আমার কলম আমাকে দিয়ে কখন যে কি লেখায় আমি নিজেই তার ব্যাখ্যা দিতে পারিনা। অদ্ভুত ভাবে মাথায় শব্দগুলো কিলবিল করে, আর আমি সেগুলোকে ল্যাপি অথবা ফোনের স্ক্রিনে ঘষতে থাকি । সাধারণত কোন মহৎ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লিখতে গেলে একটু দিনক্ষণ দেখতে হয়। যেমন তাঁর জন্মদিন অথবা মৃত্যুদিন। আমার পাগল শব্দেরা আমায় দিনক্ষণ নিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়না। তারা মাথায় এসে ভিড় করে, আর উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে যতক্ষন পর্যন্ত আমি তাদের মগজ থেকে কালো কালিতে রুপান্তরিত না করছি। আজ আবার হল এরুপ। তারই ফলস্বরূপ এই লেখা।
জানিনা তাঁকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার আছে কিনা। তবুও তাঁর অন্ধ ভক্ত হিসেবে আমি সবসময় তাঁকে নিয়ে লিখে যাই। ওই যে বললাম দিনক্ষণ না দেখেই। আমার মনে হত আমি তাকে অনেক কাছ থেকে জানি। কিন্তু সত্যি একটা মানুষের মনের মধ্যে একসমুদ্র রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে, এটা হয়ত আজ স্পষ্ট হল। প্রত্যেকটা মন যেন এক একটা মহাসমুদ্র। আমরা ভাবি আমাদের প্রিয় মানুষটার সব রহস্য আমরা জেনে গেছি। আর সেই ভেবেই খুব খুশিও হই, কিন্তু আসলেই আমরা তার সিকিভাগও জানি না হয়ত।
"পথের পাঁচালী" উপন্যাস ছোটবেলা থেকে নিয়ে আজ অবধি পাঁচ বার শেষ করেছি। গ্রাম বাংলার ওই রুপ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এছাড়াও অনেক ছোটগল্প পড়েছি তাঁর। বেশ কয়েকদিন থেকেই এপার ওপার, এদিক সেদিক থেকে জোগাড় করে করে তার জীবনী পড়ছি।নেট ঘেঁটে নানা অজানা তথ্য পড়ছি তাঁর ব্যাপারে। আজ তাঁর জীবনী ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম আসলেই সে এক মহাসমুদ্র রহস্য বুকে নিয়ে বেঁচে ছিল বছরের পর বছর।
প্রথম স্ত্রী "গৌরি" আর ছোট বোনের মৃত্যু বিভূতিভূষণ এর জীবনে এনে দিয়েছিল আমূল পরিবর্তন। তিনি প্রায় বলতেন তিনি তাঁর বোন আর স্ত্রীকে একসাথে দেখেছেন। তারা এসে প্রায় তাকে ডাক দিত। তিনি নাকি তাঁর স্ত্রীর সাথে কথাও বলতেন মাঝে মাঝে। ধীরে ধীরে তিনি ডুবে যাচ্ছিলেন ওই মৃত্যুর ওপারের জীবনে। পরলোকে। তার নিঃসঙ্গতা তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেই অলৌকিক, পরলৌকিক জীবনে।
খানিক তন্ত্র মন্ত্রের দিকেও আগ্রহ বাড়ে তাঁর সেই সময়। যে মানুষটি গ্রাম বাংলার বর্ষাকে নিজের কলমের মাধ্যমে আলাদা একটা রুপ দিয়েছিল, তার জীবনে কালবৈশাখীর মত হঠাৎ আছড়ে পড়েছিল বিষন্নতা, একাকীত্ব। আর এই একাকীত্বই তাকে পরলোক চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর এই মানসিক অবস্থার কথা স্পষ্ট বোঝা যায় "দেবযান" উপন্যাসটিতে।
দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী জীবনে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর সঙ্গে তিনি বিভূতিভূষনকে তন্ত্র মন্ত্রের আরও কাছে নিয়ে যায়। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুর মশাই ষোড়শীকান্ত ছিলেন একজন গুনী তান্ত্রিক। যার জীবনী অবলম্বনে লেখা " তারানাথ তান্ত্রিক"। আসলে তারানাথ তার দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুর মশাই।
তিনি এসব পরলৌকিক চিন্তায় এতটাই মগ্ন হয়ে যান যে, স্কুলে চাকরি করাকালীন কয়েকজনের সাথে প্লানচেট পর্যন্ত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ধরা পড়ে যান। তাঁর চাকরিটা চলে যায়।
সবথেকে বড় এবং অলৌকিক ঘটনা হল। তিনি একদিন ফুলডুংরিতে ঘুরতে গিয়ে নিজের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। যদিও তাঁর কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি মারা যায়।
জানিনা আরও কতশত রহস্য চাপা ছিল ওই বুকটাতে। তার ঘাটশিলার বাড়িতে প্রায় দশ-এগারো বার গেছি। কাটিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা।আজ তাঁর সম্পর্কে এসব জেনে এটাই বলার ইচ্ছা হল " সত্যি একজন একাকীত্বে ভোগা মানুষ বেঁচে থেকেও আসলে মারাই যায়।"
©Rajkumar Mahato
rajkumarauthor.blogspot.com