মাইয়ার দেড় বচ্ছর বয়সে একদিন খাওয়ার টেবিলে খোঁটা দিয়া বসি- আস্ত একখান কালিকাপ্রসাদ…
বৌম্যাডাম দিনা হা কইরা তাকায়- মানে কী?
আমি কই আপনের মাইয়া প্রসাদের মতো খায়…
দিনা ঝাড়ি দিয়া প্রশ্ন বাড়ায়- এই কথার কী মানে?
আমি কই দুনিয়াতে মাথার চুল থাইকা কনুই পর্যন্ত ল্যাপ্টাইয়া ভাত খায় মাত্র দুইটা মানুষ; এক কালিকাপ্রসাদ আর দ্বিতীয় আপনের মাইয়া…
আমার পাৎলামি নিয়া বৌম্যাডাম বহুত দুশ্চিন্তায় থাকে। জীবনেও সে আমারে ভদ্রতা বজায় রাখিতে পারিয়া সমাজে চলতে দেখে নাই। তাই এইবার সংক্ষেপ ঝাড়ি সাইরা সে বিস্তারিত ঝাড়ে উপদেশী বয়ান- তুমি কিন্তু এইসব বাইরে বলতে যাবা না। সে বহুত বড়ো একজন শিল্পী। তুমি এইসব বললে মাইনসে তোমারে ফাউল বলবে। ভাববে হিংসায় তুমি তারে ছোট বানাইতে চাও…
প্রসাদ-বন্দনাযুক্ত উপদেশ থেকে বাঁচতে দিনারে থামাইয়া আমি নিজেই শুরু করি প্রসাদ প্রশংসার একখান দীর্ঘ বক্তৃতা…
কিন্তু ঝামেলা হইল ঘনিষ্ঠ মানুষ ছোট হইলে যেমন তারে বেশি ছোট কইরা দেখা যায় না; তেমনি বড়ো হইলেও তারে বেশি বড়ো কইরা ভাবা যায় না। ছোটবড়ো সকল ঘনিষ্ঠরেই আমরা টাইনা নিজের সাইজে আইনা সম্পর্ক বাঁচাইয়া রাখি। আর টান দিবার পরেও যে সম্পর্কের খাপে ঢোকে না; সে পরিণত হয় দূরবর্তী একখান স্মৃতিময় নামে…
প্রসাদের ক্ষেত্রে সেইটা ঘটে নাই। যদিও প্রসাদ বাংলাদেশে আসলে আমি কিঞ্চিত ভয়েই থাকতাম ছোটখাটো একটা দুঃখ ভিতরে চাইপা নিয়া। বাংলাদেশে প্রসাদের লাখে লাখে ভক্ত তারে কলকাতার শিল্প হিসাবে জানে। এই জাগাটায় খচাৎ কইরা এটা খোঁচা লাগে বুকে…
প্রসাদ কলিকাত্তি হইলে হয়ত তারে শুধু শিল্পী বইলাই চিনতাম। কিন্তু তারে তো আমি সিলেটি বইলা জানি; যেই সিলেটের কথা দেশ বিভাগের কালে দিল্লি বোম্বে কলকাতার নেতারা হয় জানতই না; না হয় ভুইলাই গেছিল; না হয় বাদ দিয়াই গেছিল অদরকারি ভাইবা…
দেশ বিভাগের সক্রিয় মানুষেরা আমাগো থাইকা মোটামুটি সাড়ে তিন প্রজন্ম আগের মানুষ। তাগো কার কদ্দুর ক্ষেমতা আছিল আর কার কদ্দুর ধান্দা আছিল সে বিষয়ে রাজনৈতিক কল্পকাহিনী ছাড়া আমাগো হাতে প্রামাণিক তেমনি কিছু নাই। তবে সেই কালে তারা বিষের যে শিশিটা ঢাইলা দিছিল সেইটা নিশ্চিতভাবে এখনো পারদের কণার মতো গড়াইতেই আছে সমাজের ভিতর…
- ঘিন্না আর হিংসা ছাড়া দেশ বিভাগের আর কোনো জীবন্ত উপাদান দেখি না আমি…
প্রসাদ এইখানে আমারে থামাইয়া দেয়- একটা সুফলও কিন্তু আছে…
আমি কই কী?
প্রসাদ একটু থাইমা হাসি দিয়া কয়- দেশ বিভাগের সুফলটা হইল বাংলাদেশ। দেশ বিভাগ না হইলে অন্তত বাংলাদেশ হইত না…
এইটা প্রসাদের লগে প্রথম পরিচয় দিনের সারা রাত্তির আড্ডার একটা অংশ…
দুই হাজার এক সালের দিকে প্রসাদ পয়লা সিলেট গেছিল ভারতীয় গণনাট্যের সাথে। সেই সময়ই পয়লা পরিচয় আর তার ল্যাঞ্জা ধইরা হোটেলের বারান্দায় সারা রাত্তিরের আড্ডা…
বাংলাদেশের মানুষ শুনলে যে কোনো সময় তারা তাগো বাপা দাদার ভিটা দখলের আসামি বানায়া ফালায় দেইখা কলিকাত্তিগো লগে আড্ডা দিতে গেলে কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়া গুটাইয়াই থাকতে হয়। কিন্তু বরাক উপত্যকার মানুষদের লগে এই অভিজ্ঞতা হয় নাই আমার। বরাক উপত্যকার লগে আমাগো যোগাযোগের মূল সেতু দুই পারের দুই মানুষ। সিলেটের নাটকের দল কথাকলির আমিরুল ইসলাম বাবু আর শিলচরের ভারতীয় গণনাট্যের শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার…
অথচ অদ্ভুত হইল আমার নানাবাড়ি কাছাড়। নানার বাকি সব ভাইবোনই কাছাড়ে থাকছেন; শুধু তিনিই পাড়ি দিছিলেন সিলেটে; সেইটা দেশ বিভাগের কারণে না; বিশাল গোষ্ঠির এক মাইয়া বিয়া করার পর; বৌ বাপের বাড়ির কাছাকাছি থাকতে চায় সেই দাবি মেনে…
আবার হইলে হইতে পারে প্রসাদের পরিবারের দেশান্তর ইতিহাসেও দেশ বিভাগের কোনো ক্ষত নাই দেইখা উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়া তার লগে আলাপে কারোই পারিবারিক তিতা ইতিহাস আইসা বিষয়টারে গান্ধা করে নাই…
প্রসাদের কোনো এক পূর্ব পুরুষ আছিলেন কবিরাজ। সিলেট থাইকা শিলচর গেছিলেন চিকিৎসার ডাকে। তিনার চিকিৎসায় ভালো হইয়া শিলচরবাসী তিনারে সেইখানে রাইখা দিছে। এই রকম একটা স্বাভাবিক স্থানান্তরের ইতিহাস শুনছি তার পরিবারে…
কিন্তু তারপরেও দেশ বিভাগের গন্ধ বোধহয় বাদ দেওয়া যায় না- ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যে জলধি নদী…
এই গানটা প্রসাদ কেন লিখবে? গানটা পয়লা শুনছিলাম শুভদার গলায়। শুইনা চমকাইয়া জিগাইছিলাম এইটা কার গান?
শুভদা কয় আমাগো প্রসাদের…
দেশ বিভাগের তৃতীয় প্রজন্মের কোনো মানুষ এই গান লিখতে পারে বিশ্বাস করা কঠিন। পয়লা আমার মনে হইছিল এইটা হয়ত পয়লা প্রজন্মের কারো লেখা; হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘হবিগঞ্জের জলালি কৈতর’ গানে ডানা ভাইঙ্গা পড়া কৈতরের যে আহাজারিটা আছে; মনে হইছিল সেই আহাজারির তারে বান্ধা এই গান…
কিন্তু গানটা সত্যি সত্যি হেমাঙ্গ বিশ্বাস থাইকা কয়েক প্রজন্ম অগ্রসর; আরো বহুত জটিল মনস্তত্বের- ‘আমিও জেনেছি অ তে অজগর ব মানে শুধু বন্যা…
গানটা লাইনে লাইনে ঘাঁটায়। এই রকম পরিচয়পত্র দেখাইয়া তো কোনো বাঙালিরে আগে বাঙালত্ব দাবি করতে শুনি নাই। মাইর খাইয়া; ঘরবাড়ি বৌ খুয়াইয়া; দেশান্তরি হইয়াও তো প্রাচীন চর্যাপদের কবি ভুসুকু এক্কেবারে বুক থাবড়াইয়াই নিজের বাঙাল পরিচয় ঘোষণা দিছিলেন। তিনিও তো নিজের বাঙালত্বের পক্ষে কোনো পরিচয়পত্র দেখান নাই…
আমি সরাসরি প্রসাদরে জিগাই- এইটার মানে কী মিয়া? নির্বাসিতা নদীর মানে কী?
বাঙালিরে তো দেশান্তর নিয়া হাউকাউ করতে শুনছি সারা জীবন। কে কত বড়ো জামিদারি ফালায়া গেছে বা আসছে সেই বর্ণনা শুনছি। রায়ট আর লুটপাটের বিকটত্ব শুনছি; হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো ‘তোমরা আমায় চিননি’ কইয়া হাওরের ছোট মাছ খাইয়া বানানো তাকতের বড়াই করতে শুনছি। কিন্তু এই রকম নির্বাসনের গাঁথা তো রচনা করে নাই কেউ…
প্রসাদ কয়; আসামে যে বাঙালি আছে সেইটাই বেশিরভাগ কলিকাত্তি জানে না। তাগো হিসাবে বাঙালি আছে খালি পশ্চিম বাংলায় আর বাংলাদেশে আর দুই এক চিমটি আগরতলায়…
এমন সঙ্কটের কথা আমি আগে শুনি নাই…
মাত্র দুইটা ছাড়া বাকি সব সঙ্কটেই বাঙালি ঝিমায়; তারপর সঙ্কট দুর্গতিতে পরিণত হইলে দুর্গতির বন্দনাসহকারে গাইয়া উঠে- আমি অপার হয়ে বসে আছি; পারে লয়ে যাও আমায়…
বাঙালি একটা দুর্গতিপ্রিয় জাতি। এই জাতি দুর্গতি নিয়া কান্দে আবার গানও বান্ধে। এই জাতির সব থিকা বড়ো দেবতার নাম দুর্গতিনাশিনী। দুনিয়ার আর কোনো জাতে দুর্গতিনাশের মন্ত্রণালয় দিয়া অত বড়ো দেবতা বসানোর কোনো উদাহরণ আমি দেখি নাই…
বাঙালি জাতির সঙ্কট আছে মাত্র দুইটা; হিন্দু আর মুসলমান। হিন্দু মুসলমান ছাড়া আর কোনো সঙ্কট নিয়া কথা কয় না বাঙালি জাতি। পেটে ভাত না থাকলেও সেইটা যেমন বাইরে চাইপা যায় তেমনি পুরানা পায়খানাও চাইপা রাখে দাঁত কিড়মিড় কইরা…
প্রসাদের গানটা বরাকের গুটিকয় বাঙালিতে শেষ হয় না। এর পরেই গানটা উচ্চারণ করে একটা বিস্ময়কর কথা- ‘বাংলা কখনো ফতেমা বিবি বাংলা কখনো রাধা…
বাঙালির একমাত্র সঙ্কট হিন্দু মুসলমানে আইসা পড়ে প্রসাদ। উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির কথা সাহিত্য সংস্কৃতি যতই বলুক না কেন; ইতিহাস আর লোকসংস্কৃতি কিন্তু ভিন্ন কথা কয়…
লোক সংস্কৃতির সব থিকা জীবন্ত উপাদান হইল গালাগালি। বাংলা ভাষায় ধর্মে ধর্মে যে গালাগালিগুলা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধইরা টিকা আছে; সেইগুলা কিন্তু প্রতিটা পরিবারের ঘরের ভিতরের সংবাদ দেয়। সংবাদ দেয় প্রতিটা পাড়ার গোপন মানসিকতার। এক্কেবারে বাচ্চা বাঙালও কিন্তু অন্তত ডজনখানেক সাম্প্রদায়িক গালি জুইতমতো দিতে জানে; যেইগুলা সে শিখে পরিবার কিংবা পাড়ার স্বতস্ফূর্তভাবে চর্চিত সংস্কৃতি থাইকা…
তো এইরকম সংস্কৃতির বিপরীতে ঐক্যের কথা বহুতেই কইছেন বহুত উদাহরণ দিয়া। বহুতে বহুত চেষ্টাও করছেন। গান্ধীর মতো ‘বেগম সীতা’ আর ‘বাদশা রাম’ কইয়াও হিন্দু মুসলমান ঐক্যের বহুত আদেখলা চেষ্টা করছেন বহুতে। কাম হয় নাই; চলতে আছে ঘিন্নার কম্পিটিশন…
কিন্তু প্রসাদের উপমাটা ধাক্কা মারে। ফাতেমা বিবি আর রাধা…
বাংলাদেশের বাউলরা বলে ‘অন্তরে মা ফাতেমা আর কণ্ঠে সরস্বতী’ না হইলে কেউ বাউল হইতে পারে না…
মানে হইল কণ্ঠে থাকতে হবে সুর আর অন্তরে দুঃখ; কারবালার প্রান্তরে নিজেরে নির্বংশ হইতে দেইখা মা ফাতেমার যে দুঃখ; সেইটা থাকতে হবে ভিতরে। তাইলেই একজন হইতে পারবে বাউল। কিন্তু প্রসাদ উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানের শান্তির কল্পনা করতে গিয়া মরুভূমির ফাতেমা বিবিরে টাইনা আনল ক্যান? উত্তরটা মিলে ফাতেমার লগে উচ্চারাতি রাধার নামের ভিতর…
ফাতেমা সব হারাইছে আর রাধা কিচ্ছু পায় নাই। ফাতেমার আছিল; গেছে। আর রাধা পাওয়ার লাইগা ছাড়ছে সব; কিন্তু পাইতে পাইছে অপমান। ফাতেমার অনুভূতির নাম কষ্ট আর রাধার অনুভবটার নাম দুঃখ। ‘বাংলা কখনো ফতেমা বিবি; বাংলা কখনো রাধা…
আমি প্রসাদরে চ্যালেঞ্জ কইরা বসি; তুমি কি এই নাম দুইটা বুইঝা বসাইছ? নাকি হাতের কাছে পাইয়া এমনিতেই বসাইয়া দিছ?
প্রসাদ কথা কয় ধীরে বিছায়া। মনে হয় বাক্যগুলা আগে মগজে রিহার্সাল দিয়া তারপর মুখ দিয়া ছাড়ে। একটু থাইমা প্রসাদ আমার কথার উত্তর না দিয়া উল্টা জিগায়- তোমার কী মনে হয়?
শিলচর ছাইড়া কলকাতা যাইবার পর গানটা পরিত্যাগ করে প্রসাদ। অন্তত দোহার দিয়া প্রসাদরে যারা চিনে তারা এই গানটার লগে প্রসাদের সম্পর্ক জানে না। আর দোহারের কোনো সম্পর্কই নাই এই গানটার লগে…
আমি তারে সরাসরি জিগাইছি কয়বার; গানটা বাদ দিছ ক্যান? প্রসাদ পাশ কাটাইয়া গেছে…
উত্তরটা আমি পাইছি প্রসাদ মরার পর; একজনের একটা লেখায়; কার লেখা মনে নাই। সেইটা হইল; প্রসাদ সিলেটরে কলকাতা নিয়া গেছে; সেইখান থাইকা সিলেটরে নিয়া বাইরাইছিল বিশ্ব ভ্রমণে। সেইটাই হইল তার দোহার…
আর সেই ভ্রমণে ক্ষুদ্র বিষণ্নতা বড়োই বেমানান…। এইবার মনে মনে কথাটা স্বীকার কইরা নিবার মুহূর্তে আমার মনে পইড়া যায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সেই অতি আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ- ‘তোমরা আমায় চিননি…
জলালি কৈতর কিংবা হাওরের পানি দিয়া নয়; সিলেটের গান গাইয়াই প্রসাদ সেই প্রশ্নটা রাখছে সকলের কাছে- তোমরা আমায় চিননি?
আমার ধারণা শিল্পী কিংবা সংগঠক হিসাবে প্রসাদের বিচার সম্ভব না আমার। আর স্মৃতিচারণ জিনসটা বহুত ঝামেলাপূর্ণ একটা অসৎ সংস্কৃতি। নিজের পিঠ বাচাইবার লাইগা কিংবা নিজেরে মাথার দিকে দুয়েক ইঞ্চি বড়ো করার লাইগা বহুত মিছা কথা মানুষ কয় স্মৃতিচারণ সাহিত্যের পাতায়…
- ও লীলেন অমুকদিন কুষ্টিয়া যেতে পারবে?
- না তা পারব না
- তাইলে আমারে একটা মানুষ দেও যে আমারে লালন সাঁইর মাজারে নিয়া যাবে…
অথবা সে যাদবপুর ভার্সিটিতে কোনো একটা সেশন নিবে। ওইখানে খাড়ায়া আমারে ফোন করে- খোয়াবনামায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে শ্লোকটা লিখছিলেন পাকুড় গাছ আর গজার মাছ নিয়া সেইটা আমারে পাঠাও…
আমিও বই ঘাইটা মোবাইল খুটাইয়া তারে এসেমেস করি:
“সিথানে পাকুড় গাছ মুনসির বসতি
তলায় গজার মাছ অতি হিংস্রমতি।
গভীর নিশিতকালে মুনসির আদেশে
বিলের গজার মাছ রূপ লয় মেষে।।”
এই তো যোগাযোগ। প্রসাদের লগে আমার সব যোগাযোগ এইরকমই টুকটাক টুকটাক টুকটাক…
হঠাৎ বহুত কিছু লণ্ডভণ্ড হইয়া যায়। ধর্মের চাপাতি আইসা পড়তে থাকে লেখকদের ঘাড়ে। আড়াই বছরের মাইয়া কোলে নিয়া সংক্ষেপে দেশের গাট্টি গোল করতে হয় দুই হাজার পনরোর শেষে। প্রসাদ মেইল করে- জুনের দিকে আম্রিকা আসবো দেখা হবে?
আমি কই হবে…
কিন্তু সে আসার পর আমি আর যোগাযোগ করি না। তিন বচ্ছরে পা দেওয়া মাইয়া ছাড়া কারো লগেই বলতে গেলে কথা কই না; গুটায়ে থাকি নিজের বিষাক্ত বিষণ্ন আর ভার উদ্বাস্তু জীবনের ভিতর…
প্রসাদ আইসা ফিরা যায়। আমিও টাইনা কাদার ভিতর থাইকা কিছুটা তুইলা আনি কর্ণের রথের চাকা। এর মাঝে এক সকালে দেখি যিশু ভাই আমার ফেসবুকের আউটায় পোস্ট কইরা বসছে প্রসাদ আর আমার একটা ছবি…
দুই হাজার দশ সালের দিকে যিশু তরফদার আর আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থাইকা চলচ্চিত্র বিষয়ে পিএইচডি করার খায়েশে গিয়া হাজির হইস্লাম কলকাতায়। কিন্তু গিয়া দেখি নিয়মাবলি আর সময়সূচির লগে আমাগো ভিসা শর্তাবলির খটাখট সংঘাত…
সেই সময় প্রসাদ কলকাতায়। ভিসাশর্ত আর অ্যাডমিশন ক্যাঁচালের ফাঁকে অন্তত আমাদের ইন্টারভিউ শিডিউল করা যায় কি না তার লাইগা নিজের চ্যানেলে বহুত দৌড়াদৌড়ি করছে সে। হয় নাই। তবে সেই সময়ই প্রসাদ আর আমার ছবিটা তুলছিল যিশু ভাই…
সেই ছবিটাই সে আমার দেয়ালে পোস্ট কইরা সে আমারে জানায় সেই সংবাদ; প্রসাদ নাই…
কিচ্ছু বলা হয় না আমার। আমি ঝিমাই। প্রসাদের ভক্তদের লেখা পড়ি। বন্ধুদের লেখা পড়ি। বড়োদের লেখা পড়ি; আমি ঝিমাই। কিছুই বলতে পারি না আমি…
হঠাৎ চমকাইয়া উঠি বৌ ম্যাডামের একটা ফেসবুক নোটে। প্রসাদের লগে তার একবার দেখা হইছিল ঢাকায়; সেই বর্ণনা…
প্রসাদ সেইবার গান করতে আসছিল ঢাকার সব থিকা অভিজাত ক্লাবে; ঢাকা ক্লাব। অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমি গেছিলাম প্রসাদরে দেখতে। বৌ ম্যাডামও আছিলেন সাথে। খাজুরা কথাবার্তা ছাড়া কিছু হয় নাই সেদিন। কিন্তু বৌ ম্যাডাম মনে করায়া দিলেন; প্রসাদের লাইগা একটা জিনিস নিয়া গেছিলাম আমি…
দুই দুই চাইরশো টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়া আমি সেইখানে গেছিলাম দশ টাকায় কিনা দুই খিলি পান তারে পৌঁছাইয়া দিতে…
আমার মনে হয় প্রসাদের লগে আমার সম্পর্কের ধরনটা ওইখানেই আছিল; যেইখানে থাকলে দেশের সব থিকা পয়সাওয়ালাগো অতিথি হইবার পরেও ফোন কইরা বলা যায়- হাকিমপুরি জর্দা দিয়া দুই খিলি পান নিয়া আসো না লীলেন…
ব্যাস। আমিও গেলাম চাইরশো টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়া দশ টাকার পান পৌঁছাইতে; এক উন্মাদনা কিংবা ঐক্যের টানে…