সাপের লেখা আর বাঘের দেখা কপালে থাকতে হয়। যে আগে দেখে টিকে যায় সে আর তার কামড়ে মারা যায় অন্যজন। এটাই সুন্দরবনের নিয়ম...
গাঁজাভর্তি বিড়িতে আগুন ধরিয়ে ছোট্ট মাছধরা নৌকার বৈঠা হাতে নিয়ে হাসে আব্দুল ওহাব সরকার- মানুষও তালি কামড়ায়। ...কামড়ায়ইতো। সাপে-বাঘে কামড়ায় দাঁতে আর মানুষ কামড়ায় হাতে; কত কিসিমের দাঁত যে গজায় মানুষের হাতে...
সুন্দরবনের খাইখাই ভূতুড়ে বিকেলে একটু একটু করে একটা খালের দিকে এগিয়ে যায় আব্দুল ওহাব। নিচে নিঃশব্দ কামট। পাড় ঘেঁষে ঘাপটিমারা কুমির। গাছের মগডালে বানর; নিচে বেকুব হরিণ আর নদী মাটি বাতাসে ওৎ পেতে বসে থাকা সুন্দরবনের বাঘ...
স্রোতের উল্টোদিকে ঠেলে আসা একটা ট্রলার দেখে আব্দুল ওহাব একমনে মাছ ধরতে থাকে। ট্রলারটা ফরেস্টের। মাছধরার কোনো পাস-পারমিট নেই ওহাবের কাছে। ট্রলারটা কাছে এলে হাত তুলে সালাম দিয়ে কাকুতি মিনতি করে- স্যার গরিব মানুষ। খাওয়ার জন্যি দুডো মাছ ধরি
কয়েকটা ধমক দিয়ে বড়ো দুটো মাছ ট্রলারে তুলে ফরেস্টাররা চলে গেলে আব্দুল ওহাব আবারও মাছ ধরতে থাকে। ভটভটির শব্দ না মিলানো পর্যন্ত মাছ ধরে ওহাব। তারপর নৌকাটাকে ছোট একটা খালে ঢুকিয়ে কুড়াল হাতে শোলার ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে এগিয়ে যায় ভেতরে। ঝড়ে পড়া একটা গাছের নিচ থেকে কাদা সরিয়ে পলিথিন প্যাক করা রাইফেলটা বের করে আবার নৌকা চালায়। আরেকটা ছোট খালে ঢুকে এক জায়গায় নৌকাটাকে টেনে একটু উপরে তুলে বেঁধে রাখে। একটা পলিথিনের ব্যাগ কোমরে ঝুলিয়ে একহাতে কুড়াল আর গলায় আড়াআড়ি রাইফেলটা ঝুলিয়ে একটা গাছে উঠে বসে। কোপ মেরে কুড়ালটা আটকে রাখে গাছে। পলিব্যাগ থেকে গুলি নিয়ে রাইফেল রেডি করে গামছা দিয়ে বেঁধে রাখে গাছের আরেকটা ডালে। তারপর ব্যাগ থেকে আরেকটা গাঁজাভর্তি বিড়ি বের করে হাতের তালুতে আগুন লুকিয়ে দম দেয় অনেকক্ষণ। ...ভাগ্য ভালো। মামাদের ঘ্রাণশক্তি খুবই বাজে। নইলে গাঁজার গন্ধেই তারা মউতের ঘ্রাণ পেতো
কয়েকটা কুত্তার ডাক দিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে চারপাশে তাকায় আব্দুল ওহাব। টাটকা পায়ের ছাপগুলো বলে আশেপাশে আছে মামা। কুত্তার ডাক কানে গেলেই আসবে। তবে যদি তারে মউতে ডাক না দেয় তাহলে এসেও লাভ নেই। একহাত সামনে দিয়ে বাতাসে ভর করে চলে যাবে আবার। অথবা আসবেই না। আব্দুল ওহাব দেখেছে বহুবার। আস্ত হরিণ ভেট দিয়েও কাজ হয়নি
ওরা অবশ্য বলছিল একটা হরিণ মেরে ফেলে রাখতে। ওহাব রাজি হয়নি। হরিণের গায়ে গুলি করতে মায়া লাগে তার। নখ নাই দাঁত নাই ছাগলের মতো একটা জানোয়ার; কাশি দিলে জঙ্গল ভেঙে পালায়; ওগুলোরে গুলি করে কেমনে? তাছাড়া হরিণ মারার জন্য বাড়তি একটা গুলি মানে বাড়তি একবার ফরেস্টারদের কান খাড়া করে দেয়া
শালাদের যত জারিজুরি সব জেলে আর মাঝিদের সাথেই। বাঘ কিংবা চোরাশিকারিদের বালও ছিঁড়তে পারে না। ফি সপ্তা বাঘে দুইটা একটা মানুষ পাড়ে; ওরা রাইফেল দিয়ে গুলি করে এদিক সেদিক। বাঘের উপর গুলি করার পারমিশন নাই ওদের। কিন্তু এইগুলা সুন্দরবনের বাঘ। বুদ্ধিতে মানুষের সমান। নইলে অতদিনে বাঙাল চাষার ক্ষেতে লাঙ্গল টানতে হতো বাঘের। ওরা ভালো করেই জানে ওইসব ফরেস্টার থেকে সরকারের কাছে তারা বেশি দামি। তাই গুলি করতে দেখলে দুই পা সামনে গিয়ে ঘাড় কাৎ করে তাকায়। আর দূর থেকে গুলির শব্দ শুনলে উল্টা শব্দের দিকে আসে। মনে করে হরিণ ফেলল কেউ। এইবার দৌড়াদৌড়ি না করেই মুফতে পাওয়া যাবে একটা শিকার...
নিজের নামের সঙ্গে সরকার থাকলেও সরকারের আগামাথা বোঝে না আব্দুল ওহাব সরকার। মানুষের বাঘ মারা নিষেধ। কিন্তু বাঘে যে হামেশা মানুষ মারে? সুন্দরবনের এমন কোনো বাঘ আছে যার পেটে মানুষের মাংস যায়নি? অথচ সরকার কিছুই বলে না এখানে। শুধু বাঘ কেন? হরিণ মারাও নিষেধ। কিন্তু হরিণ কি থাকে? হরিণ তো সব হয় বাঘের পেটে না হয় চোরাশিকারির নৌকায় যায়। না খাওয়া মানুষ একটা হরিণ মারলে ফরেস্টের লোকরা ধরে নিয়ে জেলে ঢোকায়
আব্দুল ওহাব হাসে। সুন্দরবনের মানুষদের ধরা কি অতটাই সহজ? বাদায় তাদের এক নাম। লোকালয়ে নাম আরেক। তার নিজেরই বা কয়টা নাম সেও কি ঠিক বলতে পারে? আর শিকারিদের তারা করবেই বা কী? গহিন জঙ্গলে যারা শিকার করতে আসে তাদের কাছে ফরেস্টারদের মাথা বরাবর একটা গুলি ঢুকিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না। সরকার দেখতেও আসবে না ফরেস্টার বাঘের কামড়ে মরল না মরল মানুষের কামড় খেয়ে
চোখ ছোট করে প্রতিটা ঘাসের দিকে তাকায় আব্দুল ওহাব। তাজ্জব মানে মামার লুকানোর ক্ষমতা দেখে। অত বড়ো একখান ধড়। ক্যাটকেটে হলুদের মধ্যে কালো। বহু দূর থেকে চোখে পড়ার কথা। কিন্তু মাত্র এক হাঁটু ঘাসের মধ্যে কিংবা ছোট্ট একটা গাছের আড়ালে কেমনে পুরো শরীরটা লুকিয়ে ফেলে মামা; এখনও মাথায় ঢোকে না তার। একটা গোলপাতার ঝোপে এমনভাবে নিজেকে আড়াল করে যে দশ হাত দূর থেকেও মনে হয় গোলপাতার ফাঁকে মরা গোলপাতা ছাড়া ছিল না কিছুই
- এইসো। এইসো মামা। সামনে এইসো আরো...
হামাগুড়ি নয়। আস্তে আস্তে হেঁটে এসেই দাঁড়ায়। সাড়ে সাত থেকে আট বছর বয়স। বিশাল থেকে ছোটো আর মাঝারি থেকে বড়ো। আব্দুল ওহাবের আবারও হাসি পায়। বাঘরে মানুষ সব সময়ই বড়ো বানিয়ে দেখতে পছন্দ করে। এইজন্য বাঘ মাপে লেঙ্গুড়ে-মাথায়। নাকের ডগা থেকে লেজের আগা পর্যন্ত মাপ দিয়ে বলে বারো ফুট অত ইঞ্চি বড়ো। আব্দুল ওহাবের মাথায় ঢোকে না লেজ জোড়া দিয়ে বাঘেরে বড়ো বানানোর দরকারটা কী? বাঘ তো এমনিতেই বড়ো...
বাঘটার দিকে তাকিয়ে আফসোস করে আব্দুল ওহাব- মামারে; অত বড়ো শরিলডার কী দোরকার ছেলো তোর। খালি চাইরডা দাঁত- কয়টা নখ আর ছালডা ছাড়া পুরাডাই তো আকাম্মা তোর...
কথাটা বলেই মনে মনে হাসে আব্দুল ওহাব- দাঁত আর নখ না থাইকলি তো মামারে বাঘই বলত না কেউ। রামছাগল বানাই বেইন্দে নাইকতো গোয়ালে
শিকার দেখতে না পেলে বাঘ হামাগুড়ি দেয় না। কুত্তার ডাক শুনে বাঘটা দাঁড়িয়ে অনুমানের চেষ্টা করে ডাকটা কোনদিকে। এখন শ্বাসের শব্দও আটকে রাখতে হবে। মামাদের চোখ আর কান বড়ো ভয়ানক। দেখে ফেললেই সুরুৎ করে মিলিয়ে যাবে। ওহাব শ্বাস বন্ধ করে রাইফেলের মুখটা আস্তে আস্তে ঘোরায়...
শিকারে যে যত বেশি নিঃশব্দ ভাগ্য তত বেশি পক্ষে তার। এই বিশাল জন্তুটা জলকাদা ভেঙে কত নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে পারে আব্দুল ওহাব জানে। শিকার ধরার কালে বাতাসে ভর দিয়ে হাঁটে বাঘ। কথাটা বিশ্বাস করে সে। শিকার দেখলেই নিজের ওজনটাকে একটা শামুকের সমান বানিয়ে ফেলে এই বিশাল প্রাণীটা। এত জলকাদা-মরা ডাল- গাছপালা; সবকিছুই মুখ বন্ধ করে সহ্য করে শিকারি বাঘের শরীরের ওজন। আর ভুলেও কোনো গাছের ডাল টুক করে যদি একটু শব্দ করে ওঠে; আব্দুল ওহাব নিজের চোখে দেখেছে; রাগে নিজের পা নিজেই কামড়ে ধরেছে বাঘ- শব্দ কেন হলো? তারপর ঝিম মেরে বসে আবার এগিয়ে গেছে শিকারের দিকে
কিন্তু বাঘের ওজন টের পাওয়া যায় যখন সে শিকারের দিকে প্রকাশ্যে দৌড়টা শুরু করে। ওরে ধুপধাপ। পুরা সুন্দরবন কেঁপে ওঠে তার ভারে। কারণ মামায় তখন তার শিকার ছাড়া আর পোছে না কিছুই। ...বাঘে যারে দেখে হাজারেও না রুখে...
কথাটা ছোটবেলায়ই শোনা। হাজার হাজার হরিণ কিংবা মানুষের মাঝখান থেকে বাঘ শুধু একটাকেই দেখে। আর যারে দেখে তার আশেপাশে যত হরিণ আর মানুষই থাকুক না কেন মামায় ওইটারেই ধরে; পাছার মধ্যে এক ধাক্কা দিয়ে দৌড়ের গতি টালমাটাল করে ঘাড়ের পেছনে কামড় আর পিঠের মধ্যে থাবা। নিজের পুরা ওজনটা ঢেলে দেয় শিকারের পিঠে; কার বাপের সাধ্যি এই কামড় থাবা আর ওজন নিয়ে মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকে? হাতির সঙ্গে মামার লড়াই দেখেনি ওহাব। কিন্তু হরিণ আর মানুষের সাথে দেখেছে। মুহূর্তের মধ্যে কাদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে শিকার। আর সঙ্গে সঙ্গেই মামা একটা থাবা সামনে বাড়িয়ে শিকারের মাথায় ধরে হ্যাঁচকা এক টানে কড়াৎ করে ভেঙে ফেলে ঘাড়। এই এক টানেই মানুষ আর হরিণ যার যা হবার তা হয়ে যায়। আব্দুল ওহাব মনে মনে আবারও হাসে। ঘাড় ভেঙে দিয়েও আরো কিছুক্ষণ শিকারকে কামড়ে ধরে থাকে বাঘ। তারপর কামড় ছেড়ে হাত দিয়ে একটা নাড়া দিয়ে দেখে নড়ে কি না। হরিণ নড়ে না। কিন্তু পুরুষ মানুষের দুই পায়ের ফাঁকের অঙ্গটা নড়ে। মামায় মনে করে এইটা বোধহয় কোনো একটা অস্ত্র কিংবা এইখানে এখনও জান আছে; আবার একটা থাবা দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়- নড়ে কি না। আর কিছুই নড়ে না। খালি ওইটা নড়ে। এইবার দেয় ঘপ করে ওইটাতে একটা কামড়। এক কামড়ে পুরাটা মুখের মধ্যে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। মানুষ ধরলে প্রথমেই ওইটা খায়। অবশ্য পুরুষ মানুষ। বাঘে খাওয়া মহিলা মানুষ দেখেনি ওহাব। মেয়েরা অতদূর বনে আসে না বলেই সুন্দরবনের বাঘ খালি পুরুষদেরই খায়...
আরো কয়েক পা এগিয়ে আসে বাঘটা। নিশানার মধ্যেই এখন। কিন্তু এখন মারলে মারতে হবে বুকে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছে বুকে মারলে ছেঁড়াফাঁড়া বুক নিয়েও বাঘ কয়েক মাইল দৌড়াতে পারে। বাঘের পেছনে অতদূর দৌড়ানো সম্ভব না বলে অনেক শিকারি শেষ পর্যন্ত মরা বাঘ খুঁজেও পায় না
বাঘের কাছ থেকেই ওহাবের বাঘ মারা শিক্ষা। ঘাড় ভেঙে শিকার মারে বাঘ। শিকারকে জায়গায় ফেলে দেবার জন্য ঘাড়ের হাড্ডিটাই একমাত্র জায়গা। কিন্তু ওইখানে টার্গেট করা অনেক মুনশিয়ানার কাজ। উপর থেকে ঠিকঠিক কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝখানে চালিয়ে দিতে হয় গুলিটা। এক গুলিতে কাঁধের হাড্ডি ভেঙে ঢুকে চুরমার করে দেয় ঘাড়ের হাড্ডিটাও। কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলে পুরাটাই উল্টে যেতে পারে। বড়োজোর বাঘের একটা পা ল্যাংড়া হয়। আর বাঘ ল্যাংড়া হলেও বাঘ। যেমন দৌড়ে- তেমনি থাবায়
বাঘটা আরেকটু সামনে এসে ডানে বামে তাকায়। কিছু না পেয়ে ঘুরে আব্দুল ওহাবের দিকে পাছা দিয়ে বামদিকে কান খাড়া করে তাকিয়ে থাকে। আব্দুল ওহাব এখন মামার কানের ভেতরের সাদা দুইটা নকল চোখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। শিকার ধরার কালে দৌড় শুরুর আগে মামায় যখন কান দুইটা সামনে আনে তখন কানের ভেতরের সাদা দুইটা নকল চোখে মামারে আরো বেশি ভয়ানক দেখায়
রাইফেলটা নিশানায় ধরে আব্দুল ওহাব নিঃশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকায়। মামারা অবশ্য বেশিরভাগ সময় একা একাই থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে বাঘার সাথে বাঘিনিরাও ঘোরে। ওইটা একটা বিপদ। ওই ক্ষেত্রে আগে বাঘিনিকে গুলিটা করতে হয়। বাঘিনি পড়ে গেলে বাঘা দৌড়ায়। কিন্তু বাঘিনির সামনে যদি বাঘার কিছু হয় তবে দুনিয়াতে কিয়ামত ঘটিয়ে ছাড়ে বাঘিনি মামা...
বাঘের ঘাড়টা রাইফেলের টার্গেটে এখনও একটু তেরছাভাবে আছে। এখান থেকে গুলি করলে চামড়ার উপর দিয়ে পিছলে যেতে পারে। অবশ্য আব্দুল ওহাব যদি নিজেকে বামপাশের ডালের বাইরে নিয়ে আসতে পারে তাহলে একেবারে খাপেখাপে ঘাড় আর মেরুদণ্ডের হাড্ডির জোড়ায় গুলি চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু এখন নড়াচড়া করতে গেলে পুরাটাই ফেঁসে যেতে পারে। আব্দুল ওহাব নিজের পজিশনে দাঁড়িয়ে শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে। মামা তো আর সারাদিন একদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। ঘাড়টা সোজা করে যদি মাত্র দুই তিন সেকেন্ড সময় দেয় তাহলেই কাফি। মাত্র একটা গুলি। এক গুলিতে না মরলে আব্দুল ওহাবের কোনো লাভ নেই। গুলি খেয়ে জখম হয়ে যদি দৌড় লাগায় তবে কোথায় কোন জঙ্গলে গিয়ে কয়দিন পরে মরবে কে জানে
কোঁচড়ে আরেকটা গাঁজাবিড়ি আছে। গুলিটা জায়গামতো বসিয়ে দিতে পারলে রাইফেলটা গাছের ডালে গামছায় বেঁধে ধীরে ধীরে পুরাটা খেয়ে তারপর নামবে। বাঘ ফেলার পর সাথে সাথে তার সামনে যাওয়া ঠিক না। আশেপাশে তার জোড় থাকলে খবর আছে। কিছুক্ষণ পর গাছের ডালে বাড়ি দিয়ে- চারপাশে জানান দিয়ে কুড়ালটা হাতে করে নেমে যেতে হবে বাঘের সামনে। মামাদের সামনে পড়ে গেলে রাইফেল কোনো কাজের জিনিস না। থাবার সামনে কুড়ালের কোপ ছাড়া বাঁচার কোনো উপায় নাই
তারপর মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের কাজ। কোমরের পলিব্যাগ থেকে প্লায়ার্স বের করে আঙুলগুলোর গিঁটে চাপ দিয়ে আলগা করে চাকু দিয়ে চামড়া কেটে নখগুলো ব্যাগে ভরা। তারপর প্লায়ার্স দিয়ে টোকা মেরে দাঁতের গোড়ায় ছেনি ঢুকিয়ে চাড় মেরে মেরে চারটা দাঁত খুলে আনা। ব্যাস। মামা তখন পুরোপুরি একটা বড়োসড়ো ভেড়া। পরেরদিন কসাইরা আসবে মামার চামড়া খুলে নিতে
আব্দুল ওহাব নিজে কোনোদিনও চামড়া ছিলে না। চামড়া ছিলার সময় থাকেও না। চামড়া ছাড়া অত বড়ো শরীরটা দেখলে কষ্ট হয় তার। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঘ যদি নিজের নখ দাঁত আর চামড়া খুলে পোঁটলা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখত তাহলে তাকে আর মরতে হতো না। দাঁত নখ চামড়া খুলে তার অত বড়ো শরীরটা সবাই বনেই ফেলে যায়। কেউ খায়ও না। কেউ নেয়ও না। ওখানেই পচে। কিন্তু নিজের হাতে বাঘের দাঁত- নখ খোলার আলাদা একটা মজা আছে। বাঘ তো আর চামড়ার জন্য বাঘ না। বাঘেরা বাঘ হয় দাঁতে আর থাবায়। সেই বাঘেরে নিজের হাতে একটু একটু করে ভেড়া বানানোর অনুভূতিটাই আলাদা। দাঁত-নখ খোলার পর আব্দুল ওহাব যখন নখ আর দাঁতের সুচালো মাথায় আস্তে আস্তে আঙুলের ডগা ঘষে; তখন তার পুরো শরীরটা শিরশির করে কেঁপে উঠে; বাঘের পুরা বাঘত্ব এখন তার হাতে। কাদার মধ্যে যা পড়ে আছে তা কসাই আর চামারের ধন...
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে আব্দুল ওহাবের। বৌ চেয়েছিল ছেলের গলায় একটা বাঘের দাঁতের লকেট ঝোলাতে। সোনা না হোক রুপা দিয়ে বাঁধিয়ে দিলেই হতো। একবার একটা দাঁত সরিয়েও রেখেছিল আব্দুল ওহাব। কিন্তু পরে আবার বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ...থাক। কী দোরকার? জেইলের ছেইলের গলায় বাঘের দাঁত দেখলি জঙ্গলের শোওরোরাও হাসপে...
বাঘটা সুবিধা দিচ্ছে না। এখন জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকাচ্ছে। এখনও গুলি পিছলে যাবার ভয় আছে। আব্দুল ওহাব আবার নিজের পজিশন বদলানোর কথা ভেবে বাদ দিয়ে দেয়। আজকে না পারলে কালকে হবে। কিন্তু উল্টাপাল্টা গুলি করে খামাখা একটা নিশ্চিত শিকার হাতছাড়া করা ঠিক না। এখনও যা বেলা আছে তাতে কাজ শেষ করে বড়ো নদীর ওই পাড়ে খালের ভেতরে দাঁড়ানো মহাজনের ট্রলারে দাঁত-নখ দিয়ে চামড়ার ঠিকানা বলে বেলাবেলিই বাড়ি ফিরতে পারবে। অবশ্য বড়ো নদীতে ফরেস্টারদের সামনা সামনি পড়ে যাবার ভয় আছে। গুলির শব্দ শুনলে টহল বোট নিয়ে তারা হয়ত এদিকে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্য আব্দুল ওহাবেরও উত্তর মুখস্থ করা আছে। তাকে যদি জিজ্ঞেস করে সে কোনো গুলির আওয়াজ শুনেছে কি না। সে নির্দ্বিধায় উত্তর দেবে- আপনাগের বন্দুকের একটা দেওড় ছাড়া তো আর কিছু শুনিনি
সুন্দরবনে একটা জেলের পক্ষে ফরেস্টার ছাড়া আর কেউ গুলি করতে পারে এটা ভাবা সম্ভব? একটা জেলের যতটা সরল হতে হয় ততটা সরলতা নিয়েই সে উত্তরটা দেবে। এতে যদি তারা বলে যে তারা কোনো গুলি করেনি তাহলে আব্দুল ওহাব বিষয়টা আল্লার হাতে ছেড়ে দেবে- তালি আল্লা মালুম স্যার। আপনারা চুইলে যাবার পরে একটা দেওড়ের আওয়াজ শুনলাম। ভাবলাম আপনেরাই করলেন...
এর পরে সুন্দরবনের মাঝিকে তাদের আর কিছু জিজ্ঞেস করার কথা না। ফরেস্টের লোকগুলারে দেখলে হাসি পায় আব্দুল ওহাবের- বনে দেওড় শুনলি নিজেরা গেয়ে দেখার সাহস নি। নেংটিপরা জেইলারে এইসে জিজ্ঞেস করে গুলি কুরছে কেডা? বালস্য বাল। এরা বাঁচাপি বাঘ...
কাজ শেষে সবার আগে রাইফেলটা নতুন কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। ফরেস্টাররা যদি চেক করে পেয়ে যায় তাহলে বিপদ। তাছাড়া মহাজনের ট্রলারে রাইফেল নিয়ে যাওয়া নিরাপদ না। একটা রাইফেল হাতানোর জন্য তার মতো জেলেকে নদীতে ভাসিয়ে দিতে তাদের বিন্দুমাত্র বাঁধবে না। আব্দুল ওহাব মনে মনে হাসে। সুন্দরবনের নদীতে লাশ না ভাসিয়ে রাইফেল হাত বদলের আর কী কোনো সহজ উপায় আছে?
- এইসো মামা। এইসো এইসো এইসো। ভাগিনারে ইট্টু দয়া কুরো মামা...
বাঘটা জায়গায় দাঁড়িয়ে এবার সটান সামনের দিকে তাকায়। আব্দুল ওহাব যে পয়েন্টটা খুঁজছিল সেটা একেবারেই তার নিশানার সামনে। আব্দুল ওহাব আরেকবার রিং আর টিপের মধ্যে চোখ দিয়ে টার্গেট নিখুঁত করে নিশ্বাস বন্ধ রেখে ট্রিগারে আঙুল ছোঁয়ায়- বেয়াদবি মাপ কুরে দিও মামা। পেটের দায়ে করি। ...বিসমিল্লা...
- ঘুড়ুস
সেকেন্ডের মধ্যেই গুলিটা গিয়ে লাগে বাঘের ঘাড় আর পিঠের সন্ধিতে সামনের দুপায়ের উপরের অংশের জোড়ার ঠিক মাঝখানে। ঘাড়ের হাড্ডি ভেঙে গুলিটা ঢুকে যায় ভেতরে কিংবা বের হয়ে যায় নিচে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা ধপাস। বাঘটা ঘ্যাক করে মাথাটা ডান দিকে তুলতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে বামে। আব্দুল ওহাব বাঘের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে- মাপ কুরে দিও মামা। কোনো শত্রুতা নাই...
অন্য স্বাদের। চুম্বকের আকর্ষণ গল্পে। লেখকের বর্ণনা ভঙ্গিতে মুন্সয়ানা। দারুন।
টানটান লেখা। লেখকের বর্ননা য় মুন্সিয়ানা আছে।