একেবারে কোনার টেবিলে বসেছি আমরা। আমার উল্টোদিকে একটা চেয়ার। তারপর দেয়াল। বামপাশের চেয়ারটা খালি। ডানপাশের চেয়ারে সে বসা। তিন নম্বর পেগে দুয়েক চুমুক হয়ে গেছে আমাদের। গোলাপি আমেজ আসতে শুরু করেছে একটু একটু করে...
কনুইটা টেবিলে ঠেকিয়ে ডানহাতে মাথা ভর দিয়ে সে বামহাতে তার গ্লাসটা নাড়াচাড়া করছে। তাকিয়েও আছে গ্লাসে। ওভাবে থেকেই জিজ্ঞেস করল- তোরা আমাকে খুব ভাগ্যবান মেয়ে মনে করিস। তাই না?
উত্তর দিতে আমি সময় নিলাম। কিংবা আপনাতেই সময় নেয়া হয়ে গেলো। আরেক ঢোক মুখে ঢেলে এমনভাবে গিললাম যাতে শব্দ না হয়। আমাকে ভাবতে হচ্ছে। প্রশ্ন না করলেও তার এরকম জিজ্ঞাসার উত্তরে জীবনীকাররা ভাগ্যবতী ভাগ্যবতী লিখতে লিখতে প্রকাশনা অধিদপ্তর ফাটিয়ে ফেলে। কোথাও প্রসঙ্গটা পেলে আমিও নেহাত দশ-বিশবারের কম তাকে ভাগ্যবতী কিংবা ভাগ্যবান নারী বলতে ছাড়তাম না। কিন্তু এখন প্রশ্নটা সে নিজেই করেছে; করেছে একমাত্র আমাকে এবং উত্তরটা একমাত্র সেই শুনতে চায়। এবং... প্রশ্নটা গোলাপি মুহূর্তের; সুতরাং কোথাও একটা কী আছে। সুতরাং বক্তৃতা-সাক্ষাতকার কিংবা প্রবন্ধের পরিস্থিতিতে এখানে হ্যাঁ বলার জায়গা নেই। আমি আরেক ঢোক গলায় ঢেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম...
গ্লাস নাড়াচাড়া করা হাত দিয়ে সে অযথাই শাড়ির আঁচল ঠিক করল। সোজা হয়ে বসে দুই হাতের কোষে গ্লাসটা ধরে চোখ বন্ধ করে এক ঢোক গিলে ওভাবেই গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। কিন্তু ছাড়ল না। ধরেই থাকল। তারপর বেশ টানটান হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল- তোরা সবাই আমাকে খুব সৌভাগ্যবান মেয়ে ভাবিস তাই না?
আমি পাশ কাটিয়ে গেলাম- সহজ হিসেবেতো তাই ভাবার কথা
- সহজ হিসেব। সহজ হিসেব...
কথাটা সে কয়েকবার আওড়াল। তারপর গ্লাস থেকে সরিয়ে হাত দুটো আড়াআড়ি টেবিলে পেতে মাথাটা নামিয়ে আনল হাতের উপর। তার চোখ নিচের দিকে। তখনও সে বিড়বিড় করছে- সহজ হিসেব। সহজ হিসেব। সহজ হিসেব নামে যে হিসেব করা হয় তা কি সবার ক্ষেত্রেই সহজ হয়? হয় না। তোরা কেউই আমাকে নিয়ে কোনো হিসেবই করিসনি
এবার মুখটা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল একই অবস্থায় থেকে। একটু হাসল- কোনো দিন ভেবেছিস আমাকে নিয়ে?
- তোকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে
- জানি। সেই বাড়ির বৌ হবার জন্য আমার একমাত্র যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়েছিল সৌন্দর্য
- তখনতো তুই একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলি
- যারা আমাকে সংগ্রহ করেছিল তারা বুঝতে পেরেছিল বড়ো হলে আমি সুন্দরী হব
- আজ তোকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে লালপেড়ে সবুজ শাড়ির জন্য
- তাও জানি। কলকাতায় আমাকে কয়েক বছর রেখে এসব শেখানো হয়েছে
সে আবার ডান হাতে মাথা ঠেস দিয়ে তাকাল সরাসরি- আচ্ছা; এই যে বললি আমি সুন্দর। সত্য করে বল তো আর কোনো দিন আমাকে নিয়ে আলাদাভাবে এইটুকুও কি তুই ভেবেছিস? নাকি অন্য কেউ ভেবেছে? ...ভাবেনি। তুইও ভাবিসনি। ভাবার দরকারটাই বা কী? আমিতো আর বিশিষ্ট কেউ না। তোরা আমার নাম মুখস্থ করেছিস আমি তোদের কবির বিয়ে করা বৌ বলে
- নিঃসন্দেহে এটা একটা বড়ো পরিচয়
- কার?
- কেন? তোর
- আমি কে?
- তুই মানে... আমাদের কবির স্ত্রী
- তোদের কবির স্ত্রী
হাসল। গ্লাসটা খালি করে ফেলল এক ঢোকে। আমার আরো কাছে মুখটা এগিয়ে এনে ঘুম জড়ানো গলায় বলল- কিন্তু আমি একটা রক্ত মাংসের আলাদা মানুষ। সাধারণ মানুষ। স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো সাধারণ মানুষ
- তাতে সমস্যাটা কোথায়?
- বিয়েটা যখন হয়েছে তখন পর্যন্ত আমারও মনে হয়েছিল সমস্যাতো কোথাও নেই। স্বামী পাচ্ছি। সংসার পাচ্ছি। কিন্তু বিয়ে হবার পর দেখলাম আমি স্বামী কিংবা সংসার কোনোটাই পাইনি। আমি তোদের কবির বউ হয়ে গেছি
- বুঝিনি
- না বোঝার কী আছে? তোরাতো বহু কিছুই বুঝিস। তোদের কবি নাকি পুরো জাতিটাকেই অনেক বেশি বুদ্ধিমান করে দিয়ে গেছেন তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে
- দ্যাখ আমি এখন অনেকটা টাল। অত ঘোরপ্যাঁচ ধরতে পারব না। খোলাসা করে বল
খালি গ্লাসটা নিয়ে আলতো কয়েকটা টোকা দিলো টেবিলে। বরফের ছোট্ট একটা কুঁচি তুলে মুখে দিয়ে টেবিল ক্লথে আস্তে আস্তে ভেজা আঙুলগুলো ঘষতে লাগল। টেবিলে আঙুল দিয়ে আল্পনা কাটতে কাটতে সেদিকে তাকিয়েই আবার সরব হয়ে উঠল- তোদের কবির জীবন বিত্তান্তের ছকে পেশা-শখ-জন্ম তারিখের পাশাপাশি আরেকটা ঘর হচ্ছে স্ত্রীর নাম লেখার ঘর। তার সাথে আমার বিয়ে হওয়ায় আমার প্রাপ্তি ঘটেছে তার জীবন বিত্তান্তের ছকে আধাইঞ্চি জায়গা। এর বেশি কিছুই নয়। তার জীবনীকারেরা দু-তিনশো পাতার বইয়ের দু তিন জায়গায় আমার নামটা ব্যবহার করে তোদের কাছে আমাকে পরিচিত করে দিয়েছেন। কিন্তু এছাড়া...?
- কী এছাড়া?
- আমার জীবন? আমার জীবনী? আমার কীভাবে কেটেছে ভেবেছিস কোনোদিন?
- ভাবার সুযোগ কোথায়? তুইতো একটা গৃহবধূই ছিলি
- দ্যাটস রাইট। একটা গৃহবধূ। পারিবারিক ছবিতে যার জন্য একটা নির্ধারিত স্থান থাকে। কবির জীবনী লিখলে যার জন্য এক লাইনের একটা জায়গা রাখতে হয়। সেই গৃহবধূ?
- তা ছাড়া?
হাতের ইশারায় ওয়েটারকে আরো সার্ভ করতে বলে সে আমার দিকে ঘুরল- তুই তোদের কবির জীবনী পড়েছিস?
- হ্যাঁ
- কয়টা?
- দুটো
- পড়ে কি তোর কোথাও মনে হয়েছে যে তিনি একজন স্বামীও ছিলেন?
- জীবনীগুলোতো আর জীবন বিত্তান্ত নয়। ওগুলো তার কবি-জীবন নিয়ে লেখা
- কোথাও কি দেখেছিস তার জীবনী তার কবি-জীবনের বাইরে কোনো কিছু ছিল?
- এজন্যই তাকে আমরা কবিগুরু বলি। তিনি মহান ছিলেন বলেই পুরো জীবনটাকে কবিতা কেন্দ্রিক করতে পেরেছিলেন ব্যক্তিজীবনের ঊর্ধ্বে উঠে
- কিন্তু আমি তার ভক্ত ছিলাম না। ছিলাম স্ত্রী
- অবশ্যই
- তাহলে আমার কী হলো?
- মানে?
- তিনি বিয়ে করলেন আমাকে। আর সব কিছু দিয়ে দিলেন তোদেরকে। বিষয়টা কী দাঁড়াল তাহলে?
ওয়েটার আসায় সে চুপ করল। ওয়েটার খালি গ্লাসগুলো সরিয়ে আরো ছয়টা গ্লাস রাখল। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কাবাব দিতে বলব?
- নারে অভ্যাস নেই। পিরালি বামুনের বাড়িতে প্রায় বিধবার অভ্যাস করেছি আমি। এখন খেলে আবার তোদের কবির অসম্মান হতে পারে
একা একাই হেসে উঠল খিলখিল করে। মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে আধমাথা ঘোমটা টেনে ওয়েটারের দিকে ফিরে বলল বেশি করে ঝাল মিশিয়ে বাদাম দিতে- তুই খেলে কাবাব দিতে বল
- না পোড়া মাংস খেলে আমার অ্যাসিডিটি হয়
- আমার হয় লেবু খেলে
খুব যত্ন করে দুটো গ্লাস বানাল সে। একটা আমার দিকে বাড়িয়ে নিজেরটা টেনে এক চুমুক মুখে দিলো। গ্লাসটা টেবিলে রেখে শাড়ির খুঁট আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল- তোদের কবি সারা জীবনে কখনো শ্বশুর বাড়ি গেছেন বলে শুনেছিস?
- না
- কিন্তু তার একটা শ্বশুর বাড়ি ছিল। আমার বাবার বাড়ি। মেয়ের জামাই শ্বশুর বাড়ি না এলে আমাদের মতো মানুষের মা-বাবার লাগে
- তিনি ব্যস্ত মানুষ...
- ব্যস্ত মানুষ। ...সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশি বান্ধবী ভিক্টোরিয়ার বাড়ি যাওয়া যায়। বুড়ো বয়সের কিশোরী বান্ধবী মৈত্রেয়ীর বাড়ি যাওয়া যায়। শুধু জীবনে একবারও শ্বশুর বাড়ি যাওয়া যায় না। তাতে কবিতার ক্ষতি হয়
পুরো গ্লাসটা সে এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। আমি তার হাত ধরলাম- তারি... বেশি খাওয়ার দরকার নেই। আস্তে আস্তে খা
- ভয় নেই। তোদের কবির জীবনী যা লেখার তা লেখা হয়ে গেছে। এখন আমি মাতাল হলেও আর তার কিছু যায় আসে না। ...তবে তোকে থ্যাংকস। তুই আমার আসোল নামটা ধরে ডাকিস এ জন্য। তোদের কবির দেয়া নামে আমাকে কেউ ডাকলে আমার গা রি রি করে
- কিন্তু ওটা একটা অসাধারণ নাম
- আমিও তাই ভেবেছিলাম; যখন প্রথম আমার নামটা পাল্টানো হয়। ভবতারিণী। একেবারেই সেকেলে নাম ছিল আমার। সেটা পাল্টে যখন তিনি মৃণালিনী দিলেন তখন ভাবলাম এ তার অসাধারণ ভালবাসারই প্রকাশ। কিন্তু হা ভগবান... পরে দেখলাম নাম দেয়া তার কবিত্বেরই একটা অন্য রকম খেলা। তিনি হাজার হাজার মানুষ-গাছ-পাখি-দালান কোঠা; সব কিছুর নাম দিয়েছেন। তার সাথে আমারও একটা নাম। কোনো বিশেষত্ব নেই এতে। আমি কোনোভাবেই তার কাছে বিশেষ কেউ নই। তার কাছে গিয়ে যদি কেউ বলত যে গরু শব্দটা একটা পুরোনো শব্দ। তাহলে তিনি হয়ত গরুর জন্যও হাম্বামৃগ বা এই জাতীয় কোনো কাব্যিক একটা নাম ঠিক করে দিতেন। ...তখন থেকেই এই নামটা শুনলে আমার গা ঘিনঘিন করে। হোক পুরোনো। তবুওতো ভবতারিণী আমার নিজের নাম। আমার মা-বাবা ওই নামটা আমার জন্যই বাছাই করেছেন...
ওয়েটার বাদাম দিয়ে দুটো খালি গ্লাস নিয়ে গেলো। পঞ্চম পেগটা বানিয়ে আমি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। গ্লাসটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে রইল। এরপর এক চুমুক দিয়ে টেবিলে থুতনি ঠেকিয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল- আমি অনেক দিন তার থেকে দূরে থেকেছি। কলকাতায়। বিয়ের পর ওখানে আমাকে পড়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি আমাকে কোনো চিঠি লিখেননি। তিনি চিঠি লিখেছেন তার বৌদিকে। ভাতিজি ইন্দিরাকে। এবং দেশি বিদেশি অসংখ্য বান্ধবীকে। ... কেন জানিস? আমি কবিতা বুঝতাম না। কবিতা না বোঝা বউয়ের কাছে চিঠি লেখার চেয়ে কবিতা বোঝা বউদি কিংবা রোম্যান্টিক ভাতিজিকে চিঠি লেখা অনেক শান্তির...
নেশা জমে উঠেছে। বারবার সে একবার টেবিলে থুতনি ঠেকিয়ে আরেকবার হাতে মাথা ঠেকিয়ে মাথার ওজন অন্য কোথাও রাখার চেষ্টা করছে- তিনি মোট কতটা বই লিখেছেন বলতে পারবি?
- না। কিন্তু অনেক
- হ্যাঁ অনেক। কিন্তু এর একটা বইও তিনি আমার নামে উৎসর্গ করার দরকার বোধ করেননি। অথচ নামে বেনামে বৌদি কাদম্বরীকে উৎসর্গ করেছেন পাঁচ পাঁচটা বই। এটাকে তুই কী বলবি?
বিষয়টা ঘোরানো দরকার। কিন্তু টাল হলে আমার আর মগজ খাটাতে ইচ্ছা করে না। ভারি ভারি বিষয়- সাহিত্য ফাহিত্য- দুঃখ এসব সহ্য হয় না। টাল হলে বরং খোঁচা টোচা মেরে কোনো পাবলিককে ক্ষেপাতে দারুণ লাগে। এ ক্ষেত্রে আমার সুনাম কিংবা দুর্নাম দুটোই রীতিমতো ঈর্ষণীয়। কিন্তু একে ক্ষেপানোতো যাবেই না; উল্টো ঠিকঠাক মতো বাড়িতে পৌঁছে না দিতে পারলে বাংলা সাহিত্য থেকে আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে। কারণ তার স্বামীর চ্যালা চামুন্ডারা সব বাংলা সাহিত্যের মাফিয়া। তারা যদি দেখে যে আমি কবিগুরুর বৌকে নিয়ে কোথাও মাতলামো করছি তা হলে আগামী কাল কোনো দৈনিকেই আর কোনো সংবাদ থাকবে না। আমার গুষ্টি উদ্ধারে ভরে যাবে পত্রিকার পাতা...
আমি আস্তে করে তার হাতের উপর হাত রাখলাম- দ্যাখ্ উনি তার সারা জীবন লেখালেখিতেই কাটিয়েছেন। তুই তার স্ত্রী কিন্তু যেহেতু তোর সাথে তার লেখালেখির কোনো শেয়ারিং ছিল না এজন্য হয়ত...
- বুঝলাম। এজন্য আমাকে কোনো বই তিনি দেননি। কোনো চিঠি লিখেননি। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু ঘরে? ঘরেতো তার সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। অথচ সেই ঘরে একটা দিন আমার সাথে হাসেনওনি তিনি। তিনি কীভাবে হাসেন তা আমি দেখেছি মাত্র একদিন। তাও আমার সাথে নয়। আমার সামনে একা একাই হেসেছেন তিনি। আমি পাশে ছিলাম বলে দেখেছি
- কী বিষয়ে?
- বিষয়টা পারিবারিক। শ্বশুর মশাইর কোম্পানি ফর্মেটে বাড়ি পরিচালনার একটা বিষয় নিয়ে। ওই বাড়িতে সকল নিয়ম কানুন তোদের এখনকার একেকটা অফিস কিংবা কোম্পানির মতো বানিয়ে রেখেছিলেন তোদের মহর্ষি। সব কিছুই নির্দিষ্ট করা ছিল। কারো পক্ষেই নিয়মের বাইরে কোনো কিছু পাওয়া ছিল দুরূহ। তখন বাড়ির ক্যাশিয়ার ছিলেন তোদের কবির পিঠেপিঠি বড়ো ভাই সোমেন দা। সবাই তাকে মাথা খারাপ লোক হিসেবেই জানত। কিন্তু তিনি হিসেবে খুব পাকা আর প্রশাসনে কড়া ছিলেন বলে শ্বশুর মশাই তাকেই বাড়ির ক্যাশিয়ার বানান। তখন আমাদের সকালের নাস্তার জন্য বরাদ্দ ছিল লুচি আর আলুর দম। তোদের কবি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। খেতেন খুবই অল্প। আর যে সব বিষয় সোমেন ঠাকুরের অধীনে সেসব নিয়ে কোনো দিন তিনি ঘাঁটাঘাঁটি করতেও যেতেন না। বলতেন- মস্তিষ্ক বিকৃত লোক যেখানে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সেখানে বিদ্রোহ আর অভিমান দুটোই অচল এবং অনুচিত। কারণ এসবের প্রতিক্রিয়ায় তার পক্ষে যেকোনো দিন খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়...
কিন্তু একদিন ভোরবেলা চরতার রস খেয়ে বাগানে হেঁটে ফিরে এসে আমাকে বললেন- তোমাকে একবার সোমেন ঠাকুরের দরবারে যেতে হবে। তাকে গিয়ে বলবে আজও যদি লুচির সাথে আলুর দম থাকে তাহলে আমি অনশন করব। আজ আমার মেনু পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করার দাবি জানাচ্ছি আমি...
পারতপক্ষে সোমেন দা’র সামনে কেউ যেতে চায় না। গেলেই তিনি বিভিন্ন নিয়ম-কানুনের উপর একটা বক্তৃতা শুরু করে দেন। কিন্তু এই প্রথম স্বামীর কোনো কাজে লাগলাম এই কথা ভেবে গেলাম সোমেন দা’র কাছে। সোমেন দা’ শুনেই হো হো করে হেসে উঠলেন- আমাদের রবি তাহলে খাদ্যের গুনাগুণ এবং স্বাদও বোঝে? হাঃ হাঃ হাঃ যত বড়ো কবিই হও না কেন খাবারে টান পড়লে আর কবিতা হয় না। হাঃ হাঃ হাঃ... যাও। যেহেতু সে কবিতা বাদ দিয়ে খাদ্য নিয়ে চিন্তিত হয়েছে সেহেতু তার এই জৈবিক প্রয়োজনের দাবি আমি অপূর্ণ রাখব না...
সে আরেকটা গ্লাস খালি করে। একা একা হাসে- তোদের কবি হাসলেন এর একটু পরে। খেতে বসে দেখা গেলো সোমেন দা লুচি আর আলুর দম ঠিকই দিয়েছেন। সাথে বাড়তি হিসেবে দিয়েছেন ছানার মিষ্টি। আলুর দমের সাথে মিষ্টি দেখেই তোদের কবি হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। বললেন- আলুর দমের সাথে ছানার মিষ্টির যে কোনো অন্ত্যমিল কিংবা ভারসাম্য হয় না; এটা বোঝেন না বলেই প্রমাণিত হয় যে সোমেন ঠাকুরের মস্তিষ্কেও কোনো ভারসাম্য নাই। চাষাভুষোরা যে তাকে পাগল বলে তা আরেকবার ঠাকুরবাড়িতেও প্রমাণ করলেন তিনি...
মিষ্টি তিনি খাননি। আলুর দম আর লুচি খেয়েই উঠলেন। ...এই প্রথম। এই শেষ। তার আর কোনো হাসি আমি শুনিনি। হয়ত আমার সামনে হাসলেও তার কবিত্বের কোনো ক্ষতি হতো। তাই
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। ছয় নম্বর গ্লাসটাও শেষের পথে। একটা বাদামের দানা খুঁটতে খুঁটতে বলল- আমি চেষ্টা করেছিলাম। করেছি। তার কয়েকটা কবিতার অনুলেখনও করে দিয়েছি আমি। আমার ভালো লাগতো। ...তার বিদায় অভিশাপ কবিতাটা আমার অনুলেখন। তিনি বলে গেছেন আর আমি ঠোঁট দিয়ে কলম কামড়ে ধরে লিখে গেছি লাইনের পর লাইন। তিনি কচের সংলাপগুলো চোখ বন্ধ করে আর দেবযানীর সংলাপগুলো আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে যাচ্ছিলেন। ...জানিস তখন আমার মনে হচ্ছিল তিনি আমাকে দেখেই দেবযানীকে তৈরি করছেন। ...কিন্তু না। তিনি কাউকে দেখে লেখেন না কিছুই। নিজের ভেতরেই তিনি একটা নারী সত্তা পোষেন। সেই নারীকেই তিনি কখনো দেবযানী- কখনো গান্ধারী আর কখনো কুন্তী কিংবা চিত্রাঙ্গদা সাজান। অন্য কাউকে দেখতে পেলেও অন্তত আমাকে দেখেন না তিনি। তিনি যখন আমার পাশে বসে কচের সংলাপ বলেন তখন চোখ বন্ধ করে থাকেন। সেই বন্ধ করা চোখে তিনি সমগ্র বিশ্ব দেখতে পান শুধু আমাকে ছাড়া। আমি তার কাছে শুধুই পারিবারিক ছবি তোলা কিংবা তার জীবনীর নির্ধারিত ছকে বসার জন্য একটা বিয়ে করা বৌ। একটা স্ত্রী...
শেষ ঢোঁকটা সে গলায় ঢালল। আমিও শেষ করলাম। আমার দিকে তাকাল- তোকে আরেকটা থ্যাংকস। তোদের কবির কবিতার বাইরে এসে তুই আমাকে সুন্দর বলেছিস। তিনিতো দেখেননি আমাকে। আর তোরাতো তোদের কবির না দেখা কোনো বিষয়কে দেখার কথা ভাবাকেই পাপ মনে করিস। ...আমি কিন্তু আজ লালপেড়ে সবুজ শাড়ির সঙ্গে কপালে লাল টিপও পরেছি। যেটা তুই পছন্দ করিস। কিন্তু আজ সে দিকে তুই তাকিয়েও দেখিসনি...
২০০৫.০২.০৫