিয়া পাছার মাটি ঝাড়ে- তা এইবার আমারে ত্যাগ করার লাইগা কী অজুহাত খাড়া করছেন তোমার রাজা?
লক্ষ্মণ কয়- রাজার সন্দেহ তোমার গর্ভের সন্তান তার না; রাবণের…
সীতা কপাল কুচকায়- দুরো। সে না লঙ্কায় বুইঝা আসলো যে রাবণ আমারে ছুঁয় নাই। তাইলে আবার ওই প্যাচাল পাড়তেছে ক্যান?
- লঙ্কায় বুইঝা আসলেও লোকজনের কানাঘুষায় বুঝ পাল্টায়া ফেলছেন তিনি…
সীতা হাসে- আগে নিজের বুদ্ধিতেই বৌ ত্যাগের কথা কইতেন তোমার ভাই। রাজা হইবার পর লোকজনের কথায় বৌ ফালায়া দিবার সিদ্ধান্ত নিছেন তিনি। সেই দিক দিয়া এইটা নতুন…
লক্ষ্মণ কয়- তোমার গর্ভলক্ষ্মণ প্রকাশের পর লোকজনের কানাঘুষায় একেবারে অস্থির হইয়া উঠছেন তিনি। লোকজন যেইসব কথা বলতেছে সেইগুলা খণ্ডানোর যুক্তি রাজার কাছে নাই। তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিছেন…
সীতা দুই হাতে মাজার পিছন দিক ঠেক দিয়া দুই পায়ে সমান ভর দিয়া খাড়ায়- কী এমন কথা লোকজন বলতেছে যেইটা রাজায় খণ্ডাইতে পারে না?
লক্ষ্মণ চুপ কইরা থাকে। সীতা তাড়া দেয়- এমনও হইতে পারে তোমার লগে আর কোনোদিন দেখাই হবে না আমার। মিন মিন না কইরা কথাগুলা সরাসরি কও লক্ষ্মণ…
লক্ষ্মণ পা দিয়া মাটি খোঁচায়- লোকজন বলতেছে সীতা অত বছর রামের ঘর করল কিন্তু বাচ্চা হইল না। এখন রাবণের বাড়ি থাইকা ফিরার লগে লগেই সে গর্ভবতী। বিষয়টা সন্দেহজনক…
সীতা আয়েশ কইরা আবার শিকড়ের উপর বসে। গুটায়া আনা হাঁটুগুলার উপর হাত দুইটা আড়াআড়ি বিছায়া তার উপর থুতনি নামায়া লক্ষ্মণের দিকে তাকায়- তুমি কি এই বিষয়ে আমার কাছে কিছু শুনতে চাও?
লক্ষ্মণ কয়- আমি ফিরা গিয়া বলব যে তুমি শপথ কইরা বলছ তুমি শুদ্ধচরিত্র। তুমি বলছ বেহুদা অপবাদের ডরে রাম তোমারে ত্যাগ করছেন…
সীতা হাসে- আমার কথা তুমি বানায়া বলবা ক্যান?
লক্ষ্মণ কয়- তুমি শুদ্ধতার দাবি না করলে লঙ্কায় তোমারে যে শুদ্ধচরিত্র প্রমাণ করা হইছিল সেই দাবি টিকব না। তোমার অগ্নীপরীক্ষায় পাশ দেওয়ার ঘটনা কিন্তু রামের সিংহাসনে বইসা থাকার একটা বড়ো শক্তি। সেই অগ্নিপরীক্ষার একজন চাক্ষুস সাক্ষী আমি। আমি নিজের হাতেই তো সেই আগুন জ্বালাইছিলাম…
সীতা কয়- তুমি আগুন জ্বালাইছ ঠিক। কিন্তু কীভাবে কী ঘটছে সেইটাও তো দেখছ…
লক্ষ্মণ কয়- কী দেখছি বিষয় না। সবাইরে কী বলছি সেইটা বিষয়। সেইটারে বদলানো যাবে না। বহুত কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যাবে…
সীতা কয়- কী আর উল্টাবে? কূলটা বৌ নিয়া সংসার করার দায়ে ভরত ঘুটু পাকাবে। মিছা কথা বলার দায়ে রামরে সিংহাসনের অযোগ্য ঘোষণা করবেন বশিষ্ঠ। এই তো? তাতে আমার কী? পেটে বাচ্চাসহ আমারে খেদায়া দিবার পরেও তুমি কেমনে আশা করো তোমার ভাইর সিংহাসন রক্ষার দায় নিব আমি?
লক্ষ্মণ কয়- রামের সিংহাসন নিয়া আমি ভাবতেছি না বৌদি। তোমার পেটের বাচ্চার ভবিষ্যতের লাইগাই আগে যা বলা হইছে তা আর বদলানো যাবে না। তুমি যদি এখন অন্যকিছু কও তবে তোমার সন্তান কোনোদিনও গিয়া আর অযোধ্যায় খাড়াইতে পারব না…
সীতা কয়- তোমার কি মনে হয় সেই সুযোগ সে পাবে?
লক্ষ্মণ কয়- জানি না। তবে সেই রাস্তা বন্ধ করা ঠিক না সেইটা বুঝি। আর ঋষি বাল্মিকী যদি তোমার কথায় বিশ্বাস করেন তবে আমার ধারণা তিনি তোমারে আবার অযোধ্যায় গ্রহণযোগ্য কইরা তুলতে পারবেন। তার কথার দাম আছে। তুমি শপথ কইরা তিনারে তোমার শুদ্ধতার কথা বইল। তিনি তোমার জাতের মানুষ। তোমারে গুরুত্ব দিবেন তিনি…
জন্মদাতা বাপ-মায়ের নামধাম না জানলেও তার চেহারা দেইখা জাত বুইঝা ফালায় মানুষ। সীতার মনে পড়ে; তার চেহারা দেইখাই রাবণের বৌ মন্দোদরী তারে বলত ছোটজাতের মাইয়া। সে জিগায়- আইচ্ছা লক্ষ্মণ। তোমার ভাই আমারে বিবাহ করলেন মিথিলা রাজকইন্যা হিসাবে। তো আমারে সেইখানে না পাঠায়া; আমার যে অজ্ঞাত বাপ-মা অভাবের দিনে ফালায়া গেছিল তাগো জাতির কাছে কেন আমারে দিয়া যাইতে কইলেন তোমার ভাই?
লক্ষ্মণ কয়- তোমারে মিথিলায় পাঠাইলে তো সেইটা ত্যাগ হবে না; হবে নাইওর। আর ত্যাগের কথা কইয়া মিথিলায় ফিরত পাঠাইলে জনক রাজা সিরধ্বজ সহজে ছাড়বেন না। সিরধ্বজ একজন রাজর্ষি; শাস্ত্র আর সৈনিক দুইদিকেই শক্ত মানুষ তিনি। তার উপরে তোমার বিয়ার ঘটক স্বয়ং বিশ্বামিত্র। সিরধ্বজ নিজে কিছু না করলেও নিশ্চিত বিশ্বামিত্ররে ডাইকা সালিশ বসাবেন তিনি। আর সেইক্ষেত্রে যে কোনো উল্টাপাল্টা কিছু ঘইটা যাইতে পারে…
সীতা কয়- মাত্র কয়দিনের মন্ত্রী হইয়া বহুত রাজনীতি শিখা ফালাইছ দেখি…
লক্ষ্মণ কয়- না বৌদি। বাইরের মানুষের কাছে আমি রাজপুত্র বা মন্ত্রী হইলেও অযোধ্যা রাজবাড়িতে যে আমি এখনো শুদ্রানি সুমিত্রার পোলা সেইটা তো তুমি ভালো কইরাই জানো। মন্ত্রী হইলে অন্তত রাজারে আমার কিছু বলার জায়গা থাকত; বিনাবাক্যে এইভাবে আদেশ পালন করতে হইত না…
সীতা কয়- যাউকগা তোমার আর দুঃখ করা লাগত না। লঙ্কায় আমারে শুদ্ধচরিত্র বানানোর লাইগা দেখা হইলে হনুমান আর বিভীষণরে আমার ধন্যবাদ দিও…
লক্ষ্মণ কয়- তোমারে এইবার কলঙ্কিত করার পিছনে আমার ধারণা হনুমান-বিভীষণের হাত আছে…
সীতা আকাশ থাইকা পড়ে- আমার লগে তাগো কীসের শত্রুতা? রাবণের বাড়িতে বিভীষণই তো তার বৌর মাধ্যমে আমারে যাবতীয় সহায়তা দিছে। আর বলতে গেলে আমারে তো উদ্ধারই করছে হনুমান। তারপর যুদ্ধের শেষে যখন তোমার ভাই আমারে নিতে রাজি হইলেন না তখন হনুমানই তো বামুনগো দিয়া বলাইল যে অভিশাপের ডরে রাবণ আমারে স্পর্শ করে নাই। আর সেই অগ্নী পরীক্ষার জাদুও তো পুরাটাই হনুমান-বিভীষণের বুদ্ধি। তারা আমার উপর ক্ষেপার তো কোনো কারণ দেখি না…
লক্ষ্মণ কয়- তারা তোমার উপর ক্ষেপা না। তাগো ভয় রাম। বালি আর রাবণ মাইরা রামের যে সুনাম ছড়াইছে; এখন যে কোনো যুদ্ধে রাম অন্যদের সাহায্য পাবে। এখন যদি রাম রাজ্য বিস্তারে মন দেন তাইলে তাগো ভয় আমরা তাগো রাজ্যের দিকে হাত বাড়াব। তাই অযোধ্যার রাজারে মানসিকভাবে অস্থির কইরা তারা সেইটা ঠেকাইতে চায়। আমার ধারণা প্রজাগো ভিতর কানাঘুষাটা হনুমানই ছড়াইছে। ভরতের লগেও সে দেখা করছে একাধিকবার। ভরত নিজে সিংহাসন হারাইছে। এখন রামের পোলাপান জন্মাইলে তার পোলাগো কপালেও কিছু জুটব না। তাই বাজারে ছড়ানো কানাঘুষারে ভরতেও ধরছে শক্ত কইরা…
হনুমানের লগে শেষ দেখা কথা মনে হয় সীতার। রাম রাজা হইবার পর সবাইরে প্রচুর দান-দক্ষিণা করে। সীতার গলায় সে পরায়া দেয় মূল্যবান একটা মুক্তার মালা। সীতা মালাটা পাইয়া আগায়া যায় হনুমানের দিকে- রানি হিসাবে এই মালাটাই আমার প্রথম আর এখন পর্যন্ত একমাত্র সম্পদ। মালাটা আমি তোমারেই দিতে চাই…
হনুমান বিনীত হয়- বানরের গলায় মুক্তার মালা দিবা? যদি সারা জীবন এই কৃতজ্ঞতা ধইরা না রাখা যায়?
সীতা কয়- তোমার কি মনে হয় ডর দেখাইলে আর ডরানোর মতো জায়গা বাকি আছে আমার? রাজ বাড়িতে বড়ো হইছি। কূটনীতিকের লগে যে আত্মীয়তাও বেশিদিন টিকে না সেইটা জানি। রাবণের বড়ো পছন্দের মানুষ আছিলা তুমি। সেই রাবণের কী দশা তুমি করছ সেইটা তো সকলেই জানে। তোমার কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা নাই; আছে বেসুমার কৃতজ্ঞতা। এই মালাটা তুমি গ্রহণ করো…
সীতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে- হনুমানরে দোষ দেই না আমি। হয়ত এমন কিছুরই একটা আগাম ইঙ্গিত সে দিছিল আমারে। ক্ষত্রিয়রা আগাইতেছে পাহাড় আর চরের দিকে; আদিবাসী মানুষগুলার ভিতর সব সময় দেশ-ভূমি হারানোর ডর। সেইখানে হনুমান যদি নিজেগো সুরক্ষার লাইগা কূটনীতি চালায়; তারে দোষ দেই না আমি। সে আমার লাইগা যা করছে সেই কৃতজ্ঞতা কোনোদিনও শেষ হবে না। আমার খালি একটাই দুঃখ; তোমার ভাই নিজের সংসারের লাইগাও নিজের বুদ্ধিটা খাটাইল না কোনোদিন…
লক্ষ্মণের চোখে পানি। হাত জোড় কইরা সীতার সামনে খাড়ায়- আমার দোষ নিও না বৌদি। আমি হুকুমের গোলাম…
- এবং শূদ্রাণিপুত্র…
হাইসা উঠে সীতা- আশা করি তোমার পোলাগো আর তোমার এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। তাগো মা রাজকইন্যা আর বাপ রাজপুত্র। তারা রাজপুত্রগো স্বাভাবিক মর্যাদা নিয়াই বড়ো হবে। তোমার ভাইরে কইও পরের কথায় বৌ খেদায়া দেওয়া রাজারে সিংহাসন শান্তি দিব না বেশিদিন…
সীতা বইসা থাকে। লক্ষ্মণ সীতার পায়ের সামনে মাটি ছুইয়া কপালে হাত ঠেকায়। হন হন কইরা আইসা উঠে ফিরাযাত্রার নৌকায়। নদী পার হইয়া সুমন্ত্ররে কয়- চলো বাড়ি যাই…
দশরথ যুগের সারথি সুমন্ত্র; কয়েক দশক ধইরা রাজবাড়ির কর্মচারী। রাজবাড়ির চাকরির দৈর্ঘ্য নির্ভর করে কথা হজম করার উপর সুমন্ত্র জানে। এই রথ দিয়া এর আগে সে রাম লক্ষ্মণ আর সীতারে নির্বাসনে ফালায়া গেছে। সে বোঝে সীতা আর ফিরতেছে না অযোধ্যায়। অস্বাভাকি জোরে ঘোড়াগুলার পিঠে চাবুক চালায় সে। শব্দ কইরা লাফায়া উঠে দুইটা ঘোড়া…
ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে লক্ষ্মণরে অযোধ্যার দিকে টানতে থাকে সুমন্ত্রর রথ। আর লক্ষ্মণ তাকায়া দেখে নদীর ওইপাশে গাছতলায় উইঠা খাড়াইছে সীতা…
এইটা সহজিয়া রামায়ণের একটা অধ্যায়ের খসড়া। এইখানে লক্ষ্মণ সীতারে কয়- বাল্মিকী তোমার জাতের মানুষ। এই রকম জাতিগত পরিচয়গুলা শেষমেশ গল্পে রাখব কি না এখনো ঠিক করি নাই। কারণ নিশ্চিতভাবে জাতিগোষ্ঠীগুলার পুরানা নাম পরিচয় উদ্ধার করা যায় নাই। তবে এইটা নিশ্চিত যে রাম-সীতা আর হনুমান নৃতাত্ত্বিকভাবে আলাদা আলাদা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ…
হনুমান আর রাবণ একই জাতির মানুষ মোটামুটি নিশ্চিত; যদিও বাসস্থানের দিক দিয়া হনুমান পাহাড়ি মানুষ হইবার কারণে বন-নর বা বানর আর রাবণ চইরা হইবার কারণে দ্বিপবাসী বা দানব হিসাবে পরিচিত…
খুবই সম্ভাবনা আছে সীতা আর বাল্মিকীর একই জাতের মানুষ হইবার। যদিও হনুমান- সীতা আর রাবণরে এক জাতের মানুষ দাবি করার ঘটনাও আছে। সীতারে রাবণ-মন্দোদরীর মেয়ে বানায়া কাহিনীও আছে; আবার সীতারে অন্য কারো ঔরসে মন্দোদরীর বিবাহপূর্ব মাইয়া দাবি করার গল্পও আছে। তবে সীতা রাবণ কিংবা মন্দোদরীর আত্মীয় হইবার যুক্তিগুলা দুর্বল…
সীতারে অবশ্য দশরথের মেয়ে বা রাম-লক্ষ্মণের বইন দাবি কইরাও গল্পও আছে; সেইটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ…
মুণ্ডারি কাহিনীমতে হনুমান মুণ্ডাজাতির মানুষ; ল্যাঞ্জা ঝুলায়া মুণ্ডারি স্টাইলে হনুমানের ধুতি পরার ঘটনাও এই দাবিরে সমর্থন দেয়। তবে সেই কালে মুণ্ডাগো জাতিগত নাম পরিচয় কী আছিল তা বাইর করতে পারি নাই…
মুণ্ডা কাহিনীতে সীতারেও মুণ্ডারি কইন্যা বইলা দাবি করা হইছে; যারে অভাবের দিনে বাপ-মা জনকের গেরস্থ বাড়ির খেতের কাছে ফালায়া যায় মাইয়াটা অন্তত বাইচা থাকবে বইলা…
কিন্তু অন্য কিছু ঘটনায় প্রমাণ করে সীতা রাবণ-মন্দোদরী থাইকা ভিন্ন জাতের মানুষ। সেই হিসাবে রাবণ মুণ্ডারি হইলে সীতার জাত অন্য কিছু…
মন্দোদরী পরিস্কারভাবে সীতারে তার থাইকা ছোট জাতের বা ভিন্ন জাতের মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করে। মন্দোদরী সীতার কোনো ইতিহাস জানে না; আবার জনকের বাড়িতে বড়ো হইবার কারণে সীতা তার জন্মদাতা বাপমায়ের ভাষায়ও কথা কয় না। মন্দোদরী সীতার জাতি নির্ধারণ করে শুধু তার চেহারার গঠন দেইখা…
যদি ধইরা নেওয়া হয় মন্দোদরী রাবণের চেয়ে ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ তবুও রাবণের কাছে অন্তত তারই জাতের মানুষ বা মুণ্ডারিগো ছোটলোক বলবার কথা না। সেই হিসাবে সীতা রাবণ-হনুমান থাইকা অন্য কোনো জাতের মানুষ হইবার সম্ভাবনাই বেশি…
সংহিতাগুলার হিসাবে রামায়ণের সকল রচনাকারই আছিলেন ভৃগু মুনি বা ভার্গব ঘরানার বামুন। ভিল জাতি দাবি করে তারা ভৃগু মুনির বংশধর বা ভার্গব। এবং রামায়ণের শেষ বাল্মিকী রত্নাকর ভালিও (পয়লা বাল্মিকী খুব সম্ভবত ভৃগুপুত্র চ্যাবন) আছিলেন একজন ভিল…
সীতা শুধু রত্নাকর বাল্মিকীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ই পায় না; রত্নাকর সীতার শেষকৃত্যও করেন ভিল রীতি অনুসারে…
আগেকার দিনে ভিল জাতির মানুষেরা পুরুষের মরদেহ পোড়াইত আর নারীর মরদেহ দিত কবর। সীতারে কিন্তু বাল্মিকী কবরই দেন। এইসব যুক্তিতে মনে হয় সীতা আর রত্নাকর হয়ত একই জাতের মানুষ; এবং খুব সম্ভবত ভিল…
রামায়ণের মূল চরিত্রগুলার কিছু কিছু পরিচায়ক পাওয়া গেলেও; এবং সেই জাতিগোষ্ঠীগুলার উত্তরাধিকারের দাবিদার পাওয়া গেলেও মুশকিল হইল পুরানাকালে সেইসব জাতিগোষ্ঠীর নাম কী আছিল তা উদ্ধার করতে পারি নাই। যার লাইগা হনুমান-রাবণরে মুণ্ডা কিংবা সীতা-বাল্মিকীরে ভিল বলা ঠিক হইব কি না তা এখনো বুইঝা উঠতে পারি নাই…
যুগে যুগে সীতারাই দোষী। মুণ্ডা মিথ কৌতুহল জাগাচ্ছে
'লক্ষ্মণ মাটির লগে কথা কয় -' পড়তে পড়তে মনে হল যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি
লিখসেন বটে একখান! এক্কেরে জইমা ক্ষির।
দারুন লাগছে লেখাগুলো পড়তে। শেষের এনালাইসিস গুলোও অসাধারণ। আদিবাসী কালচারের সাথে সীতার পাতাল প্রবেশ এর সাদৃশ্য দারুন। কিভাবে সময়ের সাথে সাথে লৌকিক প্রথা গুলোকে টুইস্ট করে করে অলৌকিকের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় এই মহাকাব্যগুলো তার ভালো উদাহরণ।
একটা প্রশ্ন -হনুমান আর রাবন একই জনগোষ্ঠীর এই সিদ্ধান্তে আপনি এলেন কিভাবে ? মানে জিনগত ভাবে শ্রীলঙ্কা এবং সাউথ ইন্ডিয়ার তামিলরা একই রুট -কোনো সন্দেহ নেই (মানে যদি আজকের শ্রীলঙ্কাই আদৌ রামায়ণের স্বর্ণলঙ্কা হয়ে থাকে)। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এও দেখিয়েছিলো আফ্রিকার ইস্ট কোস্ট এর লোকের সাথে ইন্ডিয়ার সাউথে তামিল / কেরালা আর শ্রীলঙ্কার লোকের জিনগত সাদৃশ্য। সম্ভবত ওখান থেকে প্রাচীন মানব কোনোভাবে মাইগ্রেট করেছিল এসব জায়গায়।
কিন্তু আপনি কি আরো কিছু বৈশিষ্ট বা কালচারাল ট্রেটস দেখে এই সিদ্ধান্তে এলেন ?
কিষ্কিন্ধা হল বর্তমান কর্ণাটক।সেখান কার বনবাসী নৃগোষ্ঠী হলেন বা-নর।
লেখার ভঙ্গি বেশ ভাল।